গল্প - তপন রায়চৌধুরী
Posted in গল্পচুপ করে বসেছিলাম। মনটা ভালো নেই কিছুদিন থেকেই। খুব একা লাগছে। এখন অবশ্য সবাই একা। কেউ আসে না কারুর বড়িতে। ডোরবেল বেজে উঠল। কে এল? দরজা খুলে দেখি, প্রায় ছ'ফুট লম্বা একজন সুদর্শন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলার আগেই সে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। বেশ অস্বস্তি হল।
বললাম, ”কী ব্যাপার? আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না”
“কিন্তু আমি তো তোমাকে চিনি।“
বেশ আত্নবিশ্বাসের সঙ্গে বলল সে। তাও আবার 'তুমি' করে। আমি ভুরু কুঁচকে বললাম,
“মানে?”
“তুমি ভুলে গেছ আমায়।“
এত জোর দিয়ে বলছে যখন, কি জানি, আজকাল নানারকম ঘটছে চারিদিকে। আমি চেষ্টা করলাম মনে করতে, কিন্তু পারলাম না। মাথা নেড়ে সরাসরি বললাম,
“চিনলাম না।“
ভদ্রলোক বললেন, “ভুলে গেছ। ঠিক আছে, আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। তুমি চেতলায় থাকতে না?” আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! এ কে রে! চেতলায় আমার শৈশব কেটেছে। আমাকে চেনে বলছে! বিস্ময় চেপে রেখে বললাম,
“হ্যাঁ তো, ...”
কিছু বলতে যাবো, ও হঠাৎ আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“এবার চুপ করে থাকো। আমি বলছি, তুমি শুনে যাও।“
আমি চুপ করে গেলাম। দীর্ঘদেহী মানুষটি বলে চলল,
“তুমি কৈলাস বিদ্যামন্দিরে পড়তে। ওখানে সিক্স পর্যন্ত পড়ে গড়িয়ায় চলে এলে। স্কুল শেষ করে কলেজ, মানে ইউনিভার্সিটি, যাদবপুর ইউনিভার্সিটি, আরও বলতে হবে?”
আমার মুখ দিয়ে আর কথা বেরোচ্ছিল না। কোনোমতে বললাম,
“কিন্তু তুমি মানে আপনি কে, ঠিক চিনলাম না তো।“
“সেকথা পরে হবে। এখন কাজের কথা বলছি।“
ভদ্রলোক তখন প্রায় নিজের কন্ট্রোলে নিয়ে ফেলেছেন আমাকে। চুপ করে থাকা ছাড়া আমি আর কিছু বলতে পারছিলাম না। শুধু বললাম,
“বলুন।“
“মন খারাপ করে বসে আছো কেন?”
বিস্ময়ের শেষ প্রান্তে তখন পৌঁছে গিয়েছি আমি। কি সাংঘাতিক! আমার মনের কথাও গোপন থাকছে না! কী আর বলব! আমি ধরা পড়ে গেছি পুরোপুরি। বললাম,
“বড্ড একা লাগছে।“
“এখন সবাই একা। ওটা কোনো কাজের কথা নয়।“
“এভাবে কি থাকা যায়? ঘরে বন্দি। কোথাও যেতে পারছি না। এক বছরের ওপর হতে চলল! “
“এখন সময়টা এইরকমই। অনেক তো ছোটাছুটি করেছ, ঘোরাঘুরি করেছ, এবার একটু স্থির হও।“
“আর কত স্থির হব?”
“এখন স্থির হওয়ার সময়।“
“আর তো পারা যাচ্ছে না।“
“পারতেই হবে। এখন সকলেরই পরীক্ষার সময়।“
“কীসের পরীক্ষা?”
“তোমার ধৈর্যের, তোমার সংযমের। যারা পারবে না, তাদের চলে যেতে হবে।“
“কী করতে হবে?”
“নতুন কিছু নয়। যা করছ প্রত্যেকদিন, তাই করে যাও।“
“করছি তো সেটাই। কিন্তু বড় একঘেয়ে লাগছে।“
“তোমার কাজের দিকে মন দাও। কাজটাকে ভালোবাসো।“
“সেই একই তো কাজ।“
“তুমি পুজো করো?”
“না।“
“কাউকে ভালোবাসো?”
“জানি না।“
“সে আবার কী? তুমি ছাড়া তোমার ব্যাপার কে জানবে!”
“আসলে, ভালোবাসা ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে।“
“আঁতলামি ছাড়ো। আচ্ছা বেশ, সহজ করে বলছি।“
“বলুন।“
“এই মুহূর্তে কে ফোন করলে তোমার ভালো লাগবে?”
“কেউ না।“
“বাজে কথা।“
এমন সময় মোবাইল বেজে উঠল আমার। ছুটে গিয়ে দেখি, তুহিনা ফোন করেছে। দীর্ঘদেহী মানুষটির দিকে তাকিয়ে বললাম, “এক মিনিট।“ দেখলাম, লোকটি মুচকি মুচকি হাসছে। আমি মোবাইলটা হাত চাপা দিয়ে দীর্ঘদেহীকে বললাম, “হাসছ কেন?”
সে বলল, “তোমাকে দেখে।“
বললাম, “মানে?”
সে বলল, “এবার বল, তোমার ভালো লাগছে না?”
আমি কথা ঘুরিয়ে বললাম, “এতে ভালোলাগার কী আছে। একজন ফোন করেছিল, আমি ফোন ধরলাম।“
সে বলল, “ঠিকই। কিন্তু সে যদি তুহিনা হয়, তাহলে তোমার ভালো লাগা দশগুণ বেড়ে যায়, তাই না?”
আমি বাকরুদ্ধ। এই মানুষটা কে? আমি তুহিনাকে বললাম, “তোমাকে পরে ফোন করব আমি।“
কথাটা বলে ফোন কেটে দিলাম। দীর্ঘদেহী মানুষটা তখনও হেসে চলেছে মুচকি মুচকি। আমি বললাম, “তুমি কে বলতো?”
সে বলল, “কাজের কথা সেরে নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি। ঠান্ডা মাথায় শোনো। এখনকার অবস্থার জন্য তোমরাই দায়ী। কিভাবে দায়ী, কেন দায়ী, এতসব বলবার সময় নেই, প্রয়োজন নেই, একটু চিন্তা করলেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। শুধু বলছি, এখন ঘরেই সময় কাটাও, নিজের ভেতরে ডুব দাও, আনন্দ খোঁজ নিজের মধ্যে। ভেতর গড়ে তোলো। এমন সুযোগ আর পাবে না।“
আমি মাথা নিচু করে মানুষটির কথা ভাবতে শুরু করলাম। তারপর সামনে তাকালাম। দেখলাম, কেউ কোথাও নেই। চোখ কচলালাম। কাউকে দেখলাম না। মনে হল, আমি একটা সুন্দর বাগানে বসে আছি। ফুলের গন্ধে ভরে গেছে চারিদিক।