Next
Previous
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


 


















৩৮

বের্শেম সৈনিক হলেও যুদ্ধটা মোটেই পছন্দ করে না। ১৯৪৪ সালের শেষ অবধি যা হোক করে হোক সে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটা থেকে বেঁচে যায়। নাইটক্লাবের ওয়েটার আর ককটেল বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করত সে। যুদ্ধের সময়ে নাইটক্লাবের পরিস্থিতি নিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে সে। প্রায় ১৫০০ রাতের ঘটনা দেখেছে সে।

সে জানে যে বেশির ভাগ পুরুষ যতটা মদ সহ্য হবে বলে ভাবে, তার চেয়ে অনেক কম খেয়ে মাতাল হয়ে যায়। তাছাড়া সারাজীবন অনেক পুরুষই নিজেদের বুনো মদ্যপ বলে মনে করে। নাইটক্লাবে যারা সঙ্গিনী নিয়ে আসে, তারা সঙ্গিনীদেরকেও এই ব্যাপারটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করাবার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে মদ্যপ বলতে যা বোঝায়, সেরকম পুরুষ খুব কম আছে। তারা যখন মদ্যপান করে, তখন সেটা দেখবার একটা আলাদা মজা আছে। যুদ্ধের সময়েও এমন পুরুষ সত্যিই বিরল।

এছাড়াও আরেকটা জিনিস সে লক্ষ্য করেছে যে একটা মানুষের বুকে অথবা গলায় সেঁটে দেওয়া পদকের এক টুকরো ধাতু সেই মানুষটাকে কিছুমাত্র বদলে দেয় না। অথচ অনেকেই এরকম ভাবে যে ওই টুকরোটা কিম্বা পোশাকের কারুকাজ এসব কিছু একটা ভীতু মানুষকে অসমসাহসী কিম্বা একটা মূর্খ মানুষকে বুদ্ধিমান বানিয়ে দেবে। কিন্তু বের্শেম লক্ষ্য করে দেখেছে যে সেরকম কিছু ঘটে না। যদি এইসব বাহ্যিক কাণ্ডকারখানা করে একটা মানুষকে বদলে দেওয়া যেত, তাহলে সেই বদলটা বড় জোর নেতিবাচক হতে পারে। তবে মানুষগুলোকে অবশ্য সে খুব বেশি হলে এক রাত বা দু’ রাত দেখেছে। অতীতে এদের কাউকেই সে চিনত না। তবে একটা ব্যাপার তার কাছে একদম পরিষ্কার যে এদের বেশির ভাগ মদ খেতেই পারে না। অথচ অনেক মদ গিলতে পারে, এরকম একটা হাবভাব করে। তাছাড়া একটু গিলেই এরা যখন মাতাল হয়, তখন আর কে হিসেব রাখবে যে কে কত গিলেছে? এরা মাতাল হয়ে গেলে, এদের কাণ্ডকারখানা দেখতে একটুও ভালো লাগে না তার। এই নাইটক্লাবে যুদ্ধের সময় প্রায় পনের শ’ রাত সে কাটিয়ে ফেলেছে। অনেক কিছু দেখেছে সে। তবে এই নাইটক্লাবে অবশ্য নিষিদ্ধ বা চোরাই জিনিস কেনাবেচার ক্ষেত্রে সেরকম কড়াকড়ি কোনো দিন ছিল না।

নাইটক্লাবে মদ কিম্বা ধূমপানের জন্য সিগারেট ইত্যাদি ছাড়াও মাঝে মাঝে খাবারদাবার বিক্রি হত। বের্শেমের বস ছিল এক আঠাশ বছরের ছোকরা, যার স্বাস্থ্য বেশ ভালো; অথচ ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর অবধি তাকে সৈনিকের ট্রেনিংও নিতে হয়নি, যুদ্ধেও যেতে হয়নি।

গোটা শহরটা যে বোমায় ধ্বংস হতে বসেছে, এইসব ব্যাপার নিয়ে বসের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। শহরের বাইরে জঙ্গলের কাছে বসের একটা প্রাসাদোপম বাংলো ছিল। শোনা যায় যে সেটাতে নাকি বাঙ্কারও ছিল। বিশেষ অতিথিদের নিয়ে গোপনে পার্টি করার জন্য বস তাদের গাড়ি করে নিয়ে যেত তার বাংলোর বাগানে।

বের্শেম যুদ্ধের সময়ে প্রায় পনেরশ রাত কাটিয়েছে নাইটক্লাবে। খুব খুঁটিয়ে সে সবকিছু লক্ষ্য করত। তাছাড়া বেশির ভাগ সময়ে তাকে কথা শুনে যেতে হত; নিজে কথা বলবার অবকাশ হত না সেরকম। যদিও একঘেয়ে লাগত। কিন্তু কিছু করার ছিল না। কত যে যুদ্ধের আক্রমণ আর চক্রব্যূহের মত ঘিরে ফেলবার ঘটনা সে শুনেছিল, সে কহতব্য নয়। তার মাঝে মাঝে মনে হত যে লিখে রাখলে কেমন হয়? কিন্তু অনেক, অনেক আক্রমণ, অনেক অনেক ঘিরে ফেলবার গল্প শুনেছিল সে। কত লিখবে? অনেক বীর যোদ্ধাদের দেখেছিল সে, যারা সব সময় পুরস্কার পাওয়া মেডেলগুলো পরত না। সীমান্তের ভাইল শহরের গল্প, আক্রমণের গল্প সব শুনে শুনে তার মনে হয়েছিল যে যুদ্ধের একদম হদ্দমুদ্দ জেনে নিচ্ছে সে। তবে মাতাল হয়ে সাধারণত সবাই সত্যি কথাই বলে। অর্থাৎ সেগুলো নেহাত গল্প ছিল না। সত্যি ঘটনা ছিল। বীর যোদ্ধাদের থেকে, বারের ওয়েট্রেসদের থেকে অনেক সত্যি ঘটনা শুনেছিল সে। ফ্রান্স, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া এসব জায়গা থেকে আসা অনেকগুলো মেয়েকেই ওয়েট্রেস হিসেবে দেখেছে সে নাইটক্লাবে। ওয়েট্রেসদের অনেকের সঙ্গেই ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যেত তার। ওদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে মদ খাওয়া… উফফ, সে একটা বেশ ব্যাপার বটে!

কিন্তু আপাতত সে আউয়েলব্যার্গ বলে একটা জায়গায় একটা খামারবাড়িতে চুপচাপ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে চোখে দূরবীন লাগিয়ে। বন্দুক ছাড়াও সঙ্গে আছে একটা স্কুল নোটবই, কিছু পেন্সিল আর একটা ঘড়ি। তার থেকে ঠিক দেড়শ মিটার দূরে বয়ে যাচ্ছে একটা নদী। নদীর ওপারে ভাইডেসহাইম বলে একটা জায়গা। সেই জায়গাটার উপরে নজর রাখতে হচ্ছে তাকে। তবে ভাইডেসহাইমে নজর রাখবার মত সেরকম কিছু ঘটছে না।

শহরটার সামনের দিকের প্রায় অর্ধেকটা জ্যাম কারখানার দেওয়াল দিয়ে ঘেরা এবং জ্যাম কারখানাটা এখন বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। মাঝেমধ্যে এক দুটো লোক দেখা যায় পথে। কালেভদ্রে কেউ কেউ পশ্চিম দিকে হাইডেসহাইমের দিকে যাচ্ছে। তারপর যেতে যেতে সরু রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ভাইডেসহাইমে কিছু কিছু লোক আঙুরের ক্ষেতে কিম্বা ফলের বাগানে কাজ করছে। দেখা যাচ্ছে যে লোকগুলো কাজ করছে। তবে সব কথাই কি নোটবুকে লিখে রাখতে হবে? যে বন্দুকের ভার দেওয়া হয়েছে তাকে, সেটার জন্য দিনে সাতটার বেশি গোলা বরাদ্দ নয়। দিনে সাতটা গোলা যদি সে খরচ না করতে পারে, তাহলে এই বন্দুকের জন্য গোলার বরাদ্দ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। এদিকে আবার হাইডেসহাইমের দিকে যেসব আমেরিকানরা ঘাঁটি গেড়েছে, তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে যেতে হলে ওই সাতখানা গোলা যথেষ্ট নয়। ওদের দিকে একখানা গোলা ছুঁড়লে ওরা একশখানা ছুঁড়ে জবাব দেয়। সেইজন্য ওদের দিকে গোলা ছোঁড়া একেবারে বারণ শুধু নয়, একদম নিষিদ্ধ। কোনো মানে হয় না ওদের দিকে গোলা ছোঁড়ার।

শুধু গোলা ছোঁড়া নয়, ওদের বিষয়ে নোট নেবারও কোনো মানে হয় না। বের্শেম তার নোটবুকে লিখে রেখেছে … ‘সকাল ১০.৩০ হাইডেসহাইমের দিক থেকে একটা আমেরিকান গাড়ি এসে ভাইডেসহাইমের জ্যাম কারখানার প্রবেশদ্বারের লাগোয়া একটা বাড়ি অবধি এলো। জ্যাম কারখানার সামনে গাড়িটা পার্ক করে রাখা থাকছে। গাড়িটা ফিরছে ১১.১৫।’

এই গাড়িটা রোজ আসছে। বন্দুকের থেকে মাত্র দেড়শ মিটার দূরে দাঁড়াচ্ছে রোজ। বন্দুকের নাগালের দূরত্বের মধ্যেই। কিন্তু ওই গাড়িটাতে গোলা ছোঁড়া হয় না। এই যে এত কিছু বের্শেম লিখে রেখেছে তার নোটবুকে, সেটারও কোনো মানে হয় না। সব সময় ওই গাড়িটা থেকে একজন আমেরিকান সৈনিক নেমে এসে ওই বাড়িটায় ঢোকে। ঘণ্টাখানেক থাকে। তারপর ফিরে যায়।

(চলবে)