Next
Previous
1

গল্প - তপন রায়চৌধুরী

Posted in






‘আশ্রয়’ আবাসনের গেটের সামনে বিরাট একটা লাল রঙের গাড়ি এসে থামল। পুলিশের গাড়ি। আশপাশের লোকেরা ভীতসন্ত্রস্ত। কী হল আবার? নিশ্চয়ই মারাত্নক কিছু ঘটেছে। আবাসনের উলটোদিকের আশ্রম-বাড়ির দরজার একপাশে একটা লম্বা কংক্রিটের নালা রাখা আছে অনেকদিন ধরে। তার ওপরে বসে স্থানীয় কিছু ছেলে নির্ভেজাল গুলতানি করছিল। তাদের থেকে একটু দূরেই পুলিশের গাড়িটা এসে দাঁড়াল। ছেলেগুলো বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াল ভয়ে। পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল তারা। গাড়ি থেকে সর্বপ্রথম নামলেন স্থানীয় থানার ওসি রণবীর ব্যানার্জী। দুঁদে পুলিশ অফিসার হিসেবে এলাকায় তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁকে অনুসরণ করল প্রায় পাঁচ-ছ’জন উর্দিধারী পুলিশ। ওসি সমেত বাকি পুলিশরা আবাসনের গেট খুলে ঢুকে পড়লেন ভেতরে। কেয়ারটেকার ঋজু সামন্ত হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বাইরে ছুটে এল। পুলিশের দলের একজন সরাসরি ঋজুর কাছে গিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলেন।

‘আশ্রয়’ আবাসনে দুটো ব্লক আছে। দুটো ব্লকেই পনেরোটা করে তিরিশটা ফ্ল্যাট। কিছু ফ্ল্যাট ফাঁকা, লোকজন নেই। যেসব ফ্ল্যাটে লোকজন আছেন, তাদের কেউই বাইরে বেরোচ্ছেন না, সম্ভবত পুলিশের গাড়ি দেখে। কে আর ঝামেলায় জড়াতে চায় নিজেকে! দু’নম্বর ব্লকের তিনতলার বিপ্লব রক্ষিতের বাড়িতে একটি মেয়ে কাজ করে। শিউলি। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে শিউলি জানালার পর্দা সরিয়ে পুলিশের গাড়ি দেখে বেশ ভয় পেয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে এসে বলল,

“মাসিমা গো, পুলিশ এসেছে নীচে।“

অঞ্জলি রক্ষিত বললেন,

“তোর আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই মনে হচ্ছে। জানালা দিয়ে দেখতে গেছিস আবার !“


অন্য আরও দুএকটা ফ্ল্যাটের জানালার পর্দা একটু নড়েই আবার জানালা ঢেকে দিল। কারুর কারুর জানালা খোলা অবস্থা থেকে বন্ধ হয়ে গেল একটু পরেই।


আবাসনের সেক্রেটারি সুজাতা চৌধুরীর হাত থেকে সকালবেলাতেই একটা থালা পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। কাজের মেয়ে শুক্লা বলেছিল,

“কী হল গো মাসিমা? দেখবে, আজ নিশ্চয়ই বাড়িতে লোক আসবে তোমার।“

সুজাতা বলেছিলেন, “ঠিক আছে। তুই তোর কাজ কর তো। পাকামো করতে হবে না।“


অবশ্য সুজাতা চৌধুরী মনে মনে নিজেও বিশ্বাস করেন, হাত থেকে থালা-বাসন পড়ে গেলে বাড়িতে লোক আসে। এর আগে বেশ কয়েকবার সেরকম ঘটেছে। তাই আজও সুজাতার মনে হচ্ছে, হয়ত লোক আসতে পারে বাড়িতে। চটপট সকাল সকাল স্নান করে ধোপদুরস্ত শাড়ি-ব্লাউজ পরে তৈরি হয়ে থাকলেন সুজাতা। যদি কেউ এসে পড়ে সত্যিসত্যিই!


ডোরবেল বেজে উঠল। শুক্লা একগাল হেসে বলল,

“ওই যে মাসিমা, কলিংবেল বাজছে। বলেছিলুম না ..”’


শুক্লা দরজা খুলেই দু’পা পিছিয়ে এল ভেতরে। কেয়ারটেকার ঋজু সামন্ত’র সঙ্গে স্থানীয় থানার ওসি রণবীর ব্যানার্জী। ড্রয়িং রুমে বসেছিলেন সুজাতা চৌধুরী। শুক্লা খবর দিতেই বেশ একটু চিন্তা নিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন সুজাতা চৌধুরী।

ওসির দিকে আঙুল দেখিয়ে ঋজু বলল,

“উনি এসেছেন আপনার কাছে।“


কথাটা বলেই ঋজু চলে গেল। বেশ একটু ভীতু ভাব নিয়ে চোখ গোল করে সুজাতা চৌধুরী বললেন,

“কী ব্যাপার?”

মাথা থেকে টুপিটা হাতে নিয়ে ওসি সাহেব বললেন,

“গুড মর্ণিং ম্যাম। একটা জরুরি কথা ছিল আপনার সঙ্গে। ভেতরে আসব কি?”

একরকম বাধ্য হয়েই সুজাতা চৌধুরী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন,

“হ্যাঁ আসুন।“


দরজা বন্ধ হয়ে গেল। দুটো সোফা মুখোমুখি। একটাতে বসলেন ওসি রণবীর ব্যানার্জী, অন্যটাতে সুজাতা চৌধুরী। টুপিটা সোফায় রেখে বুকপকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ভাঁজ করা কাগজ ওসি রণবীর ব্যানার্জী সুজাতা চৌধুরীর হাতে দিয়ে বললেন,

“দেখুন তো ম্যাম, ঠিক আছে কিনা।“


বেশ ভুরু কুঁচকে কাগজটা হাতে নিয়ে সুজাতা দেখলেন একটা ছোট্ট কবিতা লেখা আছে কাগজে। কবিতার নাম ‘অর্ঘ্য’। তলায় কোনো নাম নেই।


সুজাতা চৌধুরী হতভম্ব। ভুরু কোঁচকালেন ওসির দিকে তাকিয়ে, তারপর কাগজে লেখা কবিতার দিকে। এরকম আরও একবার তাকালেন। তারপর কবিতাটা পড়লেন। দারুণ লাগল। আবার তাকালেন সামনে বসা সুঠাম যুবকটির দিকে। বোঝার চেষ্টা করলেন ভদ্রলোককে। ওসি রণবীর ব্যানার্জী তখন মিটিমিটি হাসছেন সুজাতা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে। তারপর বিনীত এবং নরম স্বরে বলে উঠলেন,

“আমাকে চিনতে পারলেন না ম্যাম। আমি রণবীর। রূপনারায়ণপুরে হোলি চাইল্ড স্কুলে আপনি বাংলা পড়াতেন আমাদের। আমি কবিতা লিখতাম। আপনি কারেক্ট করে দিতেন। আমার ব্যাগের একধারের ফিতেটা প্রায়ই খোলা থাকত। আপনি আটকে দিতেন। সুজাতা চৌধুরী তখন প্রায় বিস্ময়ে এবং আনন্দে কাঁপছেন। সেই অবস্থাতেই একটু হেসে বললেন,

“তুমি ... তুমি সেই রণবীর! এই পোশাক?”


ওসি রণবীর ব্যানার্জী সোফা ছেড়ে উঠে প্রণাম করলেন সুজাতা চৌধুরীকে। তারপর বললেন,

“আমি তো কিছুদিন হল এখানকার থানার ওসি হয়ে এসেছি। খবর পেয়েছি আপনি এখানে থাকেন। কিছুদিন ধরেই ভাবছি, আপনার সঙ্গে দেখা করব, কিন্তু হয়ে উঠছিল না। আজ সকালেই এই কবিতাটা লিখলাম। ভাবলাম, আজই দেখা করি। তাই ...”

সুজাতা চৌধুরী বেশ অবাক এবং বেশ উদ্ভাসিত হয়ে হেসে বললেন,

“কীভাবে জানলে আমি এখানে আছি?”

ওসি সাহেব হেসে মজা করে বললেন,

“এখন তো পুলিশ হয়ে গেছি ম্যাম। আমাদের জানতে হয়। আজ আসি। কোনোরকম অসুবিধা হলে আমাকে জানাবেন।“

ভীষণ ব্যস্ত হয়ে সুজাতা চৌধুরী বললেন,

“সেকি ! এখনই উঠবে? একটু ..”’

ওসি সাহেব বললেন,

“নীচে আমার লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। আরেকদিন সময় করে আসার চেষ্টা করব। আজ চলি।“


চলে যাওয়ার আগে ওসি সাহেব আরেকবার প্রণাম করলেন তার ম্যামকে।