Next
Previous
2

গল্প - তপন রায়চৌধুরী

Posted in






কর্ড লাইনে বর্ধমান যাবো ঠিক করলাম। একটু বেলাই হয়ে গেছে। রোদের তাপ সাংঘাতিক। চৈত্র মাস শেষের পথে। আর ক’দিন বাদেই বাংলা নতুন বছর। বৃষ্টির নামগন্ধ দেখি না। কর্ড লাইনের গাড়িটা মেন লাইনের থেকে কিছুটা আগে গিয়ে বর্ধমানে পৌঁছয়।

গাড়ি ছাড়ল পাঁচ মিনিট লেট করে। কর্ড লাইন মানেই চালের বস্তা, আলুর বস্তা, শাঁকের আটি এবং তার সঙ্গে তস্য নোংরা জামাকাপড় পড়া অজস্র গরীব মানুষের কোলাহল। এছাড়া বিচিত্ররকম হকার তো আছেই। ট্রেনের জানালার বাইরে তাকালে কিছুটা মানসিক তৃপ্তি পাওয়া যায়। প্রকৃতিদেবী তাঁর সঞ্চয়ের ভান্ডার উপুড় করে দিয়েছেন। এত গরমে তাঁর দ্যুতি ম্লান হয়নি এতটুকুও। সুতরাং জানালার ধারে বসে বাইরের দৃশ্য দেখা ছাড়া দ্বিতীয় আর কোন রাস্তা খুঁজে পেলাম না।

হঠাৎ অনুভব করলাম কিছুটা স্নিগ্ধ শীতল হাওয়া। প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। মনটাও যে! কোথায় ছিলে তুমি! একটু ঘুরে বসলাম। একটি মেয়ে। বকমধ্যে হংস যথা। কতই বা বয়স হবে ষোল ... সতের ... আঠের, না, এর বেশি মোটেই নয়। গায়ের রং ফর্সা, বেশ তন্বী চেহারা। একটা হালকা নীল রঙের শাড়িতে ওকে মানিয়েছে দারুণ! কপালে দুই ভুরুর মাঝখানে একটা ছোট্ট নীল টিপ, শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করা। চোখ দুটো টানা টানা, কিন্তু কেমন যেন উদাস ভাব। পৃথিবীতে যাই ঘটুক না কেন, তাতে খুব একটা ওর বোধ হয় যায় আসে না। অথচ বেশ বুদ্ধি মাখানো চেহারা। কারুর দিকে ও বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকে না, অথচ মনে হয় কোনো কিছুই ওর নজর এড়ায় না।

ঠিক আমার মুখোমুখি বসল। আমার মত অন্য লোকগুলোও একটু নড়েচড়ে বসল যেন। ওরাও কি একই ধরনের চিন্তা করছে? আমারই মত? না করলেই ভালো। পাশের লোকটাকে যেন আমারই মত দেখছি, মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে মেয়েটির দিকে। এসব মোটেই ভালো নয়। খুব নির্লজ্জ দেখাচ্ছে লোকটাকে। এবার আমি মেয়েটিকে ছেড়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম শাসনের ভঙ্গিতে। ঠিক করলাম, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকব। তাহলে নিশ্চয়ই লোকটা বুঝতে পারবে ওর মতলবটা আমি ধরে ফেলেছি। কিন্তু একি! লোকটাও যে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ও-ও কি আমাকে একইরকম শাসন ...। নাহ্, আমি হেরে গেলাম! ধ্যৎ, বাইরেটাই ভালো। প্রকৃতিদত্ত সৌন্দর্যের মধ্যে ডুবে যেতে চাইলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলাম না। ট্রেনের ভিতরের মূর্ত্তিমতি প্রকৃতি যে পুরুষকে ডাকছে! এই চিরন্তন আহ্বান অগ্রাহ্য করি কী করে! দৃষ্টি ফেরালাম বাইরে থেকে ভেতরে, মেয়েটির দিকে। কানের দুলটা নজরে এল এখন। আহা, বেশ ছোট, কিন্তু চমৎকার! সহজে চোখে পড়ে না দুলটা, কিন্তু একবার তাকালে চোখ আটকে যায়। মেয়েটির রূপ দমবন্ধ করা। কত মুনি-ঋষি টলে যায় এই রূপে, কত কীটপতঙ্গ পুড়ে মরে এই আগুনে! আর আমি তো সামান্য মানুষ। তবে মাঝে মাঝে তাকালে ক্ষতি কি! তবে ওই, মাঝে মাঝে! তা না হলে আমারও কীটপতঙ্গের দশা হতে পারে। আমি কি প্রেমে পড়লাম? না, না, তা কি করে হয়, আমি তো সজাগ দ্রষ্টা পুরুষ! সব দেখে যাচ্ছি শুধু। বিশ্লেষণ করছি।

মেয়েটির মুখে একটু হাসি যেন! কেন? এ হাসির মানে কী! আমার দিকেই একটু তাকালো মনে হল। নিজের দিকে আড়চোখে একটু দেখে নিলাম। কই, হাস্যকর কিছু তো নজরে পড়ল না। তাহলে হয়ত আমি লক্ষ্য নয়। কিংবা, ও কি আলাপ করতে ... না, না, এতটা সস্তা হওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়, ওকে মানায় না। তাহলে কি আমার মনের চিন্তা মুখে ফুটে উঠেছে? এরা কিন্তু সব পড়তে পারে। না বাবা, ওই মাঝে মাঝে তাকানোই ভালো। বুঝতে যেন না পারে। তাহলেই বোকা হয়ে যাবো। কিংবা আমাকে যদি কিছু প্রশ্ন করে, যার উত্তর শুধু আমারই জানা, তবে দারুণ হয়! এইভাবে কথা শুরু হতে পারে। তারপর কথা চলবে, মাঝে মাঝে কিছুক্ষণ। হাসি হবে অল্প অল্প, যা অন্য লোকের নজর কাড়বে না, শুধু আমিই বুঝে নেবো তার অর্থ। কথার ফাঁকে ও কোথায় থাকে জেনে নেবো, হয়ত সেখানে যাবো না কোনোদিন। ও হয়ত আমার কথা জানতে চাইবে। এইভাবে চলবে আমাদের ...। কিন্তু তর যে আর সইছে না।

মেয়েটি নিশ্চয়ই বর্ধমানে যাবে আমারই মত।

ওঃ, গাড়িময় হকারের ছড়াছড়ি । আজ যেন একটু বেশিই হকার। তা’ও আবার এদিকটায়। কেন রে বাবা, ওই তো, ওদিকেও তো অনেক লোক বসে, যাও না বাবা ওদিকে! এদিকেই কি তোমার সব খদ্দের জমা আছে? আর একবার দুবার নয়, বারবার একজনকে অনুরোধ করলে কার না বিরক্তি হয়। জিনিস লাগবে কি লাগবে না, ফুরিয়ে গেল কথা। মেয়েটি বেশি ওদিকে না তাকালেই হয়, ওর তো আর কোনো জিনিস কেনার থাকতে পারে না! কিন্তু হকারের হাঁকাহাঁকিতে মাঝেমাঝেই ওকে বিচলিত দেখছি যেন। আহা! দেবো নাকি ওদের একটু ধমকে। কিছুই পারছি না, না পারছি মেয়েটিকে কিছু বলতে, না পারছি হকারগুলোকে কিছু বলতে। অথচ কী একটা অস্বস্তির ভাব ভেতরে। আবার বাইরের দিকে তাকালাম। নতুন করে খুঁজতে চাইলাম প্রকৃতির অন্তর্নিহিত রূপ।

আসলে, ভেতরে ভেতরে ক্রমশ বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। একটা মানুষকে জলের মধ্যে ডুবিয়ে চেপে ধরে রাখলে যে অবস্থা হয় আমারও অবস্থা ছিল অনেকটা সেইরকমই, একটা তীব্র যন্ত্রণা, যার থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলাম প্রাণপণে। চাইছিলাম, বাইরের প্রকৃতির মধ্যে একটা স্বস্তি খুঁজে নিতে, কিন্তু চূড়ান্ত ব্যর্থ এবং অবসন্ন হয়ে গেলাম কিছু পরেই। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ভীষণ অখেয়ালেই দৃষ্টি ফিরে এল ট্রেনের ভেতরে। চোখ চলে গেল যথারীতি মেয়েটির দিকে। ওহ্! আমাকে যেন স্বর্গ থেকে নরকে ছুঁড়ে দেওয়া হল। আমার প্রেম ছুটে গেল মুহূর্তে। দু’জোড়া সিঙ্গাপুরী কলা কিনে প্রিয়া আমার একটি একটি করে সেগুলো ধ্বংস করছেন। সিটের উপরেই বাবু হয়ে বসেছেন তিনি। ভ্যানিটি ব্যাগটি কোলের উপরে রাখা। বেশ টোপলা মুখ করে কলা খাচ্ছেন, আর গোলগোল চোখ করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। আহ্, কী শান্তি! এবার খুব সহজেই জানালার বাইরে তাকাতে পারলাম আমি। বাইরেটা মনে হল অনেক বেশি স্নিগ্ধ, আকর্ষণীয়, মোহময়।