গল্প - মনোজিৎকুমার দাস
Posted in গল্পবিলের মাঝের কয়েকটি গ্রাম । জঙ্গলকাটি , স্বরূপপুর , আগুন পাখি ,বিলকমল ,সোনাঝরা । গ্রাম কয়েকটি জঙ্গলকাটি জমিদারীর আধীন । লেখাপড়া হীন অন্ত্যজ শ্রেণির গরীব প্রজাদের ওপর অন্যায় অত্যাচার আর ব্যাভিচার করতে কসুর করেনি ওই জমিদারগোষ্ঠী । কসুর করেনি খাজনা না দেওয়ার অভিযোগে গরীব প্রজাদের জমি নিলামে বিক্রি করে দিতে।
ওই গোষ্ঠির জমিদার বাহাদুর নিবারণবাবুর চরিত্র সদরে ফুলের মত পবিত্র ।আর ভিতরে মাকাল ফলের ভেতরের মত কালো ।রিরংসা জাড়িত নিবারণবাবু কাম চরিতার্থ করার জন্য একদল দালাল, লেঠেল আর পাইক পেয়াদা সদা প্রস্তুত । জমিদার বংশের বড়বাবু থেকে মেঝবাবু ,সেজবাবু , ছোটবাবুদের চরিত্র একই ছাঁছে বাঁধা ।
সুন্দরী সুন্দরী বউ ঘরে থাকতে খাসতালুকের প্রজাদের বউ মেয়েদের প্রতি আসক্তি তাদের প্রবল ! ভাবলে হাসি পায় , জমিদাররাই আবার সমাজপতি হয়ে অন্ত্যজ শ্রেণির প্রজাদের অপকর্মের নামগন্ধ পেলে শূলে চড়াতে কসুর করেনি
নিবারণ তাদের এস্টেটের জমিদার হওয়ার আগে নিবারণের বাবা রাজশেখর জঙ্গলকাটির জমিদার ছিলেন, এক সময় তিনি বয়সের ভারে নুব্জ হয়ে পড়েন । তার ছেলেমেয়ের সংখ্যা অর্ধ ডজন । রাজশেখরের রক্ষিতা কামিনীসুন্দরী এককালে ডাকসাইটে সুন্দরী ছিল তা তার বেশি বয়সের চেহারা দেখেও বুঝতে পারা যেত । বিরজাবালা রাজশেখরে অগ্নিসাক্ষী করা বউ হলেও একসময় অন্দরমহলের সর্ব্ময় ক্ষমতা ছিল কামিনীসুন্দরীর ওপর।
অল্প বয়সে রাজশেখরের ছেলেমেয়েরা জানতো সেই তাদের মা । রক্ষিতা হয়েও রাজশেখরের সংসারের হাল ধরে রাখার জন্য কামিনীসুন্দরীই আসলে রাজশেখরের পরিবারের সর্বেসর্বা ছিল তার যৌবনের ফুটন্ত দিনগুলোতে ।বলতে গেলে বলতে হয়, সেই কালপর্বে রাজশেখরের শয়নকক্ষের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল অনিন্দ্যসুন্দরী রক্ষিতা কামিনীসুন্দরীর ওপর ।
বড়বাবুর সুপুত্র নিবারণ তার বয়ঃসন্ধিক্ষণের কাল থেকেই ছিল রিরংসা জারিত । তার কামনার বহ্নি থেকে অন্ত্যজ শ্রেণির উঠন্ত বয়সী মেয়েরা খুব কমই রেহাই পেয়েছে । নাদুসনদুস সুন্দর চেহারার তের চোদ্দ বছর বয়সের ছেলেরা পর্যন্তও তার হাত থেকে রেহাই পায়নি । জমিদার পরিবারে সমকামিতা পাকাপোক্ত আসন গেড়ে বসে ,যা ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে ! এমন কি নিকট সম্পর্কের বোন ফুলবালা নিবারণের কামনার বহ্নিতে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় । ফুটফুটে কিশোরীরটির কুমারিত্বকে ছিড়ে খায় নিবারণ সুযোগ বুঝে । নিবারণ অনেক আগেই তার কৌমার্য ভঙ্গের অভিষেক ঘটিয়েছিল বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে ।
ব্রিটিশ রাজত্বের বিদায় ঘন্টা বাজার শেষলগ্নের কথা । চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে সৃষ্ট জমিদাররা কামিনী ও কাঞ্চনের পেছনে খেপা কুকুরের মতো ছুটে বেড়ানোর নজির জঙ্গলকাটির জমিদার বাড়িতে এক সময় প্রকট রূপ ধারণ করে ।
কুমারিত্ব হারানো ফুলবালার বিয়ে তার বাপ মা একটা ভাল ছেলের সাথে দিলে রাজশেখর জমিদারবাবু বড় পুত্র নিবারণের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়। তারপর তার বাবা রাজশেখর জমিদার মারা যাওয়ায় নিবারণের পোয়াবার হল । তার ওপর জমিদারীর ভার পড়ে । বলে রাখা ভাল জমিদার বাবু মারা যাবার আগেই নিবারণের বিয়ে দিয়ে যান পাবনার সাতআনি জমিদার সূর্যকান্ত চৌধুরী একমাত্র সুন্দরী মেয়ে রূপমালার সাথে । রূপমালা তার স্বামীকে বসে রাখতে পারেন না । নিবারণবাবু তখন অগাধ ক্ষমতার অধিকারী । তিনি ফন্দি আটেন যে করেই হোক ফুলমালাকে তার চাই চাই । সঙ্গপাঙ্গদের সাথে পরামর্শ করে নিবারণ ঠিক করলেন ফুলমালা বাপের বাড়ি এলে তাকে সোয়ামীর বাড়িতে ফিরে যেতে দেয়া হবে না । ফুলমালার স্বামী কমলকান্ত সরল সোজা মানুষ । প্রথম প্রথম নিবারণ কমলকান্তের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেন । তিনি ভাবেন , কমলকান্তকে প্রথমেই রাগিয়ে নেয়া যাবে না । তার সাথে ভাল ব্যবহার করায় কমলাকান্ত জমিদার বাবুর ওপর বেজায় খুশি হয় ।
কমলাকান্ত বাড়ি ফিরে গেলে নিবারণ নিজমূর্তি ধারণ করেন ।
ফুলমালার ইচ্ছে ছিল না বিবাহ পূর্বজীবনের পঙ্কিল জীবনে আবার ফিরে যেতে । কিন্তু ইচ্ছে না থাকলেও ফুলমালার ভাগ্যে সুখ লেখা ছিল না । ফুলমালার বর তাকে নিতে এলে নানা অজুহাতে তাকে মারধর করে তাড়িয়ে দিল নিবারণবাবুর লেঠেলরা ।তারপর ফুলমালা চিরদিনের জন্য নিবারণের রক্ষিতা হিসাবে জীবন কাটিয়ে এক সময় ইহধাম ছেড়ে গেল ।
সেকালে বাল্যবিধবার অভাব ছিল না গ্রামগঞ্জে। মেয়ে সরবরাহকারী দালালরা সেই সব বাল্যবিধবাদের খোঁজ এনে দিত জমিদারদেরকে । অনেক বাল্যবিধবাই এই শ্রেণির জমিদার জোদ্দারদের লালসার শিকার হতো অবলীলাক্রমে।
গোপালনগর গ্রামে একটি বাল্যবিধবার খোঁজ এনে দেয় ফেলু দালাল নিবারণ জমিদারকে। একদিন ফেলু দালাল তাকে বাবুকে বলল,“ গোপালনগরে একটা ডাসা মালের খোঁজ পাইছি বাবু।লবঙ্গলতা নামের মেয়েটির চেহারা সুরত দেখলি পারে আশি বছরের বুড়োও ---’ বাবু ধমক দিয়ে ফেলু দালালের কথা থামিয়ে দিয়ে বলে উঠেন,“ আসল কথাটা ক তো দেখি। ডাসা মালটাকে আমার বাগান বাড়িতে কবে নিয়ে আসবি তাই বল।”
“ মোর সব কতা শুনে তবে আমারে ওই কতাডা কন হুজুর।”
“ সব কথা কীরে গাধা।না আসতি চাইলে সামনের আমাবশ্যার রাতে পদ লেঠের দলবল দিয়ে মালটাকে তুলে নিয়ে আসবি ।তবে খবরদার পদটা আবার যেন আগে ভাগে এঁঠো করে না দেয়। তুইতো জানিস আমি কারো এঠো মাল আমার ভোগে লাগাইনে।”
“ হুজুর ,মুইরে তো কতা কতিই দিচ্ছেন না!” ফেলু দালাল কথাটা বলে মনে মনে হেসে ভাবে হুজুর এঁঠো ভোগে লাগায় না!তোর মত শকুনরা তো ভাগোরের মরাই চেটে তোলে। ফেলু দালালকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে নিবারণবাবু নরম সুরে বলে,“ তা হলি ক তোর কথা।”
“তাহলি ডাসা মালটার কতা মন থিকে ঝেড়ে ফেলেন হুজুর!মালটাতো এহন আপনার গোপালনগরের পিয়ারের বন্ধু বিয়ে না করে আইবুড়ো থাকা গজেন গোসাইয়ের সেবাদাসী।তার মুখির গ্রাস আফনি কারে নিতি পারবেনে কিনা কন হুজুর।”
ফেলু দালাল কথা শেষ করে বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিবারণ ফেলু দালালের কথা শুনে কী যেন ভেবে বলে উঠেন,“ লবঙ্গলতা না কী বললি! তা কপালে তিলক কাটা মালাটালা জপ করা গজেন আবার এ লাইনে কবে থকে এসে জুটেছে বলতে পারিস্ ফেলু !
কানু বউ বাচ্ছাকে ভারতে পাঠিয়ে দিয়ে বাগদির মেয়েটাকে ঘরে তুললি আমি তোরে কই ছিলাম দ্যাশটা রসাতলে যাচ্ছে।তা তুই ক লবঙ্গলতার চেহারায় কেমন জেল্লা আছে যাতে আমার বন্ধু গজেন গোসাই তার সঙ্গে লীলে করছে। কুঞ্জ অগ্রদানে ঠাকুর বোশেখ মাসে পঞ্জিকা পড়তে এসে যথার্থ্ কথা কইছিল,‘ এই কলিকালে মানির মান থাকবে না, রাজপ্রজা এক আসনে পাত পাড়বে।”
নিবারণবাবু কথা থামিয়ে গোখুরো সাপের মত গজরাতে থাকলেন্।তারপর তিনি বেশ সময় ধরে কী যেন ভেবে এক সময় ফেলু দালালকে বললেন,“ আমার বন্ধু গজেন গোসাইকে খেঁপিয়ে লাভ নেই।সহিসকে বল,‘ ঘোড়া রেডি করতে,’ আমি নিজেই গজেন গোসাইয়ের ওখানে এখনই যাব। আমি দেখতে চাই গোসাই কী দেখে মেয়েটিকে সেবাদাসী করেছে।!”
নিবারণ বিকালের দিকে গোপালনগরের গজেন গোসাইয়ের আশ্রমের উদ্ধেশ্যে ঘোড়া ছুটালেন।এক সময় গজেন ও নিবারণ এক গ্লাসের বন্ধু ছিল। এক সময় নিবারণের অনেক অপকর্মের সাথী ছিল গজেন। কিন্তু হঠাৎ করে গজেন তারক গোসাইজীর সংস্পর্শে এসে সাচ্চা সাত্ত্বিক বনে যাওয়ার খবর নিবারণ আগে থেকেই শুনেছিলেন। নিবারণ গোপালনগরে পৌঁছে প্রথমেই গজেন গোসাইয়ের আশ্রমে সন্ধ্যের পর পরই হাজির হলেন। গজেন গোসাই তাকে তার আশ্রমে দেখতে পেয়ে চিন্তায় পড়ল এই ভেবে কেন তার একালের একগ্লাসের দোস্ত হঠাৎ করে কোন মতলবে তার আশ্রমে হাজির!গজেন গোসাই নিবারণকে আপ্যায়ন করতে কসুর করল না।
ফেলু দালালের কথা মত নিবারণ গজেন গোসাইয়ের আশ্রমে কোন সেবাদাসীকে দেখতে পেলেন না।তবে তিনি জানতে পারলেন বালবিধবা সুন্দরী মেয়েটি মাঝেমধ্যে গজেন গোসাইয়ের আশ্রমে এসে থাকে।
নিবারণ ভাবলেন, এককালের তার এক গ্লাসের দোস্ত এখন গোসাইজী, তার সঙ্গে বুঝে সুঝে কথাবার্তা বলতে হবে।সুযোগ বুঝে এক সময় সে গজেন গোসাইকে বললেন,“ আশ্রমে তো অনেক সেবাদাসী থাকে শুনেছি,তোর আশ্রমে তো বুড়োবুড়িদের দেখছি মাত্র । তোর সেবাদাসী কোথায়?”
“ আমি এখন বুঝতে পারছি তুমি আমার আশ্রমে দেবাদাসীর খোঁজ করতেই এসেছো। আজ রাতটা এখানে থাকলে সকালে সেবাদাসীকে দেখতে পাবে। সে আমার সেবাদাসী নয়, আমার আশ্রমের শ্রীকৃষ্ণের সেবাদাসী, আর সে আমার স্হেময়ী মা।”! গজেন গোসাইয়ের কথা শুনে নিবারণ হো হো করে হেসে বলে উঠেন, “ দু’দিনের বৌরাগী ভাতকে কয় অন্ন!” তার কথা শুনে গজেন গোসাই হেসে বলে,“ তোমার এক গ্লাসের দোস্ত গজেন আর আজকের গজেন গোসাইয়ের মধ্যে ফরাক আকাশ পাতাল। সকালেই আমার মাকে দেখতে পেয়ে বুঝতে পাবে সে এক আলোর শিখা।”
গজেন গোসাই রাতে নিবারণকে প্রসাদ খাইয়ে আশ্রমের একটা রুমে শোবার ব্যবস্থা করল। তার আগে নিবারণে ঘোড়াটাকে আশ্রমের গোশালার এক কোণে বেঁধে রেখে এলো গজেন গোসাই নিজেই।বিছানায় শুয়ে মাত্র লবঙ্গলতার কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় নিবারণ ঘুমিয়ে পড়লেন।গভীর রাত!ফেলু দালালের বর্ণনা মত চেহারার একটা সুন্দরী ষোড়শী মেয়ে তার সামনে হাজির। অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়েটির চারদিকে একটা আলোর জ্যোতি। নিবারণ হাত বাড়িয়ে তাকে জাপটে ধরতে গেলে সুন্দরী মেয়েটি মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।মুহূর্তের মধ্যে মেয়েটি আবার এসে হাজির হলে তিনি ভাবলেন, গজেন গোসাইকে ধন্যবাদ! তাহলে তার সুন্দরী ষোড়শী সেবাদাসী মেয়েটিকে তার কছে পাঠিয়েছে।এবার মেয়েটি কাছে এসে বলল,“ আপনি আমার জন্য এখানে এসেছন, তাই আমি না এসে পারলাম না।এবার নিবারণ আহ্লাদে গদ গদ হয়ে তার হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,“ ওগো সুন্দরী, তুমি আমার বাহুলগ্না হও।”
“ তথাস্তু!” নিবারণ দু’হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে একটা আগুনের শিখা যেন তাকে ঘিরে ধরল।নিবারণ ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে বলে উঠল,“ গজেন গোসাই তুমি কোথায় আছো , আমি যে জ্বলে পুড়ে থাক হয়ে গেলাম।”
গজেন গোসাইক ভেতরের রুমে থেকে নিবারণে রুমে ছুটে এসে দেখতে পেল নিবারণ বিছানার বসে ঘেমে নেয়ে উঠেছেন। “সুন্দরী ষোড়শী এক অগ্নিকন্যা আমাকে পুড়িয়ে মেরেই ফেলেই ছিল তুমি না এলে গজেন!” নিবারণের বুঝতে পারল সে স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠেছে।
“ তুমি কি আমাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলবার জন্য ওই মেয়েটিকে পাঠিয়েছিলে।”
“ কী যা তা বলছো নিবারণ! তুমি স্বপ্ন দেখে কী আবোলতাবোল বলছো।” পরদিন ভোরেই নিবারণ গজেনকে কিছু না বলেই গোশালা থেকে নিজেই ঘোড়া বের করে সেখান থেকে কেটে পড়ল।
জমিদারী লাটে উঠল ,সরকার তা খাস করে নিলে ।নিবারণের একমাত্র ছেলে অভিরাম বাবকে বেটা সেপাইকা ঘোড়া । লেখাপড়ায় লালবাতি জ্বালিয়ে বাউন্ডেলাপনা করাই তার একমাত্র কাজ । এদিকে জমিদার বাবু নিবারণ একদিন নিরুদেশ হয়ে গেলেন চিরতরের জন্য । পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও নিবারণের খোঁজ পেল না ।লোকে বলাবলি করল , খারাপ চরিত্রের লোকের এমনই হয় । অনেক পরে প্রকাশ পেল একজন গরীব প্রজার নবপরিণতা বউয়ের ইজ্জত লুটতে গেলে তারা নিবারণকে পিটিয়ে মেরে লাশ গুম করে দেয় ।
জমিদারী না থাকলেও নিবারণের একমাত্র ছেলে অভিরামের পায় কে ! এদিকে অভিরামের কাকা কানুবাবুর চরিত্র তার দাদা নিবারণের থেকেও সরেস । নিজের সোমত্ত বউ ও একমাত্র ছেলেকে ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজে বলরাম বাগদির যুবতী বউ মালতিকে বাড়িতে তুলো। আর অন্যদিকে, মালতির সোয়ামী বলরামকে মারধর করে গ্রাম ছাড়া করল নিবারনের লেঠেলরা। মালতির মেয়ে জন্মালে লোকে বলাবলি করল মেয়েটি কানুবাবুর ঔরসজাত ।
দিনের পর পর দিন ,বছরের পর বছর কেটে গেলে মালতির রূপযৌবনে ভাটা পড়তে থাকল, আর তার মেয়ে সাধনা শিশু থেকে কিশোরী হল , তারপর দিনে দিনে যৌবনবতী হয়ে উঠল । এবার কানু বাবুর লোলুপ দৃষ্টি পড়ল সাধনার ওপর । এক সময় সে মাকে ভোগ করেছে এবার মেয়ে সাধনাকে ভোগ করতে লাগল । এক সময় কানুবাবুর শরীর ভেঙে পড়ল। প্যারালাইজড অবস্থায় তিন বছর বিছানায় পড়ে থেকে মানবেতর দিন কাটিয়ে একদিন তার ইহলীলা সাঙ্গ হল।
এদিকে দিন বদলে পালা শুরু হল । জমিদারতন্ত্রের অবসান হলেও জমিদারের শেষ বংশধর অভিরামের রক্তে বিষ । নিজের ঘরে সুন্দরী বউ আর ফুটফুটে দুটো মেয়ে আর একটা ছেলে । কিন্তু অভিরাম আসক্ত বাড়ির পাশের অন্ত্যজ শ্রেণির এক গরীব মানুষের অবিবাহিতা মেয়ের প্রতি । অভিরাম মেয়েটির সঙ্গে অবৈধ কাজে লিপ্ত থাকার কথা চাউর হতে দেরি হল না । এক সময় মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হল । সে অভিরামকে চাপ দিয়ে বলল ," আমরা স্বামী স্ত্রীর মত রাতে পর রাত কাটিয়েছি ।এখন আমার গর্ভে তোমার সন্তান। আমাকে বিয়ে করে পেটের সন্তানকে বাঁচাও ।"
অভিরাম কী তাতে রাজি হয় ! অভিরাম গা ঢাকা দিয়েও পার পেল না।তার বিরুদ্ধ সালিশ বসল।রায় হল মেয়েটিকে হয় বিয়ে করতে হবে নয় তো মেয়েটি নামে তিন বিঘে জমি লিখে দিতে হবে আর সে সঙ্গে এক লাখ টাকাও দিতে হবে।
সালিশের রায় মেনে না নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না অভিরামের। অভিরাম জমি ও টাকা দিয়ে সেবারের মত রেহাই পেল। অভিরাম জঙ্গলকাটি জমিদারীর শেষ বংশধর। কয়লা ধুলে কি ময়লা যায়! জমিদার বংশের আভিজাত্য অস্তিমজ্জায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা অভিরামের দুই মেয়ে আর এক ছেলে। নিলীমা বড় মেয়ে আর ছোট মেয়ে অনিন্দ্যিতা। একমাত্র ছেলে শিবরাম। অভিরামের বউ সুলেখা প্যারালাইজড হয়ে শয্যাশায়ী।
সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে , একটা অত্যাচারী জমিদার পরিবারের অমানুষ লোকটার বউ হয়ে সারাটা জীবন তো কত রকমের ভোগান্তির শিকার হয়ে জীবনটা বরবাদ হয়ে গেল , জীবনে সুখ কাকে বলে জানতে পারলাম না। তার অপাপবিদ্বা মেয়ে দুটোর কী হবে সে মরে গেলে।রোগ শয্যায় শুয়ে সে প্রতিজ্ঞা করে যে করেই হোক মেয়ে দুটোকে বিয়ে দিয়ে মরতে হবে। আমি কোনক্রমেই লাম্পট্য জারিত বাবার অপকর্মের ভাগীদার মেয়ে দুটোকে হতে দেব না। ওদের বিয়ে না দিয়ে চোখ বুঁজলে নিলীমা ও অনিন্দ্যিতাকে শকুনেরা ছিড়ে খাবে।
সে তার দাদাদের সাহয্যে মেয়ে দুটোকে বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগে।সে ভাবে , তার বিয়ের সময় তাদের তিরিশ চল্লিশ বিঘে জমি ছিল। অথচ তার স্বামী অভিরাম একে একে সব জমিই বিক্রি করে আজ নি:স্ব। শুধুমাত্র অবশিষ্ট আছে ভিটে বাড়িটা ।
একদিন রাতে অভিরামের বউ সুলেখা তার স্বামীকে বলে ,“ তোমার সাথে একটা জরুরী কথা আছে।” বউয়ের কথা শুনে অভিরাম কথা জড়িয়ে জড়িয়ে বলে,“ বু-ড়ো বয়সে আমা-র সা-থে কী ক-থা থাক-তে পারে! সুলেখা বুঝতে পারে আজ আবার মদ গিলে এসেছে।সে ভাবে, মদ আর মাগীবাজি করে তিরিশ- চল্লিশ বিঘে জমি সাবার করে দিয়ে আজ তার স্বামী ---। সে আর ভাবতে পারে না।সুলেখা সে রাতে তার স্বামীর সঙ্গে আর কোন কথা বলে না। সে প্রতিজ্ঞা করে সে তার দাদা অমল আর বিমলকে ধরে মেয়ে দুটোর বিয়ে দেবোই। তার স্বামী একমাত্র তাদেরকেই ভয় পায়। ওদের বিয়ে না দিয়ে মরলে তার আত্মা শান্তি পাবে না।
শেষ পর্যন্ত দাদাদের সাহায্যে ভিটে বাড়িটা বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে নিলীমা ও অনিন্দ্যিতার মোটামুটি কর্ম্ করা দুটো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সুলেথা স্বস্তি পায়।মেয়েদের বিয়ের মাস তিনেক পরে সুলেখা মারা যায়।অভিরাম তার একমাত্র ছেলে জয়দেবকে নিয়ে ভিটে বাড়ি ছেড়ে এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে এক সময় অভিরাম পাগল হয়ে যায়।
জমিদার বংশের ছেলে জয়দেবের চেহারা সত্যি রাজপুরুষের মত। সে তার আধা পাগল বাবা অভিরামকে নিয়ে এক গিরিধারীর আশ্রমে আশ্রয় নেয়।জয়দেব একটু বড় হলে গেড়ুয়া বসন পরে ভিক্ষা করতে শুরু করে।বছর খানেক পরে অভিরাম একদিন মারা যায়। আপন বলতে জয়দেবের আর কেউ থাকে না। মাথায় গেড়ুয়া রঙের পাগড়ি, পরনে গেড়ুয়া বসনে জয়দেব এখন রাধা গোবিন্দের নাম করে মুষ্টি ভিক্ষা করে বেড়ায়।