Next
Previous
0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(৫)

বিমূঢ় ও বিপর্যস্ত অবস্থাতেও এতক্ষণৃ গোলকপতি টের পেল যে রাঢ়বঙ্গে এসেও আজন্ম এক অনাহুতের মত তাকে এক এক করে তার সমস্ত অবলম্বনগুলি যেন বন্ধনমুক্তির স্বাধীনতায় তাকে জোর করে ঠেলে দিচ্ছে নির্মোহ সামাজিকতায়। তাই আগামীকালের পৃথিবীতে যদিও বা সে শেষমেশ বেঁচে থাকে তবে তার পরিচয়টি হবে কৌলিকবংশপরিত‍্যাজ‍্য একজন অতি সাধারণ এক শ্রমজীবি মানুষের মতই।

গোলকপতি তার মৃত স্ত্রীর মাথাটি কোলে নিয়ে সারারাত আর না ঘুমিয়েই স্তব্ধবাক হয়ে বসে থাকল ভোরের প্রতীক্ষায়।

....

বিস্ময়ের ব‍্যাপার এই যে কোন অজানিত কারণে তার আজ আর একটুও শোক বোধ হচ্ছে না। সে যেন জেনেই গেছে যে কাল সকালে লক্ষ্মীমণির শবদেহটি সৎকারের সাথে সাথেই যেন তার সংগ্রামটি যেন আরও তীব্রতর হতে চলেছে।

নবাবহাটের আড়তে একটা কথা কদিন হল বেশ লোকমুখে ফিরছে। গোলকপতি এতদিন এসবের কিছুই জানত না। গতকাল লক্ষ্মীমণির অকাল মৃত‍্যু তাকে সবরকম বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়েছে বলে সে ভাবল আবার সকল উদ‍্যমটিকে ফিরিয়ে আনাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সে জানে যে তার শরীরে অস্বীকৃত হলেও রাজরক্ত বইছে তাই নিশ্চেষ্ট অবস্থায় বসে থেকে ভাগ‍্যকে কেবল দোষারোপ করার মূর্খামি সে কখনোই করবে না। তাই সে আজ এইসব রোমহর্ষক খবরাখবরের সবটা আড়তদার নগেন মুৎসুদ্দির কাছে সে উৎকর্ণ কন্ঠে শুনছিল। সেখানেই সে জানতে পারল যে নবাবী আমলের একজন দক্ষ রাজকর্মচারী কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পৌত্র ‘রামকান্ত রায়’ মুর্শিদাবাদ থেকে এসে এখন হুগলী জেলার অন্তর্গত একটি বর্ধিষ্ণু গঞ্জ খানাকুলে এসে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেছে ও নিজের অবিশ্বাস‍্য বুদ্ধিবলে ও কর্মদক্ষতার জোরে পূর্বজদের ব‍্যবহৃত ‘চৌধুরী’ উপাধির বদলে ‘রাজা’ বা ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধির জন‍্য ঈষৎ লালায়িত হয়েছেন । যদিও এই কৃষ্ণচন্দ্রের অন‍্য শাখার কিছু বংশধরেরা আরও বিভিন্ন বিষয় সম্পত্তির মালিক হয়ে বর্ধমান রাজারই অধীনে ছোটখাটো জমিদার হয়ে বসে আছেন। সেজন‍্য রামকান্ত ইদানীং কালে "রায়" পদবীটিকে পুরোপুরি ত‍্যাগ করতে পারেননি। তাছাড়া তিনি নিজেও বর্ধমানের মহারাণী বিষণকুমারীকে নানা বৈষয়িক বিষয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এসে তাঁর বন্ধুবৃত্তে বেশ স্থায়ী একটি জায়গা করে নিতেও সক্ষম হয়েছেন।

ইদানীং ইংরেজ কোম্পানির এজেন্টরাও এই ব্যবস্থায় বেশ খুশী। এরমধ‍্যে রামকান্ত রায়ের কনিষ্ঠ পুত্রটিও ইদানীং দেশে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে। 'রামমোহন' নামের এই কনিষ্ঠপুত্রটি অবশ‍্য রামকান্তের জ‍্যেষ্ঠপুত্র জগমোহনের চেয়ে মেজাজে ও স্বভাবে অনেকটাই আলাদা।

সে ইংরাজী ও ল‍্যাটিনে শ্বেতাঙ্গদের সমতূল‍্য যথেষ্টভাবে শিক্ষিত ও হিন্দুস্তানী রায়তদারে কাজকর্মের জন‍্য উর্দু ও ফারসীভাষায় একইরকমভাবে সুপন্ডিত হলেও সে বড় একরোখা ও তর্কপ্রিয় স্বভাবের এক স্পষ্টবাদী নব‍্যযুবা। কিছুদিন সে কাশীধাম থেকে সোজা তিব্বতে গিয়ে অনেকদিন শাস্ত্রচর্চা করেছে ও স্বভাবতই দীর্ঘকাল নিরুদ্দেশ থাকার পরে বছর দেড়েক হল স্বদেশে ফিরেছে।

এখন সেই শিক্ষিত যুবাটির মনে হয়েছে যে চিরায়ত হিন্দুধর্মের লোকাচারগুলির বেশীটাই নাকি এখনকার দিনে অচল। তাই সে নিজে এসব পাল্টে দেবার সংকল্পে নেমেছে। শোনা যাচ্ছে যে লাটবাহাদুর স্বয়ং বেন্টিঙ্ক সাহেব এই রামমোহনের সুহৃদতূল‍্য। এখন যদিও জনস্বার্থেই নাকি ইংরেজ সরকার " সতীদাহে"র মত চিরায়ত প্রথাটিকে বন্ধ করতে অগ্রসর হয়েছে।তবে দুর্জনে বলাবলি করছে এসব কিছুই নাকি এই ম্লেচ্ছ রামমোহনের কূট মস্তিষ্কের ফসল।