ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক৩৩
পরের দিন একবারও ফাইনহালস মেয়েটির দিকে দূরবীন তাক করে দেখেনি। যদিও সে শুনতে পেয়েছিল যে মেয়েটি গান গাইছে এবং ঘুরে ফিরে অস্ফুটে একটা সুর গুনগুন করে যাচ্ছে। সে পাহাড়ের দিকেই দেখতে লাগল সারাক্ষণ। তাঁর মন খুশিতে ভরে উঠল যখন সে পাহাড়ের মাথায় একপাল ছাগল চরতে দেখতে পেল। গির্জার চুড়ার পেছনে ডান দিকে অনেকগুলো সাদা সাদা বিন্দু ঘুরে বেড়াচ্ছে আগে পিছে পাহাড়ের ধূসর সবুজ জমির উপরে। হঠাৎ সে দূরবীন নামিয়ে রাখল। পাহাড়ের দিক থেকে গুলিগোলার শব্দ ভেসে এল একবার।
তারপর আবার একটা শব্দ। একদম পরিষ্কার শোনা গেল। খুব জোরে নয়; অনেকটা দূরে হয়তো। ব্রিজের উপরে যেসব শ্রমিকেরা কাজ করছিল, তারা কাজ বন্ধ করে থমকে দাঁড়াল। স্লোভাক মেয়েটির গুনগুন গান থেমে গেল। লেফটেন্যান্ট মুক দৌড়ে চলে এল। দূরবীনটা ফাইনহালসের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিজে তাক করল পাহাড়ের দিকে; অনেকটা সময় ধরে দেখতে লাগল সে। নাহ, আর কোনো শব্দ শোনা গেল না। মুক ফিরিয়ে দিল তাকে দূরবীনটা… ‘সাবধানে কিন্তু এখন… দেখতে থাকুন সমানে, দেখতে থাকুন’ মৃদুস্বরে বলে সে দৌড়ে গেল উঠোনে। সেখানে অন্যান্য সৈনিকরা বন্দুকগুলো পরিষ্কার করছিল। সেসব তদারক করতে লাগল মুক।
অন্যান্য দিনের তুলনায় সেদিনের বিকেলটা বেশ চুপচাপ, থমথমে হয়ে উঠল। যদিও শ্রমিকদের কাজ করার শব্দ, ধাতু কাটা, জোড়া, স্ক্রু লাগানো ইত্যাদি সবই শোনা যেতে লাগল। একতলায় বয়স্ক নারীর কণ্ঠস্বর রান্নাঘর থেকে শোনা যাচ্ছিল। সেই নারী সমানে তার কন্যার সংগে কথা বলে যাচ্ছিল, যদিও একতরফা কথা, কারণ কন্যা কোনো কথার জবাব দিচ্ছিল না। টেমানদের বাড়ির রান্নাঘরের জানালা থেকে স্লোভাক মেয়েটির গুনগুন গান গাওয়ার শব্দ ভেসে আসছিল। মেয়েটি শ্রমিকদের জন্য রাতের খাবার বানাতে বানাতে গান গাইছিল। বিশাল কড়াইতে বড় বড় আলু সাঁতলানো হচ্ছিল, মাটির পাত্রে টমেটো সাজিয়ে রাখা হচ্ছিল; বিকেলের আলোয় খাবারগুলো খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল।
ফাইনহালস পাহাড়ের দিকে দেখতে লাগল; দূরবীন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল জঙ্গলের দিকে, নদীর পাড়ের দিকে। চারদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। কোনো কিছু নড়ছে না কোথাও। দু’জন সান্ত্রী, যারা রাতে টহল দেয়, তারা জঙ্গলের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। ফাইনহালস শ্রমিকদের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। ওদের কাজ প্রায় শেষের মুখে। বিম দিয়ে তৈরি কালো জমাট রাস্তাটা দুদিক থেকে শুরু হয়ে মাঝে এক জায়গায় এসে জুড়ে যাওয়া একটু বাকি। দূরবীনের কাচ একটু নামিয়ে সে দেখতে পেল যে রাস্তার উপরে সব জিনিসপত্র জড়ো করে রাখা হচ্ছে। শ্রমিকদের কাজের যন্ত্রপাতি, ঠেলাগাড়ি, বিছানাপত্র, চেয়ার, রান্নার চুলা ইত্যাদি। কিছুক্ষণের মধ্যে টেসার্জি থেকে একটা গাড়ি এলো। সব জিনিসপত্র নিয়ে আট জন শ্রমিক চলে গেল সেটায় চড়ে। স্লোভাক মেয়েটা জানালায় বসে তাদের দিকে হাত নাড়ল। জায়গাটা আরেকটু চুপচাপ হয়ে গেল। সন্ধের দিকে নদীতে মোটরবোট নিয়ে সৈনিকরা টহল দিতে বেরল। ব্রিজের মাঝের প্রায় মিটার দুয়েক পথ জুড়ে যাওয়া বাকি। খুব বেশি হলে তিন চারটে বিম বসবে ওইখানে। শ্রমিকেরা সেদিনের মত কাজ বন্ধ করল। ফাইনহালস লক্ষ্য করল যে ওদের সব যন্ত্রপাতি ব্রিজের উপরেই রাখা আছে। টেসার্জি থেকে গাড়িটা ফেরত এল। রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছোট ঝুড়িতে ফল এবং কিছু বোতল নামাতে লাগল তারা গাড়ি থেকে। কিছু সময়ের মধ্যেই ফাইনহালসের ডিউটি শেষ হবে। ডিউটি শেষ হবার আগেই আবার একটা বিরাট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এল। নাটকে যেমন বাজ পড়ার শব্দ হয়, ঠিক সেরকম তিন চার বার পাহাড়ের দিক থেকে ভেসে এসে প্রতিধ্বনিত হয়ে ভেঙে ভেঙে গুমগুম করে ছড়িয়ে পড়তে লাগল শব্দটা। তারপর সব চুপচাপ। তারপর আবার ছুটে এল লেফটেন্যান্ট মুক। মুকের মুখটা কুঁচকে আছে। চোখ রাখছে সে দূরবীনে; বাম থেকে ডাইনে, পাহাড়ে, পাথরে, জংগলে চারদিকে দেখে যাচ্ছে লেফটেন্যান্ট। মাথা নাড়ছে বারবার। নামিয়ে রাখল সে দূরবীনটা। একটা কাগজের টুকরোতে কী যেন লিখল সে; অল্পক্ষণ পরেই ডয়সেনের সাইকেলে চেপে গ্রেস গেল টেসার্জির দিকে।
গ্রেস বেরিয়ে যাবার পরে পাহাড়ের দিক থেকে মেশিনগানের লড়াইয়ের শব্দ পরিষ্কার শুনতে পেল ফাইনহালস। রাশিয়ান মেশিনগানের করাতের মত খ্যাসখেসে কর্কশ চাপা শব্দের বিপরীতে জার্মান মেশিনগানের স্নায়ু অবশ করা তীব্র শব্দ। মনে হচ্ছে বন্দুকের ব্রেকগুলো কেউ পাগলের মত পিষে যাচ্ছে… পিছলে অবিরাম বেরিয়ে আসছে গুলি। তবে এই যুদ্ধ বেশিক্ষণ চলল না। অল্প কয়েক বার চাপান উতোরের পরে তিন চারটে হ্যান্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণের শব্দ; সেই শব্দের প্রতিধ্বনিগুলো সংখ্যায় বাড়তে বাড়তে এবং তীব্রতায় ফিকে হতে হতে পাহাড়ের মাথা থেকে জঙ্গলে, সমতলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। পুরো বিষয়টা ফাইনহালসের কাছে কিছুটা হাস্যকর বলে মনে হচ্ছিল। সে লক্ষ্য করেছে, যখনই যুদ্ধ বাঁধে, তখনই লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক বেশি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় শব্দ শোনা যায়। এবার আর শব্দ শুনে মুক দৌড়ে এলো না। সে ব্রিজের উপরে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আরেকটা গুলির শব্দ শোনা গেল। হয়তো এটা রাইফেলের গুলি; প্রতিধ্বনিত শব্দটা একটা ছোট নুড়িপাথর গড়িয়ে পড়ার মত হালকা আওয়াজ। তারপর সন্ধে নেমে আসা অবধি সব চুপচাপ। ফাইনহালস দূরবীনের জানালাটা একটা ধাতব পাত দিয়ে ঢেকে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল।
গ্রেস এখনও ফিরে আসেনি। নিচে খাবার ঘরে মুক বেশ উত্তেজিত একটা ভাষণ দিল, যার মর্মার্থ হচ্ছে যে রাতে সবাইকে সজাগ এবং সতর্ক থাকতে হবে। সে সম্পূর্ণ যুদ্ধসাজে সেজে ভয়ানক গম্ভীর মুখ করে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করল। তার বুকে পদকগুলো সাঁটা আছে, কাঁধে মেশিনগান, বেল্ট থেকে ঝুলছে ইস্পাতের হেলমেট। গ্রেস ফিরে আসবার আগেই টেসার্জি থেকে একটা ধূসর রঙের গাড়ি এলো; গাড়ি থেকে নামল এক লালমুখো মোটাসোটা ক্যাপ্টেন এবং রোগাপাতলা কাঠ কাঠ কঠোর চেহারার এক ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট। মুকের সঙ্গে তারা ধীরে সুস্থে গিয়ে ব্রিজের উপরে উঠল।
টেমানদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ফাইনহালস লক্ষ্য করল যে তারা যাচ্ছে। দূর থেকে তিনজনকে দেখে মনে হচ্ছিল যে তারা বিষয়টা বুঝে নেবার জন্য আরেকটু এগোবে। কিন্তু দেখা গেল যে তারা ফিরে আসছে। ডয়সেন তার ঘরের জানালা দিয়ে দেখছিল। টেমানদের বাড়ির একতলায় শ্রমিকেরা তাদের রান্নাঘরে একটা খড়খড়ে পুরনো টেবিল ঘিরে আধো অন্ধকারে বসে খাচ্ছিল। তাদের প্লেটে আলু, টমেটো। রান্নাঘরের এক কোণে স্লোভাক মেয়েটা এক হাত কোমরে রেখে, আরেক হাতে একটা সিগারেট নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুখটা সিগারেটের কাছে নিয়ে এসে, মেয়েটা একটু বেশিই যেন শরীরটা ঝাঁকিয়ে দেখানেপনা করছে; এমনটাই মনে হল ফাইনহালসের। তারপর যখন অফিসারেরা চলে যাচ্ছেন, ধূসর গাড়িটা স্টার্ট নেবে, ঠিক তখনই রান্নাঘরের জানালায় সিগারেটটা রেখে দিয়ে মেয়েটা ফাইনহালসের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে হাসল। ওই মেয়েটার দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে অফিসারদের অভিবাদন করতে ভুলে গেল ফাইনহালস। মেয়েটা জানালা থেকে একটু নিচু হয়ে তাকিয়েছিল; তার গাঢ় রঙের অন্তর্বাসের ভিতর দিয়ে দৃশ্যমান বিভাজিকা; স্লোভাক মেয়েটার বাদামি মুখের নিচে সাদাটে স্তনের আভাস হৃদয়চিহ্নের আকারে জেগে আছে।
মুক ফাইনহালসের সামনে দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকে মিসেস সুজানের বাড়িতে ঢুকে গেল; সে বলতে বলতে গেল, ‘মেশিনগানটা নিয়ে আসবেন ভেতরে…’।
ফাইনহালস দেখতে পেল যে গাড়িটা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে রাস্তায় রাখা আছে একটা অস্ত্রের বাক্স এবং পাশেই একটা সরু কালো মেশিনগান শোয়ানো আছে। ফাইনহালস ধীরে ধীরে রাস্তা পেরিয়ে মেশিনগানটা নিয়ে বাড়িতে ঢুকে গেল; আবার ফিরে এসে বাক্সটা নিয়ে গেল ভিতরে। স্লোভাক মেয়েটা তখনও জানালায় এলিয়ে বসে আছে। সিগারেট থেকে জ্বলন্ত ছাইটা ফেলে দিয়ে সেটা ঘষে নিবিয়ে বাকিটুকু সে রেখে দিল তার অ্যাপ্রনের পকেটে। সে এখনও তাকিয়ে আছে ফাইনহালসের দিকে; তবে আর হাসছে না। মেয়েটাকে হঠাৎ খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে; অল্প হাঁ হয়ে থাকা মুখের ঠোঁটদুটো যন্ত্রণাকাতর উজ্জ্বল লাল হয়ে উঠেছে। তারপর হঠাৎ করেই মেয়েটা নিজের ঠোঁট কুঁচকে মুখটা বন্ধ করে পেছন ফিরে কাজ করতে শুরু করল। খাবার টেবিলটা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শ্রমিকেরা খাওয়া সেরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ব্রিজের দিকে হাঁটতে শুরু করল। ফাইনহালস যখন ব্রিজের উপরে মেশিনগান হাতে নিয়ে গেল আধঘণ্টা পরে, তখনও শ্রমিকেরা সেখানে কাজ করছিল। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। তার মধ্যেও ওরা কাজ করে যাচ্ছে সেতুর উপরে শেষ বিমটা জুড়ে দেবার জন্য। ডয়সেন নিজের হাতে শেষ জোড়ের স্ক্রু লাগাচ্ছে। কার্বাইড ল্যাম্প জ্বালিয়েছে সে কাজটা শেষ করবার জন্য। ডয়সেন যেভাবে রেঞ্চ ঘোরাচ্ছিল, ফাইনহালসের মনে হল সে যেন ব্যারেল অরগানের* হাতল ঘোরাচ্ছে। একটা বিশাল কালো বাক্সের মত দেখতে যন্ত্রাংশে সে ড্রিল করছিল, অথচ কোনো শব্দ হচ্ছিল না। ফাইনহালস মেশিনগানটা নামিয়ে রেখে গ্রেসকে বলল… ‘এক মিনিট… এখনই আসছি…’
(চলবে)
*ব্যারেল অরগান- প্রাচীন ইউরোপীয় বাদ্যযন্ত্র, পাইপ অরগানও বলা হয়। যন্ত্রটির পাইপের মধ্যে যে সুর বাজানো হবে, সেই সুরের স্বরলিপি পিনের সাহায্যে আগে থেকেই গেঁথে অর্থাৎ প্রোগ্রাম করে রাখা থাকে। যন্ত্রের হাতল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুর বাজানো হয়। সাত থেকে দশটির বেশি সুরের অংশ একটা মাঝারি আকারের ব্যারেল অরগানে এক বৈঠকে বাজানো সম্ভব নয়।