Next
Previous
0

গল্প - প্রদীপ ঘটক

Posted in




















- রঞ্জনা,দেশের বাড়ি যাবে একবার? অনেকদিন যাইনি।

বিষাদী কন্ঠে কথাগুলো বলে রঞ্জনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সুকন্ঠ।

রঞ্জনা চায়ের কাপটা টি-টেবিলে ঠক্ করে নামাতেই কাপ থেকে কিছুটা চা চলকে পড়লো ডিসে।

সুকন্ঠ আজও অফিস যায় নি। মেয়েটাকে স্কুলে দিয়ে এসে নিজের ঘরেই বসে ল্যাপটপ নিয়ে। গতকালই কোর্টে উঠেছিল ওদের কেসটা। জজ সাহেব হতাশ হয়ে উচ্চারণ করেছিলেন " আজ ১৬টা ডিভোর্স কেস! এত ডিভোর্স কেন?" তারপর জজ সাহেব টেবিলে হাতের উপর মাথা রেখেছিলেন। সমস্ত আদালত স্তব্ধ। নির্বাক হয়ে ছিল ওরা দুজনেও। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে বলেছিলেন "এক সাথে সময় কাটান, কথা বলুন। ইগো সরিয়ে 'সরি' বলতে শিখুন। ছোট্ট একটা কথা কিন্তু বহু সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে। ভাবুন, সন্তান আছে আপনাদের।"

কয়েকমাস পরে আজই সুকন্ঠর ফ্ল্যাটে এসেছে রঞ্জনা, মেয়েকে নিয়ে। পাশে ফ্ল্যাটের পর ফ্ল্যাট আকাশ ছুঁয়েছে। জানালা আছে প্রকৃতি নেই, উন্মুক্ত বাতাস ঢোকে না এ ঘরে। দূর থেকে চলমান পৃথিবীর গাড়ির আওয়াজ ভেসে আসে শুধু। থামা নেই, জিজ্ঞাসআ নেই, শুধু যন্ত্রের মতো চলেছে এ শহর।

সুকন্ঠ সিগারেট ধরিয়ে অবিন্যস্ত ধোঁয়া ছেড়ে বলে " ধানের টাকা আনতেও তো যেতে হবে। অনেকদিন বাড়ি ঘর গুলোও দেখা হয়নি। আগের বার দেখে এসেছিলাম দক্ষিণের পাঁচিলটায় ফাট ধরেছে।"

কথাকয়টি শুনেই রঞ্জনা রান্না ঘরে চলে যায়। সুকন্ঠ রিমোটে হোম থিয়েটার অন করে। শুরু হয় "আমার যে দিন গেছে চলে………

তার ছিঁড়ে গেছে কবে, একদিন হা হা রবে
সুর হারায়ে গেছে পলে পলে।"

রাতে আজও তারা একসাথে খায়নি। মেয়েটার সাথে রঞ্জনা খেয়েছে। মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সুকন্ঠের ভেজানো দরজা অল্প খুলে রঞ্জনা বলে " কবে যাওয়া হবে? আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছি।"

-যদি বলি কালই?


পরদিন খেয়ে বেরিয়েছিল সুকন্ঠরা। গাড়িতে উচ্ছ্বল মেয়ের দু'পাশে ওরা নিঃশব্দ পাথরের মতো বসেছিল। হাইওয়ের দু'পাশে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। ইলেকট্রিক পোল মাঠ চিরে চলে গেছে ঠিকানাহীন হয়ে। লকলকে ধানের উপর দিয়ে ভেসে আসছে ভিজে হাওয়া। জমির জল নেমে এসে নয়ানজুলি ভরে দিয়েছে।

সুকন্ঠর বাড়ি পাশে গজিয়ে উঠেছে কিছু 'ছোটলোকের' বাড়ি। সরকার থেকে পাওয়া খাস জমিগুলো এতদিন চাষ হতো। এখন বাড়িঘর হয়েছে। উঠোনহীন বাড়িতে ছোট ছোট পরিবার। উঠোনে সবুজ গোবর গোলা, লাল মাটি দিয়ে নিকানো ধারি। উঠোনের মাঝে গোল লালমাটির বৃত্ত।

গ্রামের সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তেই ঢুকছিল সুকন্ঠর গাড়ি। বাড়ির সামনে রাস্তাতেই গাড়ি দাঁড়ালো। রঞ্জনা ব্যাগপত্তর নামাচ্ছে। পাশের বাড়িতে তখন এক দম্পতির তীব্র কলহ। বেলা গড়িয়ে গেছে। জন খেটে , নদীতে চান করে এসে সুচাঁদ দেখে তখনও রান্না হয়নি। কলহের মাত্রা তীব্র হ'তেই সুচাঁদ এক চড় কষিয়ে দেয় বউয়ের গালে। আঁতকে ওঠে রঞ্জনা, সেদিন সুকন্ঠও………, সুকন্ঠ মাথা নামায়।

সন্ধ্যা নামলেই ঘন হয়ে আসে গ্রাম। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত মানুষগুলো ন'টাতেই রাত্রির গভীরে ঢুকে যায়। নিঝঝুম পরিবেশে জেগে শুধু ওরা দুজন। রঞ্জনার মোবাইলে হালকা সুরে বেজে চলেছে " কোথায় আলো/কোথায় ওরে আলো/ বিরহানলে জ্বালো তারে জ্বালো……"

এমন সময়েই তাদের জানালার পাশ থেকে ভেসে আসে কিছু কথা।

-কি রে কাঁদচিস?

ফোঁপানোর পাশে আবারও একবার জিজ্ঞাসা।

-তুমি গায়ে হাত দিলে?

-জানিস তো কোদালের কাজ কত কষ্ট। খিদে পেয়েচিল যে। জানিস তো খিদে পেলে মানুষের মাতার ঠিক থাকে না।

-আমিও তো জ্বালন কুড়িয়ে ফেরলাম। রান্না চাপাতে দেরি হলো। তুমি সয়াবিন চচ্চড়ি খেতে ভালোবাসো বলে ওটা করতে গেয়ে দেরি হলো।

-তা আমাকে বললি না। বেশ আমার দিকে ঘোর।

তারপরই কয়েকটা চকাস চকাস চুমুর শব্দ।

-উমমম , ছাড়ো……

-ছাড়বো না, কি করবি কর্।

আরো কয়েকটা চুমুর আওয়াজ। রঞ্জনা লজ্জা পায়। মোবাইলে বাজছে " এ ঘোর রাতে কিসের লাগি/পরান মম সহসা জাগি………"