ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক৭
ছাতের কামরাটি সংযুক্ত পরিবারের পাঠ্যপুস্তকের মত সবসময় খোলা পড়ে থাকে। ঘরের কো্নে একজোড়া মুগুর, মানে সরকারিভাবে ঘরটার মালিক বড়ছেলে বদ্রী পালোয়ান। তবে পরিবারের অন্য সদস্যরাও নিজেদের ইচ্ছেমত ঘরটার ব্যবহার করে থাকে। মহিলারা নানান কিসিমের কাঁচের বয়াম ও মাটির পাত্রে নানাধরণের আচার ভরে ছাতে রোদ খাইয়ে বিকেল হবার মুখে ঘরটার মধ্যে ভরে দেন। ছাতে শুকুতে দেয়া কাপড়চোপড়েরও একই হাল। কামরার ভেতরে এ’মুড়ো থেকে ও’মুড়ো অব্দি একটা দড়ি টাঙানো। তাতে সন্ধ্যের পর ল্যাংগোট ও চোলি, বক্ষবন্ধনী ও সায়া একসাথে দোলা খায়। বৈদ্যজীর ফার্মেসি থেকে একগাদা ফালতু শিশি একটা আলমারি ভরে রাখা। অধিকাংশই খালি। কিন্তু তাতে দু’রকম লেবেল সাঁটা—‘ওষুধ খাওয়ার আগে’ আর ‘ওষুধ খাওয়ার পর’। প্রথমটায় একটা অর্ধমানবের ছবি, পরেরটায় এমন চেহারা যার গোঁফে তা’, ল্যাঙ্গোট কষে বাঁধা। অর্থাৎ, বোঝা যায় যে এই সেই শিশি যা হাজার নবযুবকদের সিংহ বানিয়ে দিয়েছে। তবে কথা হল, এরা সব স্নানের ঘর এবং শোবার ঘরের মধ্যেই সিংহবিক্রমে চলা ফেরা করে, কিন্তু বাইরে বেরোলে নিরীহ ছাগলছানা হয়ে যায়।
একধরণের সাহিত্য আছে যার বিষয় ‘গুপ্ত’ এবং ‘ভারতে ইংরেজ রাজত্ব’ গোছের বইয়ের চেয়েও ভয়ংকর। কারণ এই ধরনের বই ছাপিয়ে ফেলা ১৯৪৭ সালের আগে তো নিষিদ্ধ ছিলই, এখনও অপরাধের আওতায় পড়ে। এই ধরণের সাহিত্য অফিসের গোপন ফাইলের মত গোপন হয়েও গোপন নয়, এবং এরা আহার-নিদ্রা ও ভয়ে ভয়ে কাটানো মানবজীবনে নিঃসন্দেহে এক আনন্দময় লিটারারি সাপ্লিমেন্টের কাজ করে। এছাড়া এরা সাহিত্যের কুলীন এবং জনপ্রিয় সাহিত্যের কৃত্রিম শ্রেণীবিভাগের বেড়া টপকে ব্যাপকহারে জনগণেশের হৃদয়ে আসন পাকা করে নেয়। এতে এমনকিছু রহস্য নেই। খালি বর্ণনা করা হয় যে কোন পুরুষ অন্য পুরুষ বা নারীর সঙ্গে কেমন করে কী কী করেছিল। অর্থাৎ কবি সুমিত্রানন্দন পন্থের দার্শনিক ভাষায় বললে ‘মানব মানবীর চিরন্তন সম্পর্কে’র বর্ণনা।
এই ঘরটা এমন সব সাহিত্য পড়ার জন্যেও কাজে আসে, আর বোঝা যায় যে পরিবারের একমাত্র ছাত্র হওয়ার ফলে এই সব অধ্যয়ন একমাত্র রূপ্পনবাবুই করে থাকেন। এটুকুই নয়, ঘরটা রূপ্পনবাবুর অন্য কাজেও লাগে। যে সুখ পেতে অন্যদের চাই রুটির টুকরো, গাছের ছায়া, পানপাত্র ও প্রেমিকা, তা’ উনি এই কামরাতেই পুরোপুরি আদায় করে নিতেন।
এই কামরায় পরিবারের সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পতাকা ওড়া দেখে লোকজন স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে। এই ঘরটা একবার দেখলে নিঃসন্দেহ হবেন যে পূর্ব গোলার্ধে সংযুক্ত পরিবারে কোন দিক থেকেই কোন বিপদের আশংকা নেই।
রঙ্গনাথের এই কামরায় ঠাঁই হল। এখানে ও চার-পাঁচ মাস থাকবে। বৈদ্যজী ঠিক বলেছেন। এম এ পড়তে পড়তে রঙ্গনাথও অন্য সব ছাত্রের মত দুর্বল হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই জ্বর হত। সমস্ত গড়পড়তা হিন্দুস্থানী নাগরিকের মত রঙ্গনাথেরও আধুনিক ডাক্তারিতে বিশ্বাস নেই, তবু ওষুধ খাচ্ছিল, এখনও পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। সব শহুরেদের মত ওরও বিশ্বাস যে শহরের ওষুধ আর গ্রামের হাওয়া্য কোন তফাৎ নেই। তাই ও এখানে মামাবাড়িতে কয়েকমাস থাকতে এসেছে। এম এ করার পর চাকরি না পেয়ে ও অন্য গড়পড়তা মূর্খদের মত পিএইচডি করতে নাম লেখাল। আবার সাধারণ বুদ্ধিমানদের মত ওর এটাও জানা ছিল যে রিসার্চ করতে হলে রোজ ইউনিভার্সিটিতে হাজিরা দেয়া এবং লাইব্রেরিতে বসে থাকার কোন মানে নেই। তাই ও ভাবল যে কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে আরাম করি, শরীর ভাল করি, পড়াশুনো করি, দরকার পড়লে মাঝে মাঝে শহরে গিয়ে বই পালটে নিয়ে আসি। আর মাঝে মাঝে মামাবাবু মানে বৈদ্যজীকে শিষ্ট ভাষায় এটা বলার সুযোগ করে দিই—হায়, আমাদের নবযুবকেরা অকর্মার ধাড়ি! নইলে আজ আমাদের মত বুড়োদের ঘাড়ে এতসব দায়িত্বের বোঝা চাপে !
উপরের কামরাটি বেশ বড়সড়। রঙ্গনাথ এসেইই ওর এক কোনায় নিজের রাজ্য আলাদা করে নিল। ঘরটা সাফসুতরো করিয়ে তাতে একটা চারপাই আর একটা বিছানা পাকাপাকি ভাবে পাতা হল। পাশের আলমারিটিতে ওর বইপত্তর ভরে তাতে গোয়েন্দা সিরিজ বা ‘গুপ্তজ্ঞান’ গোছের বই রাখা নিষিদ্ধ হল। কলেজ থেকে এসে গেল একটা ছোটখাট টেবিল আর চেয়ার। খাটিয়ার পাশে একটা জানলা যা খুললে বাগান এবং চাষের ক্ষেত চোখে পড়ে। এই দৃশ্য রঙ্গনাথের জীবনকে কবিত্বময় করে তুলল। কখনও কখনও ওর সত্যি সত্যি মনে হত ওর সামনে কত ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কত রবার্ট ফ্রস্ট, কত গুরুভক্ত সিং মিলে একটা অর্কেস্ট্রা বাজাচ্ছে।ওদের পেছনে রয়েছে অনেক স্থানীয় লেখক তুরী আর শিঙে ফুঁকতে ফুঁকতে যাদের বুক হাপরের মত উঠছে আর নামছে।
রূপ্পনবাবু কোত্থেকে কিছু ইঁটের টুকরো এনে জুড়ে টুরে একটা রেডিওর আকার বানিয়েছিলেন। কামরার ছাদের বাঁশ আর আশেপাশের গাছগাছালির সাহায্যে লম্বা লম্বা তার এমন ভাবে টাঙানো হয়েছিল যেন এই কামরাটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় ট্রান্সমিশন সেন্টার। কিন্তু সেন্টারের ভেতরের রেডিওটি শুনতে কানে একটা হেডফোন লাগানো জরুরি। রঙ্গনাথ কখনও সখনও ওটা কানে লাগিয়ে স্থানীয় সংবাদ ও বৈষ্ণব সন্তদের কান্নাকাটিমার্কা ভজন শুনতে পেত। ও বুঝে যেত যে অল ইন্ডিয়া রেডিও দশবছর আগে যা ছিল এখনও তাই। এত গাল খেয়েছে তবু বেহায়ার মত জিদ ধরেছে যে - পরিবত্তোন চাইনে।
রঙ্গনাথের দৈনিক রুটিন বৈদ্যজীর পরামর্শে তৈরি হয়েছে।
সাতসকালে উঠতে হবে, উঠে ভাবতে হবে যে কালকের খাবার ঠিকমত হজম হয়েছে।
ব্রাহ্মে মূহুর্তে উত্তিষ্ঠেৎ জীর্ণাজীর্ণং নিরুপয়েৎ।
তারপর তামার লোটায় রাত্তিরে রাখা জল খাও, বেশ খানিকটা বেড়িয়ে নিত্যকর্ম ষেরে এস।কারণ সংসারে ওই একটা কাজই নিত্য, বাকি সব অনিত্য। তারপর রয়েছে হাত-মুখ ধুয়ে নিমের বা বাবুলের দাঁতন চিবোনো, হাত এবং দাঁত পরিষ্কার করা।
নিম্বস্য তিক্তকে শ্রেষ্ঠঃ কষায়ে বব্বুলস্তয়া।
এরপর একের পর এক-- কুসুম গরম জলে কুলকুচি করা, ব্যায়াম করা, দুধ খেয়ে পড়তে বসা, দুপুরের খাবার, বিশ্রাম, আবার পড়াশুনো, সন্ধ্যের মুখে একটু বেড়িয়ে আসা, ফিরে এসে সাধারণ ব্যায়াম, বাদাম-মুনক্কার শরবত, আবার পড়া, রাতের খাবার, পড়া এবং নিদ্রা।
রঙ্গনাথ এই রূটিন খুব নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলল। তবে তাতে সামান্য পরিবর্তন। পড়ার বেশিরভাগ সময় বৈদ্যজীর বৈঠকখানার দরবারে ‘গঞ্জহা’দের সঙ্গে খোশগল্পে কাটতে লাগল। বৈদ্যজী এই পরিবর্তনে অখুশি নন, কারণ এতে রঙ্গনাথের বীর্যরক্ষায় কোন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, বাকি সব মেনে চললেই হল। একদিকে এই দরবারে ভাগ্নের নিয়মিত হাজিরায় উনি খুশি, কারণ একজন লেখাপড়া জানা লোক তাঁর দরবারে রয়েছে এবং বাইরের লোকজনের কাছে গর্বের সঙ্গে পরিচয় করানো যাচ্ছে।
কিছুদিনের মধ্যে রঙ্গনাথের মনে হল যে যা কোথাও নেই তাও শিবপালগঞ্জে আছে, আর যা শিবপালগঞ্জে নেই তা কোথাও নেই; ঠিক মহাভারতের মত। এটাও বিশ্বাস হল যে ভারতবাসী সর্বত্র এক, আমাদের বুদ্ধিটুদ্ধি সবজায়গায় একই রকম। যেসব পাঁয়তারা প্যাঁচ-পয়জারের প্রশংসায় নামজাদা খবরের কাগজগুলো প্রথম পাতায় বড় বড় হেডলাইনে মোটা মোটা অক্ষরে রোজ চেঁচায়, যার ধাক্কায় বড় বড় নিগম, কমিশন এবং প্রশাসন ডিগবাজি খায়, ওসবের একগাদা অখিল ভারতীয় প্রতিভা শিবপালগঞ্জে কাঁচামালের মত এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে। ভেবে ভেবে ভারতের সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতি ওর আস্থা আরও মজবুত হল।
কিন্তু একটা জিনিস এখানে নেই।ও দেখেছিল যে শহরে পুরনো ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে এক বিতর্ক শুরু হয়েছে। পুরনো প্রজন্মের বিশ্বাস আমরা অনেক বুঝদার, অনেক বুদ্ধিমান। আমাদের পরে গোটা দুনিয়ায় বুদ্ধি ব্যাপারটাই গায়েব হয়ে গেছে, নতুনের জন্যে ছিটেফোঁটাও বাঁচেনি। কিন্তু নতুন প্রজন্মের দৃঢ় বিশ্বাস যে পুরনোর দল হল অল্পে খুশি হওয়া স্থবির, সমাজের প্রতি দায়িত্বহীন। আর আমরা? আমরা সচেতন, কোন কিছুতেই সহজে সন্তুষ্ট হওয়ার বান্দা নই, নিজের স্বার্থের প্রতি নিষ্ঠাবান, এবং সমাজের প্রতি আস্থাহীন, কারণ সমাজ বলে আজ আর কিছু নেই।
এই সব তর্ক-বিতর্ক বিশেষ করে সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে বেড়ে উঠছিল, কারণ অন্য সব বিষয়ের জায়গায় সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রের জাল অনেক বেশি ছড়ানো, কিন্তু সবচেয়ে কম লোকসানদায়ক। পুরানো দের চোখে নতুনরা মূর্খ আর নতুনদের চোখে প্রাচীনেরা সব ভাঁড়—ব্যাপারটা এদ্দুর গড়িয়েছে যে সাহিত্য-শিল্পকলা না হয়ে অন্য কিছু হলে এতদিনে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যেত। রঙ্গনাথ প্রথমে ভেবেছিল নতুন-পুরনোর এই লড়াইয়ের শহুরে ব্যামো শিবপালগঞ্জে ছড়ায়নি। একদিন ওর ভুল ভেঙে গেল। দেখল এখানেও ওই নতুন-পুরনোর লড়াই। এখানকার রাজনীতি এব্যাপারেও কিছু কম নয়।
শুরু হয়েছিল একটি চোদ্দ বছরের ছেলেকে নিয়ে। এক সন্ধ্যার বৈঠকে একজন শিবপালগঞ্জের ওই ছেলেটির জীবন-চরিত ব্যাখ্যা করা শুরু করল।বোঝা গেল যে ছোঁড়াটার মধ্যে বদমাশ হওয়ার ক্ষমতা এতটাই প্রবল হয়ে উঠল যে বড় বড় মনোবৈজ্ঞানিক ও সমাজবিজ্ঞানী একে প্রভূর মায়া বলে মানতে বাধ্য হন। শোনা যায় যে আমেরিকায় পড়ে দেশে ফেরত আসা কিছু বিদ্বান ছেলেটার বিষয়ে রিসার্চ করেছিলেন। ওঁরা চাইছিলেন ওঁদের বইয়ের বাঁধা থিওরির —ভেঙে যাওয়া পরিবার, অসৎসঙ্গ, খারাপ পরিবেশ, বাপ-পিতামো’র ক্রিমিনাল রেকর্ড ইত্যাদি- ফ্রেমে ছেলেটাকে ফিট করাতে, কিন্তু সে ছেলে কোনমতেই ওই ফেমে বাঁধা পড়তে রাজি নয়।
এতে ওই পন্ডিতদের ব্যর্থতা নয়, বরং আমাদের দেশের যোগ্যতা প্রমাণিত হয়।আমরা আজকাল ধনবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি-বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান আদির ক্ষেত্রে এমন সব প্র্যাক্টিক্যাল সমস্যা এক তুড়িতে তৈরি করে দিই যে আমেরিকায় দামি কাগজে ছাপা মোটা মোটা বইয়ের দামি থিওরিগুলো হার মেনে যায় এবং ভারতীয় পন্ডিতেরা ঘাবড়ে গিয়ে ফের আমেরিকায় দৌড়তে বাধ্য হয়। এই ছোঁড়াটার কেস-হিস্ট্রিটা এমন হাঙ্গামা খাড়া করল যে এক নামকরা পন্ডিত ওঁর আগামী আমেরিকা প্রবাসের সময় এর সমাধান খুঁজে বের করার প্রতিজ্ঞা করলেন।
শিবপালগঞ্জের ইতিহাসের পাতায় ছেলেটা দু’তিন বছরের জন্যে হঠাৎ উদয় হয়ে সবার চোখ ধাঁধিয়ে দিল, তারপর পুলিশের মার, উকিলের যুক্তিতর্ক এবং ম্যাজিস্ট্রেটের দেওয়া শাস্তি নির্বিকার ভাবে স্বীকার করে নাবালক অপরাধীদের জেলখানার ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে গেল। পরের খবর হল ছেলেটার ব্যক্তিগত চরিত্র দেশের পন্ডিতদের জন্যে এক প্রহেলিকা মনে হওয়ায় সে রহস্যভেদ করতে ভারত ও আমেরিকার মৈত্রীর দোহাই দিয়ে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে। খবরটা শিবপালগঞ্জে পৌঁছতে পৌঁছতে মিথ বা লোককথার চেহারা পেয়ে গেল। তখন থেকে ছেলেটার লীলা-প্রসংগ বড় গর্বের সঙ্গে বর্ণনা করা হয়।
রঙ্গনাথকে বলা হল যে ছোঁড়াটা দশবছর বয়সেই এমন জোরে দৌড়ুত যে পনের বছরের ছেলেছোকরারা ওর নাগাল পেত না। এগার বছরের মাথায় ও রেলে বিনা টিকিটে চড়ায় এবং টিকিট চেকারদের বোকা বানানোর খেলায় পাকা খেলুড়ে হয়ে উঠল। আরো এক বছর যেতে না যেতে ও যাত্রীদের মালপত্তর গায়েব করায় এমন হাত পাকালো যেন দক্ষ সার্জন লোক্যাল অ্যনাস্থেশিয়া দিয়ে কারও অপারেশন করছে এবং টেবিলে শোয়া রোগী টের পাচ্ছে না যে ওর একটি অঙ্গ শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এই ধরণের চুরিতে ওর এত নাম হওয়ার বিশেষ কারণ হল একবারও ধরা না পরা। শেষে চোদ্দ বছর বয়েসে যখন প্রথম ধরা পড়ল ততদিনে ও দরজার ওপরের কাঁচ ভেঙে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে ছিটকিনি খোলায় পারঙ্গম হয়েছে। বাংলোবাড়িতে চুরি করতে স্কাইলাইট দিয়ে না ঢুকে নিজস্ব কায়দায় দরজা খুলে ঢোকে এবং কাজটি সেরে ভালোমানুষের মত সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে।
এই ছেলেটির গুণগান চলছিল, এমন সময় কেউ তুলে দিল ‘বহরাম চোট্টা’র প্রসংগ।ও নাকি একসময় এই এলাকার ইতিহাস অনুযায়ী বেশ নামকরা চোর ছিল। কিন্তু নামটা শোনামাত্র এক ছোকরা চেঁচিয়ে আপত্তি করল। ঠিক যেমন বিধানসভায় কোন যুক্তি ছাড়াই সির্ফ চিৎকার করে ‘স্পীচ’এর বিরোধ করা হয়। ওর কথা হচ্ছে-বহরাম চোট্টা আবার কোন চোর নাকি? রামস্বরূপ চোর বারো বছর বয়সেই যা মাল সরিয়েছিল বহরাম ব্যাটা জনম ভর চেষ্টা করেও সেটা গুণে শেষ করতে পারবে না।
রঙ্গনাথ এই বিতর্কে যেন দুই প্রজন্মের লড়াইয়ের আঁচ পেল।শনিচরকে বলল, ‘কী ব্যাপার? আজকালকার চোরেরা কি সবাই ভারি সেয়ানা? আগেকার দিনেও তো একের পর এক ভয়ংকর সব চোট্টা জন্মেছিল’।
শনিচরের বয়েসটা এমন যে ওকে নতুনেরা ভাবে বুড়োদের দলে আর বুড়োরা ভাবে ছোঁড়াদের দলে। এবং প্রজন্মের ভাগাভাগি তো বয়সের মাপকাঠি দিয়ে কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হয়নি, ফলে দুটো দলই ওকে দুধভাত করে রেখেছে। তাই ওকে কেউ কোন দলকে সমর্থন করতে মাথার দিব্যি দেয়নি। শিল্প-সাহিত্যের দুনিয়ায় যেমন কয়েক’শ আধবুড়ো সমালোচক এমনভাবে মাথা নাড়ে যাতে তার স্পষ্ট কোন মত বোঝা যায়না, শনিচরও ঠিক সেই ভাবে এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘ভাই রঙ্গনাথ, পুরনো দিনের ওস্তাদদের কথা আর বোল না। ছিলেন বটে ঠাকুর দূরবীন সিং। আমি সেসব দিনও দেখেছি। কিন্তু আজকালকার চ্যাংড়াদের কথা না বলাই ভাল।
‘ আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে, যখন আজকের ছেলেছোকরারা জন্মায়নি, বা জন্মে কিছু বৃন্দগান গাইতঃ
“ হে গোবিন্দ, হে গোপাল!
আমার রাজা-রানীকে দেখো ঠাকুর, হে দীনদয়াল”।
অথবা,
“ হে আমার রাজরাজেশ্বর,
জর্জ পঞ্চমকে রক্ষা কর গো, রক্ষা কর”!
সেই সময় শিবপালগঞ্জের সবচেয়ে বড় ‘গঞ্জহা’ ছিলেন ঠাকুর দূরবীণ সিং। বাপ-মা হয়ত ভেবেছিলেন যে নাম যখন দূরবীন রেখেছি, ছেলে সব কাজ বৈজ্ঞানিক ঢংয়ে করবে।বড় হয়ে উনি তাই করলেন। যে জিনিসে একবার হাত দিয়েছেন, তো সোজা তার বুনিয়াদে গিয়ে ঘা’ দিয়েছেন।ইংরেজের আইন-কানুন ওনার ভালো লাগেনি।তাই মহাত্মা গান্ধী যখন শুধু লবণ আইন অমান্য করতে ডান্ডি গেলেন, দূরবীন সিং ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের সমস্ত ধারা ভাঙতে উঠে পড়ে লাগলেন।
স্বভাবে উনি পরোপকারী বটেন। এখন পরোপকার হল একটা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী রোগ, আর এ নিয়ে সবার আলাদা আলাদা মত। কেউ পিঁপড়েকে আটা খাওয়ায়, অন্য কেউ অবিবাহিত বয়স্ক মহিলাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক করার লক্ষ্যে নিজের চেহারায় ‘প্রেম করতে এক পায়ে খাড়া’ গোছের প্ল্যাকার্ড লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কাউকে যেন খোলাখুলি ঘুষ চাইতে না হয়, তাই এক পরোপকারী যত ঘুষ দেনেওয়ালা তাদের সঙ্গে দিনরাত দরদাম করে মধ্যস্থতার কাজ করে বেড়ায়। এসব হল পরোপকার কাকে বলে তা’ নিয়ে কিছু ব্যক্তিগত ধারণা মাত্র। দূরবীন সিংয়েরও পরোপকার কাকে বলে তা’ নিয়ে নিজস্ব ধারণা ছিল। উনি দুর্বলের রক্ষার জন্যে সদাই আতুর হতেন। এই জন্যে কোথাও মারপিট হচ্ছে শুনতে পেলেই উনি বিনা নেমন্তনে পৌঁছে যেতেন এবং সবসময় দুর্বলের পক্ষ নিয়ে লাঠি ভাঁজতেন। সেসব শান্তিপূর্ণ দিনে এ’সব ব্যাপারের জন্যে রেট বাঁধা থাকত। সবাই জানত যে বাবু জয়রামপ্রসাদ উকিল যেমন মারপিটের কেসে আদালতে দাঁড়াতে প্রত্যেকবার পঞ্চাশ টাকা নিতেন তেমনই দূরবীন সিং ও মামলাটা আদালতে গড়ানোর আগে প্রথম যে দরকারি মারপিটটা হত তার জন্যে পঞ্চাশ টাকা করে নিতেন। বড়সড় পেটাপেটির সময়, মানে যখন বেশ কিছু লোক জমায়েতের দরকার, তখন মাথাপিছু হিসেবে রেট ঠিক হত, টাকাটা বেড়ে যেত। কিন্তু তারও রেট আগে থেকে ঠিক করা থাকত,ফলে কেউ ধোঁকা খেত না। ওনার লোকজনকে মদ ও মাংস খাওয়াতে হত। কিন্তু উনি নিজে সেই পরিস্থিতিতে মদ বা মাংস কিছুই ছুঁতেন না।ফলে ওঁর পেট হালকা এবং মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকত যা যুদ্ধের ময়দানে বড়ই দরকারি। ‘মাংস’ ও ‘মদিরা’ দেখেও যে সোজা ‘না’ বলতে পারে তাকে সদাচারী সাত্ত্বিক মানুষ ধরা হয়, তাই ওনাকেও সাত্ত্বিক বলতে কোন বাধা নেই।
দূরবীন সিংযের একটি বৈশিষ্ট্য হল উনি কখনও কারও ঘরে সিঁদ দিতেন না, সোজা পাঁচিল টপকে ঢুকতেন। উনি সুযোগ পেলে যেকোন রাজ্যে পোলভল্ট চ্যাম্পিয়ন হতে পারতেন। গোড়ার দিকে টাকাপয়সার টানাটানি হলে কালেভদ্রে পাঁচিল টপকাতে যেতেন। পরের দিকে এ’ধরণের কাজকম্মো কখনো সখনো শুধু নতুন চ্যালাদের প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং দেবার জন্যে করতেন। সে যুগে চোর শুধু চোরই হত, আর ডাকাতেরা ডাকাত। চোরেরা শুধু চুরি করতেই ঢুকত আর একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও যদি হাত-পা নাড়ত তাহলে যে পথে সিঁদ কেটে ঢুকেছিল সে পথেই ভদ্রভাবে বেরিয়ে যেত। ডাকাতের দল মালপত্তর লুঠে নেয়ার চাইতে মারপিট করতে বেশি উৎসাহী হত। এই ট্র্যাডিশনে দূরবীন সিং যোগ করলেন চুরি করার সময় যে জেগে উঠবে তাকে ঠ্যাঙাও। এই দাওয়াইটি সমসাময়িক চোরদের মধ্যে ভারি লোকপ্রিয় হল। এভাবে দূরবীন সিং চোর এবং ডাকাতের মধ্যের ফারাকটা প্রায় মিটিয়ে দিলেন এবং চুরির মেথডলজিতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এলেন।
কিন্তু কালের কুটিল গতি!
শিবপালগঞ্জে যা কিছু কালধর্মের সঙ্গে বেখাপ্পা, তাই ‘কালের কুটিল গতি’ হয়ে যায়।অমন যে ঠাকুর দূরবীন সিং , তিনিও বুড়োবয়েসে একবার নেশাড়ু ভাইপোর এক তামাচা খেয়ে কুয়োর পাড় থেকে গড়িয়ে পড়লেন। শিরদাঁড়ার হাড় ভেঙে গেল। কিছু দিন ঘরের কোণায় দাঁড় করিয়ে রাখা লাঠিগাছটির দিকে তাকিয়ে ওটা ওই ভাইপোর মুখে ঠুঁসে দেবার কল্পনা করে দিন কাটাতে লাগলেন। শেষে একদিন লাঠি এবং ভাইপোর মুখশ্রীকে যেমন ছিল তেমনই রেখে উনি শিবপালগঞ্জের ধরাকে বীরশূন্য করে বীরগতি প্রাপ্ত হলেন; অর্থাৎ টেঁসে গেলেন।
শনিচর এবার দূরবীন সিংকে নিয়ে ওর নিজস্ব স্মৃতিচারণে ডুবে গেলঃ
“ভাইয়া রঙ্গনাথ, এক কৃষ্ণপক্ষের রাতে আমি ভোলুপুরের তিওয়ারিদের বাগানের ভেতর দিয়ে আসছিলাম।তখন আমারও ছেলেমানুষির সীমা ছিল না, বাঘ ও ছাগলকে সমদৃষ্টিতে দেখতাম। শরীরে এমণ তেজ যে হাওয়ায় লাঠি ঘোরাই এবং শুকনো পাতায় একটু খরখরানি টের পেলেই তক্ষুণি মা তুলে গাল দিই। তো, এক নিকষকালো রাতে আমি একটা ডান্ডা হাতে নিয়ে সটাসট চলে আসছি। তক্ষুণি গাছের আড়াল থেকে কে যেন হাঁক পাড়ল—খবরদার!
“ ভাবলাম নিশ্চয়ই কোন ভূত প্রেত, কিন্তু ওদের তো এই ডান্ডায় কিছু হবে না। আমি তাই লাল ল্যাঙ্গোটধারীর ধ্যান করলাম, তবে তাঁর ধ্যান কখন কাজে দেয়? যদি ভূত-প্রেত-মামদো এসে ধরে তবে না? কিন্তু গাছের আড়াল থেকে এগিয়ে এল এক কেলেকুষ্টি হাট্টাকাট্টা সাজোয়ান। বলল, যা কিছু আছে চুপচাপ বের করে দাও। ধুতি-পিরেন সব খুলে নামিয়ে রাখো!
মারার জন্যে লাঠি তুলতেই দেখি চারদিক দিয়ে পাঁচ-ছ’জন আমাকে ঘিরে ফেলেছে। সবার হাতে বড় বড় লাঠি ও ভল্ল।আমি ভাবলাম—নাও শনিচর, আজ তোমার জমাখরচ হিসেব-নিকেশ সব হল বলে । উঁচিয়ে ধরা ডান্ডা হাতেই রয়ে গেল, চালানোর হিম্মত হলনা।
একজন বলল, লাঠি তুলেছিলে, চালালে না কেন? যদি এক বাপের ব্যাটা হোস, তো চালা লাঠি!
বড্ড রাগ হল। কিন্তু ভাই, যেই রাগের চোটে মুখ খুললাম কান্না পেয়ে গেল। আমার মুখ দিয়ে বেরোল—'জান নিওনা, মাল নিয়ে যাও’।
আরেকজন বলল-শালার আট আনার জান, তার জন্যে শেয়ালের মত ফেউ ফেউ করছে। এ’ব্যাটা তো মাল ছেড়ে দেবে বলছে, ঠিক আছে। দিয়ে দে সব মাল।‘
ব্যস ভাইয়া, একটা ঝোলা। তার মধ্যে খানিকটা ছাতু ছিল, আর একটা চমৎকার মোরাদাবাদী লোটা।মামাবাড়ি থেকে পাওয়া। ফাস্ট কিলাস সুতোর বুনুনি। সে কী লোটা, বালতি বললেই হয়। কুয়ো থেকে দুই সের জল তোলা যেত।আসল ঘিয়ে ভাজা একতাড়া পুরি। তখন শালার ডালডা বনস্পতির চল ছিলনা। ব্যাটারা সব গুনে গুনে নিয়ে নিল। তারপর ধুতি খুলতে বলল, গেঁজেতে একটা টাকা ছিল, তাও ছাড়েনি। যখন খালি ল্যাঙোট পরে কুর্তা গায়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, এক ব্যাটা বলল, ‘এবার মুখে কুলুপ এঁটে সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা দাও।চুঁ-চাঁ করেছ কি এই বাগানে পুঁতে রেখে দেব’।
আমি রওনা দিচ্ছি তো একজন হেঁকে উঠল,’ বাড়ি কোথায়’?
বললাম--আমি একজন গঞ্জহা(শিবপালগঞ্জ নিবাসী)।
তারপর ভাই, কি আর বলব, সবক’টা লুটেরে এ ওর মুখের দিকে তাকায়। কেউ আমাকে শুধোয় -শিবপালগঞ্জের মুখিয়ার নাম বল।
আরেকজন আমার পরিবারের কর্তার নাম জানতে চায়। তিননম্বর বলে- দুরবীন সিং? ওনাকে চেন?
আমি বললাম,’সেবার দূরবীন সিং এর দলের হয়ে লাঠিও চালিয়েছি।ওই যখন রঙপুরে দু’পক্ষেই বড় জমায়েত হয়েছিল। সকালে সূয্যি না উঠলে ওখানে অন্ততঃ হাজার লোকের লাশ পড়ত।উনি আমার গ্রামসম্পর্কে কাকা’।
ওরে ব্বাবা! রাম-রাম সীতারাম! যেন কালো মানুষের ভিড়ে কোন গোরা মিলিটারি সাহাব ঢুকে পড়েছে। হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল। কেউ আমার ধুতি ফিরিয়ে দিচ্ছে, তো কেউ জামাজুতো। একজন ঝোলা ফেরত দিয়ে গেল। আর একজন হাত জোড় করল,” তোমার দুটো পুরি খেয়ে ফেলেছি, এর পয়সা নিয়ে নাও।কিন্তু দূরবীন সিং যেন জানতে না পারেন যে আমরা তোমাকে ঘেরাও করেছিলাম। চাইলে আরও ক’টা টাকা নাও। বল তো পেট চিরে পুরি বের করে দিচ্ছি।আমরা কি জানতাম যে তুমি একজন ‘গঞ্জহা’?
তারপর ওরা আমাকে আমাদের গাঁয়ের পুকুরপাড় অব্দি এগিয়ে দিল। অনেক কাকুতি-মিনতি করল। আমিও ওদের বুঝিয়ে সুজিয়ে চোখের জল মুছিয়ে বললাম- আরে তুমি হলে আমার ঘরের লোক। দুটো পুরি খেয়েছ তো কী হয়েছে? আরও দুটো খাও।
লোকটা পালিয়ে গেল। বলে গেল,’ ঢের হয়েছে দাদা! আর না। কী করে জানব যে তুমি ‘গঞ্জহা’? ব্যস, দাদা! দূরবীন সিং যেন জানতে না পারেন’।
আমি বললাম—বাড়ি চলো। জল-টল খাবে। খিদে পেলে দুটি ডাল-ভাত খেয়ে নেবে। কিন্তু ও শুনল না। বলল,’দাদা, এবার ভাইকে যেতে দাও। তুমিও বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়, আর কাল সকাল নাগাদ সব ভুলে যেও, কেমন? তবে কাউকে কিছু বোলনা যেন।‘
তো ভাইয়া, আমি ঘরে গিয়ে বিছানায় লম্বা হলাম। ভোরের আলো ফুটতেই দূরবীন সিংয়ের বাড়ি গিয়ে ওনার পা’ জড়িয়ে ধরলাম। কাকা, কাল রাত্তিরে তোমার নাম নেওয়ায় লাল-ল্যাঙোটধারী দেবতার আশীর্বাদ পেয়েছিলাম। তোমার নাম নিয়েই প্রাণে বেঁচে ফিরেছি।
উনি পা’ সরিয়ে নিয়ে বললেন- ‘যা ব্যাটা শনিচরা! কোন চিন্তা করিসনা। যতদিন আমি আছি, আলো-অন্ধকারে দিন-রাত্তিরে যেখানে ইচ্ছে ঘুরে বেড়াস, কোন কিছুতেই ভয় পাস না। সাপ-বিচ্ছু তো তুই সামলে নিবি, বাকিদের সামলানো আমার উপর ছেড়ে দিস’।
এবার শনিচর একটা বড় করে শ্বাস টানল, তারপর চুপ মেরে গেল। রঙ্গনাথ বুঝল যে শনিচর এখন বটতলা-মার্কা নভেলের লেখকদের মত আসল কথায় আসার আগে সাসপেন্স তৈরি করছে। ও ভালোমানুষের মত বলল,’তাহলে তো যতদিন দূরবীন সিং বেঁচে ছিলেন ততদিন ‘গঞ্জহা’ লোকজনের খুব পায়াভারি’?
রূপ্পনবাবু মুখ খুললেন, এবং রঙ্গনাথের সামনে প্রথমবার কোন সাহিত্যিক পংক্তি ঝাড়লেন। উনি শ্বাস টেনে গম্ভীর হয়ে আওড়ালেনঃ
“কি পুরুষ বলী নহিঁ হোত হ্যায়, কি সময় হোত বলবান।
কি ভিল্লন লুটী গোপিকা, কি ওহি অর্জুন ওহি বাণ”।।
‘পুরুষকার নয়, পাল্লাতে মহাকাল পড়ে যায় ভারী,
অর্জুনের হাতে সেই গাণ্ডীব, তবু লুঠ হয়ে যায় গোপীনারী”।।
রঙ্গনাথ ফুট কাটে,’ কী হোল রূপ্পনবাবু, শিবপালগঞ্জ থেকে তোমার গোপিকা কেউ হরণ করেছে নাকি’?
রূপ্পনবাবুর হুকুমঃ ‘শনিচর, তোমার অন্য গল্পটাও শুনিয়ে দাও’।
শনিচরের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হল।
“ ভাইয়া, লেঠেলের কাজ তো এসেম্বলীর মত হতে পারেনা। এসেম্বলীতে তুমি যত বুড়ো হবে, যত তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি যত লোপ পাবে—ততই তুমি উপরে উঠতে থাকবে। এই এম এল এ হরমন সিংকে দেখ।উঠে দাঁড়ালে ভয় হয় -মুখ থুবড়ে পড়লো বুঝি! কিন্তু না, রাজনীতিতে দিনের পর দিন ওনার ওজন বাড়ছে। কিন্তু লেঠেলদের ব্যাপারটা সেরেফ কলজের জোরের ব্যাপার। যতদিন চলছে ততদিন ঠিক। যেদিন চলবে না , সেদিন সোজা হালাল হয়ে যাবে।
এই পাঁচ-ছ’বছর আগের কথা। কার্তিক-স্নানের জন্যে গঙ্গার ঘাটে গেছলাম। ফেরার সময় ভোলুপুরের কাছে রাত হয়ে গেল।ফুটফুটে চাঁদনী রাত। বাগানের মধ্যে দিয়ে আসার সময় গুনগুনিয়ে একটা চৌপদী গাইতে শুরু করেছি কি পেছন থেকে পিঠের ডানদিকে একটা লাঠির বাড়ি পড়ল। কোন কথাবার্তা নয়, কোন রাম-রাম নমস্কার-চমৎকার নয়, সোজা লাঠির বাড়ি! ভাইয়া, চৌপদী যে কোথায় পালাল কে জানে, কিন্তু আমার কাঁধের ঝোলাটি ছিটকে পড়ল বিশ হাত দূরে। হাতের লাঠিও পড়ে গেছে। চেঁচাতে গেছি তো তিনটে লোক আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একজন মুখটা চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলল,’ চুপ সালে! ঘাড় মটকে দেব’। ভাবলাম লাফিয়ে উঠি, কিন্তু ভাব যদি কেউ পেছন থেকে লাঠি মারে তো স্বয়ং গামা পালোয়ানও কাত হবেন, আমি কোন ছার! খানিকক্ষণ মুখ বুঁজে পড়ে থেকে হাতে পায়ে ধরে মিনতি করলাম-মুখ খুলে দাও, চেঁচাব না কথা দিচ্ছি। তখন মুখের কাপড় খুলে দিয়ে একজন বলল- টাকাকড়ি কোথায় রেখেছ?
আমি বললাম, ‘বাপু, যা কিছু আছে সব এই ঝোলায়’।
ঝোলায় দেড় টাকা খুচরো ছিল। এক ডাকাত সেগুলো হাতে ঠুন ঠুন করে বলল—ল্যাঙ্গোট খুলে দেখাও।
বললাম, ‘ওটা খুলিও না। ওর নীচে কিস্যু নেই। একেবারে ন্যাংটো হয়ে যাব’।
আর যায় কোথা! ব্যাটাদের মেজাজ বিগড়ে গেল। ভাবল আমি বোধহয় ঠাট্টা করছি । তারপর তো শরীরের সবকিছু খুলিয়ে এমন তল্লাসি চালাল যে গাঁজা-ভাঙের খোঁজে পুলিশের তল্লাসিও হার মানবে। যখন কিছুই পেল না তখন এক ব্যাটা আমার পেছনে এক লাথি মেরে বলল—চুপচাপ মুখ বন্ধ রেখে নাক বরাবর চলে যা, গিয়ে সোজা নিজের খোঁয়াড়ে ঢুকে পড়।
ততক্ষণে আমার জিভের সাড় ফিরে এসেছে। বললাম,” দেখ বাপু, তোমরা যে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ, ভাল করেছ। মালপত্তর নিয়ে নিলে, তাও কিছু বলব না। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখ, তোমরা কিন্তু নুন থেকে নুন কেড়ে খাচ্ছ। তোমরা যদি সরকারের, তো আমিও দরবারের লোক”।
ওরা এবার আমার কাছ ঘেঁষে এসে নানান প্রশ্ন করতে লাগল। যেমন, আমি কে বটি? কোথায় থাকি? কার শাকরেদ এই সব।
আমি বুক ফুলিয়ে বললাম—আমি একজন গঞ্জহা, ঠাকুর দূরবীন সিংয়ের চ্যালা।
আর বোল না রঙ্গনাথ ভাই। শোনা মাত্র ওরা খ্যাক-খ্যাক করে হেসে উঠল। একজন আমার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারল। আমি খালি ভাবছিলাম যে এবার কী হবে, তো ব্যাটা আমাকে ল্যাং মেরে চিৎ করে ফেলল।
আমি শরীরের ধূলো ঝেড়ে টেরে দাঁড়ালাম। এক ব্যাটা কমবয়েসি সাজোয়ান ডাকাত বলে কি—এই দূরবীন সিং আবার কোথাকার কে?
অমনি সবাই খি-খি করতে লাগল।
এবার আমার পালা।
“সেকী, দূরবীন সিং কে জাননা? বাইরে থেকে এসেছ বুঝি? এদিকে দশ কোশের আশেপাশে কেউ গঞ্জহাদের সঙ্গে লাগতে আসেনা। দূরবীন সিং এর গাঁয়ের লোকজনকে সবাই সমঝে চলে। কিন্তু বাপু, তুমি যখন ওনার নামই শোননি, তো কী আর বলব, নিয়ে যাও আমার ঝোলা”।
“ ডাকাতগুলো ফের খিক-খিক শুরু করল। তবে একজন বলল যে নাম শুনেছে।কিন্তু এখন আর দূরবীন সিংয়ের সেদিন নেই। বুড়োগুলো সব একটু-আধটু লাঠিবাজি দেখিয়ে ্নিজেদের ভারি ওস্তাদ মনে করত।এদের ওই দূরবীন সিংও লাঠি চালিয়ে দু’চারটে বাড়ির পাঁচিল টপকে মস্ত বাহাদূর হয়ে গেছল। এখন গেঁড়িতে চড়ে দেয়াল টপকানো তো বাচ্চারা স্কুলেই শিখে নেয়।
এক ডাকাত বলল, লাঠি চালানোর বিদ্যেটাও আজকাল স্কুলেই শেখা যায়। আমিও ওভাবেই শিখেছি।
আগের নওজোয়ান বলল,’তো ওই দূরবীন সিং হলেন তোমাদের গুরুঠাকুর? শালার কাছে একটা দেশি পিস্তলও নেই, এদিকে এলাকা আগলে রাখার শখ’!
এক ব্যাটার হাতে ছিল চোরবাতি(টর্চ)। ও পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে বলল,” দেখে নে ব্যাটা। এই হল ছ’ঘরা। দেশি পিস্তল নয়, আসল বিলায়তি মাল’। বলতে বলতে ও পিস্তলের নল আমার বুকে ঠেকিয়ে দিল। তারপর বলল,’যা, গিয়ে তোর বাপকে বল গে’--অন্ধের দেশে কাণা রাজা হওয়ার দিন শেষ। এখন ওর খাটিয়ায় পড়ে থেকে কাঁদার দিন। যদি দিনে রাতে কখনও চোখে পড়ে তো মাথার খুলি উড়ে যাবে। বুঝলি ব্যাটা ফকীরেদাস’?
এরপর ভাইয়া,আমার শরীরে এমন তেজ এসে গেল যে নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। হাতের লাঠি ওখানেই ফেলে হরিণের বেগে ছুট লাগালাম। পেছনে ওদের হাসির খ্যা খ্যা আওয়াজ আমায় যেন তাড়া করছিল। একজন বলল,’মার শালার দূরবীন সিংকে।এই, দাঁড়া বলছি, দেখ তোকে যদি মেরে মেরে দূরবীন না বানাই’।
কিন্তু ভাই, এ তল্লাটে কেউ আমায় দৌড়ে হারাতে পারেনি। আজকাল স্কুল-কলেজের ছেলে-ছোকরাদের সিটি বাজিয়ে বাজিয়ে দৌড়ুতে শেখায়। আমি কোথাও না শিখেই এমন দৌড় লাগাই যে খরগোশ বেচারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোয়। ভাই, ওরা খুব খারাপ খারাপ গাল পাড়ল , কিন্তু দৌড়ে আমার নাগাল পেলনা। কোনরকমে ঘরে পৌঁছলাম। দূরবীন সিংযের তখন সত্যিই দিন শেষ। পুলিসও ভেতরে ভেতরে ওঁনার বিরুদ্ধে চলে গেছল। পরের দিন আমার পেট গুড়গুড় করল, কিন্তু আমি ওই ঘটনাটি আর ওনাকে জানাইনি। বললে হয়ত দূরবীন কাকা শক লেগে তক্ষুনি টেঁসে যেত’।
রূপ্পনবাবু এতক্ষণ ওনার দুঃখী দূঃখী চেহারাটা একটা ভারি ঝোলার মতন শরীরে টাঙিয়ে রেখেছিলেন। একটা বড় নিঃশ্বাস টেনে বললেন—হলে ভালই হত। তখনই টেঁসে গেলে পরে আর ভাইপোর হাতে মরতে হতনা।