Next
Previous
1

গল্প - আর্যা ভট্টাচার্য

Posted in






' এবার তাহলে খুঁড়তে শুরু করি'?

হেড কন্সটেবলের দিকে তাকিয়ে হিন্দিতেই জিজ্ঞেস করে ভিখু সর্দার। বাকি তিনজন লোকও তারই। এ ধরনের কাজে ফৈজাবাদ পুলিশ এ রকম কয়েকটা দলকেই ডাকে। এরা এসব কাজে এক্সপার্ট। তাই কাজটা তাড়াতাড়ি আর ভালো ভাবে হয়। আকবরা গ্রামের ক্ষেত্রেও এদের ডাক পড়েছে।

গ্রামের পুকুর থেকে পশ্চিম দিকে খানিকটা গেলেই একটা বিশাল অশ্বত্থ গাছ। তার থেকে একশো মিটার মতো দূরে মোটামুটি ৬ফুট রেডিয়াস নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি হবে। গ্রামে এমন কান্ড এর আগে আর হয়নি তাই গ্রামের লোক একেবারে ভেঙে পড়েছে। তাদের সামলানোও এক কাজ! জনা তিনেক কন্সটেবল দড়ি দিয়ে জায়গাটা ঘিরে রেখেছে। তাও কী আর কৌতুহলী জনতাকে আটকে রাখা যায়! তারা অনবরত চেঁচামেচি করে চলেছে।

খোঁড়ার এলাকার বাইরে কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার আর দুটো খাটিয়া পাতা। যেমন উত্তরপ্রদেশের গ্রামের দিকে হয় আরকি। একটা চেয়ারে ফৈজাবাদ থানার ওসি সুশীল ঝা বসে আছেন। আর তার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে কন্সটেবল তেজপাল। আর একটু দূরে রীতেশ শর্মা আর মানিকচাঁদ সিং । তারা ভিড় সামলাতে ব্যস্ত। ওসির পাশের চেয়ারক'টায় গ্রামের মুখিয়া, পার্টি পঞ্চায়েতপ্রধান আর গ্রামের আরও কয়েকজন গন্যমান্য ব্যক্তি। একটা খাটিয়াতে একজন সাহেব এবং একজন বাঙালি মহিলা কাগজপত্র ল্যাপটপ ছড়িয়ে বসেছেন। ইতিমধ্যে গ্রামের লোক জেনে গেছে যে ওই সাহেব বিলেত থেকে এসেছেন। তাঁর নাম রিচার্ড টমসন। আর ওই মহিলা হলেন বিদিশা রায়। ওরা নাকি ভুত ফুত আত্মা টাত্মা নিয়ে কাজ করেন।

বেড়ে রগড়। আর সেটা দেখার জন্যই এতো ভিড়।

তাঁদের পাশের খাটিয়ায় দামী প্যান্ট শার্টপরা এক ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা আর একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা ছেলে।

'এদের নাম জানিস?”আফজল রঘুকে জিজ্ঞেস করে।“

আফজল আর রঘু এই গ্রামের ই ছেলে। প্রায় বেকার ই বলা যায়। টুকটাক কাজ করে আরকি। তবে দুজনে মিলে একটা ব্যবসা করার প্ল্যান করছে। বয়স তো বেশি নয়। বিশ বাইশ হবে। লেগে যাবে কিছু একটা। সেই ব্যাপারেই আগের দিন আফজল মথুরা গেছিল। এই ফিরেছে। আর ফিরেই এতো ভিড় ভারাক্কা দেখে অবাক। আর রঘু ছাড়া কাকেইবা জিজ্ঞেস করবে। অগত্যা রঘুকেই পাকড়াও করেছে। এমনিতেও রঘুর চোখ এড়িয়ে এ গ্রামে কিচ্ছুটি হবার উপায় নেই। একেবারে চলতা ফিরতা ব্রেকিং নিউজ চ্যানেল।

“কেন জানবোনা? ওরা কলকাতা থেকে এসেছে। বাঙালি। লোকটা কলেজে পড়ায়। নাম ভাস্কর পাল। মহিলাটা ওর বৌ। সেও নাকি স্কুলে পড়ায়। নাম শুনলাম রূপা। আর ওই যে বাচ্চাটা ওর শুভনাম জানিনা, ডাকছিলতো 'বাবাই' বলে। ওই তো… ওকে নিয়েই তো”, মুখে একটা সবজান্তা হাসি নিয়ে ঈষৎ ভুরু নাচিয়ে বলে রঘু।

' সকাল থেকেই তো সব এসেছে। তুই এখনই ফিরেছিস তাই সবটা জানিস না…পুরা মাদারি কা খেল ভাই',

রঘু আর আফজল পুলিশের চোখ, কান বাঁচিয়ে চোখ টিপে খিঁক খিঁক করে হাসতে থাকে।

একটু দূরে অশ্বত্থ গাছের নিচে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে জানকীদেবী। এক অদ্ভুত অনুভূতি তাকে যেন অবশ করে ফেলছে। ভেতরে ভেতরে কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

শীত প্রায় এসেই গেল। বেলাও ছোট হচ্ছে। তাই আজ সকালেই রজাইগুলো, রোদে দেবে বলে গুছিয়ে নিয়েছে আর তখনই হঠাত করে দৌড়ে একটা অচেনা বাচ্চা কোথা থেকে এসে তাকে একেবারে দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছিল। জড়িয়ে ধরেছিল মানে হাঁটুর কাছটা আরকি। অতো ছোট বাচ্চা তার হাঁটু পর্যন্তই পৌঁছেছিল, তার হাঁটুর কাছটাই জড়িয়ে ধরে বাচ্চাটা বলে উঠেছিল, “জানকী.. প্যারী..মেরি জান”। ওর বলার মধ্যে কী যেন একটা ছিল….. আর ভংগীটাও! এও কি সম্ভব! সাঙ্ঘাতিক হতভম্ব হয়ে চমকে উঠেছিল জানকী, আর তার হাত থেকে রজাইগুলোই সব মাটিতে পড়ে গেছিল।

'কে এই বাচ্চা? কার? কোথা থেকেই বা এলো!

যেন বা তার না বলা মনের কথা পড়ে নিয়ে তার হাত ধরে টেনে, 'চলো, অন্দর চলতে হ্যায়' বলে উঠোন পেরিয়ে, এক ছুটে একটা বড় ঘরের মধ্যে গিয়ে একেবারে বিছানায় উঠে সটান শুয়ে পড়েছিল বাচ্চাটা।

যেন এই বাড়ি তার কতো দিনের চেনা।বছর পাঁচেকের বাচ্চা, অথচ যেন বাচ্চা নয়। হাবভাব সবেতেই অন্য কারো যেন ছাপ।

আয়েস করে বিছানায় শুয়ে জানকীকে বিছানায় এসে বসার জন্য' দূরে কেন, এখানে এসো' বলে ডাকতে লাগলো। কী যে বলবে জানকী যখন কিছুই বুঝতে পারছেনা ঠিক তখনই দুজন লোক আর দুজন মহিলাকে সংগে নিয়ে জানকীর ছেলে বলবীর এসে ঘরে ঢুকেছিল।

সেই শুরু।

আবার কী এক আশঙ্কায় জানকীর বুকের ভেতর টা কেঁপে ওঠে। আশেপাশের লোকেরা অনেকেই জানকীকে চোরা চাহনিতে দেখছে। এই মধ্য বয়সেও জানকী শুধু যে যথেষ্ট সুন্দরী তা নয়, শারীরিক ভাবেও সে আজও আকর্ষক। তবে লোকজন তার দিকে সেজন্য তাকাচ্ছেনা। তাদের দৃষ্টিতে শুধুই কৌতুহল আর আশংকা। এমনিতেও জানকীর চরিত্রে আজ অবধি কেউ কোনো বেচাল দেখেনি। প্রায় দশ বছর হলো জানকীর স্বামী ওমপ্রকাশ নিরুদ্দেশ। প্রচুর থানা পুলিশ করেও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাই কোনো ক্রিয়া করম ও হয়নি। যদি বেঁচে থাকে!

আর মরে গিয়ে থাকলে, ক্রিয়া করমহীন হয়ে তার আত্মা কতোই না কষ্ট পাচ্ছে! কিন্তু চোদ্দো বছর না কাটলে ক্রিয়া করম কিছুই তো করা যাবে না। এতো সবাই জানে। আর এ সবই গোপনে গ্রামের লোকেদের আলোচনার বিষয়। দিন এভাবে ই চলছিলো।

কিন্তু এতদিন বাদে হঠাৎ কলকাতা থেকে এই দলটা এলো, আর গ্রাম জুড়ে একেবারে শোরগোল পড়ে গেল।

গ্রামের লোকজন কী বলছে বা ভাবছে সে দিকে বিদিশা রায়ের মন ছিলো না। ওখানে বসেই ল্যাপটপ খুলে কাহিনির ইম্পর্ট্যান্ট অংশগুলো আর একবার দেখে নিচ্ছিলেন, অনেকটা যান্ত্রিক ভাবেই। ল্যাপটপে দেখে তাঁর মন চলে গেছিল বছর খানেক আগের অগাস্ট মাসের দশ তারিখে; যেদিন প্রথম মিস্টার আর মিসেস পাল তাঁদের বছর চারেকের ছেলে রাজদীপকে নিয়ে তার চেম্বারে এসেছিলেন।

মিস্টার পাল জানিয়েছিলেন, তাঁর ছেলে রাজদীপ, যার ডাক নাম বাবাই, তার জন্যই তাঁরা এসেছেন। ইন ফ্যাক্ট রাজদীপের পেডিয়াট্রিশিয়ান ড: বীতশোক সেন তাঁদের পাঠিয়েছেন।

“এই যে ওর প্রেস্ক্রিপশন”, বলে ড:সেনের লেখা প্রেস্ক্রিপশন্টাও মিস্টার পাল এগিয়ে দিয়েছিলেন।

“ হ্যাঁ, আমি জানি। বীতশোক আমাকে ফোন করেছিল।আচ্ছা, আপনার ছেলে কি আনউসুয়াল কিছু বলছে বা করছে?”, বাচ্চাটিকে চোখ দিয়ে জরিপ করতে করতে বিদিশা রায় জিজ্ঞেস করেছিলেন। '

ব্যবহারে অস্বাভাবিক কিছু তো দেখা যাচ্ছেনা এখন পর্যন্ত। একটা মিষ্টি সুন্দর বাচ্চা মায়ের পাশের চেয়ারে বসে এদিক ওদিক দেখছে। এপারেন্টলি কোয়াইট নর্মাল। মনে মনে ভাবেন বিদিশা। তাহলে আমার কাছে কেন? তার মতো সাইকোলজি এবং প্যারাসাইকোলজির ডাক্তারের কাছে বীতশোক পাঠালো কেন ! কারণ তো কিছু আছে নিশ্চয়ই।

এবার কথা বলে ওঠেন মিসেস পাল। বাচ্চাটির মা। তাঁর গলার স্বর, বলার ভঙ্গি, সবেতেই বোঝা যাচ্ছে যে উনি প্রচন্ডরকম হাইপার আর টেন্সড হয়ে রয়েছেন।

“ কী ভাবে আপনাকে বোঝাবো ডক্টর, বাবাই আমাদের একমাত্র ছেলে। ইন ফ্যাক্ট আমাদের বিয়ের সাত বছর পরে ও জন্মেছে। অনেক ট্রিটমেন্টের পর, আই ভি মেথড এ। বুঝতেই তো পারছেন, সেজন্য ওকে নিয়ে আমরা প্রথম থেকেই একটু এক্সট্রা কেয়ারফুল ছিলাম। তবে ওর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু ছিলোনা। বরং বাচ্চা হিসেবে ও যথেষ্ট ইন্টালিজেন্ট। আর ও কথাও বলেছে খুব তাড়াতাড়ি । আর তখন থেকেই যতো ঝামেলার শুরু '; বলতে বলতে মিসেস পালের চোখ ছলছল করে ওঠে।

মিসেস পালের দিকে একটা টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বিদিশা রায় ক্যাসুয়ালি জিজ্ঞেস করেন, “ কী রকম? “

“ কথা বলা শুরু করতেই জানেন তো, বাবাই থেকে থেকে বাঙলার সঙ্গে হিন্দিতেও কথা বলতে শুরু করলো। যদিও ওর বা আমাদের কোনো ঘনিষ্ঠ অবাঙালি বন্ধু নেই।

তাও আমরা ভেবেছিলাম হয়তো হিন্দি গান শুনে বা টিভি থেকে, লাইনগুলো পিক আপ করেছে। কিন্তু লক্ষ্য করলাম যে কথাগুলো ও বলছে সেগুলো কোনো গান বা সিরিয়ালের ডায়লগ নয়। ও সব নিজস্ব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলছে। যেন বাচ্চা নয়, কোনো বড়ো মানুষ কথা বলছে।

তখনই ভয় পেয়ে, ওকে ড: সেনের কাছে নিয়ে গেলাম। কারণ উনিই ওকে ছোট থেকে দেখছেন।“

“আচ্ছা, ও কি কোনো জায়গা, প্রফেশন বা কারুর নাম বলতো? “

ল্যাপটপে নোট নিতে নিতেই প্রশ্ন করেন বিদিশা।

এ বার হাল ধরেন মিস্টার পাল।

“ প্রথম যে ঝামেলাটা শুরু করে, কিছুতেই ওর মায়ের কাছে থাকবেনা। সমানে বলতো, আমি তোমার কাছে থাকবোনা। আমি জানকীর কাছে যাব। জানকী তোমার মতন দেখতে নয়। জানকী খুব সুন্দর। আমাকে খুব ভালোবাসে। আদর করে। যদি জিজ্ঞেস করতাম জানকী তোমার কে হয়, ওমনি চুপ। আর দুটো নাম খুব বলে,ওমপ্রকাশ আর আকবর।

প্রায় ই বলে ওর নাকি ছেলে আছে, দোকান আছে। ও এখানে থাকবেনা। ওখানেই যাবে। একেক দিন ওখানে তক্ষুনি নিয়ে যাবার জন্য এমন ট্যান্ট্রাম, চেঁচামেচি করতে থাকে যে সামলানোই মুশকিল হয়ে যায়। খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত করতে চায়না। আমার এক পাড়ার কাকু বললেন যে বাবাই জাতিস্মর। আর জাতিস্মররা নাকি বেশিদিন বাঁচেনা। খুব ভয় পেয়ে গেছি আমরা। কী হবে এখন আমার ছেলের?!“

বলে ভাস্কর পাল চিন্তিত ও অসহায় ভাবে ড: বিদিশা রায়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন ।

“দেখুন ও সব বাজে কথায় কান দেবেন না। হতে পারে দিস ইস আ কেস অফ রিইনকারনেশন। আবার নাও হতে পারে। আরও এভিডেন্স না পেলে, এখনই কিছু বলা যাবেনা। বাচ্চারা অনেক সময় ই তাদের কল্পনার জগতে থাকে। সেটাই সত্যি বলে মনে করে।আপনারা এক কাজ করুন, ওর উপর একটু নজর রাখুন। কী বলছে, কী করছে…রিমার্কেবল কিছু দেখলে বা শুনলে একটা জায়গায় লিখে রাখুন। জার্ণাল টাইপের কথা বলছি আরকি। তবে ও কিছু বললে চুপ করিয়ে দেবেন না। আবার জেরা করার মতো করে কিছু জিজ্ঞেস ও করবেন না। ও নিজে থেকে কিছু বললে একটু উৎসাহ দেবেন। আর কী বলছে, যেমন বললাম, লিখে রাখবেন “।

এবার রাজদীপের তাকিয়ে ড:রায় মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “ তোমার নাম কি? “

বাবাই নিশ্চুপ।

“তোমার মা, বাবা তোমাকে কি বলে ডাকেন?”

“বাবাই”,

“ জানকীকে চেনো?'

ব্যস, চুপ।

মুখে আর কোনো কথা নেই।

হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে নিজের মনেই আস্তে করে বললো, বাগিচা'

আস্তে বললেও সেটা ড:রায়ের কান এড়ালোনা।


একটু ক্ষণ বাবাই এর দিকে তাকিয়ে থেকে, তারপর ওর পেরেন্টদের দিকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলেছিলেন,

“পরের সপ্তাহে আমি একদিন যাবো আপনাদের বাড়িতে। নিজের পরিবেশে ওর হয়তো ওপেন আপ করতে সুবিধা হবে।

আর একটা কথা। এ বিষয়ে আমি ড: রিচার্ড টমসনকে কন্সাল্ট এবং ইনক্লুড করতে চাই। উনি পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত প্যারাসাইকোলজিস্ট ই নন, আমার রিসার্চ গাইড ও ছিলেন। আপনাদের কোনো আপত্তি নেই তো?”

“ না,না, আপত্তির প্রশ্নই ওঠেনা। আমরা শুধু চাই আমাদের ছেলে স্বাভাবিক হয়ে যাক” বাচ্চাটির বাবা, মা দুজনেই প্রায় কাঁদোকাঁদো স্বরে বলে উঠেছিলেন।

চেম্বারে এবং বাড়িতে রাজদীপের সঙ্গে কথা বলে, আর পাল দম্পতির লেখা জার্নাল থেকে মাস দুয়েকের ভেতর মোটামুটি যা জানা গেল, তার থেকে বিদিশা এবং ড: টমসন, দুজনেই অনুমান করলেন যে যদি এটা পূর্ব জন্মের ব্যাপার হয়, তাহলে রাজদীপ যেখানে থাকতো সেটা একটা আধা মফ:স্বল বা বর্ধিষ্ণু গ্রাম হওয়া সম্ভব।

সে বারবার ওমপ্রকাশের কথা বলে। সুতরাং তার নাম ওমপ্রকাশ হবার সম্ভাবনা আছে। যদিও তার নাম কি ছিল এ প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর তার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি । তবে তার যে ছেলে আছে সে কথা সে স্পষ্ট বলেছে।

মেয়ে হয়তো ছিলনা, কারণ তার মেয়ে আছে কিনা যখন জিজ্ঞেস করা হয়, তখন সে পরিষ্কার মাথা নেড়ে ' না' বলেছে । তার স্ত্রীর নাম সম্ভবত: জানকী এবং তাকে সে যে খুব ভালোবাসতো এটা তার বারবার জানকীর কাছে যাবার ইচ্ছে, তার রূপের প্রশংসা করা, মা কে জানকীর মতন সাজতে বলা-এ সব থেকেই মোটামুটি নিশ্চিত। এছাড়াও সে আরেকটা নাম খুব বলে। “মতি”।

এই মতি কী কোনও মানুষ , নাকি পশুপাখি সেটা তার কথা থেকে এখনো বোঝা যায়নি।

প্রথম ব্রেকথ্রু টা এলো একদিন যখন ড: টমসনের কথা মতন বিদিশা ল্যাপটপে রাজদীপকে নাম না বলে, বিভিন্ন জায়গার ছবি দেখাতে লাগলেন। দিল্লীর ছবি দেখেই রাজদীপের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বিদিশার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ' এই তো দিল্লি।'

ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হলেও বিদিশা শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলেন,” তুমি এখানে থাকতে?”

“ না তো। কারোবার কে লিয়ে যানা পড়তা”

আবার সেই হিন্দি।

“তোমার বাড়ি কি দিল্লি থেকে অনেক দূরে ছিল?”

“না তো”

এবার বিদিশা দিল্লির কাছাকাছি জায়গা, যেমন গুরগাঁও, নয়ডা, এইসব জায়গার ছবি দেখাতে দেখাতে যেই গাজিয়াবাদের ছবি এসেছে, অমনি রাজদীপ নিজে থেকেই বলে উঠলো, “ গাজিয়াবাদ।“

তারপর মা কে জড়িয়ে ধরে আকুল ভাবে বলতে লাগলো, “ আমাকে এক্ষুনি নিয়ে চলো। ওই তহসিলেই জানকী থাকে

আমার ছেলে থাকে। আমি যাবো “

'জানকীর গ্রামের নাম জানো তুমি?', -বিদিশার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে কী যেন ভাবতে থাকে রাজদীপ। কোনো উত্তর দ্যায়না।

নিয়ম মতো বিদিশা এবার নিজের পরিচয় জানিয়ে গাজিয়াবাদ থানায় একটা মেইল করলেন যে ওমপ্রকাশ বলে মৃত কোনো লোকের খবর তাঁদের জানা আছে কিনা। কিন্তু সে মেইলের কোনো উত্তরই আর আসেনা ।

তবে মেইল এলো একটা, সেটা ড:টমসনের কাছ থেকে এবং একটা খুব আশাপ্রদ খবর নিয়ে। এই কেস নিয়ে রিসার্চের জন্য এডিনবারা বিশ্ববিদ্যালয় ভালো গ্রান্ট এপ্রুভ করেছে।

তাছাড়া ড: টমসন দিল্লির উঁচু পুলিশ মহলে কথাও বলেছেন। তাঁরা গাজিয়াবাদ পুলিশকে তাঁর সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করার অনুরোধ করেছেন।

ড: টমসনের সঙ্গেও গাজিয়াবাদ পুলিশের ওসির কথা হয়েছে। উনি একটু সময় চেয়ে নিয়েছেন, কিন্তু কাজ শুরু করে দিয়েছেন।

ড: টমসন দিল্লিতে আসার পরে, রাজদীপ এবং তার বাবা মাকে নিয়ে, ড: টমসন যে হোটেলে উঠেছেন, কাজের সুবিধার জন্য স্বাভাবিক ভাবেই ড:বিদিশাও দিল্লির সেই হোটেলেই উঠলেন। কথা আগেই ঠিক ছিলো যে দিল্লিকে বেস করে, ওখান থেকেই থেকেই তাঁরা গাড়ি করে গাজিয়াবাদ যাতায়াত করবেন।

প্রথম দিন অবশ্য রাজদীপ তার মায়ের সংগে হোটেলেই থাকলো। বাকীরা মোটামুটি এগারো টার মধ্যে গাজিয়াবাদ থানায় পৌঁছে গেলেন।

থানার ওসি সুশীল ঝা তাদের খুব খাতির করেই বসালেন। যেহেতু ওপর থেকে অর্ডার ছিলো তাই ওসির খাতাপত্র, সব রেকর্ড একদম রেডি করা ছিল। খাতা দেখতে দেখতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “ আচ্ছা, লাস্ট কতো বছরের হিস্ট্রি আপনারা চাইছেন?”

ড:টমসন একটু ভেবে বললেন, “ আপাতত বছর পনেরোর বলুন”

“ হুম, তখন অবশ্য আমি এ থানায় ছিলাম না, তবে করপোরেশন থেকে পাওয়া রিপোর্ট বলছে, গত পনেরো বছরে তেইশ জন ওমপ্রকাশ এই তহসিলে মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনের একটি করে ছেলে। এই পাঁচ জনের বাড়িতেই আমি নিজে খোঁজ নিতে গেছিলাম। কিন্তু, জীবিত বা মৃত, এঁদের কারুর স্ত্রীরই নাম জানকী নয়। শুধু তাই নয় , এঁদের প্রত্যেকের ই একাধিক সন্তান। একটি মাত্র ছেলে কারুর নেই। “

“ তা যদি হয়, তাহলে হয়তো আমরা ভুল করছি। গাজিয়াবাদের আশেপাশে বলতে মনে হয় রাজদীপ এই তহসিলগুলো মিন করেনি। ফিরে গিয়ে আর একবার বাচ্চাটির সঙ্গে কথা বলতে হবে, বুঝলে?”বিদিশাকে একটু অন্যমনস্ক ভাবে বলেন ড: টমসন।

বুড়োমতো এক কনস্টেবল এতোক্ষণ একটু দূরে দাঁড়িয়ে সব কথাবার্তা শুনছিল, সে এবার এগিয়ে এসে নীচু স্বরে ওসিকে কী যেন বললো। “আচ্ছা , তাই নাকি? যাও তো, খাতাখানা নিয়ে এসো দেখি “

“ওয়েট আ মোমেন্ট প্লিজ , হয়তো একটা খবর পাওয়া যেতে পারে, তবে সেটা আপনাদের কোনো কাজে লাগবে কিনা জানিনা।

আর একজন ওমপ্রকাশের কথা ও বললো, তবে সেটা আমার এখানে আসার আগের ঘটনা। আর সেই ওমপ্রকাশ মৃত নয়। নিরুদ্দেশ ।

এই যে পেয়েছি। আকবরা তহসিলের…”

'প্লিজ ওয়েট', সুশীল ঝা এটুকু বলতেই তাঁকে মাঝপথে বাধা দিয়ে ড: টমসন টেবিলে রাখা ল্যাপটপটা স্ক্রোল করে একটা জায়গায় আঙুল রেখে বিদিশার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ এই দ্যাখো, ছেলেটি বারবার আকবর বলে। আমরা ভেবেছি ও কোনো মানুষের নাম বলছে

কিন্তু একচুয়ালি, ও একটা জায়গার নাম বলে। ও আকবরা বলে আর ওর বাবা মা ভেবেছেন আকবর। বুঝলে তো?

নাউ প্লিজ গো অন মিস্টার ঝা ”

“ হুঁ, এই রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১০ সালের ১৫ ডিসেম্বর আকবরা গ্রামের ওমপ্রকাশ নামে এক ব্যক্তি নিখোঁজ হয়ে যান। তাঁর স্ত্রীর নাম অবশ্য কিছু লেখা নেই। কিন্তু তার ছেলের নাম বলবীর। “

“ আচ্ছা, কে কে রিপোর্ট লেখাতে এসেছিলেন তা কি কিছু লেখা আছে? “, এবার বিদিশা প্রশ্ন করেন।

সুশীল ঝা উত্তর দেবার আগেই ওই বুড়ো কন্সটেবল বলে ওঠে, “ ওমপ্রকাশের ছেলে বলবীর, মতিলাল, মানে মতিলাল যাদব আর ওমপ্রকাশের দাদা নীতিশ ভাইয়া। আসলে আমি তখন থানাতেই ছিলাম। আমার সবটা ভালো মনেও আছে, কারণ আমিও আকবরার কাছেই থাকি। আর ওমপ্রকাশ আমার দূর সম্পর্কের চাচেরা ভাই ছিল। “

বিদিশা সবে 'ওঁর স্ত্রী.. ' বলেছে কি বলেনি,

“ হাঁ জী, জানকী। বহোত সুন্দর হ্যায় দেখনে মে। মন্দভাগ…” বলে উদাস হয়ে শূন্যে তাকিয়ে থাকে সেই কন্সটেবল।

“ মতিলাল কে?”

“ ওমপ্রকাশের ছোট বেলার বন্ধু। জিগরি দোস্ত”- বিদিশার প্রশ্নের উত্তরে জানায় সেই কন্সটেবল।

বিদিশা ড: টমসনকে বলে, 'তাহলে স্যার মতি আর জানকী দুজনের হদিশই পাওয়া গেল। “

হালকা মাথা নেড়ে তাকে সমর্থন করেন ড: টমসন।তারপর ল্যাপটপের দিকে চোখ রেখেই ওসিকে জিজ্ঞেস করেন,

“আচ্ছা, মিস্টার ঝা, আর কিছু কি আছে রিপোর্টে? মানে মিসিং এর আগে কেউ তাকে শেষ বার দেখেছিল কিনা বা সে কাউকে কিছু বলেছিল কিনা…এইসব রুটিন ইনফরমেশন আর কি “

সুশীল ঝার কান এইসব কথোপকথনের দিকে থাকলেও, তিনি সেইসঙ্গে রিপোর্টটাও পড়ছিলেন।

এবার রিপোর্টের একটা অংশের উপরে পেন রেখে বললেন, “ এই যে লেখা রয়েছে যে,২০১০ এর ১৪ ডিসেম্বর সন্ধে ছ'টা নাগাদ দুই বন্ধু মতিলাল আর ওমপ্রকাশ নিজের নিজের দোকান বন্ধ করে রোজকার মতোই সত্যপালের চায়ের দোকানে চা খেতে গেছিল। তখন সত্যপাল, ওমপ্রকাশকে বলতে শুনেছিল যে সে চা খেয়ে গাজিয়াবাদে যাবে। সে রাতটা ওখানেই থাকবে।

কিছু একটা দরকারী কাজ আছে।কী কাজ তা সে বলেনি। অন্তত রিপোর্ট তাই বলছে।“

“ এইসব কথা সে অবশ্য মতিকেই বলছিল, সত্যপাল ওভারহিয়ার করে আরকি।

আর মতিলালের বয়ানও ঠিক তাই ছিল। দু'জনকে আলাদা আলাদাভাবে ইন্টারোগেট করা হলেও, তাদের বয়ানে কোনো গরমিল পাওয়া যায়নি। “

তাদের দিকে মুখ তুলে বলেন সুশীল ঝা।

“ হুঁ, লেখা রয়েছে যে, তারপর তারা দুজন, মানে ওমপ্রকাশ এবং মতিলাল দুজন গন্তব্য অনুযায়ী দু'দিকে, যে যার পথ ধরে।তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। সময় আন্দাজ ছ'টা সাড়ে ছ'টা। এখানেও মতিলাল এবং সত্যপালের বয়ান এক।“

“ বুঝলেন তো, তারপর থেকে কেউ আর ওমপ্রকাশকে কোনোদিন দেখতে পায়নি।

পুলিশ অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে, হাসপাতাল, মর্গ…, কিন্তু ওমপ্রকাশের কোনো খোঁজই আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি । তার কোনো হদিসই নেই।…এই হলো কেসটার টোটাল রিপোর্ট। “

“ আপনাকে একটা অনুরোধ করছি মিস্টার ওসি , আপনি ওমপ্রকাশের ছেলেকে একটু জানিয়ে রাখুন, আমরা কাল ওদের বাড়িতে যাবো। কিন্তু সেকথা সে কাউকে, এমনকি তার মা কেও যেন না বলে। আর আপনিও কাইন্ডলি এখনই কাউকে কিছু বলবেন না। আর উনিও যেন না বলেন” কন্সটেবলের দিকে ইংগিত করেন ড:টমসন।

“ না, না, চিন্তা করবেননা। যেমন বলবেন তেমনই সব হবে। “

“আসলে কেউ কোনোভাবে বায়াসড হয়ে যাক, সেটা আমরা চাইছিনা “ ড: টমসনের কথার সূত্র ধরে বিদিশা বলে এবার।

“ বেফিকর রহিয়ে”৷ ওসি আশ্বাস দ্যান আর কন্সটেবল ও মস্ত করে মাথা নাড়ে।

পরের দিন বেলা বারোটা নাগাদ আকবরা গ্রামের দিকে দুটো গাড়ি করে তাঁরা রওয়ানা হলেন। একটা গাড়িতে রাজদীপের সঙ্গে তার বাবা, মা আর ড: বিদিশা। গাজিয়াবাদ থানার ওসি আর সেই কনস্টেবলের সঙ্গে অন্য গাড়িতে ড: টমসন। মাঝপথে ওমপ্রকাশের ছেলে বলবীরকে তার স্কুল থেকে ড: টমসনদের গাড়িতে তুলে নেওয়া হলো। তাঁরা আগের দিনই তাঁরা শুনেছিলেন যে বলবীর একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ায় আর স্কুলটা গ্রামের পথেই পরে। বলবীর গাড়িতে ওঠার আগেই অবশ্য ড: রায়ের এবং রাজদীপের সঙ্গে আলাপ করানোর ছুতোয় বলবীরকে রাজদীপ যে গাড়িতে বসেছিল সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন ড:টমসন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।

রাজদীপ জানলার যেদিকে বসেছিল, বলবীর সেদিকে এসে রাজদীপের বাবা মা আর ড:রায়কে 'নমস্তে' আর রাজদীপের দিকে তাকিয়ে, বাচ্চাদের সঙ্গে লোকে যেমন ভাবে কথা বলে, সেই টোনেই 'হাই' বলেছিল। সে সময়ে ড:বিদিশা এবং ড: টমসন রাজদীপকে খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করছিলেন । কিন্তু না। রাজদীপের কোনো হেলদোলই নেই। বলবীরের দিকে নিস্পৃহ ভাবে জাস্ট একবার তাকিয়ে, সে যেমন জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল, তেমনই তাকিয়ে রইলো।

ড:টমসন আর বিদিশা একটু অবাক হয়েই চোখ তাকাতাকি করলেন।

যাইহোক, দুটো গাড়ি আর একটা পুলিশ ভ্যান তো তারপর আকবরা গ্রামের দিকে রওয়ানা দিল।

আকবরা জায়গাটা এঁদো গ্রাম নয়। ভেতর দিকে মাটির রাস্তা দেখা গেলেও , গ্রামের পথ মূলতঃ পাকা। পিচ ঢালা। যদিও একটু ভাঙাচোরা। খানাখন্দ রয়েছে।

কিছু কিছু মাটির বাড়ি থাকলেও, অনেক পাকা বাড়িও রয়েছে । তবে বেশিরভাগই প্লাস্টারিঙ ছাড়া। দোকান টোকান ও রয়েছে। সবুজের সমারোহ এখন কম।শীতের শুরু তে পাতা ঝরতে শুরু করেছে।

বিদিশার গ্রাম সম্পর্কে যা অভিজ্ঞতা, তার থেকে এই আকবরা গ্রাম অনেকটাই উন্নত।

ড: টমসন ও এতোক্ষণ খুব ইন্টারেস্ট নিয়ে ভারতীয় গ্রাম দেখছিলেন। এবার গ্রাম দেখা থেকে মন সরিয়ে, বলবীরের দিকে মন দিলেন । বলবীরকে দেখে মনে হচ্ছে বছর তেইশ চব্বিশ বয়স হবে। এমনিতে ঠিকঠাক, তবে এখন স্বভাবতই একটু ঘাবড়ে আছে।

“আচ্ছা, মিস্টার বলবীর, মতিলাল তো আপনার বাবার খুব বন্ধু শুনলাম। তাঁর সঙ্গে একবার কথা বলা যাবে? “, ক্যাসুয়াল টোনে জিজ্ঞেস করেন টমসন।

“নো স্যার জী, ইয়ে তো নেহি হো পায়েগা।দুখ কি বাত হ্যায় জি, পিতাজি লাপাতা হবার মাস আটেক বাদে মতিলাল চাচা হরিয়ানার কাছে একটা বাস এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। পিতাজি লাপাতা হবার পর যতদিন বেঁচেছিলেন আমাদের খুব হেল্প করেছেন।”

“ তাহলে ওর পরিবারের কারুর সঙ্গে… “

ড:টমসনের কথা শেষ হবার আগেই ওই কন্সটেবল, যার নাম জানা গেছে তেজপাল, উত্তর দ্যায়,” ওরা কেউই এখানে আর থাকেনা। সে অনেকদিন হল; মতিলালের ছেলে তার পুরো ফ্যামিলিকে নিয়ে কানপুরে চলে গেছে। ওখানেই চাকরি পেয়েছে তো। বাড়ি এখন তালা দেওয়া। শুনছি বাড়ি বিক্রি করে দেবে। আর এখানে আসবেনা। লড়কা, লড়কী সব কানপুরেই পড়াশোনা করে কিনা”

সামনের গাড়িটা হঠাৎ ব্রেক কষে থেমে যায়। সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই পেছনের দুটো গাড়িও।

“গাড়ি থামাও। এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে” চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো রাজদীপ। দু'গাড়ির সবাই বিস্মিত হয়ে নেমে পড়েছে।

বিদিশা বলবীরের দিকে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকালে, বলবীর অবাক চোখে হতভম্বের মতো হালকা করে মাথা নাড়লো।

রাজদীপ গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে এক ছুটে নেমে, সবার আগে দৌড়ে দৌড়ে , এ গলি সে গলি পেরিয়ে একটা ছোট সাদা একতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পরলো। তারপরেই বাগানের দরজা খুলে ঢুকে “জানকী! প্যারী জানকী “ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে, বারান্দায় রজাই হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরী মধ্যবয়সী গোলাপি রঙের শাড়ি পরা এক মহিলাকে আকুল ভাবে জড়িয়ে ধরলো।


“ ইয়ে লোগ কৌন হৈ বেটা? আউর ইয়ে বাচ্চা ?”

ড: টমসনদের সঙ্গে ঘরে ঢুকে জানকীর বিস্মিত প্রশ্নের উত্তরে বলবীর যা জানে মোটামুটি সেটুকুই বললো। এবং জানকীর বাকি প্রশ্নের উত্তর যে একমাত্র ওই ডাক্তাররা জানেন সে কথাও জানালো।

রাজদীপ তখনও আরাম করে বিছানায় শুয়ে জানকীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। মুখে আনন্দের হাসি। অনেক দিন বাদে খুব প্রিয় কাউকে পাবার হাসি।

“ প্লিজ, কাম”

বলবীরের ডাকে রাজদীপ আর জানকী ছাড়া, বাকি সকলে ঘর থেকে বেড়িয়ে, বাগানে, বলবীরের পেতে দেওয়া খাটিয়ার উপরে বসলেন।

বলবীর মা কে ডাকতে আবার ভিতরে গেল। কী যে হচ্ছে… সব যেন তার মাথার উপর দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে।

একটু পরে, বলবীরের সঙ্গে জানকী, তার পেছনে বছর বারো তেরোর একটি কিশোরী এবং জানকীর হাত ধরে রাজদীপ বাগানে এসে দাঁড়ালো।

মেয়েটি বলবীর জানালো তার বোন। বলবীরের সঙ্গে জানকীর মুখের কিছু মিল থাকলেও , মেয়েটির সঙ্গে বলবীর বা জানকী কারুরই কোনো সাদৃশ্য নেই।

কিন্তু মেয়ে এলো কোত্থেকে !

রাজদীপ যদিও জানকীকে ছাড়তে চাইছিলনা, কিন্তু তার মা ব্যাগ থেকে দুটো গাড়ি বের করে বললেন, 'আয়, খেলবি না? এই দ্যাখ' বলে হাসি মুখে দ্যাখাতেই, রাজদীপ জানকীর হাত ছেড়ে আস্তে আস্তে খাটিয়ায় তার মায়ের পাশে এসে বসল।

“ওকে তুমি চেনো?” ছোট মেয়েটিকে দেখিয়ে বিদিশা জিজ্ঞেস করলেন।

“না” পরিষ্কার উত্তর রাজদীপের।

“আর একে?”, এবার বলবীরকে দেখিয়ে বিদিশা জিজ্ঞেস করেন।

“ না, একই উত্তর রাজদীপের।

“ স্যার, মেয়ে নেই সে কথা রাজদীপ বারবার বলছে। এটা তাহলে ডিস্ক্রিপেন্সি কলামে নোট করি? '

ড:টমসন, যিনি এতোক্ষণ রাজদীপের কথাবার্তা, আচরণ ল্যাপটপে নোট করছিলেন , বিদিশাকে নীচু গলায় কিছু একটা বললেন। বিদিশাও মাথা নেড়ে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জানকীর দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “ আপনার মেয়ে কবে জন্মেছে বলবেন প্লিজ। আপনার স্বামী নিরুদ্দেশ হবার আগে,না পরে?”

জানকী কিছু বলার আগে বলবীর এগিয়ে এসে জানালো যে তার বাবা নিরুদ্দেশ হয়েছে ডিসেম্বরে আর তার বোন লছমী জন্মেছে পরের বছর জুলাই এর শেষে।

“ “আচ্ছা, আপনার স্বামী কি জানতেন যে আপনি সন্তান সম্ভবা? “

“ নেহি জি। মেরেকো ভি পাতা নেহি থা কি ম্যাঁয় পেট সে হুঁ”, কেমন যেন একটা অস্বস্তি ভরা নার্ভাসনেস জানকীর গলায়।

“বুঝলাম। আচ্ছা, বলবীর তোমার ছোট বেলার কোনো ছবি আছে? মানে যখন তোমার বাবা নিরুদ্দেশ হননি , তখন কার। থাকলে দেখাতে পারো? “

“ ইয়েস ম্যাডাম”

বলবীর ঘরে গিয়ে তার ছোটবেলার একটা ছবি নিয়ে এসে বিদিশার হাতে দিল।

বিদিশা সেই ছবিটা নিয়ে রাজদীপের কাছে বসে বললো, “ রাজদীপ খুব ভালো ছেলে। দ্যাখো তো সোনা ছেলে, একে তুমি চেনো ? “

“ হ্যাঁ,… বলবীর”

গাড়ি নিয়ে খেলতে খেলতে নির্বিকার ভাবে উত্তর দ্যায় রাজদীপ।

এদিকে গ্রামের অনেকেই শুনে ফেলেছে , দেশী বিদেশী ডাক্তার, পুলিশ সবাই মিলে বলবীরদের বাড়িতে এসেছে। কৌতুহলে বেশ কিছু লোক বলবীরদের বাগানের দরজার সামনে ভিড় জমিয়েছে।

যদিও পুলিশ তাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। এরই মধ্যে একজন মাঝবয়েসী লোক পুলিশকে কিছু একটা বলাতে পুলিশ তাকে ঢুকতে দিল।

সে সামনে এসে দাঁড়াতেই তার দিকে তাকিয়ে , রাজদীপ বলে উঠলো, “ সত্তু, তু ক্যাসা হৈ? ঠিক হ্যায় না? “

সবাই একেবারে থ। জানা গেল, এই সত্তু ওমপ্রকাশের দূর সম্পর্কের কাকার ছেলে। চাচেরা ভাই।

এবার থানার ওসি, ড: টমসনের পাশে এসে, গলা নামিয়ে বললেন, “ দেখুন স্যার, অনেক চেষ্টা করেও আমরা এই কেসের কোনো কিনারা করতে পারিনি। ও যদি সত্যি আগের জন্মে ওমপ্রকাশ হয়ে থাকে, তার মানে ওমপ্রকাশ মারা গেছে। আর তাহলে ও নিশ্চয়ই জানবে ওমপ্রকাশের কী হয়েছিল। কেমন ভাবে মারা গেলো। তাই না? আপনি একটু জিজ্ঞেস করুন না স্যার, যদি বলে”

“ চিন্তা করবেননা। সেটাই আমাদের নেক্সট স্টেপ” বলে ড: বিদিশার দিকে প্রশ্ন শুরু করার ইংগিত করলেন ড:টমসন।

রাজদীপের হাতে একটা বড়ো চকোলেট বার দিয়ে বিদিশা এবার বললেন “চকোলেটটা খেয়ে দেখো তো ভালো কিনা ?”

“হ্যাঁ ভালো “, চকোলেট খেতে খেতেই মস্ত মাথা নেড়ে বলে রাজদীপ।

“ আচ্ছা রাজদীপ, ওমপ্রকাশ কোথায় আছে তুমি জানো?”

মাথা নেড়ে আবারও হ্যাঁ বলে রাজদীপ।

“ আমাকে বলবে?”

চকোলেট খেতে খেতে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে রাজদীপ।

“ কোথায় বলো তাহলে “

“ এখানেই। মাটির নীচে”

মাথা ঘুরে প্রায় পরে যাচ্ছিল জানকী। বলবীর তাড়াতাড়ি গিয়ে তাকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দ্যায়।

“ আমাদের সেই জায়গা দেখাতে পারবে এখন ? “

এবার চকোলেট শেষ করে, আর মাথা নেড়ে নয়, “পারবো তো” স্পষ্ট বলে রাজদীপ।

“ আমরা এই মুহূর্তে কেসের সব থেকে ক্রুশিয়াল ফেজে এসে পড়েছি। তাহলে চলুন মিস্টার ঝা। যাওয়া যাক”। কথাগুলো বলার সময় ড: টমসনের চোখ উত্তেজনায় চকচক করে ওঠে।

ইন ফ্যাক্ট, উপস্থিত সকলেই কম বেশি উত্তেজিত।

“ চলো তাহলে। আমাদের সেখানে নিয়ে চলো” রাজদীপের হাত ধরে বলেন বিদিশা।

মুহূর্তে তাঁর হাত ছাড়িয়ে

সবার আগে আগে রওয়ানা দ্যায় রাজদীপ। আর তার পেছন পেছন, বাড়ির সবাই তো বটেই, প্রায় পুরো গ্রাম রওয়ানা দিল। এতো ভিড় দেখে ওসি ঝা থানায় ফোন করে আরও দুজন পুলিশকে আসতে বলে দিলেন।

এ গলি ও গলি ঘুরে , গ্রামের লোক বসতির একটু বাইরে, একটা মস্ত অশ্বত্থ গাছ আর জলা ডোবার মাঝামাঝি আগাছায় ভরা একটা জায়গা দেখিয়ে রাজদীপ বললো, “এর নীচে আছে”

“ এই জায়গাটা খুঁড়লে পাওয়া যাবে ? “

“ কিঁউ নেহি? “, রাজদীপের সোজা উত্তর।

এবার ওসি ভিখু সর্দারকে খবর পাঠালেন। আর কিছুক্ষণ বাদে দলবল নিয়ে, ভিখু সর্দারও এসে হাজির।

ওসি পুলিশদের বললেন দড়ি দিয়ে পুরো জায়গা টা ঘিরে দিতে, আর কেউ যেন দড়ি পেরিয়ে না ঢুকতে পারে সে দিকে নজর রাখতে।

গ্রামের লোকেরাই একটা খাটিয়া আর কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার এনে ওসি এবং আর সকলের বসার ব্যবস্থা করে দিল। শুধু জানকী অন্য দিকে অশ্বত্থ গাছের নিচে একা দাঁড়িয়ে রইলো।শক্ত কাঠের মতো। দু’একজন গ্রামের মহিলা তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তাদের দিকে সে তাকিয়েও দেখলোনা। তার চোখ শুধু ওই জলাজমির দিকে।

“ এবার জমি খুঁড়তে শুরু করি?” জিজ্ঞেস করে ভিখু সর্দার।

“ হুঁ, করো”

পুলিশের অনুমতি পেয়ে জমিতে কোদলের কোপ লাগায় ভিখুর চেলা।

“ ছেলেটি কি ঠিক বলছে? সত্যিই কি কিছু পাওয়া যাবে? নাকি সবটাই পণ্ডশ্রম? “ ওসি ঝা, ড: টমসন, ড:বিদিশা, সবার মাথায় একই চিন্তা। কেবল রাজদীপ নির্বিকার।

ধীরে ধীরে সময় বয়ে যায়।

“ পেয়েছি স্যার, একটা মানুষের কঙ্কাল “

ভিখু এ কথা বলা মাত্র অশ্বত্থ গাছের নীচ থেকে একটা হৈচৈ ওঠে।

জানকী অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। আশেপাশের মহিলারা ডোবা থেকে জল এনে ছিটিয়ে কোনো রকমে তার জ্ঞান ফিরিয়ে ধরে ধরে বসিয়ে দ্যায়।

“ এ কি ওমপ্রকাশ? “,কংকালের দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে বিদিশা।

চারদিকে তুমুল বিস্ময় ও কলরব শুরু হয়ে গেলো। সবাই কাছে এসে কঙ্কাল দেখতে চায়। কিন্তু পুলিশদের বাধা দেওয়া এবং ধমকের জন্য তারা দূর থেকেই যতটা পারে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। গুঞ্জন যেন আর থামতেই চায়না।

“ হাঁ, এহি হৈ ওমপ্রকাশ”, ড:বিদিশার প্রশ্নের উত্তরে বলে রাজদীপ।

“তুমি কি জানো, ওমপ্রকাশ কিভাবে মারা গেলো আর মাটির নীচে ই বা গেল কি করে? “

এবার সব গুঞ্জন থেমে গিয়ে এক আশ্চর্য নীরবতা নেমে এলো আশেপাশে। যেন ঝড়ের আগের মুহূর্ত।

“হ্যাঁ, জানি তো” খুব স্পষ্ট ভাবে বলে রাজদীপ।

“ আমাদের বলবে? “, খুব মোলায়েম ভাবে স্নেহ মিশিয়ে অনুরোধের মতো সুরে জিজ্ঞেস করেন বিদিশা। ড:টমসন মন দিয়ে তাদের কথোপকথন নোট করতে থাকেন।

“ আমি আর জানকী বিছানায় শুয়ে ছিলাম। জানকী আমাকে কতো আদর করছিলো। তখনই ও দরজা খুলে ঢুকে এলো। জানকীকে খুব মারতে শুরু করলো। মুঝসে সহা নেহী গয়া। মার দিয়া। তখন জানকী আর আমি ওকে এখানে এনে মাটির নীচে পুঁতে দিলাম”

রাজদীপের কথা শুনে সবাই কেমন যেন হতচকিত হয়ে গেলো। একটা আওয়াজ নেই কোথথাও।

“স্যার, এটা মনে হচ্ছে , আ কেস অফ মিস আইডেন্টিফিকেশন। রাজদীপ ওমপ্রকাশের রিইনকারনেশন নয় মনে হচ্ছে। আর এই স্কেলিটন ও ওমপ্রকাশের নয়। কোথাও কিছু ভুল হয়েছে মনে হয়। “

“ইয়েস, দ্যাটস প্রবাবেল। কিন্তু তুমি আরও কথা বলো। প্রশ্ন করো”, বিদিশার সাজেশনের উত্তরে বলেন ড:টমসন।

“ ও, তাহলে এটা ওমপ্রকাশ নয়। তাইতো?”

“ না, ওই ওমপ্রকাশ। এই তো রয়েছে। জৈসে মাটিকে অন্দর পুঁতে দিয়েছিলাম, ঐসে হি ”

“ এ যদি ওমপ্রকাশ হয়, তাহলে ওমপ্রকাশকে কে মেরেছে তুমি জানো? বলতে পারবে ? “

“ হ্যাঁ জানি তো। আমি মেরেছি। ম্যায় নে মার ডালা”

এতো গুলো লোক স্তব্ধ হয়ে রাজদীপের দিকে তাকিয়ে আছে। একটুও শব্দ নেই কোথাও । সুঁচ পড়লেও যেন শোনা যাবে।

শুধু জানকীর গলা থেকে গোঙানির মতো একটা আওয়াজ বেরিয়ে এলো।

“ এ যদি ওমপ্রকাশ হয়, তুমি তো তাহলে ওমপ্রকাশ না? ঠিক তো? ' বিদিশার হতবাক জিজ্ঞাসা।

“ কৌন মৈঁ? আমি কেন ওমপ্রকাশ হবো? পাগল আউরৎ “ – হা হা করে হেসে ওঠে রাজদীপ।

“ আর তুমি ওমপ্রকাশকে মেরেছো, তাইতো?”

“ জি হাঁ”

“তাহলে তুমি কে? “

বিদিশার প্রশ্নের উত্তরে বেশ জোরের সঙ্গে , স্পষ্ট ভাবে বলে রাজদীপ,

“ আমার নাম মতিলাল.

মৈ হুঁ মতিলাল যাদব।“