ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক
৩৫
ফিঙ্কের সম্পত্তির বহর দেখে ফাইনহালসের চোখের পলক পড়ছিল না। সামনে অবশ্য অপরিসর একটা পুরনো বাড়ি, যেটার গায়ে সাইনবোর্ড লাগানো আছে… ‘ফিঙ্কের পানশালা ও সরাইখানা ১৭১০ সালে প্রতিষ্ঠিত’। একটা লড়ঝড়ে সিঁড়ি, যেটা রেস্তরাঁয় উঠে গেছে। দরজার বাঁয়ে একটা জানালা, ডানদিকে দুটো জানালা। ডানদিকের শেষের জানালার পর থেকেই শুরু হচ্ছে ওয়াইনের খামার। একটা সরু গেট সবুজ রঙ করা, যার মধ্য দিয়ে অতিকষ্টে একটা গাড়ি ঢুকতে পারে।
কিন্তু এখন, গেট খুলে ভেতরে ঢুকে সামনের করিডোর পেরিয়ে বিশাল উঠোনটা দেখে সে থমকে দাঁড়াল। চতুষ্কোণ উঠোন ঘিরে নতুন ঝকঝকে কিছু বিল্ডিং। দোতলায় কাঠের রেলিং দেওয়া টানা বারান্দা সব কটা বিল্ডিংএ। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে আরেকটা গেট খুলে দিলে আরেকটা উঠোন। সেটা ঘিরে কিছু ছাউনি দেওয়া ঘর। ডানদিকে একটা একতলা বাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে একটা বিশাল হলঘর সেই বাড়িটার মধ্যে। সে সবকিছু ধীরে সুস্থে দেখতে লাগল; কান পেতে শুনবার চেষ্টা করল কোনো শব্দ পাওয়া যায় কি না। তারপর দু’ জন আমেরিকান রক্ষীকে দেখে আবার থমকে দাঁড়াল। দ্বিতীয় উঠোনের সামনে এরা পাহারা দিচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট ছন্দে কিছুক্ষণ পর পর একজন আরেকজনকে অতিক্রম করে যাচ্ছে পায়চারি করতে করতে। বন্ধ খাঁচার মধ্যে দু’খানা জানোয়ার একসঙ্গে থাকলে এমন হয়, দেখেছে ফাইনহালস। একজন চশমা পরা, ঠোঁট নড়ছে ক্রমাগত, কিছু মুখে নিয়ে চিবাচ্ছে লোকটা। আরেকজন সিগারেট খাচ্ছে। দু’জনেরই ইস্পাতের হেলমেট একটু আলগা করে পেছনে হেলানো। দু’জনকেই ভারি ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
ফাইনহালস বাঁয়ে দরজাটার পাল্লায় একবার ধাক্কা দিল। দরজাটার গায়ে লেখা আছে ‘ব্যক্তিগত’। ডানদিকের দরজার গায়ে অতিথিশালার সাঙ্কেতিক চিহ্ন আঁকা আছে। দুটো দরজাই বন্ধ। সে কিছু সময় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল। রক্ষীদের পায়চারি করা দেখল। নৈঃশব্দ্যের মধ্যে দূরে কোথায় যেন বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। বল ছোঁড়ার মত গ্রেনেড ছোঁড়া শুরু হয় অনেক সময়। দরকার না থাকলেও ছোঁড়া হয়। লড়াইয়ের জন্য নয় সব সময়; কতকটা হল্লা করার জন্য, শব্দ করে করে ভয়টা জিইয়ে রাখবার জন্য। যেন ঘোষণা হয়ে চলেছে সব সময়… ‘যুদ্ধ, এটা যুদ্ধ। হুঁশিয়ার, যুদ্ধ!’ পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে শব্দগুলি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। ফলে এমনিতেই শব্দ বেড়ে যাচ্ছিল। কিছু সময় পরে ফাইনহালস বুঝতে পারল যে জার্মানদের দিক থেকে কোনো গোলাগুলি ছোঁড়া হচ্ছে না। আমেরিকানরা একতরফা গ্রেনেড ছুঁড়ে যাচ্ছে।
সেই অর্থে কোনো গুলিবিনিময় হচ্ছে না কোথাও। একতরফা ভাবে বিস্ফোরণের শব্দ নদীর ওপারে শান্ত পাহাড়ি প্রকৃতির মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন হুমকির পরিবেশ জারি রাখবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ফাইনহালস ধীরে ধীরে করিডোরের একদম অন্ধকার প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল। বাঁয়ে একটা সিঁড়ি মাটির নিচে সেলারের দিকে গেছে। ডানদিকে একটা ছোট দরজা, যেটার উপরে একটা কার্ডবোর্ড পেরেক দিয়ে আটকানো আছে। কার্ডবোর্ডের উপরে লেখা ‘রান্নাঘর’। ফাইনহালস রান্নাঘরের দরজায় টোকা দিল।
খুব ক্ষীণ একটা শব্দ শুনতে পেল সে… ‘ভেতরে আসুন।’
হাতল ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে সে চারটি মুখ দেখতে পেল। চারটি মুখের মধ্যে দু’টি মুখের সঙ্গে সেই মুখটির সাদৃশ্য দেখে সে চমকে উঠল। কতটুকুই বা সে দেখেছিল সেই প্রাণহীন, ক্লান্ত মুখটিকে? হাঙ্গেরিয়ান গ্রামের এক তৃণভূমিতে, লালচে আগুনের আভায় সে দেখেছিল তাকে। এখন এখানে মুখে পাইপ নিয়ে জানালার কাছে বসে থাকা এই বৃদ্ধ লোকটিকে দেখতে অনেকটা সেই মুখের মত; সেও এমনি রোগা আর বুড়োটে গড়নের হালকা চেহারার ছিল আর চোখে ছিল এক ক্লান্ত জ্ঞানী ভাব। দ্বিতীয় যে মুখের সঙ্গে সেই মুখটির সাদৃশ্য দেখে সে ভয় পেল এখন, সেটা হল একটা বাচ্চা ছেলের মুখ। কত আর বয়স হবে বাচ্চাটার? বছর পাঁচ ছয়েক। বাচ্চাটা হাতে একটা কাঠের খেলনাগাড়ি নিয়ে মেঝেতে কুঁকড়ে বসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। বাচ্চাটারও রোগাপাতলা গড়ন। মুখের ভাব কেমন বুড়োটে, ক্লান্ত, জ্ঞানী ধরনের; গাঢ় রঙের চোখের মণি, একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকে দেখে তারপর উদাসীনভাবে চোখ নামিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে খেলনাগাড়িটা মেঝেতে ঘষে ঘষে চালিয়ে খেলতে থাকে বাচ্চাটা।
দু’জন মহিলা টেবিলে বসে আলুর খোসা ছাড়াচ্ছিল। একজন বয়স্ক, তার মুখ চওড়া, বাদামি গায়ের রঙ, ভালো স্বাস্থ্য। খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে অল্প বয়সে খুব রূপ ছিল তার। পাশে যে মহিলা বসে আছে, সে ফ্যাকাসে আর বুড়োটে চেহারার। খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে যতটা বুড়োটে দেখাচ্ছে, সে আসলে তত বয়স্ক নয়। আসলে মহিলার বয়স অল্প। কিন্তু খুব ক্লান্ত আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। হাতের নড়াচড়াও ক্লান্ত এবং দ্বিধাগ্রস্ত। ব্লন্ড সোনালি চুলের গোছা ফ্যাকাসে কপাল পেরিয়ে এলোমেলো হয়ে মুখের উপরে পড়েছে। কিন্তু বয়স্ক মহিলার চুল আঁচড়ে সুন্দর পরিপাটি করে বাঁধা।
‘সুপ্রভাত!’ বলল ফাইনহালস।
‘সুপ্রভাত!’ তারা উত্তর দিল। ফাইনহালস ঘরে ঢুকে তার পেছনে দরজাটা বন্ধ করল। একটু ইতস্তত করে সে প্রথমে একটা খাঁকারি দিয়ে গলাটা সাফ করে নিল। তারপর সে অনুভব করল যে সে ঘামছে। ঘামের স্রোতে পরনের শার্টটা বগলের কাছে আর পিঠের কাছে একেবারে তার শরীরে লেপটে বসেছে।
(চলবে)