গল্প - তপন রায়চৌধুরী
Posted in গল্পহরিবাবু নিয়মনিষ্ঠ লোক। প্রত্যেকদিন ভোর তিনটে পঁয়তাল্লিশে ঘুম থেকে ওঠেন। চারটের মধ্যে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে যান। সকালের নির্মল হাওয়ায় নিজেকে শুদ্ধ করে নিতে চান দিনের শুরুতেই। এটা তাঁর বহুদিনের অভ্যেস। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। সবে ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। ভোরের আলো ফোটেনি তখনও। দরজাটা বাইরের দিক থেকে টেনে বন্ধ করে রাস্তায় নামলেন হরিবাবু। কিছুটা এগিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। সামনে, রাস্তার ঠিক মাঝখানে কী একটা পড়ে আছে যেন! আরেকটু এগিয়ে রাস্তার আলোয় হরিবাবু দেখলেন, একটা খয়েরি রঙের ব্রিফকেস দাঁড় করানো আছে। এত সকালে কে ওটা রেখে গেল! হরিবাবু আর এগোলেন না সামনে, ভাবলেন, বোমা-টোমা থাকতে পারে ভেতরে! তিনি বাড়ি ফিরে এলেন। কিন্তু বাড়িতে ফিরেও অস্বস্তি। কী হতে পারে! জঙ্গি কার্যকলাপই হবে হয়ত! যে-কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ হতে পারে। তাহলে কি চুপ করে বাড়িতে বসে থাকা সম্ভব! হাঁকডাক করে মানুষদের জাগানো দরকার তো! নাহলে কী অনর্থ ঘটে যাবে কে জানে! কিন্তু এত ভোরে কে ...! এক্ষুনি যদি বিস্ফোরণ হয়! তিনি কানে আঙুল দিলেন। অত জোর আওয়াজ তিনি সহ্য করতে পারবেন না। কিছু একটা করা উচিত! হরিবাবু বাইরে বেরোলেন আবার। দূর থেকে লক্ষ করলেন বাক্সটা। এর মধ্যে আরও দু-চারজন দাঁড়িয়ে গেছে দূরে। হরিবাবু ত্বরিতগতিতে তাদের কাছে গিয়ে বললেন, “কী ব্যাপার বলুন তো! এত সকালে ...!”
“হ্যাঁ, তাই তো! ব্রিফকেস বলে কথা। বোমা-টোমাও থাকতে পারে ভেতরে। বেশি কাছে এগোনো ঠিক হবে না। দূরে থাকাই ভালো। পুলিশে খবর দেওয়া উচিত।“
ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। একটু একটু করে লোক জমতে শুরু করেছে। সবাই দেখছে বেশ দূর থেকে। কেউ দু-এক পা কাছে এগিয়েই আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ লোকের আশঙ্কা, ব্রিফকেসের ভেতরে টাইমার লাগানো আছে, বিস্ফোরণ হতে পারে, এটা জঙ্গিদেরই কাজ হবে। অবিলম্বে পুলিশকে খবর দেওয়া দরকার। আর দেরি করা যায় না।
প্রায় শ-খানেক লোক জমে গেছে ততক্ষণে। সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক হল, নিকটবর্তী থানায় অবিলম্বে খবর দেওয়া দরকার। দু-তিন জন লোক সাইকেলে চেপে চলে গেল থানায়। এদিকে ছেলে ছোকরারা দূর থেকে মাঝেমধ্যেই ইট মারা শুরু করেছে বাক্স লক্ষ করে। তাদেরকে ধমকাচ্ছেন দূরে-কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মাঝবয়েসি এবং প্রবীণ লোকজন। একসময়ে ইটের ঘায়ে ব্রিফকেসটা দাঁড়ানো অবস্থা থেকে শুয়ে পড়ল মাটিতে। চেঁচামেচি শুরু হল জনগণের মধ্যে। বয়স্ক মানুষেরা রেগে ধমকানি দিলেন ছেলেদের। ইটবৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল।
থানা থেকে তিনজন পুলিশ চলে এলেন একটু বাদেই। গাড়ি থেকে নামলেন। তারাও দূর থেকে ব্যাপারটা দেখলেন, কাছে ঘেঁষলেন না। বাক্সটা থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে সাধারণ রুটিনমাফিক মৌখিক তদন্ত করা শুরু করলেন তারা।
“আপনাদের মধ্যে কে প্রথম দেখেছেন ব্রিফকেসটা?”
হরিবাবু চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন দূরে। আগ বাড়িয়ে কিছু বললেন না। জানেন, পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। কিন্তু রেহাই পাওয়া গেল না। আগের দু’জন ভদ্রলোকের মধ্যে একজন হরিবাবুর দিকে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে পুলিশদের বললেন, “ওই ভদ্রলোকই প্রথম দেখেছেন।“
“আপনি?” পুলিশের মধ্যে একজন বলে উঠলেন।
হরিবাবু কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলেন পুলিশের কথায়। তারপর সহজভাবেই পুলিশের কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলেন। কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোন সূত্র মিলল না। শেষ পর্যন্ত আলোচনায় সিদ্ধান্ত নিলেন পুলিশরা, এ তাদের কম্ম নয়, লালবাজারের বম্ব স্কোয়াডে খবর দেওয়া দরকার।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বম্ব স্কোয়াডের লোকজন চলে এলেন। তাদের সঙ্গে ছিল দুটো ল্যাব্রাডর কুকুর। লোকে লোকারণ্য তখন। সকাল আটটা বেজে গেছে। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভীতিটা বোধহয় চলে যায়। এখন কৌতূহলটাই প্রধান হয়ে দাঁড়াল। কী ঘটতে চলেছে কে জানে! কী আছে বাক্সে! বম্ব স্কোয়াডের লোকজন তাদের নিয়মমাফিক কাজকর্ম শুরু করে দিলেন। দড়ি দিয়ে বৃত্তাকারভাবে বাক্সটার চারদিকে ঘিরে দেওয়া হল। কুকুর দুটোকে ছেড়ে দেওয়া হল বৃত্তের মধ্যে। ব্রিফকেসের সামনে গিয়ে তারা একটু শুঁকল কিছুক্ষণ। তারপর সামান্য ঘেউ ঘেউ করে উঠল। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে সনাক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু হল। কয়েকশো লোক তখন রুদ্ধনিঃশ্বাসে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, কী হয় সেটা দেখার জন্য। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বম্ব স্কোয়াডের লোকেরা নিশ্চিন্ত হলেন, বিস্ফোরণের কোনো সম্ভাবনা নেই। সবাই ততক্ষণে একটু যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। ভয় চলে যাওয়াতে এবার কৌতূহল জেঁকে বসল সবার মধ্যে। তাহলে কী!
লালবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। বম্ব স্কোয়াডের প্রধান মোবাইলে বলে উঠলেন, “না, না, ভয়ের কিছু নেই।“
“তবে?”
“একটু পরে জানাচ্ছি সবকিছু।“
“ওকে। ক্যারি অন।“
অপেক্ষমান জনতার তর সইছে না আর। মিডিয়ার লোকজন এসে গেছে অনেকক্ষণ হল। কালই ছবি উঠবে কাগজে।
ব্রিফকেস খোলা হল। বম্ব স্কোয়াডের লোকজন উঁকি মেরে দেখলেন বাক্সের ভেতরটাতে। তারপর উঁচু করে উলটে ধরলেন বাক্সটা। অজস্র সাদা কাগজের টুকরো ওপর থেকে ঝুরঝুর করে পড়তে লাগল মাটিতে। সবাই হকচকিয়ে থেমে রইল প্রথমটায়, তারপর দারুণ উল্লাসে ফেটে পড়ল জনতা। কেমন ঠকান ঠকল! বম্ব স্কোয়াডের লোকজন তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করে মাটিতে আছড়ে মারলেন ব্রিফকেসটাকে। তারপর হতাশ হয়ে ত্বরিতগতিতে গাড়িতে উঠে চলে গেলেন নিমেষে। পড়ে থাকা কাগজের টুকরোগুলো কেউ কেউ কুড়িয়ে নিল কয়েকটা। কেউ কেউ কাগজগুলো ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে মজা করতে করতে চলে গেল।
সবাই চলে গেলে হরিবাবু গুটিগুটি পায়ে সেই জায়গাটায় এলেন। বুঝবার চেষ্টা করলেন ব্যাপারটা। কে এভাবে বাক্সটা রেখে গেল এখানে! আর কেনই বা! নিছক এমনি এমনি! ঠিক মানতে পারলেন না হরিবাবু। তিনি কিছু কাগজ তুলে নিলেন মাটি থেকে। দেখলেন সবগুলোই সাদা। কী ব্যাপার! হরিবাবু ছাড়বার লোক নন। সেই ছাত্রজীবন থেকে তাঁর অভ্যেস, সন্দেহজনক সবকিছুই খুঁটিয়ে দেখা। নিশ্চয়ই এর মধ্যে কিছু রহস্য আছে। এতটা ভাঁওতা হবে! শুধু শুধু সাদা কাগজভর্তি একটা ব্রিফকেস কেউ ফেলে রেখে যেতে পারে না। একমাত্র পাগল আর আহাম্মক ছাড়া! দেখাই যাক না!
হরিবাবু বাড়িতে এসে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। তারপর সব জানালা বন্ধ করে দিলেন। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। এবার টেবিলে রাখা টেবিলল্যাম্পটা জ্বাললেন। কাগজের টুকরোগুলো টেবিলে রেখে খুব ভালো করে উলটেপালটে পরীক্ষা করলেন। একটা কাগজ তুলে নিয়ে তাতে স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই চমকে উঠলেন হরিবাবু। খুব আবছা সরু কোনো পেনে হলুদ রঙে কিছু একটা লেখা আছে যেন। রহস্যের গন্ধ পেলেন হরিবাবু। পড়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। হঠাৎ তার মনে হল, নিশ্চয়ই লেবুর রস বা ওই জাতীয় কিছু রস দিয়ে লেখা হয়েছে। তাহলে কাগজের তলা থেকে তাপ দিলে লেখাটা ফুটে উঠবে! হরিবাবু ত্বরিতগতিতে রান্নাঘরে চলে গেলেন। গ্যাস জ্বাললেন। শিখাটা খুব অল্প করে দিয়ে একটা কাগজের টুকরো তার ওপর ধরলেন। জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠল লেখা – “ফোন করিস। সৃঞ্জয়।“ তলায় একটা মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে। কী কান্ড! এ তো তার কলেজজীবনের বন্ধু সৃঞ্জয়। এতদিন পর! ঠিক বুঝলেন না হরিবাবু। সকাল দশটা বাজে তখন। হরিবাবু ফোন করলেন ওই মোবাইল নম্বরে। ওপ্রান্ত থেকে কন্ঠস্বর ভেসে এল –
“তোর ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম হরি। কেমন চমকে দিলাম বল তো। মনে আছে, তুই গর্ব করে বলতি, কেউ তোকে কোনোদিন চমকাতে পারবে না, আমি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলাম তোকে। একদিন এর উত্তর দেব আমি। মনে পড়ে? শোন, এখন আর কোন ঝগড়া নয়, একদিন আয় আমার এখানে। গল্প করব চুটিয়ে।“
প্রায় তিরিশ বছর আগে সৃঞ্জয় চলে গিয়েছিল আমেরিকা। উচ্চশিক্ষার জন্য। তারপর কোনো যোগাযোগ ছিল না হরিবাবুর সঙ্গে। আর, আজ হঠাৎ ...।
থাকতে না পেরে হরিবাবু বলে উঠলেন, “সত্যিই চমকে গেছি রে! কবে এলি আমেরিকা থেকে? ব্রিফকেস তুই রেখেছিস? কখন? কেন? আমার বাড়ি চিনলি কী করে?”
“একসঙ্গে এত প্রশ্ন করলে তার উত্তর দেব কী করে! তার চেয়ে বরং একদিন আয়, জমিয়ে গল্প করব। সল্টলেকে আছি এখন। ঠিকানা মেসেজ করে দিচ্ছি। ওকে?”
“দাঁড়া, দাঁড়া। প্লীজ সৃঞ্জয়, নিশ্চয়ই যাবো তোর ওখানে। আগে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দে।“
“নাহ্, তোর দেখি সেই খোঁচানো অভ্যেসটা গেল না এখনও।“
“কী করে যাবে বল! এ তো জন্মসূত্রে পাওয়া।“
“তা বটে! শোন্, বলি তাহলে। তোর অলোককে মনে আছে তো? অলোকানন্দ ঘোষ। ব্যাকবেঞ্চার। একেবারে গ্যালারির শেষ দিকে বসত। মহা দুষ্টু ছিল।“
“হ্যাঁ হ্যাঁ। ওর সঙ্গে তো আমারও যোগাযোগ আছে। এখনও। মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হয়।“
“হ্যাঁ ঠিক। ওর সঙ্গে আমারও কথা হয় ফোনে। আমি দিনসাতেক হল আমেরিকা থেকে এসেছি। থাকব একমাস মতন। জানিস তো, অলোক ছিল আমাদের গেজেট। ওর কাছ থেকে সকলের খবরাখবর পেলাম। তোর খবরও ওর কাছ থেকেই পাই। এমনকি তোর বাড়ির স্ট্রাকচার, গলি, পাশের রাস্তা, তোর ডেলি রুটিন, সবকিছু। অলোক ঘাবড়ে গেল প্রথমটায়। বলল, হরির এত খবরে তোর দরকার কী! কারণটা বললাম ওকে। ও বলল, পারবি না। কিছুতেই পারবি না। হরি দারুণ সেয়ানা। আমি বললাম, বাজি! অলোকের সঙ্গে বাজি ধরলাম। ও হারলে আমাদের সকলকে একদিন খাওয়াবে। আমি হারলে ...। তারপর আজ ভোরে মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তোর বাড়ি যেতে পনেরো মিনিট লাগল। অলোকের কাছ থেকেই জেনেছিলাম, তোকে দেখে নাকি ঘড়ি মেলানো যায় এখনও। ব্রিফকেসটা যখন রাখলাম, তখন ভোর তিনটে পঞ্চাশ। দশ মিনিট বাদে তুই বেরোলি। বাকিটা তো ইতিহাস!”
“বুঝলাম। কিন্তু ব্রিফকেসটা আমিই প্রথম দেখব, তা তো নাও হতে পারত।“
“সে তো ঠিকই। একটা চান্স নিলাম। হারলে নাহয় আমিই খাওয়াবো! আর ব্রিফকেসটা দেখলে তুই তো চুপ করে থাকতে পারবি না। তোকে চিনি যে!”
“হ্যাটস অফ ভাই। তোর জবাব নেই।“
“বলছিস? বেশ। এবার বল্, কবে আসছিস? তাহলে সেদিন অলোক, শুভেন্দু, নীলাভ, ওদেরও আসতে বলব। অলোক তো খাওয়াবে আমাদের। সেরকমই তো কথা আছে। আড্ডা জমে যাবে বল।“
দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে হরি বলে উঠল, “বুঝলাম। তোর জবাব নেই সৃঞ্জয়।“
মোবাইলের অন্যপ্রান্তে সৃঞ্জয় হেসে চলল একটানা।