গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস
Posted in গল্পদমকা হাওয়া, একটা বিশাল ঢেউ। গর্জন করে ঢেউটা সমুদ্র থেকে আছড়ে পড়লো নির্জন সী-বীচে। বাঁধানো জায়গাটুকু হঠাৎ করেই জলে জলময়। কংক্রীটের বেঞ্চে বসে রঞ্জন জলে ভিজে না যাবার চেষ্টায় চপ্পল সহ পাদুটো উপরে তুলে নিল।
একটু পরে বড় বড় ঢেউগুলো শান্ত হলো। এখন জল গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে বালিয়াড়ী পেরিয়ে টানের দিকে।
জল নেমে যেতেই চোখ পড়লো। সামনেই, বাঁধানো চাতালটুকুতে। কিছুটা জলজ জঞ্জাল আর ধবধবে একটা সাদা শঙ্খ! নিজস্ব দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ওটা সমুদ্র থেকে উপরে উঠে এলো কি ভাবে?
মালার সাথে আজ কিছুক্ষণ আগেই রঞ্জনের কথা কাটাকাটি হয়ে গ্যাছে। সমুদ্র-পারে নির্জনে এই গভীর রাতে অভিমানী এক প্রৌঢ় তাই একা একা বসে আছে!
আবার দমকা হাওয়ার হালকা চাপা গর্জন। সমুদ্র নিয়ে আসছে ঢেউএর পরে ঢেউ, একের পরে এক।
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। রঞ্জনের মনে পড়ছে রূপালির কথা! রূপালি তো তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে কতকাল আগে। একমাত্র ছেলে দীপান, কম বয়সেই মাতৃহারা! ক্লাস এইট থেকে হোষ্টেলে মানুষ। পড়াশোনা শেষ করে দীপান্তর এখন স্টেটসে চাকুরী করছে।
রঞ্জন একমনে ভাবছে তার ফেলে আসা জীবনের কথা। যা সংঘর্ষময়, কখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন, কখনো তা আলোকিত!
কোথাকার মানুষ, আজ সে ভাসতে ভাসতে কোথায় চলে এসেছে! যেমন এইমাত্র একটা ঢেউ শঙ্খটাকে ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে সমুদ্র পারের চাতালে। ওটা জীবন্ত অথচ পায়ের পেশী চলছে না। এক জায়গাতেই বসে শঙ্খটা থির থির করে কাঁপছে। যেন শঙ্খটার বমি পেয়েছে। ওটার মুখ খুলে গেল। ওয়াক, ওয়াক!
শঙ্খটার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ছোট্ট ছোট্ট পাথরের কুঁচি – সেগুলো স্ফটিকের মতো উজ্জ্বল, ধবধবে সাদা। কতগুলো কুঁচি কুচকুচে কালো। পাথরগুলো ভীষণ স্বচ্ছ্ব – যেন মূল্যবান গ্রহরত্ন!
শরীরটা ঝোঁকালো রঞ্জন, স্ফটিকের মতো উজ্জ্বল রত্নগুলো নিজের হাতে তুলতে গেল। পাথরগুলো কথা বলে উঠলো,-‘ওহে রঞ্জনবাবু, আমাদেরকে ছুঁয়ো না। চিনতে পারছো না? আমরা তোমার অতীতের টুকরো টুকরো স্মৃতি!’
রঞ্জনবাবু ভাবছে, সমুদ্র-শঙ্খের ভেতর কি করে তার স্মৃতিগুলো ঢুকে পড়েছে? যদি তার অতীতগুলো শঙ্খের মধ্যে ঢুকেই যাবে, সেগুলো এমন স্মৃতির পাথর হয়ে বেরিয়ে এলো কিভাবে? তাও আবার পাথরগুলোর রঙ সাদা আর কালো – যেন জ্যোৎস্নার আলো আর রাত্রির যন্ত্রণাময় নিকষ অন্ধকার!
রঞ্জন স্পষ্ট মনে করতে পারলো। পূর্ববঙ্গে তাদের গ্রাম বাড়ীটার কথা। তার শৈশব পাঠশালা, কৈশোরের স্কুল, রাজাকারদের রক্ত, খান সেনাদের অত্যাচার, মুজিবরের ভাষণ! রঞ্জনের নিজের হাতে খুন হয়ে যাওয়া দু-দুজন রাজাকারের লাশ! তারপর বনগাঁ সীমান্ত পেরিয়ে অসহায় রঞ্জনের এই ভারতবর্ষে আসা। ভূয়ো সার্টিফিকেট দেখিয়ে কাঁচড়াপাড়ার একটা স্কুলে ক্লাস এইটে ভর্তি। পড়াশুনা। কলেজের পাশ। তারপরে সাদামাটা শিক্ষকতার চাকুরী। কিছুদিন বাদে উদ্বাস্তু ঘরের বিধবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে রূপালির সাথে তার অনাড়ম্বর বিয়ে। অনেকদিন পেরিয়ে ধীরে ধীরে রঞ্জনবাবু নামকরা স্কুলের একজন হেডমাষ্টার।
কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তার সুখের সংসারটা নিমেষেই হারিয়ে গেল। ব্রেন ফিভার, না কি একটা অসুখে হঠাৎ করেই চলে গেলো রূপালি। আত্মীয় স্বজনেরা বলেছিল আবার বিয়ে করতে। কিন্তু একমাত্র ছেলে দীপান্তরের কথা ভেবে রঞ্জনের আর দ্বিতীয়বার বিয়ে করা হয় নি।
দীপান এখন আমেরিকাতে সেটেল্ড। রঞ্জন রিটায়ার্ড। কিছুদিন আগে একবার তিনচার মাস ছেলের কাছ থেকে ঘুরে এসেছে। তারপরে সেই নিঃসঙ্গতা। তার ফ্লাট জীবনের একাকীত্ব! কিছুদিন হলো আরেকজন ডিভোর্সী মহিলাকে সে তার বান্ধবী হিসেবে পেয়েছে। তারা দুজন লিভ-ইন করছে। বিপত্নীক রঞ্জনের এই প্রৌঢ় বয়সের সঙ্গিনী মালা মিত্র।
এই মালা মিত্রকেই সঙ্গে নিয়ে কয়েকদিন হলো সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে এসেছে রঞ্জন।
মালার সাথে আজ কিছুক্ষণ আগেই বেশ ঝগড়া হয়ে গেছে। রঞ্জন এই গভীর রাতে তাই হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। মনটা তার বিষন্ন! একা একা সমুদ্রের কিনারে বসে সে ভাবছে - বাকী জীবনটা কি এভাবেই কাটবে!
সাদা শঙ্খটা অনন্ত সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চাতালের উপর থির থির করে কাঁপছে। ওটা নিজের জীবনের জন্যে তড়পাচ্ছে! ওর অসহায় অবস্থাটা যেন রঞ্জনের জীবনের মতোই করুণ! শঙ্খটা তড়পাতে তড়পাতে উঁচু উঁচু শ্বাস তুলছে। যেন রঞ্জনকে হাত নেড়ে বলছে – ‘আমি চল্লাম’! যেন ওটার মৃত্যু আসন্ন!
রঞ্জন দেখলো, সমুদ্র-বিচ্ছিন্ন শঙ্খটার চারপাশে দাউদাউ করে এইমাত্র জ্বলে উঠলো উজ্জ্বল আগুন! ওর মনে পড়লো, এমনি লকলকে আগুনের হলুদ শিখার রুমাল নাড়তে নাড়তে একদিন তার জীবন থেকে রূপালি নিঃশব্দে সরে গেছিলো!
জ্যোৎস্নার আলো, হাওয়া আর ঢেউএর সশব্দ খেলা। এখন তার আর কিছুই ভাবতে ভালো লাগছে না। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, আকাশের নক্ষত্রেরা জ্বলে জ্বলে যেন খসে পড়ছে।
হঠাৎ কাঁধে একটা আলতো ঠ্যালা। রঞ্জন চমকে উঠলো। মালা মিত্র নিঃশব্দে এসে তার সামনে রাতের মোহিনীর মতো দাঁড়িয়েছে। বললো, ‘একা একা এখানে বসে কি করছো?’ জ্যোৎস্নার আলোয় তাকে মনে হচ্ছে সমুদ্রের দেবী!
তক্ষুনি আরো একটা বিশাল ঢেউ উঠে এলো। সমুদ্রের বেলাভূমি থেকে মুমূর্ষু শঙ্খটাকে নিজের দিকে টেনে নিলো জলস্রোত। সমুদ্র তাকে জলের গান শোনাবে বলে ফিরিয়ে নিয়ে গেল নিজের গভীরে! জলজ শঙ্খটা জলের মধ্যে মিশে যেতে যেতে এবার যেন তার জৈবিক প্রাণ ফিরে পেলো।
অভিমানের সুর মালার। ঢেউএর জল এসে ভিজিয়ে দিয়েছে তার শাড়ী, দু’টো ফর্সা পা। রঞ্জনের গলাটাকে জড়িয়ে গালটাকে নিজের সিক্ত ঠোঁটে আলতো চুমু খেলো মালা। ঝড় থেমে গেলে যেমন একটা স্নিগ্ধতা নামে, তেমনি স্বরে মালা বললো,- ‘চলো, হোটেলে ফিরে চলো, আর রাগ দেখাতে হবে না!’
শঙ্খ সমুদ্রের দিকে ফিরে গেছে। রঞ্জনও ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে তার যাপিত জীবনসমুদ্রের দিকে। এতক্ষণকার শূণ্যতা থেকে মুখ ফিরিয়ে রঞ্জন সামনের রাস্তার দিকে তাকালো – এতো রাতে রাস্তাঘাট জনমানবহীন। সে আর মালা পাশপাশি হেঁটে চলেছে। তাদের ছায়াগুলো একজন আরেকজনকে ছুঁয়ে রয়েছে। অনাড়ম্বর এই গভীর রাত এখন তৃতীয় প্রহরের দিকে। তাদের পাশাপাশি এই হেঁটে যাওয়া, তাদের দুজনের এই মুহূর্তগুলো যেন সঙ্গীতময়। নিশাচর এই দুটি প্রাণের পর্যটণ - তারই স্নিগ্ধতায় সমস্ত পান্থনিবাস ও যাবতীয় হোটেলগুলো অবিশ্বাস্য রকমের উজ্জ্বল। জনহীন ট্যুরিষ্ট প্লেসের চারধারটা আলোর মায়াময় রোশনিতে ঝলমল করছে!
ওরা দুজন ফিরে যাচ্ছে হোটেলে, নিজেদের রুমে। জীবনের সমস্ত গল্পগুলো কি ছোট্ট থেকে আবার বড়ো হয়ে যাচ্ছে?
এই রাত্রে ওরা দুজনে এখন পাশাপাশি বসে আছে হোটেলের ব্যালকনিতে। শুনতে পাচ্ছে সামুদ্রিক হাওয়ার দীর্ঘশ্বাস। ওরা দুজনে দেখতে পাচ্ছে - ক্লান্ত সমুদ্রটার তরল আবেদন বারবার আছড়ে পড়ছে জনহীন বালিয়ারির নিঃসঙ্গ বুকে! এই দুনিয়াতে চারপাশে কেউ নেই, কিছু নেই। রঞ্জনের হাত মালার তপ্ত হাতের মুঠোয় আদর খাচ্ছে।
বিছানায় ওরা একজন আরেক জনকে ছুঁয়ে আছে। সমুদ্রের গর্জন আর বুনো হাওয়ার মধ্যে এখন ওরা শুধু দু’জন - খুব কাছাকাছি – ওদের সামনে সমস্ত দুনিয়াটা এখন যেন সম্পূর্ণ হারিয়ে আছে। এই দুনিয়ার অসামাজিক অস্বাস্থ্যকর বিদ্রুপময় সমস্ত বোধগুলো এই মুহূর্তে ওদের থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে নিঃসঙ্গ মৃতবৎ পড়ে আছে! ওদের কানে এখন শুধু সমুদ্রের মায়াবী সংগীত!