ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(১১)
রামমোহন মূলতঃ তাঁর নৈশকালীন পাঠাভ্যাসেই আকৈশোর অভ্যস্ত বলে গভীর রাত্রের প্রায় তৃতীয় প্রহরের আগে তিনি দুগ্ধফেনিভ শয্যার আলিঙ্গনে সাড়া দিতে পারেন না। এই অদ্ভূত আচরণটিতে যদিও তাঁর পরিবারের সদস্যরা এখন আর বিশেষ অবাক হন না।
তাই সাধারণতঃ এমন পাঠনিবেশের প্রগাঢ় ইচ্ছে হলে এসব সময়ে তিনি পুস্তক পাঠের সাথে একটি স্ফটিক নির্মিত পাত্রে বিশেষ ধরণের একপ্রকার বিলাতী 'কনিয়াক্' জাতীয় পানীয় কখনো কখনো সামান্য পরিমাণে পান করে থাকেন।
অবশ্য তাঁর এই মদিরা পানের অভ্যাসটি যতটা মস্তিষ্কের চাঞ্চল্য দূরকারক ততটা অবশ্য সাধারণ শীধুপায়ীদের প্রচলিত নেশাচ্ছন্নতার জন্য নয়।
তিনি সম্প্রতি লোকমুখে শুনেছেন যে বন্ধুবর দ্বারকনাথও অল্পমাত্রায় শেরী পান করে কখনও কখনও ব্যবসা ও জমিদারী সংক্রান্ত ঐহিক ক্লান্তি দূর করে থাকেন।
.........
মৃদু আলোকোজ্জ্বল তাঁর এই বসবার ঘরটিতে রাখা মখমল শোভিত আরামকেদারাটিতে বসে মৃদু পানীয় সেবন সহ পাঠময়তা তাঁর মনোজগতে সর্বদা স্থিরতা এনে দেয় বলে তিনি কখনো নেশাতুর হননা।
বরং এইসব সময়ে অন্যসব স্নায়বিক দৌর্বল্য কাটিয়ে তিনি অনর্গল ও সাবলীল উচ্চারণে মার্কন্ডেয় পুরাণের সংস্কৃতভাষার শ্লোকগুলি অথবা পারস্যদেশীয় ভাষায় রচিত জরথুস্ট্রীয় ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ " জেন্দ - আবেস্তা " থেকে গূঢ় উদ্দীপক কথামালাগুলি সচেতনভাবে আবৃত্তি করতে পারেন বলে নিজেই ঈষৎ গর্ববোধ করেন।
.......
শেষরাতের মৃদু হাওয়ায় সূতিকার পর্দাগুলি কাঁপছিল বলে তিনি শান্ত পদক্ষেপে কেদারা থেকে উঠে এসে জানালার কাছটিতে এসে দাঁড়ালেন।
এখন তাঁর মস্তিষ্কের মধ্যে কেবল সতীদাহ প্রথার আপাত নির্মমতার আড়ালে বৈবাহিক সূত্রে লভ্য দূরাচারী আত্মীয়দের দ্বারা মৃত স্বামীর বিষয় সম্পত্তি থেকে বিধবা বধূটিকে বঞ্চিত করবার এই জঘন্য লোকাচারটির বিরুদ্ধমত সংগ্রহের সংবেদী তালিকাটি নিয়ে বিশেষভাবে আলোড়ন চলছে।
আসলে তিনি আর কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না দরিদ্র ও অশিক্ষিত জনসমাজের এই কলঙ্কটি উচ্ছেদ করতে গিয়ে যে বেশী সংখ্যক প্রতিপত্তিশীল মানুষদের এখন সহমত প্রয়োজন তারই অপ্রতুলতাজনিত বিরোধাভাসটিতে তিনি বড়ই আশাহত।
এ প্রসঙ্গে যেটুকু সমর্থন তিনি আজ অবধি যোগাড় করতে পেরেছেন তার পরিণামটিও বড় সামান্য যে সাগরের তুলনায় তার পরিমাণ গোস্পদের তূল্য বলা যায়।
....
বেলজিয়াম থেকে সংগৃহীত আরশির বুকে সহসা এক বধূবেশী কিশোরীর একটি মুখচ্ছবি ভেসে উঠতে দেখে তিনি আজ যেন বড় বিস্মিত বোধ করলেন। বিলীয়মান প্রতিবিম্বের মত সেই বালিকাটির অবয়ব যেন তাঁর খুব পরিচিত।
তখনই স্মরণে এল এই বালিকাটি তাঁর প্রাকযৌবনে খানাকুলের এক মাতৃহারা কিশোরী ব্রাহ্মণ তনয়া। বালিকাটি একদা তাঁর মাতা তারিণী দেবীর প্রশ্রয় পেয়ে তাঁকে প্রায়শই মাতৃজ্ঞানে সম্ভাষণ করত বলে তিনিও তাকে অনুজার তূল্যই প্রশ্রয়ে অনেকবার তার অতিপ্রিয় স্বাদু তিন্তিড়ি অথবা পেয়ারা সংগ্রহ করে এনে দিয়ে বড়ই মজা পেতেন।
ঘটনাচক্রে সেই কিশোরীর অগ্রদ্বীপ নিবাসী অন্য এক প্রবীণ ও প্রায় পিতৃবয়সী এক কূলীন ব্রাহ্মণের সাথে বিবাহ হয়ে গেলে তিনি মনে মনে বড়ই বেদনা অনুভব করলেও প্রকাশ্যে তার বিরোধাভাস করতে পারেন নি। আসলে সেই সময় তিনিও যে আজকের পরিণতমনস্ক ও ধী-মান যুবক রামমোহন হয়ে ওঠেন নি।
....
তবে তাঁর মনোজগতে তখন থেকেই প্রচলিত সমাজব্যবস্থার প্রতি বিপ্রতীপ ভাবনাগুলি সবেমাত্র জারিত হতে শুরু করেছে। এই অসমবয়সী বিবাহটির অব্যবহিত কাল পরে তাঁরই প্রত্যক্ষে ঘটে যায় ওই কুসুমিতা বালিকা বধুটির অকাল বৈধব্য ও তৎসহ সতীদাহের মর্মন্তুদ ঘটনাটি।
সেদিনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় হুতাশনলাঞ্ছিত বালিকাবয়সী দেবীবিসর্জনের ঘটনাটি আজও পরিণত বয়সে এসে যেন রামমোহনকে ভীষণ আচ্ছন্ন করে তোলে।
তাই রামমোহনের মনে হতে লাগল যে সেদিনের সেই অপাপবিদ্ধ কিশোরীটির বিদেহী আত্মাটি একবার প্রকট হয়ে যেন তাঁকে সতীদাহ বিরোধী পদক্ষেপের জন্য অগ্রিম জয়মাল্যে ভূষিত করতেই একবার চাক্ষুস দর্শনটি যেন উপহার দিয়ে গেল।
...........
ওদিকে ভীড় একটু আলগা হতেই গোলকপতি জমায়েতের দিকে এগিয়ে গেল। বেলা দ্বিপ্রহর পেরিয়ে গেলেও বৃদ্ধটি এখনও জীবিত আছে। দেখে যা মনে হচ্ছে যে কালকের মধ্যাহ্নের আগে অবধি তার শ্বাসবায়ুটি এখনো সচল থাকবে। সেজন্য আজ মধ্যাহ্নে অন্তত পরিকল্পিত সতীদাহটি আর সম্ভব হচ্ছে না।
গোলকপতির পরণে রাজবাড়ী থেকে দেওয়া ধুতি ও চাদর আর তার সঙ্গে কোমরবন্ধে বর্ধমান রাজের প্রতীকচিহ্নটি কষে বাঁধা। বলা বাহুল্য এই যে প্রায় অর্ধউলঙ্গ ও স্বাস্থ্যবান ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের চেয়ে তাকে এখানে অন্তত বাহ্যিকভাবে আলাদা করে চিনে নেওয়াটা খুব কঠিন কাজ নয়। তাই গোলকপতিকে রাজবাড়ীর লোক বুঝতে পেরে একজন মাতব্বরগোছের লোক ওর দিকে এগিয়ে এল।
....
লোকটি অব্রাহ্মণ হলেও মুরুব্বিগোছের। সে চুপিচুপি গোলকপতিকে যা অত্যন্ত নীচুগলায় বলল তা যেন আগে থেকেই গোলকপতি জানত। ওরা সবাই ওই কমবয়েসী ও সর্বকনিষ্ঠা বধূটিকেই বৃদ্ধটির তেরো জন সপত্নীদের মধ্যে সতীদাহের জন্য আপাতত নির্বাচিত করেছে।
লোকটি এবার হাতের কড় গুণে হিসাব কষে গোলকপতিকে বলল যে আজ পর্যন্ত গোটা বর্ধমানে মোট পাঁচজন বিংশতিবর্ষের উর্দ্ধে বধূর সতীদাহের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। তাই আর একটি সম্পূর্ণ হলেই এখানে যেমন পুরো ছ'টি সতীদাহের সংখ্যাটি পূর্ণ হবে তেমনই এই পান্ডববর্জিত এলাকাটিও একটি সতী পীঠ হিসাবে উপযুক্ত পরিচিতি লাভ করবে। আর সেজন্য এই উপলক্ষ্যে গ্রামের সবাই একটি কালী মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করার কথা ভেবে এই সমস্ত ক্ষেত্রটিকে " সতী কালীর মাঠ" নামে প্রচারের জন্য স্বয়ং মহারাজ তেজচন্দ্রের কাছে একটি সম্মিলিত মুচলেকা সই করে পাঠাবে বলে ভাবছে।
লোকটির পরিকল্পনা শোনার পরমুহূর্তেই গোলকপতির ভিতরমহলটি এক অব্যক্ত বেদনায় যেন শিউড়ে উঠল।