Next
Previous
0

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in







একলব্য কামারের পা চেপে ধরে বলল, তোমার কন্যা মানে আমার ভগ্নী। না কোরো না খুড়ো।



“বেশ, চল তবে। কিন্তু ভাইপো, ঝামেলা করলে, তোর খুড়ি কিন্তু দুজনকেই আঁশবটি দিয়ে কেটে ফেলবে।”

“মা কালীর দিব্যি।”

দুজনে বাজার থেকে বের হয়। বাইরে একলব্যের ঘোড়াটা মাঠে বড় দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। একলব্য কামারকে বলে, কাকা! ঘোড়াটা নিয়ে আসি।

কামার অবাক হয়ে বলে, ওরে রাজপুত্তুর! তোর আবার ঘোড়াও আছে। একেই বলে গরিবের ঘোড়া রোগ।

একলব্য ঘোড়ায় চাপে। পিছনে বসিয়ে নেয় কামারকে। তার পর নির্দেশিত পথে ছুটিয়ে দেয় অশ্ব।

কামারের বাড়ি হস্তিনার উত্তরে। অস্ত্রবাজার থেকে কুরুক্ষেত্র পার হয়ে সে অনেক রাস্তা। বেশ গোছানো বাড়ি। কামারের বউ আর মেয়ে বেশ খাতিরযত্ন করল তার। জল এনে দিল। খেতে দিল যত্ন করে। কামার সদোপবাসী মানুষ—দিনে মাত্র দু বার আহার গ্রহণ করে। যেদিন অস্ত্রবাজারে যান সেদিন সকালে খেয়ে যায় আবার রাতে ফিরে খায়। একলব্যের তেমন হলে চলবে না। ব্রীহি ও যব এদের প্রধান খাদ্য। মাংসভক্ষণ করে না বললেই চলে। কামার মাঝেমধ্যে সুরাপান করে, সে কথা একলব্য তার মুখ থেকেই শুনেছে।

যবাগু আর ভর্জিত বার্তাকু দিয়ে নৈশ ভোজন সেরে কামারের সঙ্গে এক ঘরে শুয়ে পড়ল একলব্য। কামার তাকে বলল, হস্তিনার আখ্যান শুনেছিস?

একলব্য জবাব দেয়, না।

“খুব শীঘ্র একটা যুদ্ধ হবে।”

“কার সঙ্গে কার?”

কামার বলে, ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের। সে অনেক বড় কাহিনি। শুনবি?

“বলো।”

“মৎস্যগন্ধার নাম শুনেছিস?”

একলব্য জবাব দেয়, হ্যাঁ। দাশরাজ জেলের কন্যা।

“বাহ, অনেক জানিস দেখছি! তাহলে ঘুমো।”

একলব্য বলে, তুমি বলো। কিছুই জানি না তার পর। যুদ্ধের কথা বলছিলে না?

“শুনবি?”

“বলছি তো বলো। ঘুম আসছে না।”

কামার কাহিনি বলতে শুরু করে। শোন আমার নাম কানাহাইয়া কুমার, লোকে আদর করে ডাকে কামার। অবশ্য আমি ছুরি বানাই, শান দিয়ে এত তীক্ষ্ণ করে যে কুমড়ো কিংবা মানুষ ফালি করলে কেউ ধরতেই পারবে না মালটা গোটা না অর্ধেক করা! সে যাক গে! রাজবাড়ির অসি থেকে মসী সব ধার দেওয়ার জন্য রাজপেয়াদারা আমার কাছেই আসে। সেই আমি কানহাইয়া কুমার ওরফে কামার শুরু করছি।

মৎস্যগন্ধা আগে নৌকা বাইতো। সেই সময় একজন ঋষি বন থেক হস্তিনার রাজপ্রাসাদে আসতো রাজা শান্তনুকে পরামর্শ দিতে। সে বেশ কিছু কাল আগের কথা। মুনির সেই বন থেকে প্রাসাদে আসতে গেলে যমুনা নদী পার হতে হয়। মৎস্যগন্ধার নৌকাতেই আসত পরাশর। তার পর ভাব-ভালবাসা হয়ে পোয়াতী হয় মৎস্যগন্ধা। সেই ছেলের জন্ম হয় এক দ্বীপে। তার নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। সে থাকে বাপের সঙ্গে। পরাশর মৎস্যগন্ধাকে বলে, তুই রাজা শান্তনুকে বিয়ে কর। মৎস্যগন্ধা জানায়, তা কী করে হয়! অমন বুড়ো লোক। ওর ছেলে দেবব্রত তো আমার বয়সী। পরাশর বলে, যা বলছি শোন। রাণী হতে চাইলে রাজাকেই বিয়ে করতে হয়, তার পর তোর ছেলে রাজা হবে; গঙ্গাপুত্রকে সরিয়ে দেব।

মৎস্যগন্ধা বলে, রাজা কেন রাজি হবে!

“ঠিক হবে।”

তার পর পরাশর মুনি শান্তনুকে বলে, “অনেক দিন হল তোমার স্ত্রী পালিয়েছে। একটা বিয়ে করো, বুড়ো বয়সে নইলে কে দেখবে?

রাজা বলে, আরে রাম রাম! এই বয়সে বিবাহ! আমার পুত্র দেবব্রত এখন যুবক। তার বিয়ে দেব।

পরাশর বলে, সে দাও। কিন্তু তুমিও একখানা যুবতী মেয়ে দেখে বিয়ে করো।

রাজা জানায়, তাকে আর কোন যুবতী পছন্দ করবে!

অপরাহ্নে নদীর তীরে বেড়াতে যেও, মুনি এই কথা বলে চলে যায়।

রাজা শান্তনু বিকেলে মৎস্যগন্ধার দেখা পান। অপূর্ব সাজসজ্জায় ভূষিত সেই কন্যার সারা শরীরে বহিরাগত সুগন্ধের হাতছানি। এমন সুগন্ধী কোথায় পেল কন্যা? গঙ্গার গন্ধবণিক তো এত ভাল গন্ধদ্রব্য সরবরাহ করে না!

শান্তনু ভাবতে লাগলেন, অনেক কাল থেকেই পরাশর মুনি বলছে যে তার মামাতো ভাই অনন্তমুখ নামকরা বৈশ্য, তাকেই হস্তিনার বাণিজ্যের ভার দিন রাজা। কিন্তু গঙ্গার বণিকরা খুব সৎ ও ভাল মানুষ। যমুনার ওই চিত্রমুখ বৈশ্যরা তেমন সুবিধার লোক নয়। কোনও জালে পড়তে চলেছেন কি রাজা শান্তনু?

কিন্তু ওই সুগন্ধ টেনে নিয়ে গেল রাজাকে মৎস্যগন্ধার কাছে। শান্তনু জালে ধরা পড়লেন। মৎস্যগন্ধার বিবাহ হল শান্তনুর সঙ্গে। শান্তনু-গঙ্গার পুত্র দেবব্রত বুদ্ধিমান, তিনি বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তাতে মানও বাঁচে, সংঘাতও এড়ানো যায়। সেই থেকে অস্ত্রবাজার থেকে কাঁচাবাজার সব অনন্তমুখের দখলে। অনন্তর পুত্র দুর্মুখ এখন সব কিছুর দেখভাল করে। সে চাইছে বড় একটা যুদ্ধ হোক।

মৎস্যগন্ধার দুটি পুত্র হয়েছিল শান্তনু রাজার ঔরসে। বড়টির নাম চিত্রাঙ্গদ। সে এক গন্ধর্বের হাতে খুন হয়। ছোটো বিচিত্রবীর্য অনিয়ম করে মারা যায়, রেখে যায় দুই বিধবা স্ত্রীকে। মৎস্যগন্ধার আগের পক্ষের ছেলে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ওই বিধবাদের দেবর। সে পুত্র উৎপাদন করে বিধবাদের গর্ভে। তাদের একজন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, সেই এখন রাজা। কিছুই দেখে না চোখে। তার ১০১ জন ছেলে আর একটি মেয়ে। ধৃতরাষ্ট্রের ছোটো ভাই পাণ্ডু মারা গিয়েছে কিছু দিন আগে। পাণ্ডুর স্ত্রীদের গর্ভে দেবতারা পাঁটি পুত্রসন্তান উৎপাদন করেছে। এখন লড়াই হবে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের সঙ্গে পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্রদের। সেই জন্য নতুন অস্ত্রগুরু এসেছে, তার নাম দ্রোণাচার্য।

একলব্য বলে, আচার্য দ্রোণের সঙ্গে দেখা করা যায়?

কামার উত্তর দেয়, কী হবে সাক্ষাতে! তীরধনুক বেচবে?

“আজ্ঞে!”

“তুমি কি ভেবেছো, নতুন একটা ছেলে বাজারে অস্ত্র বেচছে সে কথা ওদের কানে যায়নি! দেবব্রত ভীষ্ম থেকে দ্রোণ সকলের কাছে খবর পৌঁছে গেছে। নাও এখন ঘুমোও দেখি।!”

একলব্যের ঘুম আসতে চায় না। কামারের নাসিকা গর্জন শুনতে শুনতে এক সময় কখন নিদ্রাদেবী তার উপর ভর করেছেন সে কথা একলব্য জানে না। ঘুম ভাঙলো মোরগের আওয়াজে।

কামারের বউ অনিন্দ্যা এবং কন্যা সুগন্ধা দুজনেই বড় ভাল মানুষ। তারা একলব্যের প্রাতঃরাশের ব্যবস্থা করল। ঘোড়াকে জাবনা দিল। তার পর কামারের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ আর কাজে যেও না। ছেলেটাকে প্রাসাদ দেখিয়ে আনো। ফেরার সময় একটু মাংস কিনে এনো।

একলব্য বেশ অবাক হল। কেননা সে জানে, দুধ-মাংস-তেল এইসব জিনিস বিক্রি হয় না। যদি কোনও দেশে এই সব বস্তুর কেনাবেচা হয় তাহলে জানতে হবে সেই রাজ্য পতিত। সে কামারকে জিজ্ঞাসা করল, কী গো খুড়ো, তোমাদের দেশে মাংস খোলা বাজারে বিক্রি হয়?

কামার জবাব দিল, হ্যাঁ হয়। ব্যাধেরা করে না। মাংস বেচে বৈশ্যরা। এখন তাদের নতুন নাম মাংসবণিক। শোনো ভাইপো, এককালে নদী পারাপার করতে পারানির কড়িও লাগতো না। মৎস্যগন্ধা সে সব চালু করেছেন। রাজা শান্তনুর পিতা প্রতীপ যখন নৃপতি ছিলেন, তখন হস্তিনা ছিল স্বর্ণনগরী। বণিকরা এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিল। আগে বিদেশি বণিকদের আয়ের পরে কর নেওয়া হত। এখন ঢুকতে না ঢুকতে গলায় গামছা দিয়ে সব কেড়েকুড়ে নিচ্ছে। এই দেখো না, তোমার তীরধনুকের অর্ধেক তো নিয়েই নিয়েছে। দু একটা পাঠাবে রাজার অস্ত্রশালায়, বাকিটা নিজেরা বেচে দেবে। যাক গে, প্রস্তুত হয়ে নাও। হস্তিনানগর দেখে আসি চলো।

এমন সময় দরজায় করাঘাত শোনা গেল। কে?

রাজপেয়াদা।

কী সংবাদ?

অতিথির ডাক পড়েছে রাজদরবারে।

‘যাচ্ছি’ বলে কামার একলব্যকে জানালেন, দেরি করা ঠিক নয়; এক্ষুনি বের হও।