Next
Previous
0

ধারাবাহিক - শ‍্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(১৪)

বিকালের সামান্য আগে রামমোহন গঙ্গার পাড়ে নিয়মিত একটু হাওয়া খেতে বের হন। সতীদাহ নিবারণের বিল সরকারীভাবে পাশ হয়ে গেলেও শহর কলকাতার হাওয়াটি এখনও বেশ গরম।

শোভাবাজারের রাধাকান্ত দেব দায়িত্ব নিয়ে এই বিষয়টি কেন্দ্র করে এখনও একটা ঘোঁট পাকাতে চেয়ে বাইরে থেকে সনাতনীদের অন্যায়ভাবে মদত দিচ্ছেন।আসলে নবদ্বীপ থেকে ভাটপাড়া অবধি অনেক কূলীন ও বহুবিবাহে অভ্যস্ত সব ব্রাহ্মণদের দল ওঁদের মত কিছু রসদদারদের কাছ থেকেই নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকে বলে স্বভাবতঃই ওরা নব্য বাবুদের কাছে বিচার চেয়ে পরিবেশটিকে অযথা অস্থির করে তুলেছে।

এসব দেখে মাঝেমাঝে রামমোহনের নিজের ওপরেই ভীষণ রাগ হয়। সেই মনখারাপের হতাশাময় সময়টাতে অন্তত নির্জন গঙ্গার ধার থেকে একটু ঘুরে আসলে ঠান্ডা হাওয়ায় মনটা শান্তি পায়।

মির্জাপুর থেকে বেড়িয়ে তিনি তাঁর ফিটনের কোচোয়ানটিকে নিমতলা ঘাটের দিকে গাড়িটি একবার ঘোরাতে বললেন।

যদিও শ্মশান সংলগ্ন ঘাটটিতে শবানুগমন করতে আসা শোকগ্রস্ত মানুষেরা ছাড়া বিশেষ কেউ আসেনা তাও এখানে দিনে একটিও চিতা জ্বলছে না সেটা অবশ্য আশা করা কঠিন। তবুও তিনি এদিকটাতে যে কারণে প্রায়সই এসে থাকেন তার একটি কারণ হল নিমতলার কাছেই " সম্বাদ কৌমুদী " এর একটি ছাপাখানা আছে।

কাল রাতে এখানে কারা যেন এখানে আগুন লাগাতে এসেছিল বলে তিনি শুনেছেন।

গত একটি বছরে সতীদাহের বিপক্ষে তাঁরই কিছু রচিত প্রবন্ধগুলি এই সংবাদপত্রে নিয়মিত ছাপা হওয়ায় এখন এরাও সনাতনপন্থীদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। তাই এইভাবে প্রতিশোধ নিয়ে সমাজপতিরা নিজেরা অন্তত শেষবার মাথা তুলে একবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

তিনি এগিয়ে এসে যা দেখতে পেলেন তাতে বুঝতে পারলেন যে খবরটি নিজে একজন ফড়ে মারফৎ হলেও যা পেয়েছেন তা একেবারে মিথ্যা নয়।

দেখতে পেলেন ছাপাখানাটির একটি দিক খুব বাজে ভাবে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও এখন অর্ধভস্মীভূত আবহটি জনশূন্য।

বোঝাই যাচ্ছে যে ছাপাখানার মালিক আর অন্য কর্মচারীরা সব গোলমাল বুঝে চম্পট দিয়েছে। স্বয়ং রামমোহনকে হঠাৎ এদিকপানে আসতে দেখে একরকম ভূতের মত চমকে উঠে তাঁর কাছে এসে দাঁড়াল কম্পোজিটার দুলু কুন্ডু নামের এক প্রবীণ কর্মচারী।

কাঁচা পাকা চুলের প্রায় তটস্থ লোকটি যে এখনও যে এখানকার আশ্রয় ছেড়ে পালায়নি এটাই বড় আশ্চর্যের বিষয়। এবার লোকটি ভয়ে ভয়ে তাঁকে বলল, " কি সব্বোনাশের কান্ড বলুন দিকি! যাক্ আপনি তাহলে একোনো বেঁচে আচেন! বড়তলার জমিদার বাবুদের পাইকের দল এসে রাতে আমাদের ছাপাখানাটির ওপর চড়াও হয়েছিল! একোন ওরা আপনাকে একেনে দেকতে পেলে আর রক্কে থাকবেনি। আপনি মানী মানুষ!তাও আপনি পার পেয়ে যাবেন! কিন্তু আমি আপনার সাথে কথা কইচি এটা জানতে পারলে ওরা আমাকেও পুড়িয়ে মারবে। এইইইই নিন্ সতেরোটা প্রভাকর এখনো বেঁচে আচে...এগুলো সাথে করে নিয়ে আপনিও পালান গ্যে ! দুগ্গা..দুগ্গা! "

লোকটির ভীত চেহারাটি দেখে রামমোহনের খুব মায়া হল। উনি তক্ষুণি জোব্বার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কিছু স্বর্ণমুদ্রা বের করে লোকটির হাতে দিয়ে বললেন,

- " আহা বেরাদর! এই কটি মুদ্রা আজ আপনি আপাতত নিজের কাছে গচ্ছিত রাখুন। নিশ্চিন্ত থাকুন কল্য এই প্রতিষ্ঠানটি আইনমোতাবেক আমি নিজেই ক্রয় করে নেব ও আপনাকে কর্মে পুনর্বহাল করবো। এই যুগান্তকারী লড়াইএর দিনে আসলে ছোট বড় সবাইকে সংহত হয়ে একসাথে সংগ্রাম করতে হয়। তাই আপনিও আজ আমার মত এই যুদ্ধে একজন সৈনিক হলেন। সতীদাহ বিরোধী আইন পাশ হওয়ার পরও এখন দেখছি আরএকটি অন্য লড়াইয়ের সূচনা হয়েছে। তবে আশ্বাস দিলাম যে এই নির্ভীক মানুষটি সেই কঠিনতম দিনেও আপনাদের সবার পাশে আছে ও থাকবেও। বিদায়...শুভমস্তু!.."

কর্মচারীটির বিস্মিত চক্ষুদ্বয় আরও বেশী বিস্ফারিত হতে হতেই রামমোহন নিজের কঠিন থেকে কঠিনতর মুখশ্রীতে মির্জাপুরস্থিত বাসাবাড়ির দিকে ওঁর ফিটনটিকে এবার প্রত্যাবর্তনের জন্য গম্ভীর স্বরে আদেশ দিলেন।

....

মিত্রবর দ্বারকানাথ ইংরেজ কোম্পানীর বড় হোমরাচোমড়া সব কর্তাদের নিমন্ত্রণ জানিয়ে আজ রাতে বেলগাছিয়ার ভিলায় একটি বর্ণাঢ্য খানাপিনার আয়োজন করে ওঁকেও সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেছে। সেখানে উপস্থিত থেকে এক ফাঁকে এই ভস্মপ্রায় প্রেসটিকে সত্বর কেনার ব্যাপারে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলোচনাটিও ওর সাথে সেরে ফেলতে হবে। এসব বাণিজ্যিক বিষয়ে দ্বারকনাথ বড় চৌখস।

তবে এ নিয়ে আর কোন সন্দেহ নেই যে এবারে তাঁকে আরও সংবেদী হয়ে মস্তিষ্কের লড়াইতে নামতে হবে ও দরকার হলে বিলেতে গিয়েও প্রিভি কাউন্সেলকে আরো কড়া ভাষায় সব উঠে আসা দেশীয় দ্বন্দ্বের সমূহ জবাবটি দিয়ে আসতে হবে।

......

গোলকপতি দেখল ঐ মৃতপ্রায় বৃদ্ধের সাথে আসা লোকজনেরা সব আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। বোঝা যাচ্ছে যে অন্তর্জলির সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা সঙ্গীদের মনে কিছুটা হলেও যেন বিরক্তির উদ্রেক ঘটিয়েছে।

এরমধ্যে মৃতপ্রায় বৃদ্ধটির দু'জন বলশালী পুত্রদের সাথে সম্ভাব্য শবদাহকারী ডোমেদের দুটি দিনের পারিশ্রমিক নিয়ে একপ্রস্থ বাদানুবাদ হয়ে গেল।

গোলকপতি দেখল যে এসবের ফাঁকে প্রস্তাবিত এই সতীদাহের জন্য আনা বধূটিও একবার তার শৌচকার্য্যটি আড়ালে সাড়ার জন্য সামনের ঝোপড়াটির উদ্দেশ্যে অনেকক্ষণ আগে যে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিল, এখনও সেই মেয়েটি তার মৃতপ্রায় স্বামীটির শিয়রে ফিরে আসেনি। সেটা কিন্তু তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের কেউ সেইভাবে টেরও পায়নি। অবশ্য এর মধ্যেই কিছু মাতব্বর গোছের সদস্য তাদের দুটি আঙুলের ফাঁকে পোড়ামাটির কল্কে জ্বালিয়ে পরমানন্দে গঞ্জিকা সেবনে উদ্যত হয়েছে।

অবাক লাগে যে এই মৃতপ্রায় বৃদ্ধ মানুষটি সত্যিই মরণোন্মুখ ও অন্তর্জলিতে শেষতম শয়ানে মৃত্যুর প্রহর গুণছে তা যেন সঙ্গী সাথীর দল আজ ভুলতে চেয়ে খানিকক্ষণের জন্য নেশায় মৌজ হতে চাওয়াটাকেই শ্রেয় মনে করছে।

.....

গোলকপতি যেন এইরকম একটি সুযোগের অপেক্ষাতেই সারাদিন ছিল। সে তার কাঁধের উড়নীটির সাহায্যে নিজের মুখখানিকে ঢেকে আর বাড়তি কথা না বাড়িয়ে নদীটির পূর্বদিকে ওই ঝোপড়াটির দিকে দ্রুত এগিয়ে গেল।

এখন ওরও যেন মনে হচ্ছে যে নিজের এই অনির্দিষ্ট জীবনপ্রবাহ যেন খুব দ্রুত শেষ হয়ে আসছে এক ক্রমপ্রসন্নতার সমারোহে।