ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(৮)
গোলকপতি বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ওর এই স্বল্পপ্রাণ জীবনের করুণ ইতিহাসটি রাণীমার কাছে বলতে বলতে খানিক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে আবার নিজেকে তৎক্ষণাৎ সামলে নিতেই বিষণকুমারী এই যুবাটিকে দেখে এবারে যেন নিজেও সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন।
তিনি ওকে আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে খুব নীচু স্বরে বললেন যে রাজবাড়ির খাসমহলে নয় ওঁর নিজের মহলেই একটি বিশ্বাসযোগ্য লোকের সন্ধানে তিনি চিন্তিত। তাই ও যদি এখন এইধরণের একটা স্থায়ী কাজের ব্যবস্থা চায় তাহলে সেটা উনি ভেবে দেখতে পারেন। তবে বেতন হিসাবে কোন তঙ্কা সে পাবেনা। পরিবর্তে তিনি নিজে লেখাপড়া করে দক্ষিণ রায়নার কোন একটি গ্রামে তার থাকার জন্য ও চাষযোগ্য জমি মিলিয়ে পাঁচ বিঘা জমির বন্দোবস্ত অবশ্যই করে দেবেন। এখানে সম্বৎসরে বিঘে চারেক খাস জমির যা ফলন তা একটি বা দুটি পেট চালাতে নেহাত কম হবেনা। আর এই সমস্ত কাজে তার সহায়ক রূপে দুজন বিশ্বাসী কৈবর্ত্য মুনিশকেও তিনি তার সাথে দিয়ে দেবেন।
তবে এসবের বিনিময়ে ওকে আড়ত বা রাজবাড়িতে ঘুরে বেড়িয়ে বা যে কোন সূত্রের মাধ্যমে রাণীমার বিরোধী সব গোপন ষড়যন্ত্রের খবর জেনে তৎক্ষণাৎ তা রাণীমাকে জানানোর সাথে ও ওঁর খাস খাদ্যের মাসিক বাজারটিও করার দায়িত্বটুকুও বর্তাবে।
তবে যেহেতু উনি নিজে একাহারী ও নিরামিষাশী তাই গো- দুগ্ধ ছাড়া আর সব ভোজ্যবস্তুই ওকে নিজে মুখে তুলে তারপর রাণীমার মহলে সেটি পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্যে বিষপ্রযুক্ত হলে তা রাণীমার আগে তাকেই তা গ্রহণ করে পরিবর্তে রাণীমার জীবনটিও বাঁচাতে হবে।
ইদানীং বাংলায় একদিকে ইংরেজ আর অন্যদিকে ওঁর নিজের গর্ভজাত তেজচন্দ্র এরা দুজনেই দুটি পরস্পরবিরোধী ও শত্রুমনস্ক অস্তিত্বের হলেও অন্তত রাণীমাকে গুপ্তহত্যার বিষয়ে এরা চরম বৈপরীত্যে গিয়ে যথেষ্ট একীভূত হয়ে যেতে যেমন সক্ষম তেমন এই রকম হত্যাকল্পে দুটি গোষ্ঠীই বেশ পারদর্শীও বটে। অগত্যা ওঁর এই বিশেষ ব্যবস্থাটির প্রবর্তন করতে যাওয়া। আজ ওঁর পরলোকগত স্বামী তিলোকচাঁদ বাহাদুর স্বয়ং জীবিত থাকলে এতকিছুর উপদ্রব নাও হতে পারত বলেই তাঁর একান্ত ধারণা।
.....
শহর কলকাতায় এদিকে বেশ শোরগোল শুরু হওয়ার পিছনে যে খানাকুলবাসী তেজোদ্দীপ্ত যুবকটি এবার দায়ী তা নিয়ে আর সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। বিষয়টি বেশ উত্তেজনাপ্রবণ ও সেটি আর সাধারণ কোন্দল বা পরচর্চার মধ্যে আর সীমিত নেই।
রামমোহন ও দ্বারকানাথের মত কিছু নব্যধনী ও প্রগতিশীল যুবা গত কয়েক বছর ধরে এই শহরে খৃস্টানদের মত দেখাদেখি আর একটি আলাদা দল গড়ে প্রচলিত হিঁদুয়ানির একটা বিরুদ্ধাচরণ করছিলেন। এ শহর এতদিন এসব হুজুগ দেখতে ও চাখতে অভ্যস্ত ছিল।কেবল রূপচাঁদ পক্ষীর দলের বিদ্রুপাত্মক খেউড়েই তার নিষ্পত্তিটুকু সবাই মেনে নিলেও এখন আর একটা নতুন বিষয় থেকে এসবের তলে তলে মাথা চাড়া দিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে।
আর সেটি নিয়েই তামাম শহরে বেজায় গোলমাল শুরু হয়ে গেছে। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী সহমরণের মত একটি বিশেষ প্রথা যা তামাম হিন্দুদের একটা গর্বের বিষয় তাকে এবারে খোদ ইংরেজ সরকার রদ করতে উঠে পরে লেগেছেন। এতে এই রামকান্ত রায়ের কনিষ্ঠ সন্তানটির যথেষ্ট হাত আছে বলে শোনা যাচ্ছে। সে নাকি সংস্কৃত, আরবী- ফার্সি এমনকি হিব্রুভাষার মোটা মোটা কেতাব খুলে প্রমাণ করতে চাইছে যে প্রথাটি যে শুধু অমানবিক তাই নয় বরং ভ্রান্ত।
সে নিজে অবশ্য পন্ডিত ও বহুভাষাতে পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও মোটেও উদ্ধতস্বভাবের নয়। তার শালপ্রাংশু বাহুযুগল ও বৃষস্কন্ধটির উপর মখমলের আচকান সহ মুসলমানদের মত নৈপূণ্যে গৃহিত কাশ্মিরী শালের আবেশটি তার বাবরি ছাঁদের চুল ও ঈষৎ গুম্ফ শোভিত মুখমন্ডলের সাথে একেবারে মানানসই বলে সাধারণের কিঞ্চিৎ সম্ভ্রম আদায় করে থাকে। যদিও এই বাহ্যিক গাম্ভীর্যের বাইরে কিন্তু সে কিন্তু একজন রসালাপী যুবক। তার দলের কেউ একজন এসে তাকে তার আসন্ন বিপদের কথাটি জানালে সে সাথে সাথে গোঁফ নাচিয়ে অট্টহাসিতে হেসে বলে ওঠে - " আমায় প্রহার করিতে আসিবে?? বল কী হে বৎস ?? তা সে ব্যক্তিটি কয়খান পূর্ণবয়স্ক অজের মাংসাহারে অভ্যস্ত..যে আজকাল এত শক্তিধারী হয়েছে ?? "
তবে এ কথা সত্যিই যে সে নিজেও একজন ভোজনবিলাসী ও বলশালী যুবক। তার মুখে এই কথাটি শ্রবণে অপরপ্রান্তের বেরাদরটির মুখে কিঞ্চিৎ হাস্যের উদ্গম করলেও সে নিজেও জানে গুপ্তিপাড়া থেকে নৈহাটি -ভট্টপল্লী এমনকি সূতানুটির ব্রাক্ষণদের অধিকাংশ রামমোহনের একদা মিত্রস্থানীয় ধনকুবের ও শো'বাজারের জমিদার বাবু রাধাকান্ত দেব বাহাদুর সহ আরো কিছু সমমনোভাবাপন্ন জমিদারদের অর্থেই অন্নপানে অভ্যস্ত।
তাই তারা সতীদাহের মত শাস্ত্রীয় প্রথাটির বিরুদ্ধে রামমোহন সহ তার অনুগামীদের সুযোগ পেলে পথেঘাটে বেকায়দায় পেলে এবার থেকে সবলেই প্রতিহত করবে। শোনা যাচ্ছে যে পটলডাঙার কাছে একটি মুক্তপ্রাঙ্গণে তারা একটি জনসমাবেশও আহ্বান করেছে ও তার মাধ্যমে রামমোহন বিরোধী সবাই বেশ সরবও হয়েছে। ইংরেজরা বিধর্মী। হিন্দুদের কৌলিক লোকাচার যে বঙ্গদেশে মান্য হবে সেটাই স্বাভাবিক। এমনকি এসবের ফলে ইংরেজ বড়লাট বেন্টিঙ্কও যেন বিলেতের আইনসভায় এইবছরে সতীদাহ বিরোধী বিলটিকে আনতে সাহস পেলেন না। যেন এই আইনটি এখুনি পাশ হয়ে গেলে দেশে ইংরেজ বিরোধী একটি অনর্থক ঝড়ের পরিবেশ উদ্ভূত হতে পারে যা তাদের পক্ষেও কোনভাবে এখন কাঙ্খিত নয়।
......