প্রচ্ছদ নিবন্ধ - দীপারুণ ভট্টাচার্য
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধমণিপুরে দুইজন কুকি উপজাতির মহিলাকে প্রকাশ্য দিবালোকে খোলা রাস্তায় মৈতৈ নামক অন্য এক উপজাতির একদল পুরুষ দ্বারা সম্পূর্ণ নগ্ন করে হাঁটানোর ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরেই বিষয়টা নিয়ে মিডিয়াতে তোলপাড় শুরু হয়। এমন নয় যে এর আগে মণিপুরের হিংসা ও জাতী দাঙ্গার বিষয়টা মিডিয়ার জানা ছিল না। আমরা যাদের ন্যাশনাল মিডিয়া হিসাবে জানি, প্রতিটি রাজ্যে তাদের অফিস, কর্মী কিংবা সংবাদদাতা থাকেন। মিডিয়া হাউস গুলো মূলত তাদের থেকেই সংবাদ সংগ্রহ করেন এবং মানুষের সামনে নিয়ে আসেন। কাজেই এই প্রশ্ন উঠবেই যে মণিপুরের সংবাদদাতারা কি তাদের দিল্লি (নয়ডা) অফিসে কোন সংবাদ পাঠান নি? আর যদি পাঠিয়ে থাকেন তাহলে সেগুলো প্রচার করা হয় নি কেন? মনিপুরের সংবাদ না প্রচার করার জন্যে কি সংবাদ সংস্থা গুলোর উপর কোন চাপ ছিল? কারণ মনে রাখতে হবে যে ঘটনার কথা দিয়ে আমরা লেখা শুরু করেছি সেই ঘটনাটি ঘটেছিল মে মাসের চার তারিখে। এর ৬৪ দিন পর পুলিশের খাতায় প্রথম এফআইআর লেখা হয়। এবং ৭৯ দিন পর মণিপুর বিষয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রথম সংসদের বাইরে ত্রিশ সেকেন্ডের জন্যে মুখ খোলেন। এবং এরপরই জাতীয় মিডিয়ারা এই বিষয়ে কথা বলতে শুরু করে। তাহলে কি এটা ধরে নিতে হবে যে, যদি ভিডিওটা ভাইরাল না হত এবং সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি না হত তাহলে সরকার এই বিষয়ে মুখ খুলতেন না? আর সরকার মুখ না খুললে জাতীয় মিডিয়ারা বিষয়টা মানুষের সামনে আনতেন না? সরকারের মত না পাওয়া পর্যন্ত বড় বড় মিডিয়ার কার্যত এই চুপ করে থাকার বিষয়টা সম্ভবত মণিপুরের ঘটনার থেকেও ভারতবর্ষের নিরিখে আরও বড় ক্ষতির কারণ। যা আমরা রোজ মেনে নিয়েই চলেছি।
মণিপুরের ঘটনা মূলত শুরু হয়েছিল সেই রাজ্যের হাইকোর্টের এক রায়কে কেন্দ্র করে। বিষয়টা ছিল মৈতৈ উপজাতিকে তপশিলি জাতি ভুক্ত করা যাবে কি হবে না। কোর্ট বলেছিলেন, করা যাবে। (পরে উচ্চ আদালত রায়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।) এই খবরে কুকি উপজাতির কিছু লোক মনে করেন তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে। কারণ মণিপুরে মৈতৈ উপজাতিরাই সংখ্যা গরিষ্ঠ। কাজেই সংখ্যা গরিষ্ঠরা যদি সংরক্ষণ পেয়ে যায় তাহলে তাদের ভাগ্যে কিছুই জুটবে না। প্রসঙ্গত বলে রাখা উচিৎ যে মৈতৈ উপজাতিরা মূলত হিন্দু এবং কুকি উপজাতিরা মূলত খ্রিস্টান। যাই হোক, হাইকোর্টের এই রায় আসার পরেই চুরাচাঁদপুর জেলায় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম সংঘর্ষ হয়। এবং পরে তা দ্রুত মণিপুরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। মনে রাখা ভালো যে মণিপুরের প্রায় নব্বই শতাংশ অঞ্চল পাহাড়ি। এই পাহাড়ি অঞ্চলে কুকি ও নাগা উপজাতির বাস। বাকি দশ শতাংশ সমতলে বাস করেন সংখ্যা গরিষ্ঠ মৈতৈরা। কাজেই শুরু থেকেই বিষয়টাকে কুকিরা মৈতৈদের অঞ্চল দখলের লড়াই হিসাবে দেখতে শুরু করেন এবং ইটের বদলে পাটকেল মারতে শুরু করেন। এরপর যে ঘটনা ঘটে তা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে একেবারে দুর্লভ। মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলে পুলিশের একাধিক অস্ত্রাগার থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র সহ প্রচুর বুলেট লুট হয়। বলাই বাহুল্য ইম্ফল মৈতৈ অধ্যুষিত অঞ্চল এবং মণিপুর পুলিশের সিংহ ভাগ কর্মীরা মৈতৈ। কাজেই কুকিদের ধারণা হয়, এ অস্ত্রাগার লুণ্ঠন নয়, বরং উপহার। পুলিশ অস্ত্র গুলো মৈতৈদের উপহার হিসাবে দিয়েছে যাতে তারা সেগুলো দিয়ে কুকিদের খতম করতে পারে। কুকিদের এই ধারণা যে সম্পূর্ণ অমূলক এটা বলা কঠিন। কারণ সত্যি সত্যি পুলিশের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করতে কোন দল এলে তাদের সঙ্গে পুলিশের যে সংঘর্ষ হওয়ার কথা, তেমন কোন ঘটনার খবর এখনো পর্যন্ত জানা যায় নি। কাজেই কুকিদের এই দাবীতে সত্যতা আছে এমনটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে। আর সেটা যদি ধরে নেওয়া হয় তবে এটাও ধরে নিতে হবে যে এই ঘটনায় সরকারের মদত ছিল। কারণ তা নাহলে পুলিশের বড় কর্তারা এতদিনে চাকরি খোয়াতেন! এমন খবর কিন্তু সামনে আসে নি। ঐ দুই কুকি মহিলা বলেছেন, পুলিশ নিজেই তাদের দুষ্কৃতিদের হাতে তুলে দিয়েছিল। কোন নিরপেক্ষ তদন্ত যদি কোনদিন এই ঘটনার সত্যাসত্য বিচার করে বিষয়টা মানুষের সামনে আনতে পারেন তাহলেই ঘটনায় সরকারের উদ্দেশ্য ও ভুমিকা সাধারণ ভারতবাসী বুঝতে পারবেন।
মৈতৈদের হাতে অস্ত্র এসেছে খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুকিরাও পাহাড়ি অঞ্চলের অস্ত্রাগার ও থানা থেকে অস্ত্র লুট করে। এরও কোন তথ্য নিষ্ঠ খবর সংবাদ মাধ্যম প্রচার করে নি। কাজেই এটা জানার কোন উপায় নেই যে কোন দলের হাতে ঠিক কত পরিমাণ অস্ত্র আছে! তবে সাধারণ বুদ্ধিতে এইটুকু মনে হয় যে রাজধানী ও তার আশেপাশের অঞ্চলে যত আগ্নেয়াস্ত্র থাকে প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে তার ভগ্নাংশও থাকে না। কাজেই মৈতৈদের হাতেই বেশি আগ্নেয়াস্ত্র আছে এটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে। এই যুক্তির সঙ্গে আর একটি ঘটনাকে মিলিয়ে দেখলেই বিষয়টি আমাদের কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে। দিল্লিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাস ভবনের সামনে এবং ভারতের অন্যান্য জায়গায় যেখানেই মণিপুরের বিষয়ে প্রতিবাদ হয়েছে তা করেছেন কুকি উপজাতির লোকেরা। এর থেকে আমাদের ধরে নিতে হবে মূলত তারাই আক্রান্ত। যদি মৈতৈরাও একই পরিমাণে আক্রান্ত হতেন তাহলে নিশ্চয়ই একই রকমের প্রতিবাদ করতে তাদেরও দেখা যেত!
দুইজন কুকি মহিলাকে উলঙ্গ করে হাঁটানোটাই কিন্তু একমাত্র ঘটনা নয়। বরং বলা যেতে পারে এর কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া আরও নৃশংস একটি ঘটনা ইউটিউব নির্ভর কিছু ছোট সংবাদ সংস্থার খবরে উঠে এসেছিল। ঘটনাটি সাত কিংবা নয় বছরের এক কিশোরের। যার বাবা কুকি এবং মা মৈতৈ উপজাতির মহিলা। এই কিশোরের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হলে সে আহত হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ডাকা হয় অ্যাম্বুলেন্স। হাসপাতালটি মৈতৈ এলাকার মধ্যে। কাজেই পরিবারের লোকেরা ঠিক করেন কুকি কিশোরের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে কোন কুকি মানুষ গেলে সমস্যা হতে পারে। বরং মৈতৈ মা তার ছেলেকে অ্যাম্বুলেন্স গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেই বিষয়টা নিরাপদ হবে। অথচ বিষয় হয় সম্পূর্ণ অন্য রকম। মা ও ছেলেকে অ্যাম্বুলেন্স গাড়ির মধ্যেই বন্ধ করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। জীবন্ত পুড়ে মারা যায় অসহায় মা ও ছেলে। এই ঘটনা দুই কুকি মহিলার ঘটনার মত মানুষের মনে আগুন তৈরি করতে পারে নি। কারণ এর কোন ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয় নি। হয়তো ভিডিও নেওয়াও হয় নি। আর হলেও সেটা ইন্টারনেটের অভাবে মণিপুরের বাইরে আসতে পারেনি। কারণ চুরাচাঁদপুরের প্রথম বড় হিংসা হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত মণিপুর ইন্টারনেট হীন অবস্থায় পড়ে আছে। (এ জন্যে মণিপুরের সাধারণ মানুষ কি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে বেঁচে আছেন সেটা আশাকরি পাঠকরা অনুমান করতে পারছেন। এই একই ঘটনা বছরের পর বছর কাশ্মীরে হতে আমরা দেখেছি।) সম্ভবত ঐ দুই কুকি মহিলার ভিডিওটা যিনি রেকর্ড করেছিলেন তিনি কোন ভাবে সেটা মণিপুরের বাইরে পাঠাতে পেরেছিলেন। নইলে দেশের বৃহত্তর নাগরিকরা জানতেই পারতেন না মণিপুরে কি চলছে।
আর একটা বিষয় আমাদের ভেবে দেখতে হবে। ভিডিওটি সামনে আসার পর সংসদ ভবনের বাইরে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মণিপুরের পাশাপাশি নারী নির্যাতনের ঘটনা আর যেখানে যেখানে হয়েছে যেমন রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি সে গুলোও দেখতে হবে। এই কথায় তিনি যে মণিপুরের ঘটনাকে ছোট করেছেন তাই নয় বরং তার পার্টি ম্যান আর মিডিয়া সাথীদের কথা বলার একটা রূপ রেখা বেঁধে দিয়েছেন। যাতে প্রথম ধাক্কাতেই তারা পড়ে না যায়। এরপর দেশের সুপ্রিমকোর্ট মণিপুরের ঘটনার সঙ্গে অন্য রাজ্যের ঘটনাকে জুড়ে বিষয়টাকে তুচ্ছ করার চেষ্টাকে নিন্দা করার পরেও সরকার পক্ষ এবং তাদের মিডিয়ার সাথীরা কাজটি একই ভাবে করেই চলেছেন। অনেক সাধারণ মানুষ ভেবেছিলেন দেশের প্রথম মহিলা আদিবাসী রাষ্ট্রপতি এই ঘটনায় নীরব থাকতে পারবেন না। কিন্তু তিনি দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছেন। এরপর মানুষের প্রত্যাশা মত বিরোধীরা চেষ্টা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে মণিপুর বিষয়ে সংসদের ভিতরে কিছু বলাতে। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টাকে সরকার পক্ষ ব্যর্থ করে দিয়েছেন। কাজেই স্বাধীনতার পর দেশে ঘটে যাওয়া সব থেকে বড় জাতি দাঙ্গা বিষয়ে সংসদে কোন আলোচনা হয় নি। কারণ প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের কোন ব্যর্থতা বিষয়ে সংসদে কথা বলতে চান না। তিনি চান না তার কোন কথা সংসদের রেকর্ডে থাকুক। যাতে আগামী দিনে তাকে কিংবা তার পার্টির দিকে কেউ আঙুল তুলতে না পারে। ফলে এক রকম বাধ্য হয়েই বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন। সেখানে সরকারের প্রধান যা বলেছেন তাতে শান্তির কোন আবেদন ছিল না। অবশ্য তিনি শান্তির আবেদন করতে চাইলে মণিপুর গিয়েও সেটা করতে পারতেন। মণিপুরের মোট জনসংখ্যার দুই শতাংশের বেশি মানুষ এখন উদ্বাস্তু শিবিরে রয়েছেন। তবুও রাজ্যের মানুষ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে সামনে থেকে দেখতে পেলেন না! স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী একবার গেলেন। কিছুদিনের মধ্যে আবার যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও, আর গেলেন না। সম্প্রতি স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সামান্য কিছু শব্দ ব্যয় করেছেন মণিপুর বিষয়ে। তিনি বলেছেন, মণিপুরে থেকে শান্তির খবর আসছে। তবে তার সরকারের কি কি ইতি বাচক পদক্ষেপের কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে সেটা তিনি বলেন নি। অশান্তির কারণ বিষয়েও তিনি নীরব থেকেছেন।
মহিলাদের বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর মানুষটির এই নীরবতা কিন্তু নতুন কোন ঘটনা নয়। কিছুদিন আগেই অলিম্পিক পদক জয়ী দেশের মহিলা খেলোয়াড়দের সঙ্গে এই সরকারের পুলিশ যে ব্যবহার করেছেন সেটা সবাই দেখেছেন। তারপরও তিনি যে শুধু নীরব থেকেছেন তাই নয়। অভিযুক্ত সাংসদকে ক্ষমতাচ্যুত করে কোন বার্তা দিতেও অস্বীকার করেছেন। দিল্লির রাস্তায় ধর্না দেওয়ার ফল স্বরূপ মহিলা খেলোয়াড়রা যেটা পেয়েছেন সেটা পুলিশের একটা এফআইআর এবং চার্জশিট ছাড়া আর কিছু নয়। আর একটু পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে এই সরকারের জন্যেই বিলকিস বানোর ঘর্ষকরা আজ জেলের বাইরে। পাঠকরা জানেন ২০০২ সালে গোধরা-কাণ্ডের পর গুজরাটে ব্যাপক হিংসার ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ৩রা মে দাহোড় জেলার দেবগড়ের একটি গ্রামে ভয়াবহ হামলা চালায় দুষ্কৃতীরা। গ্রামের বাসিন্দা বিলকিস বানো সহ তাঁর মা বোনকে গণধর্ষণ করা হয়। পরিবারে ১৪ জন সদস্য সহ মোট ১৭ জনকে খুন করে দুষ্কৃতীরা। ঘটনার তদন্ত শুরু করে সিবিআই। ২০০৮ সালের ২১ জুলাই মুম্বইয়ের বিশেষ সিবিআই আদালত অভিযুক্ত ১১ জনকে দুষ্কৃতীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। বর্তমান গুজরাট সরকার এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সুপারিশে সম্প্রতি মুক্তি পায় সেই ১১ জন দুষ্কৃতী। মুক্তির পর এই দুষ্কৃতীদের কিভাবে ক্ষমতাসীন পার্টির লোকেরা ফুল মালা দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন সেটা সংবাদ পত্রে কিংবা টিভি চ্যানেলে অনেকেই দেখেছেন। আর একটু পিছিয়ে গেলে বলা যেতে পারে সিদ্দিক কাপ্পানের ঘটনাটা। সিদ্দিক কাপ্পান হলেন কেরালার একজন সাংবাদিক। যিনি উত্তর প্রদেশ সরকারের দ্বারা বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনের অধীনে অভিযুক্ত হওয়া পরে ২০২০ সালের অক্টোবরে থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেলে ছিলেন। সিদ্দিকের অপরাধ ছিল কেরালা থেকে উত্তর প্রদেশের হাতরাস গ্রামে যাওয়া। সে গিয়েছিল ১৯ বছরের এক দলিত মহিলার গণধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবেদন লিখতে। যে চারজন উচ্চবর্ণের হিন্দু পুরুষ ঐ দলিত মহিলাকে ধর্ষণ ও হত্যা করে, পুলিশ তাদের আটক ও শাস্তির বিষয়ে কতটা তৎপর ছিলেন সেটা পাঠকরা একটু চেষ্টা করলেই মনে করতে পারবেন।
একের পর এক নারী নির্যাতনের এমন উদাহরণ আরও অনেক দেওয়া যেতে পারে। বুল-ডোজার বাড়ি ভাঙ্গতে এসেছে দেখে থানায় গিয়ে কোন সাহায্য না পেয়ে মা ও মেয়ে নিজেদের ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে তাতে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও উত্তর প্রদেশে সম্প্রতি ঘটেছে। উপরের কোন ঘটনার পরেই সরকারের কোন বড় মাথাকে কিছু বলতে শোনা যায় নি। এমনকি নির্যাতন কারিদের কোন দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি হতেও দেখা যায় নি। যে ঘটনা দিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম সেই দুই কুকি মহিলার জঘন্য ঘটনার পরে কতজন গ্রেপ্তার হয়েছে এবং কতজনের শাস্তি হয়েছে আমরা এখনো জানি না। তবে যা জানা গেছে তা হল, যার মোবাইল ফোনে ভিডিওটা রেকর্ড করা হয়েছিল, সে গ্রেপ্তার হয়েছে। কর্তৃপক্ষ কি তার মধ্যমে বাকিদের ধরতে আগ্রহী নাকি তার মাধ্যমে এমন অন্যান্য ভিডিও কারিদের বার্তা দিতে আগ্রহী, সেটা আমাদের জানা নেই।
ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি এমন ঘটনা ঘটলেই সরকার বিচলিত হয়ে পড়তেন। কারণ খবরের কাগজে এবং টিভি চ্যানেলে চলতে থাকতো এমন ঘটনার লাগাতার কভারেজ। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের সময় এমনটা আমরা হতে দেখেছি। সেজন্যেই বর্তমান সরকার চায় মিডিয়া চুপ করে থাকুক। কিংবা তাদের ইচ্ছানুসারে ছড়িয়ে দিক সাম্প্রদায়িক বিষ। ভেবে দেখুন, ২০০২ এর সময়ে তদানীন্তন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর বিবিসি’কে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন যে, তাঁর মূল ব্যর্থতা তিনি মিডিয়াকে ম্যানেজ করতে পারেন নি! তবে কি সেই জন্যেই এখন মিডিয়াকে নির্মম ভাবে ম্যানেজ করা হচ্ছে? নাকি তিনি বুঝে গেছেন তাঁর মূল ভোটাররা তাকে উন্নয়ন বা সুরক্ষার নামে ভোট দেয় না। ভোট দেয় ধর্মান্ধতার নামে; হিন্দু রাষ্ট্রের নামে! আশ্চর্য জনক ভাবে নারী নির্যাতনের যে ঘটনা গুলো সামনে আসছে তার সিংহ ভাগই ঘটেছে অহিন্দু এবং দলিত নারীদের সঙ্গে। বিষয়টা নিয়ে আমাদের সকলকে ভাবতে হবে এবং যেটুকু আমাদের পক্ষে করা সম্ভব সেটা করতেই হবে। যেমন পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আরও কিছু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ, পত্র পত্রিকায় লেখা-লিখি কিংবা অন্য কিছু যা আপনি করতে পারবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে ঐ দুইজন কুকি মহিলার মধ্যে একজনের স্বামী ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর জওয়ান ছিলেন। যিনি কার্গিল যুদ্ধে দেশের হয়ে লড়েছিলেন। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে এমন বর্বর ঘটনার পর তিনি বলেছেন, ‘আমি কার্গিলে দেশের রক্ষা করেছিলাম কিন্তু নিজের স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারলাম না’। এই বিষয়ে এখনো নীরব বসে থাকলে এই আফসোস একদিন আমাদেরও করতে হতে পারে।