ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(৯)
মাঝরাতে একটা নারীকন্ঠের কান্না সহ আর্তনাদে গোলকপতির ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। পরক্ষণেই সে বুঝল যে এই আওয়াজটি আসলে অন্দরমহলের আঁতুড়ঘর থেকে ভেসে আসা প্রসববেদনা সহ কোন মহিলার তার সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় ধ্বনিত হচ্ছে। তার মানে রাজবাড়ির ভিতরে তাহলে আবার একটি নতুন প্রজন্মের শুভাগমন ঘটল।
বিস্ময়ের ঘোর কাটলে ওর মনটা সাথে সাথে এক গভীর বিষাদবেদনায় যেন কেঁদে উঠল।
আজ তার স্ত্রী লক্ষ্মীমণি বেঁচে থাকলে তার মত এই অভাগার জীবনেও হয়ত এরকম প্রসববেদনা সহ একটি সদ্যোজাত শিশু কন্ঠের কান্নার ঢেউ উঠতে পারত, যা আর আপাতত শুনতে পাওয়াটি আদৌ সম্ভব নয়।
....
এখানে এসে মাস তিনেক স্থিতু হওয়ার পর ওর অন্নদাতা তথা বর্ধমান রাজবংশটির ইতিহাস সহ বেশ কিছু গোপন কথা এর মধ্যেই ওর বেশ কর্ণগোচর হয়েছে।
সুদূর লাহোরের এই পরিবারটির সাথে বঙ্গালের সম্পর্ক মাত্র আট পুরুষের। একদা শ্রীক্ষেত্র দর্শনের পথে যে পঞ্জাবী বণিক সঙ্গম রাই নামক ভাগ্যাণ্বেষী যুবা ও তার পরিবারটি অদূরের বৈকুন্ঠপুরে এসে বসতি গঠন করে ও ভাগ্যবলে, নানা ঘাতপ্রতিঘাতের পর মাত্র তৃতীয় প্রজন্মেই এদের বংশটির ভাগ্যের চাকা ঘুরে স্বয়ং মোগল সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে মোটা বখশিস্ পেয়ে আস্তে আস্তে বাংলায় সুবাহদারের পদে বহাল হয়ে জাঁকিয়ে বসে। ফলতঃ জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর বর্ধমানের নামানুসারে জনপদটিতে ক্রমে শুরু হয় এই "মহতবচাঁদ" বংশের ধারাবাহিক শাসন।
এর মধ্যে বিভিন্ন উত্থান পতনের পর ১৭৪৪ সালে এই বংশের কৃতী জমিদার তিলকচাঁদ বাহাদুরের আবির্ভাব যেন এই রাজবংশটিকে সুবে বাংলার এক অন্যতম পরিবারে পরিণত করতে থাকে। তার পরিণামেই রাণীমা বিষণকুমারী একই ভাবে স্বামীর অবর্তমানে জড়িয়ে পড়লেন ঘোর জটিল ও কুটিল রাজনীতির পঙ্কিল সলিলে। সেই রাণীমাই যে হয়ে উঠবেন গোলকপতির ভাগ্যের সহায় সেটা যেন এক অলীক গল্পকথা।
........
রামমোহনের ইদানীং নিদ্রাবেশ কমে গিয়ে অতি প্রত্যূষ থেকেই শাস্ত্রসাগর মন্থনে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। খানাকুল উদ্ভূত এই যুবকটি আপাতত সতীদাহের বিপক্ষে বেশ কিছু সপ্রমাণ -উদ্ধৃতি যোগাড় করতে সচেষ্ট। তার দৃঢ় বিশ্বাস যে এই সব প্রমাণগুলোই ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তার হাতিয়ার হয়ে উঠতে আর বেশী দেরী নেই।
শহর কলকেতা আর তার পাশ্ববর্তী জেলাগুলোতে তার এই কর্মপ্রচেষ্টা ও সতীদাহ বিরোধী উৎসাহটিকে মোটেও সুখকর চোখে দেখছেন না তাবড় সমাজপতিরা।
এর সাথে আবার যুক্ত হয়েছে কিছু প্রভাবশালী ও ধনী জমিদারবর্গের সক্রিয় বিরোধাভাসটিও। তাদের বৃহদাংশ এখন ব্রাহ্মণদের ক্ষেপিয়ে দিয়ে ওদের অনুগত জনতাকে ক্রমাগত উস্কানি দিয়ে রামমোহনকে পর্যদুস্ত করার চেষ্টায় রত।
যদিও রামমোহন এতে দমবার পাত্র নয়।
এতকিছুর মধ্যেও সে পরিবার প্রতিপালনে বেশ সফল। পারিবারিকভাবে তা পিতার সাথে সামান্য বিরোধাভাস থাকলেও সে সপরিবারে বেশ সুখকর জীবনে অধিষ্ঠিত। এর মধ্যে সম্প্রতি সে একটি পুত্র সন্তানের পিতৃত্ব লাভে বিশেষ গৌরবাণ্বিত। সদ্যজাতটির স্মিত মুখশ্রীটি দেখলেই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে তার এই প্রিয় সন্তান "রাধাপ্রসাদ' এর বড় হয়ে ওঠার পৃথিবীর আকাশটিকে নির্মল ও কুসংস্কারমুক্ত করতে তাকে চেষ্টা করতে হবে ও সফল হতেই হবে।
অবশ্য হিন্দুদের চিরাচরিত ছোঁয়াছুঁয়ি, উচ্চ-নীচ বিভেদ ও পৌত্তলিকতার বিপ্রতীপে গিয়ে তাদের মত কিছু মানুষের বদান্যতায় আদি ব্রহ্ম উপাসনার ক্ষেত্রটিও সবেমাত্র যেমন শুরু হয়েছে, ঠিক তেমনই একে একে অন্য আধুনিক ভাবধারাগুলির প্রবর্তনটিও ঠিক সমানভাবে জরুরী।
পরশু একবার বর্ধমানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা প্রয়োজন। যদিও মহারাজ তেজচন্দ্র তার সম্পূর্ণ অনুকূলে নন তাও এইসব সামন্তপ্রভুদের কিছুটা হলেও পাশে পেলে কাজটা ত্বরান্বিত হবে। এই বছর খোদ ইংল্যন্ডের আইনসভায় সতীদাহ বিলোপের বিলটি পাশ করানো যায়নি। তাই পরবর্তী অধিবেশনের আগে এটিকে পাশ করানোর উপযোগী জনমতটিকে দ্রুতগতিতে পেশ করানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
মধ্যযুগের পর্যটক আল-বেরুণীর ভ্রমণবৃত্তান্তটি মূল ফারসী ভাষায় পাঠ করতে গিয়ে তাকে বহুবার শিহরিত হতে হয়েছে। বিগত তিন-চারশ বছরেও হিন্দুস্তানের সামাজিক আবহাওয়া এক জায়গায় বদ্ধ হয়ে আটকে আছে সেটা যেন আদপেই মেনে নেওয়া যায়না। অশিক্ষার থেকেও কুশিক্ষা যেন দেশবাসীকে ঘাড় ধরে পদানত করে রেখেছে। এটাই তাকে আরো বেশী ভাবিয়ে তুলেছে।
টেবিলের উপর জলখাবারে আসা তক্র পান করার সাথে আখরোট ও কাঠবাদামের স্তুপটি থেকে সামান্য কয়েকটি মুখে তুলতেই সহাস্যে মিত্রবর দ্বারকানাথকে তার বৈঠকখানায় প্রবেশ করতে দেখে সে খুশী হল। দ্বারকানাথ আজ বেশ খুশী খুশী দৃষ্টিতে রামমোহনকে দেখে -
" অহঃ বেরাদর! একা একা এসব আহার মোটেও স্বাস্থ্যকর নয় হে! " বলে হাসিমুখে তার দিকে এগিয়ে আসতেই সে আখরোটের ভৃঙ্গারটিকে সপ্রশ্রয়ে তার দিকে এগিয়ে দিল।