গল্প - ময়ূরী মিত্র
Posted in গল্পযীশু যীশু করে মাথা খেপেছিল একবার ৷ কারণ যীশুকে দেখতে খুব সুন্দর ৷ টিকালো নাক ,ঘাড় অব্দি কোঁকড়া চুল , জল পড়ছে না অথচ জলভরা চোখ ৷ বারবার আয়নায় যীশুর চুল দেখে নিজের চুলে ওরকম স্টাইল করতে চাইতাম ৷ হত না--কুকুরের লেজের মতো গুঁটিয়ে যেত আমার চুল ৷ চুলের কুঁই কুঁই কান্নাও শুনতে পেতাম যেন ৷ রেগে গিয়ে ক্যালেন্ডারের যীশুকে পাঁচ আঙুলে কুঁচকে দিতে চাইতাম ৷ যীশু হাসতেন -- কাঁটার মুকুটের ফাঁক দিয়ে হলুদ কমলা আকাশ উঁকি দিত ৷ দিনের আকাশ তাও যীশুর চারপাশে তারারা ফুটে ৷ মনে হত --যীশু লোকটার ক্ষমতা আছে ৷ একসঙ্গে সূর্য তারা নিয়ে --দ্যাখো কেমন খেলা করছে ৷
আমার বন্ধুহীন হয়ে থাকাটা যীশু মেনে নেয়নি ৷ নেওয়ার কথাও নয় ৷ কেননা মানুষ খুব ভালোবাসে যীশু৷ বাচ্চাদের ফটাফট বন্ধু করে নেয় ৷ যীশুর হাত ধরে আমার কাছে এল চিকলেট ৷ কমলা আকাশের যীশুকে পুজো করা একটা বাচ্চা মেয়ে ৷ বাচ্চাটা এমনভাবে আমার গায়ে লেগে থাকছিল যে বন্ধুত্বের মাঝপথে তাকে ডাকলাম --চিকলেট ৷ আরে আমিও তো তখন বাচ্চা ---রামকৃষ্ণের প্রসাদ খেয়ে বেড়াই ৷ লুচি আর শুকনো বোদে ৷
আমার বাচ্চা মাথা থেকে বাচ্চা বন্ধুকে দেওয়া নাম চিকলেট ৷ চিকলেট মাঠ খুব ভালোবাসত ৷ বেলগাছিয়ায় তখন পরপর তিনটে সবুজ মাঠ ৷ তার কোনো না কোনোটাতে বিকেলবেলা চিকলেট আমার হাত ধরে ঘুরত ৷ আসলে আমি আমার মুঠোয় চিকলেটের আঙুল পুরে রাখতাম ৷ চিকলেটের বদের ধাড়ি ভাইটা দূর থেকে দেখত ৷ আমার সঙ্গে মোটে মিশত না৷ তারা খ্রিস্টান আমি হিন্দু --এসব ভাবনা যে তার এই না মেশার জন্য কাজ করত না - আমি নিশ্চিত ৷ আসলে সে থাকতে তার বোনের ওপর সমবয়সী আরেকটা মেয়ের প্রতিপত্তি ভালো ভাবে নিতে পারেনি চিকলেটের ভাই ৷ ডাকিনি কখনো --তবে মনে মনে ভাইটারও নাম দিয়ে রাখলাম - পটকাকালী ৷
খুব যত্ন করে বই মলাট দিত চিকলেট ৷ একদম টানটান থাকত মলাট ৷ আর আমি রাক্ষসের মতো বই খেতাম ৷ নতুন বই কেনার দু তিনসপ্তাহের মধ্যে বেশিরভাগ পাতা আরশোলার পাপড়ি হয়ে যেত ৷ এসব দেখে পটকাকালীর ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও চিকলেট নিজে নিজেই আমার বই মলাটের দায়িত্ব নিয়ে নিল ৷ দুপুরবেলা বইয়ে হাতী , বিল্লির জলছবি লাগাতে লাগাতে চিকলেট বলত --
---জানিস না বুঝি --যীশু এক যোদ্ধা ৷
--যাহ ঢপ ৷
----নারে ! সত্যি --এই দ্যাখ --যোদ্ধা না হলে কেউ কাঁটার মুকুট পরে এত হাসে ! মুকুট আসলে যীশু নিজে নিজেই পরে নিয়েছে ৷ মানুষের কাঁটা সাফের জন্য সবগুলো কাঁটা তুলে নিজের মুকুটে লাগিয়েছে৷ এসব ভাবালু কথা শুনে ঠিক করলাম - স্কুলে টিফিন না খেয়ে চিকলেটকে দেব ৷ ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম - চিকলেটের খিদে বেশী ৷ দুটো ধপধপে কালাকাঁদ বিকেলে চিবিয়ে চিবিয়ে খেত চিকলেট ৷ লালার সন্দেশের গুঁড়োটা কিছুতে গিলত না ৷ পটকাকালী একদিন আমাকে বলল --ওকে একটা করে সন্দেশ দে না রে ! দুটোই দিবি ?
চিকলেট নিজের বইয়ে খবরের কাগজের মলাট দিত ৷ পাশে আমার ব্রাউন পেপারগুলো খুব বিচ্ছিরি লাগত ৷ একদিন এর -তার থেকে পয়সা নিয়ে বেশ কটা লাল - সবুজ- হলুদ -বেগনে মার্বেল পেপার এনে উপহার দিলাম চিকলেটকে ৷ বললাম --বাড়ি গিয়ে আজ নিজের বইয়ে রঙিন কাগজের প্যাক দিবি ৷ ঠিক তো চিকু ?
বন্ধুর হাতে রঙিন বই দেখার আশায় অনেকগুলো চুমু দিলাম চিকলেটকে ৷ রঙিন কাগজ নিয়ে সেই যে চিকলেট চলে গেল -আর আসে না ৷ তিনদিন মতো অপেক্ষা --তারপর মাঠ পেরিয়ে দৌড় চিকলেটের ঘরে ৷ দেখি --দিনেরবেলাতেই ছোট্ট একটা বাল্ব জ্বলছে ঘরটায় ৷ তার মধ্যেই চিকলেট তার রাশ রাশ ছেঁড়া জামা সুটকেসে ভরছে ৷ শুনলাম তারা মামার বাড়ি জামসেদপুর চলে যাবে ৷
বরাবরের মতো তো চলে যাবি ! তাও এত জোরজোর হাসি তোর কেন পায় রে চিকলেট ? বাবা ! একটা করে জামা ভরছিস আর হেসে গড়াচ্ছিস ৷
সস্তার তক্তাপোষে খ্যাচখ্যাচ আওয়াজ ওঠে ৷
চিকলেট বলে--
আমার মামার খুব বড় কেক কোম্পানি ৷ আমায় ফাদারের স্কুলে ভর্তি করে দেবে -সাদা গাউন দেবে ৷
ভীষণ ঝগড়া করতে ইচ্ছে হচ্ছিল ৷ বন্ধুর সৌভাগ্য না বন্ধুর চলে যাওয়া -- কোনটা যে আমাকে অশ্রুহীন করেছিল -আজ তা কী করে নির্ণয় করি !
---- চিকলেট --এই চিকলেট --সুটকেসের ডালা বন্ধ করে দিলি যে বড়ো ! আমার মার্বেল পেপারগুলো নিয়ে যাবি না ?
---না ৷ মামা নতুন দেবে তো ! তুইই নিয়ে যা রে ৷
এবার বই ছিঁড়লে রঙিন মলাট দিস ৷--- সেই একইরকম কটকটে সুখের হাসিটা হেসে বলল চিকলেট ৷
আমাকে মাঠ অব্দি এগিয়ে দিল পটকাকালী ৷ বড্ড ভুলভাল প্রতিশ্রুতিও দিয়ে ফেলল পটকা --বড় হয়ে তারা নাকি আমার জন্য একডজন ক্রিম কেক নিয়ে ফিরবে ৷
আমি নখ দিয়ে মাঠের ঘাস খোঁচাচ্ছিলাম ৷ দেখতে চাইছিলাম - আগামী শীতে ঘাসের ডগায় কতটা শিশির জমলে মাঠ নরম হবে ৷
নরম মাটিতে ইয়া লম্বা ঘাস গজায় ৷
পায়ে কাঁকড় কম লাগে ৷