ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক৩১
ইলোনার সঙ্গে মনে মনে কথা বলে যেত ফাইনহালস। তীব্রভাবে ভাবত তার কথা ঘুমোতে যাবার আগে। কিন্তু সে একদিনও স্বপ্নে এলো না। ঘুমোতে যাবার আগে মনে হত তার যে পাশ ফিরলেই সে দেখতে পাবে ইলোনাকে। অনুভব করতে পারবে তার বাহুর স্পর্শ। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। সে অনেক দূরে আছে হয়তো। পাশ ফিরবার সেভাবে কোনো দরকার নেই। তার ঘুম আসছিল না। সে অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিল তার কথা। তার সঙ্গে দেখা হলে যে ঘরে তার সঙ্গে সময় কাটাবে, রাত্রিবাস করবে, সেরকম একটা ঘরের কথা ভাবছিল সে। ভাবতে ভাবতে কখন যে ক্লান্ত শরীরে সে ঘুমিয়ে পড়ল, সে কথা আর মনেও নেই। সকালে উঠে সে মনে করতে পারছিল না যে ঘুমের মধ্যে কেমন স্বপ্ন দেখেছে। না, সে ইলোনাকে স্বপ্নে দেখেনি।
ঘুমোতে যাবার আগে প্রার্থনা করছিল সে। মনে মনে ভেবে যাচ্ছিল যে ওই অল্প কটা দিনে ইলোনার সঙ্গে তার কী কী কথা হয়েছিল। শেষ দেখার আগে পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে করবার চেষ্টা করছিল সে। বেশির ভাগ সময়ে ইলোনা কেমন যেন লজ্জায় লাল হয়ে থাকত। সেই স্কুলের ঘরে তাদের দেখা হওয়ার সময়, বাচ্চাদের খেলনা, ম্যাপ, জীববিদ্যার চার্ট, ব্ল্যাকবোর্ড সবকিছু দিয়ে ঠাসা সেই ঘরে ইলোনাকে সব সময় কেমন যেন বিব্রত দেখাত। আসলে সে ধর্ম বিষয়ক যে কোনও কথা বলতে গিয়ে কেমন যেন থমকে যেত। কারণ ফাইনহালস তাকে বলেছিল যে তার চার্চে যেতে একদম ভালো লাগে না। চার্চের ধর্মগুরুদের বাণী, উপদেশ সবকিছু তার কাছে অসহ্য মনে হয়। ইলোনা সম্ভবত ব্যথা পেয়েছিল এই কথায়। বিষণ্ণ স্বরে বলেছিল… ‘কিন্তু প্রার্থনা খুব জরুরি, ঈশ্বরের নাম না করে প্রার্থনা করা কী ভাবে সম্ভব!’…
ফাইনহালস ভাবতেই পারেনি যে ইলোনা তাকে চুম্বন করবার অনুমতি দেবে। কিন্তু সে তাকে চুম্বন করেছিল। ইলোনাও প্রতিচুম্বন দিয়েছিল তাকে। তারা একটা ঘরে গিয়ে সময় কাটাবার কথা ভাবছিল। মনে মনে সেই ঘরটার একটা ছবি এঁকে রেখেছিল সে। ঘরটা খুব সাজানো গোছানো পরিচ্ছন্ন নয়। নীলচে একটা হাত ধোবার গামলা থাকবে ঘরটায়, হাত ধোবার জল থাকবে তাতে। বাদামি রঙের খাট। ঘরটার জানালা দিয়ে ফলের বাগান দেখা যাবে। বাগানের গাছের নিচে ফল পেকে পেকে ঝরে পড়েছে। কিছু ফল পচে মাটিতে মিশে গেছে। সে চোখ বুজে এরকম একটা ছবি মনে ভাববার চেষ্টা করত যে ওইরকম একটা ঘরে খাটে শুয়ে শুয়ে সে ইলোনার সঙ্গে গল্প করছে। সে অনেকবার ভেবেছে। কিন্তু এরকম কোনো স্বপ্ন আজ অবধি আসেনি তার ঘুমের মাঝে।
পরের দিন সকালে কাজ শুরু হল। নড়বড়ে হাড়জিরজিরে টেবিলটার সামনে হাতলওয়ালা চেয়ারটার মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে হচ্ছিল তাকে। বাড়িটার ঘিঞ্জি চিলেকোঠার ঘরের জানালায় দূরবীনে চোখ রেখে বসেছিল ফাইনহালস। পাহাড়ের দিকে, জঙ্গলের দিকে, নদীর পাড়ে, যে রাস্তা ধরে ট্রাকে করে তারা এখানে এসেছে, সব দিকে নানা ভাবে দূরবীন দিয়ে দেখে যাচ্ছিল সে সারাক্ষণ। কোনো বিপ্লবীর টিকিও দেখতে পায়নি সে। মাঠে ঘাটে কাজ করা চাষাভুষো লোকগুলোর মধ্যেও কেউ বিপ্লবী হতে পারে। হতেই পারে। ফাইনহালস তো আর তাদের চেনে না। দূরবীন দিয়ে দেখে কী বা বোঝা সম্ভব? চারদিক এত চুপচাপ যে তার মনে হতে লাগল যে সে অনন্তকাল ধরে এই চেয়ারটার মধ্যে কুঁকড়ে বসে আছে। আবার দূরবীণের মুখ ঘুরিয়ে গির্জার হলদেটে চুড়ো পেরিয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে পাহাড়ের দিকে নজর রাখতে লাগল সে।
বাতাসটা খুব পরিষ্কার। উঁচু পাহাড়ের মাথায় একপাল ছাগল দেখতে পাচ্ছে সে দূরবীনের মধ্য দিয়ে। জন্তুগুলো সাদা সাদা তুলো তুলো মেঘের মত ছড়িয়ে আছে মেঘলা আকাশের মত দেখতে পাহাড়ের ধূসর সবুজ ঢালের গায়ে। দূরবীনের মধ্য দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চারপাশের নৈঃশব্দ্য একটু একটু করে নিজের মধ্যে শুষে নিচ্ছিল সে। অদ্ভুত একাকিত্বের মধ্য বুঁদ হয়ে থাকছিল সে। পাহাড়ের গায়ে জন্তুগুলো খুব কম নড়াচড়া করছে। মনে হচ্ছে যেন দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে ওদের। দূরবীনের মধ্য দিয়ে সে এত পরিষ্কার জন্তুগুলোকে দেখতে পাচ্ছে, ঠিক যেমনটি খালি চোখে দু’ তিন কিমি দূরের জিনিস দেখা যায়। কিন্তু আসলে ওরা অনেক দূরে আছে। নিঃশব্দ, একাকী কিছু জন্তু ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের ঢালে। যে ওদের পাহাড়ের ঢালে চড়াতে এনেছে, সেই রাখালকে দেখা যাচ্ছে না। দূরবীনের লেন্স থেকে চোখ সরিয়ে সে হতবাক হয়ে গেল। গির্জার হলদেটে চুড়া পেরিয়ে পাহাড়ের ঢালটা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু খালি চোখে সে জন্তুগুলোর চিহ্নমাত্র দেখতে পাচ্ছে না। সে চোখ কুঁচকে দেখবার চেষ্টা করল। নাহ, কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। কোনো সাদা রঙের ফুটকিও সে দেখতে পাচ্ছে না। সব একাকার। অনেক দূরে রয়েছে জন্তুগুলো। সে আবার দূরবীনের লেন্সে চোখ রাখল। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ছাগলগুলো, যাদের নিশ্চল একাকিত্ব সে এত দূর থেকেও অনুভব করতে পারছে।
হঠাৎ নিচে বাগানে কুচকাওয়াজের শব্দে চমকে উঠল সে। সে দূরবীনটা এবার নিচে বাগানে সার বেঁধে দাঁড়ানো সৈনিকদের উপরে তাক করল। প্রথমে সে খালি চোখে দেখল কিছুক্ষণ সৈনিকদের নড়াচড়া। তারপর লেফটেন্যান্ট মুকএর উপরে তাক করল দূরবীনের নল। সে সবে দু দিন হল মুককে চিনেছে। লোকটা ভারি গম্ভীর। পা থেকে মাথা অবধি গুরুগম্ভীর স্বভাবের। লঘুত্ব, চপলতার লেশমাত্র নেই। সরু, একহারা গড়ন লোকটার। গম্ভীরভাবে কুচকাওয়াজের নির্দেশগুলো উচ্চারণ করছে। হাতগুলো এতটুকুও নড়ছে না। লোকটাকে দেখতে একেবারেই সুদর্শন বলা চলে না। ফ্যাকাসে ঠোঁট, মুখের রঙটাও ফ্যাকাসে, প্রায় ধূসর। ঠোঁটগুলো অল্প নড়ছে, গলার পেশিগুলোতে হালকা কাঁপুনি দেখা যাচ্ছে যখন ‘ডাইনে’, ‘বাঁয়ে’ … ‘পিছে মুড়’ এইসব নির্দেশ বলে যাচ্ছে লোকটা। ফাইনহালস দূরবীন দিয়ে শুধু মুকের মুখটা দেখছে। মুখটা প্রায় অনড়, অটল। ঠোঁটগুলো নির্দেশ বলবার সময় নড়ে কি নড়ে না, হালকা কম্পন দেখা যাচ্ছে। বাম চোখটা বিষণ্ণ। চোখগুলো কুচকাওয়াজে রত সৈনিকদের দিকেও তাকিয়ে নেই। সৈনিকদের দলটা পেরিয়ে অনেক দূরে, অনেক পিছনে লেফটেন্যান্ট মুকএর চোখগুলোর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে।
তারপর সে গ্রেসএর মুখের দিকে তাক করে দেখতে লাগল। ওর মুখটা ফোলা, একটা বিরক্তি লেগে আছে। ফাইনহালস আবার খালি চোখে বাগানের দিকে তাকায়। সৈনিকেরা ‘ডাইনে’, ‘বাঁয়ে’, ‘সাবধান’ এসব নির্দেশ মেনে কুচকাওয়াজ করে চলেছে এই অপূর্ব শান্তিপূর্ণ সবুজ উপত্যকার মাঝে। সে দেখতে পেল বাগানের আরেক পাশে এক মহিলা দড়িতে ভেজা কাপড়চোপড় মেলছে। এই মহিলা সম্ভবত বাড়িওয়ালীর মেয়ে, যে গতকাল চিৎকার করে কান্নাকাটি করছিল। মহিলাকে গম্ভীর, বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। এতটাই গম্ভীর যে চেহারার সেরকম কোনো চটক চোখে পড়ছে না, অথচ একটা বিষাদময় সৌন্দর্য আছে। সরু, লালচে মুখ, কুঁচকানো ঠোঁট। কাপড় মেলতে মেলতে মহিলা একবারও কুচকাওয়াজে রত চার সৈনিক বা লেফটেন্যান্টের দিকে তাকাচ্ছে না।
পরদিন সকালে আটটা নাগাদ ছাদে উঠে চেয়ারে বসে ফাইনহালসের মনে হল যে সে এই জায়গায় যেন কত মাস, কত বছর ধরে বসে আছে। জায়গাটার চারপাশে প্রকৃতি খুব শান্তিপূর্ণ। ফলে একাকিত্ব একটা অবধারিত বিষয় এখানে। খামারে গরুর হালকা হাম্বা ডাক শোনা যাচ্ছে। আলু ক্ষেতের দিক থেকে পাতা পোড়া গন্ধ ভেসে এসে বাতাসে মিশছে। দূরবীনের লেন্সে চোখ রেখে যন্ত্রটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গির্জার হলদে চুড়ো পেরিয়ে দূর জঙ্গলের দিকে তাক করেও সে একাকী নীরবতা ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। পাহাড়ে ধূসর সবুজ ঢালে কিছু কালচে পাথর দেখা যাচ্ছে দেওয়ালের মত। লেফটেন্যান্ট মুক নদীর পাড়ে গেছে সৈনিকদের নিয়ে আক্রমণের কায়দাকানুন শেখাতে, ড্রিল করাচ্ছে তাদের। মুকের ছোট ছোট নির্দেশের শব্দগুলো এই নীরবতার মাঝে হালকা আর্তনাদের মত শোনাচ্ছে। শব্দগুলো এতটাই আবছা শোনা যাচ্ছে যে সেগুলো নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ করবার বদলে সেটা আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাড়ির একতলার রান্নাঘরে বাড়িওয়ালীর মেয়ে একটা ধীরলয়ের বিষণ্ণ সুরের স্লোভাক লোকসঙ্গীত গেয়ে চলেছে। বাড়িওয়ালী নিজে চাষের কাজে সাহায্যকারী লোকটিকে নিয়ে ক্ষেতে কাজ করছেন আলুর ফসল ঘরে তুলবার জন্য।
পাশে আরেকটা খামারবাড়িতেও সব চুপচাপ। সে দূরবীন দিয়ে পাহাড়ের দিকে তাক করে অনেকটা সময় বসে ছিল। নিঝুম নির্জন এলাকা। কেউ নেই। কোনো নড়াচড়া নেই। ডানদিকে জঙ্গলের মধ্যে রেলস্টেশনের কাছে কিছু সাদা ধোঁয়া লক্ষ্য করল সে। ধোঁয়াটা মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। ধুলোর কুণ্ডলীর মত পাক খেয়ে উঠেই আবার মিশে গেল গাছের মাথায়। কিন্তু কিছুই শোনা যাচ্ছে না। নদীর পাড়ে ড্রিলের জন্য মুকের ছোট ছোট নির্দেশ আর বাড়ির একতলায় ওই অল্পবয়সী মহিলার বিষণ্ণ গানের সুর ছাড়া তার কানে কোনো শব্দ আসছে না…
সৈনিকেরা ফিরে আসছে নদীর পাড় থেকে। গান গাইতে গাইতে ফিরছে ওরা। চারটে পুরুষের কণ্ঠ। গান গাইছে। উফফ, ওদের গান শুনেও হাই উঠছে তার। ক্লান্ত লাগছে। বিষণ্ণ লাগছে। চার লাইনের গানটা করুণ সুরের ‘ধূসর সেনাদলের সারি’। একই পদ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইছে ওরা। গানের তালে তালে মুক ‘লেফট দুই’ … ‘লেফট দুই’ এসব নির্দেশ দেওয়া বন্ধ করছে না। লেফটেন্যান্ট মুক আসলে এই জায়গাটার নীরবতার সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই লড়াইটা একেবারে অর্থহীন। ওর নির্দেশ, সৈনিকদের গান সব কিছুই ফিকে হয়ে যাচ্ছে এই জায়গাটার নৈঃশব্দ্যের সামনে।
সৈনিকেরা বাড়িটার সামনে পৌঁছে যাবার পরে ফাইনহালস দূর থেকে প্রথম গাড়িটার শব্দ পেল। আগের দিন যে শহর থেকে তারা এখানে এসে পৌঁছেছে, গাড়িটার শব্দ সেদিক থেকেই আসছে। ফাইনহালস চমকে উঠে রাস্তার দিকে দূরবীনটা তাক করল। একটা ধুলোর মেঘ এগিয়ে আসছে দ্রুতগতিতে। ড্রাইভারের কেবিনটা বোঝা যাচ্ছে। গাড়িতে ওটা অতিকায় কী রাখা আছে? গাড়ির ছাদ ফুঁড়ে উঁচু হয়ে আছে ওটা কী যন্ত্র?
(চলবে)