গল্প - ময়ূরী মিত্র
Posted in গল্পশীতের সন্ধেতেও আজ গরম ৷ রোগীর ঘরের জানলাগুলো হাট করে খুলে দিয়েছেন সেবিকা ৷ তাঁর রোগী বড়ো ঘামে আর ঘেমে গেলেই আর্তনাদ করতে থাকে ৷ খুব মোটা তো -- ঘামে বড়ো হাঁফায় মানুষটা ৷ রোগীর মুখটা ভালো করে মুছিয়ে কপালের ঠিক মধ্যখানে একটা অর্ধ চাঁদের মতো লাল টিপ পরিয়ে দেন ৷ ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক ৷ রোগীর এই দুটিই শখ --গোল নয় --চাঁদের মতো দেখতে যুবতীদের টিপ এবং ঠোঁটরঙ ৷ সেবিকা বোঝেন --টিপ আর লিপস্টিক পরে বুড়ি মানুষটা কিছুসময় হয়ত ফেরত চায় তার যৌবন --তার সমর্থ দুটো পা ৷ সেবিকার রোগীর মূল রোগ --তিনি পদক্ষেপ হারিয়েছেন ৷ পা থাকতেও কী করে পা ফেলে ফেলে হাঁটতে হয় ভুলে গেছেন ৷ তাঁর এখনকার স্মৃতিবিন্যাস ঠিক এতখানিই বিট্রে করেছে তাঁর সঙ্গে ৷
আবার যখন ফুর্তি আসে --- স্বামী এসে চুলে হাত বোলান তখন একগাল হেসে স্বামীর সঙ্গে গাদাখানেক ঝগড়া করেন রোগী ৷ সেবিকার বাড়ির গাছপাতাটির অব্দি খোঁজ নেন বুড়ি ৷ এই যেমন আজ সকালে সেবিকা যখন রোগীর চুল বব করে কেটে শ্যাম্পু দিয়ে মাথা সাফ করে দিচ্ছিলেন -- কত যে কথা কইছিল সারা দিনমান স্তব্ধ হয়ে থাকা রোগী ৷
----- হ্যাঁ রে --এমন পুকুর পুকুর চোখ তোর --মোটা করে কাজল দিস না কেন রে ? কাজল দিবি ৷ স্মৃতি চলে যাওয়া রোগী অদ্ভুত উপমায় সেবিকার চোখ সাজান ৷ কমন শব্দে বোধহয় বিরাগ আছে রোগীটির ৷
সেবিকা মৃদু হাসেন --কে কিনে দেবে কাজল ?
রোগী -- আমি ৷ ঐ যে দ্যাখ -- আমার মেয়ের ড্রইং পেন্সিলের বাক্স ৷ ওখান থেকে যে কোনো রঙের পেন্সিল নিয়ে নে ৷ বা তুলি নে আর ওই হলুদ রঙের জলরঙ নে ৷ তুলি চুবোবি আর চোখে টানবি ৷
রোগীর খ্যাপাটে কথায় সেবিকার শরীরে এক অচেনা আনন্দ জাগে ৷ নতুন কাটা ববে হাত বুলোতে বুলোতে সেবিকা বেমালুম ভুলেই যান --বিয়ে না দিয়ে বাড়ির লোক তার রোজগার সবটা খেয়ে ফেলছে ৷ মনের ভুলে বাবাকে ফোন করে বসেন ---বাবা সব ভাই বোনকে জমির ভাগ দিলে ৷ আমারটা এবার দেবে গো বাবা ? সেই ভাগ দিয়ে আমি কলকাতায় বাড়ি করব ৷ সেই বাড়িতে তুমি আমি আর মা ই তো থাকব বাবা ৷ দেবে আমার ভাগটা ? একটা ছোট বাগানও করে দেব বাবা তোমায় ৷
সকালবেলার ফোনের উত্তর এসে যায় সন্ধেতেই -----বিয়ে থা করিস নি ৷ তোর নিজের বাড়ি বাগান কী দরকার ? কাদের জন্য দরকার ? এই রোগীর বাড়ি টানা কাজ করছিস ৷ টাকাগুলো জমা ৷ বয়স হলে গ্রামের বাড়িতে ভাইদের কাছে এসে থাকবি --জমানো টাকা থাকলে ভাইপোরা দেখবে ৷
ফোনটা পাওয়ার পর থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছেন সেবিকা ৷ বসে আছেন তো বসেই আছেন ৷ বাবাকে বলা হয়নি ---এই মাস অব্দি রোজগারের আধাভাগ বাবা ভাইয়ের সংসারে পাঠাতে হয়েছে ৷ ঠিক সময়ে ঠিক কথা বলার অভ্যেস তো করেননি কখনো ৷
রোগীর চিৎকারে হুঁশ ফেরে ৷ সেবিকা প্রথম ভাবেন -- পেটুক মানুষটা চা মুড়ির জন্য হাত ছুঁড়ছেন ৷ চা এনে দিলেন ৷ রোগী আর থামে না ৷ অন্ধকার বারান্দায় কী যেন দেখাচ্ছেন ৷ অনেকক্ষণ ধরে রোগীর ফুলো দুটো হাত খেয়াল করেন সেবিকা ৷ দুই হাত দিয়ে বারান্দার একটা ফুলের গাছকে দেখাচ্ছেন রোগী ৷ ফুলগাছের গোড়ায় একটা ঝরে পড়া ফুলকে দেখছেন আর যুক্তাক্ষর ভেঙে গোটা গোটা করে বলছেন ---বাচ্চাটা ---বাচ্চাটার একটা চোখ খু খু খুলে পড়ে গেছে তো ৷ তুলে ডালে লা লা লাগিয়ে দে ৷ লা লাগিয়ে দে বলছি ৷ নইলে মারবে ওর ওর মা ৷
সেবিকা বুঝতে পারেন না এত রেগে যাওয়া রোগীকে শান্ত করবেন কী করে ! একটি ফুল ঝরে যাওয়াতে মানুষের এমন রাগ তো কখনো দেখেননি তিনি ৷ বারবার বলেন ---কার বাচ্চা ! ও তো গাছ ৷ উত্তেজনায় রোগীর কথা ফের আটকায় --ম ম মাটির বাচ বাচ্চা ৷ অবাক হয়ে এতদিনের রোগীকে দেখতে থাকেন সেবিকা ৷ দেখতে দেখতে সামনের মানুষটির বব মুণ্ডু নিজের ভারী দুটো বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন ৷ রোগীর পুরো শরীরটা দোলাতে দোলাতে বলেন ---ও বেবি --ইউ আর স্মল বেবি ৷
সেবিকা স্থিরপ্রতিজ্ঞ --এবার ভাড়াবাড়িতেই ঠাকুরের আসন পাতবেন ৷বেশ কিছু টাকা দিয়ে খাঁটি তসরের আসন কিনবেন ৷ আর তাতে সবুজ জরিপাড় সেলাই করে নেবেন ৷ আছছা রোজ তো ডিউটিতে বেরিয়ে যেতে হবে ৷ ফুল যদি শুকিয়ে যায় --তার চেয়ে রামকৃষ্ণকে সবুজ গাছ দিয়ে সাজিয়ে দিলে কেমন হয় ! ভিজে মাটির রস খেয়ে দেবসাজ ফুটবে খুব ৷ খুব ৷
জানতে পেরে আকাশের তারারা বলে
--বেশ বেশ ৷
তোমার ঠাকুর গ্রামের মানুষ ৷
সে খুউব গরীব মানুষ ৷
তাকে দেখতে একদিন নাহয় যাব তোমার বাড়ি ৷
সেবকের আরতি নিশ্চয় পথ চিনবার পর্যাপ্ত আলো দেবে ৷