ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিকঅধ্যায়-৩
জেলা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ছেড়ে যাওয়া একটি ডাকবাংলা, তাতে গোটা দুই ছোটবড় কামরা। ওর পাশে গোটা তিন কাঁচা দেয়ালের মাথায় খাপরা লাগিয়ে তৈরি আস্তাবল।তার থেকে একটু দূরে পাকা ইঁটের দেয়ালের মাথায় টিন লাগিয়ে একটা দোকান-মতো। একপাশে রেল-ফটকের গুমটিঘরের মত কিছু। উল্টোদিকে একটা বড় বটগাছের নীচে শান-বাঁধানো কবরের মত। আস্তাবলের পাশে একটা নতুন ধরণের ঘর তোলা হয়েছে যার ওপর বড় বড় করে লিখে দেয়া--" সামুদায়িক মিলন কেন্দ্র, শিবপালগঞ্জ", অর্থাৎ কম্যুনিটি সেন্টার। এই বাড়িগুলোর পেছনদিকে তিন-চার একর পড়তি উষর জমি, তাতে দূব্বোঘাস লাগানো হয়েছে। কোথাও কোথাও ঘাস গজিয়ে উঠেছে।
এইসব কাঁচাপাকা বাড়িঘর-আস্তাবল-গুমটিকে সম্মিলিত ভাবে বলা হয় " ছংগামল বিদ্যালয় ইন্টারমিডিয়েট কলেজ"।
এখান থেকে যারা ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বেরোয় তারা বিল্ডিং এর তুলনা করে গর্বের সঙ্গে বলতে পারে-- আমরা শান্তিনিকেতনের থেকেও এগিয়ে। আমরাই আসল ভারতীয় ছাত্র। আমরা জানিনা- বিদ্যুত কী, কলের জল কী, পাকা মেজে কাকে বলে, স্যানিটারি ফিটিংস কী জিনিস। আমরা বিদেশি শিক্ষাও দেশি পদ্ধতিতে শিখেছি। তাই আমরা এখনো মাটির কাছাকাছি। এত পড়াশোনা করেও আমাদের হিসি গাছের গায়ে সহজে ঝরে পরে, বন্ধ বাথরুমে ঝরে না, মাথায় চড়ে।
ছংগামল ভদ্দরলোক কোন একসময় ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। একটি জালি রেজোলুশন পাস করিয়ে উনি বোর্ডের ডাকবাংলোটা এই কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সম্পত্তি বানিয়ে দিলেন। তার আগে কলেজটার সম্পত্তি বলতে হাতে ছিল শুধু ওই ম্যানেজিং কমিটি। আর রেজোলুশনের শর্ত অনুযায়ী কলেজটার নাম হয়ে গেল ছংগামল বিদ্যালয়।
কলেজটার প্রত্যেকটা বিল্ডিং এর আলাদা আলাদা ইতিহাস আছে। যেমন কমিউনিটি সেন্টার ভবন তৈরি হয়েছিল সরকারি পয়সায়, গ্রামসভার নামে আসা ফান্ড থেকে। কিন্তু ওটায় প্রিন্সিপালের অফিস আর ইলেভেন-টুয়েলভের ক্লাস চলে। আস্তাবলের মত দেখতে বাড়িটা গ্রামের লোকজনের শ্রমদানে গড়ে উঠেছে। টিনের শেডটা কোন মিলিটারি ছাউনির ভগ্নস্তুপ থেকে মাল ঝেড়ে এনে রাতারাতি দাঁড় করানো হয়েছে। লাঙলদেয়া উষর জমি কৃষিবিজ্ঞান পড়াতে কাজে লাগে। আর তাতে গজিয়ে ওঠা জোয়ারের দানা প্রিন্সিপালের পোষা মোষের কাজে লাগে। আমাদের দেশে ইঞ্জিনিয়র আর ডাক্তারের বড়ই অভাব। কারণ এই দেশের লোকজন বড্ড কবিস্বভাবের। কোন জিনিসকে ভাল করে বোঝার আগেই মুগ্ধ হয়ে কবিতা লিখে ফেলে। ভাকরা-নাঙ্গাল বাঁধ দেখে ওদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে---" আহা! অঘটনঘটনপটু ঈশ্বর নিজের লীলা দেখাতে আবার ভারতভূমিকেই বেছে নিয়েছেন।"
অপারেশন টেবিলে শোয়া যুবতীকে দেখেও ওরা বিদ্যাসুন্দর-গীতগোবিন্দ আওড়াতে পারে।
সেন্টিমেন্টের এমন ঝঞ্ঝাবাতাসের মধ্যেও এদেশ থেকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়র জন্মায়।
তবে তারা আসল ইঞ্জিনিয়র-ডাক্তার হয় আমেরিকা বা ইংল্যান্ড ঘুরে এলে। কিন্তু তার কিছু প্রারম্ভিক কাজকম্ম-- ওই টেক অফ্ স্টেজ আর কি--- এদেশেই হয়। সে জাতীয় কিছু কাজকম্ম এই "ছংগামল বিদ্যালয় ইন্টারকলেজ" ও করে যাচ্ছে।
ক্লাস নাইন। সায়েন্সের ক্লাস চলছে। মাস্টার মোতিরাম ছাত্রদের অপেক্ষিক ঘনত্ব বোঝাচ্ছেন। উনি একধরণের বি এস সি পাশ। বাইরে তখন এই ছোট্ট গাঁয়ের ছোটোলোকোমির অনুপ্রাসের ছটা ছেয়ে আছে। আখবোঝাই গরুর গাড়িগুলো চিনিকলের রাস্তায় এগিয়ে চলেছে। কিছু ক্ষয়াটে চেহারার ছোঁড়া পেছন থেকে টেনে টেনে আখ বের করে দৌড়ে পালাচ্ছে আর সামনে বসা গাড়ির গাড়োয়ানও টেনে গাল দিচ্ছে।
গালাগালের আওয়াজ যত উঁচুতে ওঠে, তত তার সম্মান বাড়ে,-- উড়ন তুবড়ির মত। শেষে একটা গালি আকাশে অন্য গালির সঙ্গে কাটাকুটি খেলে জানলা দিয়ে ক্লাস রুমে ঢুকে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কাজ করে। আজকেও তাই হচ্ছিল। ছেলেরা তামাশা দেখছিল আর সায়েন্স পড়ছিল।
একটি ছেলে বলল, -- মাস্টারজী, আপেক্ষিক ঘনত্ব কাকে বলে?
উনি বল্লেন--- আপেক্ষিক ঘনত্ব মানে রিলেটিভ ডেনসিটি।
এবার অন্য একটি ছাত্র বলল,-- দেখুন, আপনি কিন্তু সায়েন্স ছেড়ে ইংরেজি পড়াচ্ছেন!
মাস্টারসাহেব উবাচ-- সায়েন্স শালা ইংরেজি ছাড়া পড়ানো যায়?
এবার ছেলের দল দাঁত বের করল। কারণ, হিন্দি-ইংরেজির দ্বন্দ্বযুদ্ধ নয়, মাস্টারমশাইয়ের মুখে "শালা" শব্দের ইডিয়মেটিক প্রয়োগ।
-- এটা কোন হাসির কথা না।
ছেলেদের বিশ্বাস হল না, ওরা আরও জোরে হেসে উঠল। এবার মোতিরাম মাস্টারও তাদের সঙ্গে হাসতে লাগলেন। ছেলেরা চুপ মেরে গেল।
মাস্টার ওদের মাপ করে দিয়েছেন। বল্লেন,-- যদি রিলেটিভ ডেনসিটি বুঝতে না পারো, তো আপেক্ষিক ঘনত্বটা একটু অন্যভাবে বোঝার চেষ্টা করে দেখ। আপেক্ষিকের অর্থ -- অন্যের সঙ্গে তুলনা করে নিজের অবস্থা বোঝা। ধর, তুমি একটা গমপেষাইয়ের কল খুলেছ, আর তোমার ঘরের পাশে তোমার পড়শি আর একটা কল খুলেছে। তুমি হয়ত মাসে পাঁচশ টাকা আয় কর আর তোমার পড়শি চারশ'। তোমার লাভ ওর তুলনায় বেশি হল। একেই সায়েন্সের ভাষায় বলে তোমার আপেক্ষিক লাভ বেশি। বুঝেছ?
একটি ছেলে বলে উঠল,-- বুঝতে পেরেছি মাস্টারমশায়, কিন্তু আপনার যে গোড়ায় গলদ। এ গাঁয়ে কেউই গমপেষাইয়ের দোকান চালিয়ে মাসে পাঁচশ রোজগার করতে পারবে না।
মোতিরাম মাস্টার টেবিল চাপড়ে বল্লেন- কেন পারবে না? মানুষ চাইলে কি না পারে?
ছেলেটার এই কথায় আর কথা বলার কায়দায় একটুও হেলদোল হল না। বলল,--- কিচ্ছু পারে না। আমার কাকার গমপেষাই মেশিন হুড়ুম-দুড়ুম করে সারাদিন চলতে থাকে। কিন্তু কাকার মাসের আয় মাত্র দু'শ টাকা।
- কে তোমার কাকা?
মোতিরাম মাস্টারের গলা যেন ঘামে ভিজে গে্ল। উনি ছেলেটাকে ভাল করে দেখতে দেখতে বলে উঠলেন,- তুমি ওই বেইমান-মুন্নুর ভাইপো' নাকি?
ছেলেটা অহংকার লুকোনোর কোন চেষ্টা করল না। যেন কিছু যায় আসে না এমনি ভঙ্গিতে জবাব দিল,-নইলে আর কে?
বেইমান-মুন্নু ওনার গাঁয়ের প্রতিশ্ঠিত নাগরিক। যদিও গোলাপ ফুলে নামমাত্র গন্ধ হয়, তবু ইংরেজি সাহিত্য বলে যে গোলাপকে যে নামেই ডাক না কেন, ও আগের মতই সুগন্ধ ছড়াবে। তেমনি ওনাকে যে কোন নামেই ডাকা হোক , বেইমান-মুন্নু আগের মতই নির্বিকার চিত্তে আটা পিষতে থাকবেন, পয়সা কামাতে থাকবেন আর সম্মানিত নাগরিক হয়ে টিঁকে থাকবেন।
তবে সত্যের খাতির এটুকু বলতেই হবে যে "বেইমান-মুন্নু' জনগণের দেয়া নাম নয়, পারিবারিক সূত্রে পাওয়া। ওনার বাপু ছোটবেলায় অতি-আহ্লাদে ওনাকে বেইমান বলে ডাকতো আর ওর মা আদর করে মুন্নু। ফলে দুটো জুড়ে ওর নাম হয়ে গেল "বেইমান-মুন্নু"।
ইদানীং গোটা গাঁ ওকে বেইমান-মুন্নু বলে ডাকে। আর উনি বড় সহজভাবে এই উপনামকে স্বীকার করে নিয়েছেন, যেমন আমরা অনায়াসে আচার্য্য জে বি কৃপলানীকে "আচার্য্যজী", জে এল নেহরুকে "পন্ডিতজী" আর গান্ধীকে "মহাত্মাজী" করে নিয়েছি।
মোতিরাম মাস্টার খানিকক্ষণ বেইমান-মুন্নুর ভাইপোর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রইলেন, তারপর নিঃশ্বাস ছেড়ে বল্লেন,- যেতে দাও।
তারপর উনি বইয়ের খোলা পাতায় চোখ রাখলেন। একটু পড়ে চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেলেন ছেলের দল অনেকক্ষণ ধরে ওনার দিকেই তাকিয়ে আছে। উনি জিগাইলেন," কি ব্যাপার"?
একটি ছেলে বলল," তো এটাই বোঝা গেল যে গম পিষে মাসে পাঁচশ টাকা ঘরে আসে না।"
" কে বলেছে?", মাস্টারমশাই বলে চললেন," আমি নিজে গম পিষিয়ে মাসে সাত-সাতশ' টাকা পেয়েছি। কিন্তু বেইমান-মুন্নুর ঠ্যালায় সব ভোগে গেছে।"
বেইমান-মুন্নুর ভাইপো বেশ ভদ্রভাবে বলল," এত হা-হুতাশ করার কি আছে? এটা বিজনেস। কখনো আসে কখনো যায়। কম্পিটিশনে এ'রম হতেই পারে।"
" সৎ ও বেইমানের মধ্যে কিসের কম্পিটিশন? কি যে ফালতু বকবক কর?" মোতিরাম মাস্টার ধমকে উঠলেন। এমন সময় কলেজের চাপরাশি ওনার কাছে একটা নোটিস ধরিয়ে দিল। উনি পড়তে পড়তে বিড়বিড় করতে লাগলেন," যাকেই দেখ , একটা কিছু এনে পড়ে দিতে বলবে। পড়তে পারে একজন, তো পড়াতে চায় দশজন।"
একটা চ্যাংড়া বলল, " ঘোর অন্যায়!"
উনি চমকে উঠলেন, " কে বলল রে?"
একটা ছেলে হাত তুলল," আমি মাস্টারজী! জিগ্যেস করছিলাম, আপেক্ষিক ঘনত্ব কি করে বের করতে হয়?"
মোতিরাম মাস্টার উবাচ, " আপেক্ষিক ঘনত্ব বের করতে হলে বস্তুটির ওজন এবং আয়তন মানে ভল্যুম জানতে হবে--- তারপর আপেক্ষিক ঘনত্ব বের করার কায়দা বা পদ্ধতি জানতে হবে। পদ্ধতির কথা শুধোলে বলব ---যেকোন জিনিসের দুটো পদ্ধতি হয়। একটা সঠিক, অন্যটা বেঠিক। সঠিক পদ্ধতিতে ঠিক ফল পাওয়া যায় আর বেঠিক পদ্ধতিতে ভুল । একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা সহজে বুঝতে পারবে। ধর তুমি একটা গমপেষাইয়ের মেশিন বসিয়েছ। নতুন মেশিন, গ্রিজ-টিজ লাগিয়ে একেবারে ঝকঝক করছে।
ইঞ্জিন নতুন, বেল্ট নতুন। সবকিছু আছে, কিন্তু কারেন্ট নেই। তো ফল কি হবে?"
প্রথমে কথা বলেছিল যে ছোকরা, সে বলল," তখন ডিজেল ইঞ্জিন লাগাতে হবে, মুন্নুচাচা তাই করেছিল।"
মোতিরাম মাস্টার বল্লেন," একলা মুন্নুচাচার মাথাতেই ঘিলু আছে নাকি? এ গাঁয়ে সবার আগে ডিজল ইঞ্জিন কে এনেছিল? কেউ বলতে পারবে?"
ছেলের দল হাত তুলে কোরাস গাইল, " আপনি স্যার ,আপনি"!
স্যার এবার প্রসন্নচিত্ত হয়ে মুন্নুর ভাইপোকে বল্লেন," শুনলে তো! বেইমান-মুন্নু আমার দেখাদেখি ডিজল ইঞ্জিন লাগালো বটে, কিন্তু আমার গমপেষা কল তো কলেজ শুরু হওয়ার আগের থেকে চলছে। আমার কল থেকেই গম পেষাতে আসা গ্রাহকদের থেকে কলেজ খোলার জন্যে সের-সের আটা দান নেয়া হয়েছিল। আমার মেশিনে পিষেই সেগুলো আটা হয়ে শহরে বিক্রি হতে গেল। আমার গমপেষাই কলের পাশে বসেই কলেজের বিল্ডিংয়ের নকশা তৈরি হল আর ম্যানেজার কাকা বল্লেন,' মোতি, কলেজে তুমি মাস্টার হবে, কিন্তু আসল প্রিন্সিপালগিরি তোমাকেই করতে হবে।' সব কিছু আমার কলঘরে হল আর এখন গাঁয়ে গমপেষা কল বলতে বেইমান-মুন্নুর! আমার কলটা যেন কিছুই না!"
ছেলের দল মন দিয়ে শুনছিল। এই কথকতা এরা আগেও অনেকবার শুনেছে, এবং যেকোনো সময় শোনার জন্যে তৈরি আছে। ওদের আর এই নিয়ে কোন হেলদোল হয় না। তবে মুন্নুর ভাইপো বলল," চিজ তো আপনার বেশ ভাল, মাস্টারমশাই। আর মুন্নুচাচারটাও খাসা। তবে আপনার ধান-কুট্টিটার ওভারহলিং দরকার। ধান বড্ড ভেঙে যায়।"
মোতিরাম মাস্টার নরম সুরে বললেন," এমন কিছু নয়। আমার মত ধান-কুট্টি মেশিন গোটা তল্লাটে নেই। কিন্তু বেইমান-মুন্নু ধানকোটা গমপেষার রেট সমানে কমিয়ে দিচ্ছে, তাই লোক ওদিকে চলে যাচ্ছে। সব হিন্দুস্থানীরই এক অবস্থা, কোথাও দু'পয়সা শস্তা দেখলেই পাগলের মত দৌড়ুবে।"
" এতো সব জায়গাতেই হয়", ছেলেটা তর্ক জুড়ল।
" মোটেই না, শুধু এদেশেই হয়। তবে ও রেট কমানোর লোকসানটা ওজনে মেরে পুষিয়ে নেয়।
আর মোতিরাম মাস্টার আর যাই করুক, ওই কম্মটি কখনো করবে না।"
একটা ছেলে জিগ্যেস করল," তো আপেক্ষিক ঘনত্ব বের করতে গেলে কি করতে হবে?"
উনি ঝটপট বললেন, " তাই তো বলছিলাম!"
ওনার দৃষ্টি জানলা দিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো আখবোঝাই গাড়ির তিনফুট ওপর দিয়ে দিকচক্রবালে হারিয়ে গেল। বিগত যুগের সারাক্ষণ ভাবুক পোজ-দেয়া কবিদের স্টাইলে উনি ধীরে ধীরে বলে চললেন," গোটা এলাকায় একটাই মেশিন ছিল, লোহার বডি, কাঁচের মত ঝকঝকে---"। হটাৎ উনি সম্বিত ফিরে পেয়ে ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, "হ্যাঁ, কিসের যেন কথা হচ্ছিল?"
ছেলেটা আবার নিজের প্রশ্নটা বলল। কিন্তু সব্টা শোনার আগেই ওনার মনযোগ কেড়ে নিয়েছে একটি শব্দ। ছেলেরাও শুনতে পেয়েছে। বাইরে আখচুরি নিয়ে উঁচু গলার খিস্তি-খেউড়, চাপরাশিকে প্রিন্সিপালের গালমন্দ আর মিউজিক ক্লাসে হারমোনিয়ামের ম্যাঁও-ম্যাঁও--- সব কিছু ছাপিয়ে হটাৎ জেগে উঠেছে একটা বিকট আওয়াজ-- ভক্ ভক্ ভক্ ভক্ ! মোতিমাস্টারের গমপেষা মেশিন চালু হয়েছে। এটা তারই আওয়াজ। এটাই আসল আহ্বান। অন্ন-বস্ত্র না জোটার চেঁচামেচি, মারদাঙ্গা-ঝগড়ার হুংকার, এসব না শুনে খাঁটি নেতারা শুধু আত্মার আওয়াজ শুনতে পান। মোতিমাস্টারেরও সেই দশা। উনি আর কোন আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন না, শুধু ওই ভক্ -ভক্ -ভক্ !
উনি ক্লাস থেকে ছুটে বেরোতে গেলেন।
ছেলেরা বলল, " কি হল মাস্টারজী? এখনো তো ঘন্টা পড়েনি?"
--" মনে হচ্ছে মেশিনটা ঠিক হয়ে গেছে। দেখি গিয়ে, কেমন চলছে।"
দরজা অবদি গিয়ে হটাৎ ফিরে এলেন। চেহারায় কষ্টের ছাপ, যেন কেউ খুব জোরে চিমটি কেটেছে। বল্লেন, " বই থেকে পড়ে নিও। আপেক্ষিক ঘনত্বের চ্যাপটার খুব দরকারি।" উনি জিভে জল টেনে নিলেন। একটু থেমে বল্লেন," ইম্পর্ট্যান্ট!" বলেই চেহারায় প্রফুল্ল ভাব।
ভক্ ! ভক্ ! ভক্ !
বাইরের জটিল কর্মক্ষেত্র থেকে কর্তব্যের আহ্ববান ভেসে আসছে। ছাত্রের দল ও বইয়ের মোহ ওনাকে বেঁধে রাখতে পারল না।
ঘড়িতে চারটে বাজল। প্রিন্সিপাল সাহেব নিজের কুঠুরি থেকে বাইরে বেরোলেন। রোগা-প্যাংলা শরীরের খানিকটা হাফ-প্যান্ট আর খানিকটা শার্টে ঢাকা পড়েছে, বগলে পুলিস এর সার্জেন্টমার্কা বেত, পায়ে স্যান্ডেল। সব মিলিয়ে বেশ চটপটে আর চালাক দেখাচ্ছে। আর যত না দেখায় তার থেকে উনি নিজেকে একটু বেশি ভাবেন।
ওনার পেছন পেছন চলছে কলেজের ক্লার্ক, রোজকার মতন। প্রিন্সিপাল এবং ক্লার্কের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের কথা সবাই জানে।
এরা এখন মোতিরাম মাস্টারের ক্লাসের ধারে পৌঁছেচেন। ক্লাস চলছে ওই আস্তাবলের মত ঘরটায়। ক্লাসে যে কোন মাস্টার নেই সেটা দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে। একটা ছেলে মাস্টারের টেবিলে চড়ে বসে বসে কাঁদছে। ওর পরণের পাজামাটা নীচের থেকে উরু পর্য্যন্ত ছেঁড়া। প্রিন্সিপালকে ক্লাসের ধার দিয়ে যেতে দেখে ও আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। উনি জিগ্যেস করলেন, " কি হয়েছে? মাস্টারমশাই কোথায়?"
তাতে ছেলেটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আরেকটা ছেলে জবাব দিল-- " এটা মোতিরাম মাস্টারের ক্লাস।"
ব্যস্, প্রিন্সিপাল তৎক্ষণাৎ বুঝে গেলেন মাস্টারমশাই কোথায়। ক্লার্ক বললো," সেকেন্ডহ্যান্ড মেশিন চালাতে হলে চব্বিশ ঘন্টা চোখে চোখে রাখতে হয়। কতবার মোতিরাম মাস্টারকে বলেছি এই আটা-চাক্কিটা বেচে দাও, কিন্তু ওর মাথায় ঢুকলে তো? আরে আমিই একবার হাজার দেড়েক দিতে চেয়েছিলাম।"
প্রিন্সিপাল বল্লেন," ছাড়ান দাও, ওদিকের ক্লাস থেকে মালবীয়কে ডেকে আনো।"
ক্লার্ক একটি ছেলেকে বললো, " যাও, ওদিকের ক্লাস থেকে মালবীয়কে ডেকে আনো।"
একটু পরে ওদিক থেকে একটি ভালোমানুষ গোছের অল্পবয়সী তরুণকে আসতে দেখা গেল।
প্রিন্সিপাল ওকে দেখা মাত্র চেঁচিয়ে উঠলেন, " ভাই মালবীয়, এই ক্লাসটাও একটু দেখে নিও।"
মালবীয় কাছে এসে ছাদের একটা খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর বললো," একটা পিরিয়ডে দুটো ক্লাস? কি করে করবো?"
কাঁদুনে ছেলেটা কেঁদেই চলেছে। কিছু ছেলে ক্লাসের পেছন দিকে বসে জোরে জোরে হাসছে। বাকি সবাই এনাদের সামনে এমন ভীড় করে দাঁড়িয়েছে যেন চৌরাস্তার মোড়ে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।
প্রিন্সিপাল সাহেব এবার গলার আওয়াজ চড়িয়ে বল্লেন, " বেশি নিয়মকানুন দেখাবে না! যেদিন থেকে তোমার খান্নামাস্টারের সঙ্গে ওঠবোস শুরু হয়েছে , সেদিন থেকেই সব কাজে খালি অজুহাত।"
মালবীয় অবাক হয়ে প্রিন্সিপাল সাহেবের মুখ দেখছিল। ক্লার্ক বলল,"সরকারী বাসের হিসেবে ক্লাস চালিয়ে নাও, মালবীয়। দেখনি, একটা বাস খারাপ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লে কেমন যাত্রীদের পরের বাসে তুলে দেয়া হয়? এই ছেলেগুলোকেও অমনি করে তোমার ক্লাসে নিয়ে বসাও।"
ও বেশ মিষ্টি করে জবাব দিল, " কিন্তু এটা তো ক্লাস নাইন। আমি ওখানে তো সেভেনের ক্লাস নিচ্ছি।"
প্রিন্সিপালের ঘাড় পেছনে ঘুরলো। যারা জানে তারা বুঝে গেছে যে এবার প্রিন্সিপালের হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকবে আর ওনার চিৎকার শোনা যাবে। হলও তাই। উনি বললেন, " আমি সব জানি। তুমিও খান্নার মত তক্কো করা শুরু করেচো, আমাকে ক্লাস সেভেন আর নাইনের তফাৎ শেখাতে এয়েচো? আমাকে আর প্রিন্সিপালগিরি শেখাতে এসো না। যেমন যেমন হুকুম হবে , তেমন তেমন ক্যারি আউট করে যাও বুঝেচো কি বোঝনি? "
প্রিন্সিপাল থাকেন কাছের এক গাঁয়ে। লোকমুখে ওনার দুটো গুণের খ্যাতি দূর-দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। একটা হল জালি খরচের হিসেব দেখিয়ে ঢের সরকারি ফান্ড আদায় করা। অন্যটা রাগের চরমসীমায় শুদ্ধ হিন্দি ছেড়ে স্থানীয় অবধী বুলি আওড়ানো। উনি যখন জালি হিসেবপত্তর বানান তখন আচ্ছা-সে-আচ্ছা খাঞ্জা খাঁ অডিটরও কলম চালাতে হিমসিম খেয়ে যায়। তেমনি ওনার অবধী বুলির খই ফুটলে বড় বড় তর্কপঞ্চাননেরও বাক্যি হরে যায়।
মালবীয় মাথা নীচু করে ফিরে গেল। প্রিন্সিপাল ছেঁড়া পায়জামা পরা ছেলেটার পিঠে দু'ঘা বেত কষিয়ে বল্লেন, " যাও, সবকটা গিয়ে চুপচাপ ওই ক্লাসে বসে থাক। একটু নিঃশ্বাসের শব্দ শুনেছি কি চামড়া গুটিয়ে নেব।"
ছেলের দল চলে গেলে ক্লার্ক মিচকি হেসে বলল, " চলুন, খান্না মাস্টারের তামাশাটাও দেখে আসি।"
খান্নামাস্টারের আসল নাম খান্নাই বটে; যেমনি , তিলক, গান্ধী, প্যাটেল, নেহরু ইত্যাদি কোন জাতিসূচক পদবী না হয়ে লোকের নাম হয়ে গেছে। এই দেশে জাতপাত তুলে দেয়ার এটাই সহজ উপায়। জাতের থেকে ওর নামটা কেড়ে নিয়ে কোন মানুষের নাম বানিয়ে দিলে জাতের হাতে আর থাকে কী? তখন বাধ্য হয়ে জাতিপ্রথা নিজে নিজেই শেষ হয়ে যায়।
খান্নামাস্টারের চাকরি ইতিহাসের লেকচারারের, কিন্তু এখন উনি একটি ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ইংরেজি পড়াচ্ছেন। দাঁতে দাঁত পিষে বলছেন, " হিন্দিতে তো বড় বড় প্রেমের গল্প লিখে ফেল, কিন্তু ইংরেজির ক্লাসে কোন উত্তর না দিয়ে ঘোড়ামুখো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?"
ক্লাসের মাঝখানে একটা ছেলে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতে আমাদের দেশে ঘি-দুধ দুষ্প্রাপ্য হওয়ার আর খেলাধূলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঠ্যালায় বেশির ভাগ ছাত্রই ছ্যাকরাগাড়ির ঘোড়ার মত দেখায়, কিন্তু এই ছেলেটার মুখের গঠনে এমন একটা ভাব আছে যে এটা টাইটেল হয়ে ওর নামের সঙ্গে সেঁটে গেছে। ক্লাসের ছেলেরা জোরে জোরে হাসছে। খান্নামাস্টার এবার ইংরেজিতে জিগাইলেন, " বল, 'মেটাফর' মানে কী?"
ছেলেটা ঢ্যাঁটার মত দাঁড়িয়ে রইল। কিছুদিন আগে দেশে গুজব রটে ছিল যে অশিক্ষিত লোক মানে শিং-লেজ ছাড়া পশু। ওই গুজবের ফলে অনেক অশিক্ষিত পরিবারের ছেলে হাল-কোদাল ছেড়ে স্কুল-কলেজে হামলে পড়ল। হাজার হাজার ছেলের পাল এসে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিকে ঘিরে ফেলে এমন হল্লা শুরু করল যে শিক্ষাক্ষেত্রে হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেল। এখন আর কেউ বলে না যে অশিক্ষিত মানুষ জানোয়ারের মত। বরং ফিসফিস করে বলা হচ্ছে যে উচ্চশিক্ষা সবার জন্যে নয়, এর জন্যে 'স্ক্রীনিং' দরকার। এইভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গেঁয়ো ছেলেদের আবার হাতে লাঙল ধরিয়ে ক্ষেত-খামারে ফেরৎ পাঠানোর ফতোয়া দেয়া শুরু হয়ে গেল।
কিন্তু বার বার ফেল, ক্লাসের মধ্যে নানারকম বকাবাদ্যি-নিন্দেমন্দ,তারপর নেতাদের মুখে কৃষিকাজের মহিমাকীর্তন,-এতকিছু শোনার পরেও ওই ছেলের দল কিছুতেই লাঙল-কোদালের দুনিয়ায় ফিরে যেতে রাজি হল না। এরা কানখাজুরার মত স্কুলের গায়ে সেঁটে রইল আর যেভাবেই হোক, সেঁটে থাকতেই চাইল।
ঘোড়ামুখো ছেলেটাও এইরকম একটি ভীড়ের অংশ। ওকে রোজ ক্লাসের ভেতর নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হত --যাও বাছা! ঘরে গিয়ে তোমার মোষ দোয়াতে থাক, বলদের ল্যাজে মোচড় দাও,-- শেলী - কীটস ঠিক তোমার জন্যে নয়। কিন্তু ছেলে নিজের বাপের থেকে কয়েক শতাব্দী এগিয়ে গিয়েছে, এইসব ইশারা বুঝতে ওর বয়েই গেছে। ওর বাপ আজও দ্বাদশ শতাব্দীর গাঁড়াশি দিয়ে বলদের জন্যে চারা কাটে। ছেলে একটা আধময়লা বইয়ের আড়ালে নিজের ঘোড়ামুখ লুকিয়ে বিংশ শতাব্দীর কোলকাতার রঙীন রাতের দৃশ্য মগ্ন হয়ে দেখে। এই অবস্থার কোন পরিবর্তনে ও আগ্রহী নয়। তাই ও মেটাফরের মানে বলতে পারে না, নিজের ঘোড়ামুখ নিয়ে কোন পাল্টা জবাব দিতে পারে না।
কলেজের সমস্ত ছাত্রের মত এই ছেলেটারও নিজের পোশাক-আশাক নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। ছেলেটার পায়ে জুতো নেই, আর এমন একটা ডোরাকাটা কাপড়ের ময়লা পাজামা পরেছে যেগুলো দিয়ে শহুরে লোকেরা স্লিপিং স্যুট বানায়। ও গাঢ় খয়েরি রংয়ের মোটা জামা পরেছে। ওর বোতাম গুলো ভাঙা। মাথায় শক্ত রুক্ষ চুল। মুখধোয়া হয় নি। গিচ্পিচ্ চোখ। দেখলেই মনে হয়, ও কোন প্রোপাগ্যান্ডার চক্করে ফেঁসে কলেজে পালিয়ে এসেছে।
ছেলেটা গত বছর কোন শস্তা ম্যাগাজিন থেকে একটি প্রেমের গল্প নকল করে কলেজের ম্যাগাজিনে নিজের নামে ছাপিয়ে দিয়েছিল। খান্নামাস্টার ওর লেখকখ্যাতিতে কাদা ছিটোতে উঠে পড়ে লেগেছেন। উনি গলার স্বর বদলে বল্লেন, " লেখক মহাশয়, কিছু বলুন। মেটাফর কারে কয়?"
ছেলেটা ওর উরু চুলকোতে লাগল। মুখটা কয়েকবার আঁকাবাঁকা করে হটাৎ বলে উঠল, " যেমন মহাদেবীজির কবিতায় বার বার বেদনার মেটাফর দেখা যায়।"
খান্নামাস্টার গর্জে উঠলেন, "শাট্ আপ! এটা ইংরেজির ক্লাস।" ছেলেটা চুলকানো বন্ধ করল।
খান্নামাস্টার খাকি রঙের প্যান্ট আর নীল রঙের বুশশার্ট পরেন আর স্মার্ট দেখাবে বলে কালো চশমা। চেয়ার ছেড়ে উনি এবার টেবিলের সামনে এসে পাছার একটু ছোট অংশ টেবিলে ঠেকিয়ে কায়দা করে দাঁড়ালেন। ছেলেটাকে কিছু বলতে যাবেন, এমন সময় চোখে পড়ল পেছনের দরজায় প্রিন্সিপালের চোখ আর বারান্দায় ক্লার্কের কাঁধের অংশ।
তক্ষুণি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বল্লেন," জী, শেলীর কবিতা পড়াচ্ছিলাম।"
প্রিন্সিপাল একটি শব্দের গায়ে আর একটি শব্দ চড়িয়ে দিয়ে বল্লেন," কিন্তু আপনার কথা শুনছে কে? এখানে তো এরা ছবি দেখায় মত্ত।" উনি এবার সোজা ক্লাসের ভেতরে ঢুকে এক এক করে দুটো ছেলের পিঠে বেত ছোঁয়াতেই ওরা উঠে দাঁড়াল। একজনের নোংরা পাজামা, বুশশার্ট আর তেল-চুপচুপে চুল; অন্যজনের ন্যাড়ামাথা, কামিজ ও পালোয়ানিমার্কা আন্ডারওয়ার। প্রিন্সিপাল ওদের বল্লেন, " কি, এসবই পড়ানো হচ্ছে?"
উনি নীচু হয়ে আগের ছেলেটির চেয়ার থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিলেন। ওতে ভরপুর সিনেমা সাহিত্য ছিল। একটা পাতা খুলে উনি হাওয়ায় ঘোরালেন। ছেলেরা দেখল, ফটোতে কোন বিলেতি মেমের উদ্ধত বুক ফড়ফড় করছে। এবার পত্রিকাটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে অবধীতে চেঁচিয়ে উঠলেন, "এটাই পড়ানো হচ্ছে নাকি?"
ক্লাসরুমে সন্নাটা। " মহাদেবী কী বেদনা"র প্রেমিকপ্রবর ছেলেটি মওকা দেখে চুপচাপ নিজের সীটে বসে পড়েছে। ক্লাসের এ মুড়োয় দাঁড়িয়ে প্রিন্সিপালসাহেব ও মুড়োয় দাঁড়িয়ে থাকা খান্নামাস্টারকে তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে বল্লেন," আপনার ক্লাসে ডিসিপ্লিনের এই অবস্থা? ছেলেরা সিনেমার পত্রিকা পড়ছে! এরই জোরে আপনি প্রেসার দেয়াচ্ছিলেন যে আপনাকে ভাইস প্রিন্সিপাল বানানো হোক? এই ক্ষ্যামতায় ভাইস প্রিন্সিপালগিরি কোরবেন? ভাইয়া, যদি এমনি চলতে থাকে তো ভাইস প্রিনসিপালি যাক চুলোয়, আসছে বছর জুলাই মাস থেকেই পথে পথে ঘুরে বেড়িও।" বলতে বলতে অবধীভাষার মহাকবি গোস্বামী তুলসীদাসের আত্মা ওনার শরীরের একদিক দিয়ে ঢুকে আর একদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল।তারপর উনি শুদ্ধ হিন্দিতে ফিরে এলেন," লেখাপড়াই সব নয়, আসল হল ডিসিপ্লিন, বুঝলে হে খান্নামাস্টার!"
এইসব বলে প্রিন্সিপাল সাহেব ওমর খৈয়ামের নায়কের " বৃষ্টিধারার মত এসে ঝড়ের মত যাই" ভঙ্গিতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন।পেছন থেকে খান্নামাস্টারের ভনভনানি ওনার কানে আছড়ে পড়ল।
উনি কলেজের ফটকের বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় উঠলেন। সাইকেল চড়ে একটি লোক আসছে-- পরনে শার্ট-প্যান্ট। কাছ দিয়ে যাবার সময় ও প্রিন্সিপালকে আর উনি তাকে নমস্কার করলেন। ও এগিয়ে গেলে ক্লার্ক জিগ্যেস করল এটা আবার কোন ইস্কাপনের গোলাম?
-" ম্যালেরিয়া ইন্স্পেকটর, নতুন এসেছে। শুনেছি বিডিও'র ভাগ্নে। বড্ড চালু। আমি এখনো কিছু বলিনি। ভাবছি, কখনো তো কাজে আসবে।"
ক্লার্ক বললো," আজকাল এমনিসব ইস্কাপনের গোলাম দিয়েই কাজ হয়। ভালমানুষের দল তো কখনো কিছু করে দেয় না।"
খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ, শুধু রাস্তায় পা ফেলে চলা। তারপর প্রিন্সিপাল শুরু করলেন," সবরকম মানুষের সঙ্গেই মেলামেশা করা উচিৎ। এই কলেজের জন্যে গাধাকেও বাবা ডাকতে হয়েছে।"
ক্লার্ক উবাচ, " সে তো দেখতেই পাচ্ছি। সারাদিন তো এই করেই কাটাচ্ছেন।"
- " বলুন, বলুন দেখি! এর আগে পাঁচ-পাঁচজন প্রিন্সিপাল ছিল। কেউ এমন বড় পাকা বাড়ি তুলতে পেরেছে?" উনি এবার শান্ত হলেন," এই কমিউনিটি সেন্টার তৈরি করা তো আমারই পরিশ্রমে সম্ভব হল। ঠিক বল্লাম কি না?"
ক্লার্ক সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।
একটু পরে উনি কিছু ভাবতে ভাবতে বল্লেন," আমি তো এই তালে আছি যে কোন ব্যাটা চন্ডুল ফেঁসে গেলে এই বিল্ডিং এর আর এক-আধ ব্লক তৈরি করে ফেলব।"
ক্লার্ক চুপ্চাপ সঙ্গে চলতে চলতে হটাৎ থেমে গেল, " দুটো বিল্ডিং তৈরি হল বলে।"
প্রিন্সিপাল উৎসাহের চোটে ঘাড় তুলে বল্লেন,"কোথায়?"
-" একটা তো অস্পৃশ্যদের জন্যে চামড়া সাফ করার কারখানা। ঘোড়ার ডাক্তার বলছিল। আর একটা হল হাসপাতালে কলেরার জন্যে আলাদা ওয়ার্ড। এদিকে খালি জমি পাওয়া কঠিন। কলেজেরই আশেপাসে "টিপ্পস" দিয়ে এই বিল্ডিংগুলো বানিয়ে নিন। তারপর কায়দা করে হাতিয়ে নেব।"
প্রিন্সিপাল একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে চলার গতি বাড়িয়ে দিলেন। বিড়বিড় করতে লাগলেন," আগে থেকেই জানতাম, এখানে 'টিপ্পস্ চলবে না"।
খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ চলতে লাগলেন।
রাস্তার ধারে একজন লোক গোটা চার মজদুরকে ধরে ভারি বকাঝকা করছিল। প্রিন্সিপালসাহেব ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দু-চারমিনিটে বুঝে গেলেন লোকটা কেন বিগড়েছে। মজদুরের দল কাকুতি-মিনতি করছিল। প্রিন্সিপাল বুঝে গেলেন যে ব্যাপারটা এমন কিছু নয়, এসব ঠিকেদার আর মজুরের মধ্যে রোজ-রোজ হতেই থাকে। আজ কথাবার্তায় কিছু খিঁচ ধরেছে। উনি আগ বাড়িয়ে মজুরদের বল্লেন, " যাও রে! সব নিজের নিজের কাজে লেগে যাও। ঠিকেদার সাহেবকে ঠকাবার চেষ্টা করলে জুতো খাবে।"
মজুরের দল কৃতজ্ঞতা ভরা চোখে প্রিন্সিপালের দিকে তাকালো, তারপর সুযোগ বুঝে যে যার কাজে লেগে গেল। এবার ঠিকেদার প্রিন্সিপালকে বেশ আত্মীয়্তা দেখিয়ে বলল," বুঝলেন, সব ক'টা বেইমান! একটু চোখ বুজেছেন কানের ময়লাও চুরি করে সাফ করে দেবে। দেড়গুণো মজুরি চায় আবার কাজ দেখলে পালাই -পালাই করে।"
প্রিন্সিপাল সাহেব বল্লেন," সবজায়গায় একই অবস্থা। আমার এখানেই দেখুন। কোন ব্যাটা মাস্টার পড়াতে চায়? আমি পেছনে লেগে লেগে তবু একটু--"।
লোকটা ঠা-ঠা করে হাসল। বলল," আমায় কি বলবে? এই তো করে যাচ্ছি। সব জানি।" তারপর একটু থেমে বলল, " এদিকে কোথায়?"
জবাব দিল ক্লার্ক, " বৈদ্যজীর ওখানে। চেকে দস্তখত করতে হবে।"
" দস্তখত করিয়ে আনুন।" ও প্রিন্সিপালকে কেটে পড়ার ইশারা করলো। কিন্তু ওরা পা' বাড়াতেই প্রিন্সিপালকে বল্লো," আর কি খবর? কেমন চলছে?"
প্রিন্সিপাল দাঁড়িয়ে পড়লেন।
-" এমনিতে সব ঠিকই আছে। ওই খান্না-বান্নার দল লিবির-শিবির করছে। মানে, আপনাদের আর আমার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা করে বেড়াচ্ছে।"
ও জোর দিয়ে বল্লো," আপনি চিন্তা করবেন না। ডাঁটের সঙ্গে প্রিন্সিপালগিরি চালিয়ে যান। ওদের বলে দিন যে প্রোপাগান্ডার জবাব হল ডান্ডা! বুঝিয়ে দিন যে এটা শিবপালগঞ্জ। এখানে ছোট-বড় দেখে চলতে শিখুক।"
একটু এগিয়ে যাবার পর ক্লার্ক বলল," ঠিকেদারসায়েবকেও কলেজ-কমেটিতে মেম্বার করে নিন। কাজে আসবে।"
প্রিন্সিপাল ভাবতে লাগলেন। ক্লার্ক বলল," ওনার নামে চার বছরের পুরনো তারিখে পেট্রনের রসিদ কেটে দেব। ম্যানেজিং কমিটিতেও ওনার থাকা জরুরি। তাহলে বেশ হবে।"
প্রিন্সিপাল সাহেব তক্ষুণি কিছু বললেন না। একটু পরে বল্লেন,"আগে বৈদ্যজীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। এসব হাই-পলিটিকসের ব্যাপার। তোমার-আমার ক্ষ্যামতার বাইরে।"
সাইকেলে চড়ে আর একজন কেউ আসছে। প্রিন্সিপাল ওকে নামতে ইশারা করে বল্লেন," নন্দাপুরে বসন্ত মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ছে, আর আপনি এখানে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে শায়রী করে বেড়াচ্ছেন?"
বেচারা হাত জোড় করে বলল," কই? কবে থেকে? আমার কাছে তো কোন খবর নেই!"
প্রিন্সিপালের ভুরু বেঁকে গেল। "তোমার শহরের চক্কর থেকে ফুরসৎ হবে তবে তো খবর পাবে? চুপচাপ ওখানে চলে যাও, গিয়ে টিকে লাগাও। নইলে নালিশ হবে আর তোমায় কান ধরে বের করে দেয়া হবে। ওই টেরিলিনের বুশশার্ট গা' থেকে নেমে যাবে।"
লোকটি হেঁ-হেঁ করে কেটে পড়ল।প্রিন্সিপাল ক্লার্ককে বল্লেন," এ ব্যাটা এখানের পাব্লিক হেল্থ বিভাগের এ ডি ও। যারই নামের পেছনে অফিসারের লেজ জুড়ে যায় সে'ব্যাটাই ধরাকে সরা জ্ঞান করে।"
" এ ব্যাটাও নিজেকে কি যে ভাবে, রাস্তায় দেখা হলে চিনতে চায় না।"
--" আমিও ভাবলাম দাও ব্যাটাকে ঝেড়ে!"
ক্লার্ক বলল," আমি জানি, এটাও একটা ইস্কাপনের গোলাম।"