গল্প - জাকিয়া শিমু
Posted in গল্পমতিনের কালজীর্ণ দুধেরসরের মতো কুঞ্চিত হাতটি, বন্ধু সুনীল শক্ত করে বুকের কাছে চেপে ধরে স্থাণু হয়ে বসে আছে।
হাসপাতালের এই কামরায় জাঁকাল মাঘের-শীত ভর করেছে। ঘরের কোণে সলতেবাতির মতো একটিমাত্র ধূসর নীল বিজলিবাতি-টিমটিমিয়ে জ্বলছে। অস্পষ্ট আলো-আঁধারির রহস্যময় চাদরে ঢাকা দিয়ে আছে কামরাটি। সুনীল সেই কখন থেকে একইভাবে বন্ধুর হাতধরে বসে আছে। মুঠিবদ্ধ হাতেরপরে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে মস্তিষ্কের খোঁড়লে ডুবে থাকা স্মৃতিরা সহসা তাকে ফেরত নিয়ে যায় বহুদূরের সেই হিজলতলা গাঁয়ে, তেলাকোঁচা লতার মতো জড়াজড়ি করে দু’বন্ধুর নির্ভয়ে কেটে যাওয়া অতীত-সময়ের জমিনে।
হিজলতলা গাঁয়ে একসময়ে ওদের দু’বাড়ির সীমানাঘেঁষে বহুকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো বিশাল আকৃতির এবং বহুবছরের পুরনো এক গাবগাছ। দু’তিন বছর বয়সে শৈশবের যে-সময় থেকে মস্তিষ্কের খোঁড়লে স্মৃতি জমা হতে থাকে তখনকার ভাসাভাসা স্মৃতিকথা চোখেরকোণে ভেসে উঠছে আজ সুনীলের।
খুব ভোর করে- হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো নেশাধরা সফেদশুভ্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকা গাবফুলের গন্ধে ঘুম ভেঙ্গে যেত। রাতের আঁধারের খোলস ছেড়ে দিবস উঁকি দিতে তখনও ঢের সময়ের বাকি। পুবাকাশে সবে আবছায়া-জাফরান রঙের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। আধো আলো-অন্ধকার সাঁতরে দু’বন্ধু গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়াত তারারফুলে ছেয়ে থাকা সেই গাবতলার উঠোনে।
তখনও এযুগের পকেটওয়ালা প্যান্ট- শার্টের পাইকারি চলন শুরু হয়নি, ছোটদের জন্য তো নয়ই। গজকাপড়ে দর্জিঘরে বানানো হতো গিরুঅবধি নেমে যাওয়া ট্যাটন কাপড়ের রঙিন হাফপ্যান্ট। অবশ্য কালো সুতার তাকি কোমরে বেঁধে পকেটের কাজ পুষিয়ে নেওয়া যেত নির্দ্বিধায়। তাকিবাঁধা-কোঁচরে গাবফুল গুঁজে সূর্যমামার আকর্ষণে ছুটে যেত মতিনদের কুমিরের পিঠের মতো উঁচুনিচু ইটসুরকি বেরিয়ে যাওয়া শ্যাওলাধরা শানবাঁধা পুকুরঘাটে। ততক্ষণে গাঢ় কমলারঙের ডিমের কুসুমের মতো দিবাকর তার অস্তিত্ব জানান দিতে উঁকিঝুকি মারছে পূবাকাশে। দু’বন্ধু ইটসুরকি উঠা পুকুরঘাটে পাশাপাশি গুটিসুটি হয়ে বসে বিস্ময়ে হা হয়ে দেখত সূর্যোদয়ের সেই অপার্থিব দৃশ্য।
সেসময়ে গাঁঁয়েরবাড়িগুলোর চারপাশ ছিলো উন্মুক্ত। উপরে বিস্তর আকাশ, চারপাশ মুক্ত খোলামেলা। বাড়িগুলোর সীমানাঘেঁষে শহরের মতো হিস্যাবেড়া-আব্রুবেড়ার প্রচলন কিংবা দরকার কোনটাই ছিলো না। প্রকৃতির মতো দিলখোলা ছিল গাঁয়ের মানুষগুলো। সারাদিন মাঠের মতো খোলা উঠোনে ধুলো-জলে মাখামাখি- কাড়াকাড়ি করে তাদের শৈশবের দুর্দান্ত সময় চলে গিয়েছে আলগোছে নির্ভাবনায়।
কাছিমের পিঠে ভর করে ধীরলয়ে একসময় শৈশব থেকে কৌশরে ফিরেছে ওরা। মতিন এবং সুনীলের বয়সের ফাঁরাক মাত্র চারমাস উনিশ দিনের। হিজলতলা গাঁয়ের প্রাইমারী স্কুল বাড়ি থেকে মাইলখানেকের হাঁটাপথ। দু’জোড়া ক্ষুদ্রপায়ে অতটুকু পথ পেরোতে সূর্যদেব আসমানের মধ্যিখানে চলে আসত। তারপরও সবদিন যে স্কুলে ঠিকঠাক পৌঁছা হতো তা কিন্তু নয়। মতিন-টা ছোটবেলা থেকেই ছিল বয়সের তুল্যে বেশ আঁটসাঁট শরীরী গঠনের শক্তসামর্থ্য তবে একটু বেশিই চপল। সুনীল ছিলে তার উল্টো- বারোমেসে পীড়িত। নিদিষ্ট সময়ের মাসখানেক আগে জন্ম- নেওয়া সুনীলের, সুতিকাগার থেকেই শরীর-মনের জোর ছিলো স্তিমিত। তবে মতিনের একজোড়া নির্ভরতার হাত সুনীলের জন্যে সদা আগ বাড়িয়ে থাকত।
স্কুলের মেটেপথের দু’ধারে ছেয়ে থাকত ঢোল কলমির সারি। ফাঁকে ফাঁকে আগাছার আখড়া। সুনীলের ক্লান্তপা এলেদুলে কাঁটা নটে শাকে জড়িয়ে গেলে ব্যথার যন্ত্রণায় ছটফট করত, মতিন ছুটে এসে কাঁটা কৌশলে বের করেই ক্ষান্ত থাকত না। কাঁটা-ফুঁড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানে দাঁতেচিবিয়ে দূর্বাঘাসের কষ বের করে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে মুহূর্তে ব্যথার নিরাময়ও করে দিত। সুনীল গাছ বাইতে পারত না। কিন্তু পাখির ডিম হাতে পেতে অস্থির হয়ে উঠত। মতিন গাছের মগডালে একলাফে উঠে পাখিরবাসা থেকে পাখির নীলচে ডিম চুরি করে সুনীলের হাতের মুঠো ভরিয়ে দিত।
ওদের বাড়ির দক্ষিণে যতদূর চোখ যেত দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ ছিল। পৌষের বিকেলে মিহি রোদের ফাঁকে ফাঁকে রেশমি সুতোর মতো পাতলা কুয়াশা জমত সেখানে। ঘুড়ি উড়িয়ে একসময় দু’জনে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ত মটর-কলুইয়ের ক্ষেতের নরম বিছানায় জড়াজড়ি করে।
মাথার উপর অসীম শূন্যলোক। সেদিকে চোখ রেখে কোনঅজানা অকূল থৈথৈ ভাবনায় জড়িয়ে যেত, কে তার নাগাল পায় ! সেসময়ে তাদের ধ্যান ভাঙ্গাত মাঝেরচরের মঙ্গল রায়। আইলা লাঠি হাতে তেড়ে আসত এদের তাড়াতে। মঙ্গল রায় থেকে রক্ষা পেতে প্যান্টের তাকি-পকেটে মটরের শিম ভর্তি করে নিয়ে দৌড়ে পালাত যখন, ভগ্ন শরীরে দৌড়ে কুলাতে পারত না সুনীল। অল্পতেই দাঁড়িয়ে হাঁপাতে শুরু করত। ভগ্নশরীরে ভয়ডরও জাঁকিয়ে ধরত ওকে। আতঙ্কে বুকেরখাঁচা কামারের ফুটু হাপারের মতো দুলতে থাকত। মতিন সুনিলকে রক্ষা করতে দৌড়ে যেয়ে ওকে আড়াল করে সামনে দাঁড়িয়ে যেত।
ইছামতী নদীর ওপারের গাঁয়ে দলবেঁধে মাছ ধরতে গেলে জিয়লের কাঁটা ঠিকঠিক সুনীলের পায়ে ফুঁটে যেত। সবকিছুতে সুনীলের কারণে মতিন পিছিয়ে পড়ত। সবাই হল্লা করে মাছ তাড়িয়ে ফাঁদে ফেলে যেই মাছ ধরতে যাবে ঠিক সেসময়ে সুনীল পা চেপে ধরে যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠত। মতিনের মাছ ধরা ভেস্তে যেত। মাছের খালুই উল্টে ফেলে সুনীলকে নিয়ে নদীপাড়ে উঠে আসত। সে বয়সে অনেকটা বিজ্ঞজনের মতো বিশেষ গাম্ভীর্য মুখে এঁটে মাছের কাঁটার-মন্ত্র, তেতিয়ে-ওঠা সূর্যের দিকে মুখ ফিরিয়ে সুনীলকে পাঠ করাতো। মন্ত্রপাঠে তো নয় বন্ধুর ভালোবাসার স্পর্শে সুনীলের ব্যথার যন্ত্রণা সত্যি সত্যি কোথায় উড়ে পালাত !
এভাবে হেলায়খেলায় পাখির ডানায় ভর করে দিনগুলো বেশ ভালোয় ভালোয় কাটছিল। তখন কতো তাদের বয়স হবে, প্রাইমারী ছেড়ে হাইস্কুলে তিনক্লাসে সবে উঠল সেবছর। একদিন ভোরসকালে সুনীলের বাপ সন্যাসরোগে মুদিদোকানি ছেড়ে চিতেয় উঠলেন।
এরপর থেকে সুনীলের সুখগুলো ঝড়ে ছাই-উড়ে যাওয়ার মতো করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। পড়াশুনা চালিয়ে নেওয়ার পথ রইল না। বইখাতা সেরদরে বেচে দিয়ে বাবার মুদিদোকানে কাজে লেগে পড়তে হলো তাকে।
সুনীলের গায়েগতরে জোর কম। মতিন স্কুলশেষে সুনীলের দোকানের ভারি কাজগুলো সেরে দিয়ে আসে। আবার বেশ রাত করে বাজার ভাঙ্গতে দোকানের ঝাঁপিটানার সময় হয়, সুনীলকে সাহায্যে করতে সে ঠিক সময়মতো দোকানে যায়। বাজার থেকে আঁধাররাতে জুনিপোকার আলোতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে যতটুকু সময় মেলে দু’বন্ধু সারাদিনে জমিয়ে রাখা কথার ঝুড়ি খোলে ধরে। কতো স্বপ্ন তাদের। সেই শৈশব থেকে মুঠো মুঠো করে জমিয়ে রাখা স্বপ্নগুলো যদিও হঠাৎ হঠাৎ আকাশের নক্ষত্র ক্ষয়ে পড়ার মতো করে ঝরে যায় তারপরও আবার নতুন স্বপ্ন এসে তা ভরাট করে দেয়। দু’জনের পথ মাঝপথে এসে হুঁচট খেয়ে বাঁক ঘুরে গেছে সেই সুনীলের বাপ চলে যাওয়ার দিন থেকে। তারপরও মতিন সুনীলের চোখে বুনে দেয় আসমান ছুঁয়া স্বপ্নবৃক্ষের চারা। মতিন সুনীলের জীবনের ধুনুচি হয়ে তাকে আগলে রাখে সবসময়। মিইয়ে-পড়া সুনীল- কেবল বুকে বল পায়, অকূলে তটের দেখা পায় মতিনের পরামর্শে, উৎসাহে।
সময় বয়ে যায়। মতিন স্কুল ফাইনাল পাশ করে। কলেজে ভর্তি হতে শহরে যাওয়ার বন্দোবস্ত চলছে। সেবছর মতিনের বাবা কঠিন অসুখে পড়লেন। ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মস্তবড় অফিসার বানানোর স্বপ্নটা মাঝপথে এসে তাকে থামাতে হল। মতিন সংসারের জোয়াল ধরতে শহরে চাকুরির খুঁজে চলে যায়। এবং একসময় বাবার পরিচিত একলোক ধরে পিয়নের একটা কাজও জুটিয়ে ফেলে।
সুনীল সারাক্ষণ জোড়াভাঙ্গা ছানার মতো ছটফট করে, মতিনের পথ চেয়ে বসে থাকে। মতিনকে ছাড়া একদম চলে না। ওদিকে মতিনের দম ফেলার ফুসরত নেই। কাজের ব্যস্ততার মাঝেও সারাক্ষণ বন্ধু সুনীলের কথা পড়ে, মনের গহীনে খোঁচাতে থাকে। পিয়নের কাজে ছুটি পাওয়া বড় মুশকিল। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও অফিসের স্যারের ফুট-ফরমাশ খেটে দিন পার হয়। মাসে একবার বড়োজোর দু’বার গাঁয়ে ফিরতে পারলেও ছুটি মাত্র একদিনের।
সুনীলের দাঁড়িগোঁফ এখনো ঠিকঠাক হয়ে উঠেনি, কালোরেখার দাগে লোমের আঁচর সবে পড়তে শুরু করেছে। নরম বয়স। তাছাড়া শরীর মন উভয়ই তার বয়সের চেয়ে বেশ পিছিয়ে আছে। বাপমরা ছেলেকে নিয়ে মায়ের উৎকণ্ঠার শেষ নেই। ছেলেকে বিয়ে দিয়ে সমস্ত দুঃখের অবসান ঘটাতে মায়ের তোড়জোড় শুরু হয়। সুনীল প্রথম প্রথম বেঁকে বসলেও পরে অবশ্য এ-বিষয়ে কথা বাড়ায় না। মা সুনীলের মৌনতাকে সম্মতি ভেবে নিয়ে মায়ের দূরসম্পর্কের আত্নীয়ের সাথে বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেলে এবং সুনীলকে অল্পবয়সে সাতপাকে বাঁধা পড়তে হয়।
মতিন কাজের ব্যস্ততায় শহুরে ইটকাঠের খপ্পরে, ফাঁপরজীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। শহুরে মেয়ের সাথে ভাব-ভালোবাসা বিনিময়ে বিয়ে করে সংসারও পেতেছে। ছ’মাসে কিংবা বছরে একবার তাও অল্পসময়ের জন্যে গাঁয়ে ফিরতে পারে। সুনীলের বন্ধুর জন্যে খুব মন পুড়ে। যদিও দু’বন্ধুর প্রায়মাসে চিঠিপত্রে যোগাযোগ হয়। কিন্তু তাতে সুনীলের মন ভরে না। এরপর মাঝেমধ্যে অবশ্য সুনীল পরিবারসহ বন্ধুর সাথে দেখা করতে শহরে যায়। আচমকা সময়ে অসময়ে সুনীলকে দেখে বন্ধু মতিনের সেকি আনন্দ ! কতো কথা জমা হয়ে থাকে দুজনের মনের কোটরে। দু’বন্ধু বহুদিন পর পর হলেও দিলখোলে গল্প করে। গল্পে গল্পে কখন রাত শেষে ভোর হয়, খেয়ালে থাকে না !
এরও বছর চারেক পরের কথা।
এক আষাঢ়ে ডলকের ভর-সন্ধাবেলায় মতিন বসে আছে তার দো-কামরা ঘরের ঝুলবারান্দায়। সন্ধ্যা নামতে মাঝরাতের আঁধারে জেঁকে বসেছে চারিপাশে। বাইরে উথালপাথাল বর্ষণ ঝরছে। সেসময়ে কাঁকভেজা হয়ে পোষ্টমাষ্টার ঝুলবারান্দার ফাঁক দিয়ে তাকে একখানা হলুদখামের চিঠি ধরিয়ে দিয়ে যায়। খামের উপর সুনীলের ঠিকানা দেখতে মতিন তড়িঘড়ি করে আধভেজা খামটা খুলে। একখানা চিরকুট।
সুনীলের চিঠিগুলো সাধারণত চারপাঁচ পৃষ্ঠার বেশি হয়। মতিন ছুটিরদিনে আয়েশ করে বসে সে চিঠি পড়ে। প্রায় সপ্তাহে সুনীলের চিঠি আসে যদিও সময়ের অজুহাতে মতিন এত ঘনঘন উত্তর দিতে পারে না। কিন্তু সুনীল তাতে ক্ষান্ত হয় না। সুনীলের চিঠিতে হিজলতলা গাঁয়ে ঘটে যাওয়া সমস্তঘটনার বিস্তারিত লেখা থাকে।
গাঁয়ের কোন গাছে এবছর আম ধরেনি কিংবা ইছামতীর বাঁশের সাঁকো খুলে গেল, নাকি ঝুলে পড়ল সেসব অপ্রয়োজনীয় বার্তাও কখনো না লিখে সে চিঠি শেষ করে না। সেখানে মাত্র দু’লাইনের চিরকুট দেখে মতিনের টানটান কপালে রেশমিসুতার মতো মিহিভাঁজ ফুটে ওঠে। যদিও মতিন দু’লাইনী চিঠির ভারে মুহূর্তে চূড়া-ভাঙ্গা পাহাড়ের মতো মাটিতে ধপাস করে বসে পড়ে। সুনীলের দু’কিডনি অচল, নিথর।
সুনীল মুদিদোকানি। জমি-জিরাত বলতে দাদার-কালানের এককানি জমি। এরইমধ্যে সংসারে যোগ হয়েছে দু’কন্যাসন্তান। চোখে-মুখে অমানিশার কালো আঁধার এঁটে রাতদিন বাড়ির পুবকোণের বাঁশের মাচায় চুপচাপ বসে থাকে। সন্মূখের ভাবনায় জমাটবাঁধা অন্ধকারে ডুবে থাকে তার মন, পাঁজরফাটা দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে ওঠে তার চারপাশ। দু’চোখের জমানো স্বপ্নগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে শূন্যে ঠেকেছে সেই কবে। মেয়ে দুটো সারাক্ষণ চোখের সামনে হাঁটিহাঁটি পায়ে হেঁটে বেড়ায়। বউটা কান্না সামলে উঠতে মুখে শাড়ির আঁচলের খুঁট গুঁজে আবডালে লুকায়।
সেসব দেখে সুনীলের অসহায় দু’চোখ বেঁয়ে শুকিয়ে যাওয়া চোখেরকোণ থেকে নীহারের মতো অশ্রুবিন্দু ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ে। হাত পা ফুলে ঢোল হয়ে আছে। দোকানটা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এখন একটামাত্র কাজ বাকি, তা কেবল চিতেও ওঠা !
একদিন ভোরের আদুরে আলোয় ভর করে সুনীলের জীবনের ঘোর আঁধার কেটে আচম্বিত সুখ ফিরে আসে। সুদখ হয়ে বরাবরের মতো বন্ধু সুনীলের সায়ংকালে এগিয়ে আসে মতিন। মতিনের সাথে সুনীলের কিডনি মিলে যায়। উভয়ের রক্তের গ্রুপ ও’ নেগেটিভ। দেশে সেসময়ে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট মোটেও সহজতর ছিল না। কিন্তু দেশের বাইরে চিকিৎসা নেওয়ার অর্থনৈতিক অবস্থায় দু’বন্ধুর কেউই ছিলেন না। সুস্থসবল মতিনের জীবনের ঝুঁকি বিষয়ে চিকিৎসকদের কপালেও উদ্বেগের মিহি-চিরল ভাঁজ দেখা যায়। কিন্তু মতিনের বুকভরা সাহস এবং বন্ধুর প্রতি বিশুদ্ধ ভালোবাসার কাছে সমস্ত দুর্ভাবনা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সমস্ত ঝক্কিঝামেলা শেষে সুনীল সুস্থ হয়ে হিজলতলা গাঁয়ে ফিরে আসে।
মাঝে চল্লিশ বছর পার হয়।
একদিন আচমকা ডা-এর কথায় চল্লিশ বছর আগের মতো মতিনের মাথায় আকাশটা যেন ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে পড়ে। বয়সের ভারে কোঠরে লুকানো ধূসর চোখেজোড়ায় মুমূর্ষু মানুষের মতো নিরুপায়-দৃষ্টি মেলে সে ডা. দিকে তাকিয়ে থাকে। মতিনের কিডনি বিকল’ রোগ ধরা পড়ে।
বেশ কদিন ধরে শরীরটা ভারি হয়ে আসছিল। শরীরের জোর কমছিল খুব দ্রুত। একটুতেই হাঁপিয়ে ওঠে। ঘুম হয় না, মুখের রুচি উড়ে যায়। শেষবয়সে এসেও শরীরটা বলতে গেলে এতদিন বেশ ভালোই চলছিল। ডা.-কবিরাজ এড়িয়ে চলা মতিন, শরীরের এমন বেহাল দশায় একসময়ে ডা. কাছে যেতে বাধ্য হয়। শেষমেশ কিনা সেই চল্লিশ বছর আগেকার কথার প্রতিধ্বনি নিজের সায়ংকালে শুনতে হল ! তার একটি মাত্র কিডনি, যারও কিনা শরীরকে চালিয়ে নেয়ার ক্ষমতা প্রায় নিঃশেষ। কিডনিটা নিজে মরার আগেই মরে গেল ! অথচ বন্ধুর দেহে নিজের কিডনিটা ঠিকঠাক চলছে। প্রকৃতির কী খেয়াল ! বাঁচতে হলে প্রতিসপ্তাহে তাকে ডায়ালিসিস করতে হবে।
প্রতিসপ্তাহের বুধবার সকাল দশটায় মতিনের সময়বাঁধা ডায়ালিসিস। আষাঢ়ে-ডলক কিংবা জিরজিরে হাড় কাঁপানো শীতের প্রকোপ ঠেলে হিজলতলা গাঁ থেকে সুনীল প্রতি বুধবার ভোরের আবেশ না কাটতে বন্ধুর বাসায় উপস্থিত হয়। দু’হাত ভরে নিয়ে আসে বন্ধুর প্রিয় হরেকরকম খাবার।
এদিনে মতিনের খাবারে কড়াকড়ি একটু কম থাকে। এসুযোগে বন্ধুর প্রিয়খাবার বয়ে নিয়ে সেই আঁধারভোরে বাসে চেপে বসে সে। মতিনের ইদানীং সেই কবেকার খাবারের কথা খুব মনে পড়ে। মুখে সেই আগের স্বাদ নেই তারপরও মন চায় চেখে দেখার। সেই শৈশব-কৌশরে জিভে-লেগে থাকা স্বাদের খোঁজে মায়েরহাতের কতো খাবারের কথা মনেপড়ে মতিনের। কখনো চুলার ছাইয়ে পোড়া জিয়লমাছের ডিমের হাতে-ডলা ভর্তা , লাউপাতায় চ্যাপাশুঁটকি, অনিলের দোকানের রসগোল্লা কিংবা নিখিলের দোকানের নিমকিকাটা চানাচুর।
দু’বন্ধু বুধবারে রাজ্যের গল্প করে। ডায়ালিসিসের পুরোটা সময় সুনীল মতিনের সুঁচে-ফুটা হাতটা ধরে বসে থাকে। ও-হাতে মায়াভরা নিজের হাতটা ছুঁয়ে দিলে যেন বন্ধুর কষ্টটা একটু হলেও লাঘব হয়। দূষিতরক্তের ধারা হাতে জড়ানো পাইপের ভেতর দিয়ে মেশিনে শুদ্ধ হতে বেগে চলে, মতিনের চিরচনা হাসিমাখা মুখটা কেমন বিষণ্ণ অচেনা হয়ে উঠে। সুনীল এসময়ে বড়ো উদগ্রীব থাকে। বন্ধুর মন ফেরাতে ইনিয়ে-বিনিয়ে গল্প জুড়ে দেয়। কতো কথা বলার আছে বন্ধুকে ! সময় মিলেনি সেসব বলার। এসুযোগে আবার সেই শৈশব-কৌশরবেলার মতো অঢেল সময় মিলে যায় তাদের। ফেলে আসা সেইসব দুর্দান্ত দিনের স্মৃতি হাতরে ডায়ালিসিসের বিরক্তকর সময় আলগোছে কখন কেটে যায় টেরই পাওয়া যায় না।
বছরখানেক এমন রুটিনে ভালোয় ভালোয় চলছিল তাদের সময়। কিন্তু এবছরের গোড়ার দিকে মতিনের শরীর ভাঙ্গতে শুরু করে। ডায়ালিসিস সপ্তাহে একদিনের পরিবর্তে দু’দিন এরপর তিনদিন বেঁধে দেওয়া হয়। রক্ত দিতে হয় নিয়মিত। দুষ্করশ্রনির রক্ত হলেও সুনীলের রক্তের সাথে মিল থাকায় শেষসময়ে বন্ধুর ঋণ কিছুটা হলেও যেন শোধ করার সুযোগ পায় সে।
আজও অন্যদিনের মতো ডায়ালিসিস চলছিল। গল্প চলছিল পুরোদমে। মতিন স্মিতহাস্যে স্থিরচোখে সুনীলের মুখের দিকে তাকিয়ে শুনছিল তার কথা। হঠাৎ বন্ধুর নিথর হাতটা সুনীলের হাত থেকে সরে যেতে চমকে উঠে সুনীল। চোখ পড়ে মতিনের শরীরের সাথে লাগোয়া পাইপের বেঁয়েচলা রক্তধারার দিকে। জমাটবেঁধে আছে পাইপে চলা রক্ত। অল্পক্ষণের ব্যবধানে বন্ধুর হাতটা, নিথর-শীতল লাশের হাত হয়ে গেল !