ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(১৩)
আগামীকালের দিনটি হয়ত একটি অপ্রত্যাশিত যুদ্ধজয়ের দিন হিসাবে ইতিহাসের বুকে লেখা থাকবে। লাটভবন থেকে ফেরার পথটিতে দূর্গন্ধময় ধূলি-কর্দম সব যেন আকস্মিক মুছে গিয়ে শহর কলকাতা যেন অমরাবতীর আলোয় জেগে ওঠর প্রহর গুণছে।
তবে দুঃখের বিষয় এই যে গুটিকয়েক স্বপ্নময় মানুষ ছাড়া শহরের আগামীদিনের এই রাজবেশ ধারণটি আর কেউই দেখতে পাচ্ছেনা।
দেশবাসীর এই চক্ষুষ্মানতার অভাবে রামমোহনের মত এই কালবদলের রূপকারগণ তাই হয়তো বিরলে অশ্রুস্নাত হন।
আসমুদ্রহিমাচলবিধৌত ভূখন্ডটিতে আগামীকাল থেকেই বৈধ হতে চলেছে সতীদাহ বিরোধী আইনটি। লর্ড বেন্টিঙ্ক নিজে আজ রামমোহন ও ধর্মযাজক উইলিয়াম কেরীকে লাটভবনে ডেকে এনে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আজ এই সুসংবাদটি দিয়েছেন। তবে এই আইনটির বিরোধীতা করে প্রিভি কাউন্সিলেও যে বেশ কিছু চিঠি জমবে সেটা আর কহতব্য নয়।
বৈষ্ণবদের স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সহজানন্দ স্বামী পশ্চিম ভারতে ১৮ শতকের গোড়ায় সতীদাহের বিরুদ্ধে প্রচার করতে শুরু করেছিলেন বটে তবে জনসমর্থনের অভাবে হতাশ হয়েছিলেন বলে ক'দিন এসবে ক্ষান্ত দিয়েছিলেন। আবার এই বিষয়টি নিয়ে ইংরেজ শাসক ভাবতে বসেছে ও রামমোহন এর পিছনে জড়িত সেটা জানতে পেরে তিনিও রামমোহনকে স্বেচ্ছায় তাঁর সমর্থনটি জানিয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন। সেই পত্রটিতে তিনি বলেছেন যে নেহাত সহজানন্দ এখন বৃদ্ধ হয়েছেন, নচেৎ তিনি নিজে উপস্থিত থেকে রামমোহনকে আলিঙ্গন করতেন।
দ্বারকানাথও বেশ কিছু সংখ্যক জমিদারদের সমর্থন যোগাড় করে তাঁর দেওয়া কথাটি রেখেছিলেন।
তাই উৎসাহী রামমোহন আর বিলম্ব না করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে শেষতম পিটিশনে লিখেছিলেন যে,
"এই সমস্ত ঘটনা প্রতিটি শাস্ত্র অনুসারে হত্যা।"
অবশ্য বেদভাষ্যের পাশাপাশি পরাশর সংহিতা ও নারদ সংহিতাও এক্ষেত্রে বেশ কাজে এসেছে। সনাতন ধর্মে যে সতীদাহ বলে আদৌ কিছু নেই সেটা মেনে নিতে রক্ষণশীল সমাজপতিদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে।
এই বিষয়ে তার একদা বন্ধুস্থানীয় শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব ও তাঁর অনুগামীদের অসহযোগিতার চাপ না থাকলে হয়ত লড়াইটা এত দীর্ঘায়িত হত না। তবে আজ বিশ্বাস করা কঠিন যে মাত্র কিছুদিন আগে সতীদাহপ্রথা রদ হতে পারে শুনে প্রথমেই তাকে স্বাগত জানাতে মাঠে নেমে পড়েছিল ‘সমাচার চন্দ্রিকা’। এই পত্রিকার সম্পাদক ভবানীচরণ সেদিন লিখেছিলেন – “আমাদের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্য্যন্ত শিউরে উঠছে। আমরা বিপন্ন, ভীত, বিস্মিত।”
......
এটাই স্বস্তির ঘটনা যে লর্ড বেন্টিঙ্ক, মেটকাফ, বেলি প্রমুখর সমর্থনে কাউন্সিল সতীদাহ প্রথাকে “illegal and punishable act by criminal courts” বলে শেষমেশ নিষিদ্ধ করতে পেরেছেন । আর কদিনের মধ্যেই 'বেঙ্গল হরকরা'র মত ইংরেজী পত্রিকাটির বিদ্বজ্জনেরাও এটিকে সর্বান্তকরণে স্বাগত জানাবে বলে স্বয়ং সম্পাদক মার্শম্যান মহাশয় তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন। এই দীর্ঘ লড়াইয়ে মিত্রবর দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, হরিহর দত্ত, কালীনাথ রায় এরা সবাই পাশে না থাকলে আজকের শুভসূচনাটাই হয়ত কোনওভাবে সম্ভব হতনা।
লাটভবনে আজ শপ্যাঁ জাতীয় দ্রাক্ষারস পান করতে করতে রামমোহন হঠাৎ টের পেলেন যে তাঁর দীপ্যমান ও বলশালী শরীরে যেন কোন ফাঁকে বার্ধক্য এসে থাবা বসাতে চাইছে। পাগড়ির নীচে বাবরি ছাঁদের কেশগুচ্ছে যেন লবণ ও মরিচের সামান্য বাহুল্যে যেন আসন্ন ঋতুপরিবর্তনের ইঙ্গিতটির বিষাণ বেজে উঠছে!
আপনমনেই গুম্ফ আন্দোলিত করে সবার অলক্ষ্যেই তখন নিজের মনে যেন একটু মুচকি হেসে উঠলেন আপাত গম্ভীর ও মেধাণ্বিত মধ্যবয়স্ক অথচ চিরতরুণ স্বয়ং রামমোহন।
......
গোলকপতির মনে পড়ল যে আচার্য সর্বজ্ঞ শাস্ত্রী একবার ওকে শুনিয়েছিলেন যে অথর্ব বেদভাষ্যে আছে যে,
‘‘ইয়ং নারী পতি লোকং বৃণানা নিপদ্যত উপত্ব্য মর্ন্ত্য প্রেতম্। ধর্মং পুরাণমনু পালয়ন্তী তস্ম্যৈ প্রজাং দ্রবিণং চেহ ধেহি।।’’
(# অথর্ববেদ ১৮.৩.১)
অর্থাৎ প্রজাপিতা বলছেন যে,
‘‘হে মনুষ্য! এই স্ত্রী পুনর্বিবাহের আকাঙ্খা করিয়া মৃত পতির পরে তোমার নিকট আসিয়াছে। সে সনাতন ধর্মকে পালন করিয়া যাতে সন্তানাদি এবং সুখভোগ করতে পারে।’’
এমনকি এই শ্লোকটির সমর্থন আবার আছে ঋক বেদেও,
‘‘উদীষর্ব নার্ষ্যভি জীবলোকং গতাসুমেতমুপশেষ এহি। হস্তাগ্রাভস্য দিধিষোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সংবভূব।।’’
(# ঋকবেদ ১০.১৮.৮)
সহজ বাংলায় শাস্ত্রীমহাশয় সেদিন বলেছিলেন,
‘‘হে নারী! মৃত পতির শোকে অচল হয়ে লাভ কি?বাস্তব জীবনে ফিরে এস। পুনরায় তোমার পাণিগ্রহণকারী পতির সাথে তোমার আবার পত্নীত্ব তৈরী হবে।’’
সাম্প্রতিকের কয়েকটি ' সম্বাদ ভাস্কর ' ও 'সংবাদ কৌমুদী'র পাতায় এই একই কথা নিয়ে সপক্ষে বিস্তর লিখেছেন এক তেজোবান ব্রাহ্মণ যুবক নাম রামমোহন রায়। গোলকপতির বেশ মনে আছে যে এই ক'দিন আগে রাজবাড়ির মহাফেজখানার কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে ওই প্রবন্ধগুলির লেখকটির ব্যক্তিজীবনের কিছু কথা সে শুনেছে। এমনকি মহারাজ তেজচন্দ্র বাহাদুরের সাথে সেই লোকটির শাস্ত্রজ্ঞানে বিতর্কের প্রসঙ্গটিও লোকের মুখে মুখে ফেরে। তবে উনি রাজকুমার প্রতাপচন্দ্রের সুহৃদ বলে বর্ধমানে মাঝেমাঝেই বেড়াতে আসেন।
এই লোকটির পিতৃদেবটিও রাজনীতিতে অভিজ্ঞ ও রাণীমা বিষণকুমারীর বেশ আশ্বাসভাজন ব্যক্তি। দেওয়ানী আইনের অনেক জটিল সমাধান রামকান্ত রায় নামের প্রবীণ বৃদ্ধটির নখদর্পণে থাকে বলে রাণীমাও তার উপর নির্ভর করে থাকেন। সতীদাহের মত ঘৃণ্যপ্রথাটির বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার জন্য লোকটির উদ্দেশ্যে সে মনে মনে কূর্ণিশ জানায়।
ইস্! গোলকপতির এখন বড় আফশোস্ হচ্ছে! যদি তার সাথে সেই লোকটির ভাল করে আলাপ থাকত তাহলে সে এখনই এই সম্ভাব্য সতীদাহের সম্ভাবনাটি রোধ করে তরুণীটির জীবন এই বহ্ন্যুৎসব থেকে বাঁচাতে পারত!
....
( * এই পর্বটির জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই-
# রানা দত্ত মহাশয়।
# রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ - শিবনাথ শাস্ত্রী।
# বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস (২০১৬), স্বপন বসু, পুস্তক বিপণি (২০১৪)।
# বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা (২০০৯), বিনয় ঘোষ।
# বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ (২০১১), বিনয় ঘোষ। )