গল্প - অচিন্ত্য দাস
Posted in গল্পসেই ছোটবেলা থেকেই শুভেশের এক-আধটু আঁকার শখ। হাতও ছিল। কলেজে গিয়ে এর সঙ্গে জুড়ল ছবি তোলা। শুভেশের কাকা থাকতেন বিদেশে, মাঝেমাঝে আসতেন। উনি একবার তাঁর চকচকে বিদেশি ব্যাগ থেকে আকাশের চাঁদ বার করে শুভেশকে উপহার দিয়েছিলেন। একটা এস এল আর মিনোল্টা ক্যামেরা।
শুভেশ পাতি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। বাবার সাধারণ চাকরি, অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়েই সংসার চলত। ক্যামেরা তো হলো, কিন্তু সে যুগে ফিল্ম জিনিসটা বেশ দামী ছিল। তাও আবার একটা রোল কিনলে কেবল ছত্রিশটা ছবিই তোলা যেত। ছবি তোলার পর ডেভেলপ করে ঠিক করতে হতো কোন কোনটা ভালো উঠেছে। সেগুলো বড় করে ছাপানো হতো। বাকি ছবি একেবারে ফেলে না দিয়ে কম খরচে ছোট করে ছাপিয়ে রাখত অনেকে।
সেবার শুভেশরা কলেজ থেকে গোয়া বেড়াতে গিয়েছিল। বলাই বাহুল্য, ক্যামেরাটা শুভেশের হাতে সারাক্ষণ থাকত। তবে এখন যেমন লোকে ফোনে যত্রতত্র বাছবিচার না করে ছবি তুলতে থাকে, ক্যামেরায় তা কেউ করত না। শুভেশ ঠিক করেছিল, ওর প্রতিটা ছবি ভালো হতে হবে। ছবির বিষয়, আলোর অবস্থা সব দেখেশুনে সে ছবি নেবে। তারপর কোলকাতা ফিরে একটা অ্যালবাম বানাবে, নাম দেবে ‘গোয়া ছত্রিশ’। তাতে আট বাই দশ, ছয় বাই আট – এরকম বড় সাইজের ছবি থাকবে। সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে, সমুদ্র-চিল মাছ ধরার চেষ্টায়, মাছ ধরার বড় নৌকো ফিরে আসছে, দিগন্ত রেখায় নানা রংএর আলো ছড়িয়ে সূর্যাস্ত হচ্ছে – ছবি তোলার বিষয়ের অভাব নেই।
একদিন বিকলের দিকে, আলো তখন নরম হয়ে এসেছে, শুভেশ ক্যামেরা তাক করে সমুদ্রের ধারে বসেছিল মাছধরা পাখির ছবি তুলবে বলে। সাগরের বালুতট যেখানে পাকা রাস্তায় এসে শেষ হয়েছে সেখানে আগাছার ভেতর কিছু হলদে ফুল ফুটেছে। মানে সবুজ আর হলদে। বালিয়াড়ির রং জলের দিকটা যেমন এদিকটায় তেমন নয়। খুব শুকনো, শুকনো আর ভিজে বালির রঙে অনেক তফাৎ। আরেকটু চোখ তুললে দেখা যায় নীল সমুদ্র আর নীল আকাশ – তবে এ দুই নীল এক রকম নয়। এর মধ্যে কটা বড় ডানাওয়ালা সমুদ্রের পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। মাঝেমাঝে জলে ছোঁ মারছে। একটা ছবিতে এতগুলো রঙের তারতম্য সমেত গোটা পরিবেশটা ধরা খুব কঠিন কাজ।
একটা সুযোগ এল বটে। সামনেই গোটা কয়েক পাখি জলের ওপর উড়ছিল, ওখানটায় নিশ্চয় মাছের ঝাঁক এসেছে। দু-একটা পাখি ছোঁ মারছিল .. শুভেশের চোখের সঙ্গে সাঁটানো মিনোল্টা … শাটারে আঙুল …
ছবি নেবার জন্য মনস্থির করা আর শাটার টেপার মধ্যে দুএকটা অনুপলের তফাৎ হয়ে যায়। পেছনে একটা বড় সিমেন্টের ময়লা ফেলার জায়গা – সেখানে কটা দাঁড়কাক ক ক করে ভোজ সারছিল। তার একটা কী করে যেন সমুদ্রের দিকটায় এসে পড়ল। শাটার ততক্ষণ টেপা হয়ে গেছে। দাঁড়কাকটা আটকে গেল শাটারে। মানে শুভেশের সাধের ছবির ঠিক মাঝখানে।
গেল। অ্যালবামের নাম পাল্টে গোয়া পয়ত্রিশ রাখতে হবে!
কলকাতায় ফিরে ছবি ডেভেলপ করা হলো। ফটো তুলিয়ে আর সে ফটো তুলিয়ে যদি আঁকিয়ে হয় তাহলে তো কথাই নেই – এরা বড় খুঁতখুঁতে হয়। তাই সে অ্যলবামের নাম শেষ পর্যন্ত “গোয়া বাইশ” রাখতে হয়েছিল। বাকি চোদ্দটা ছোট সাইজের ছবি অ্যলবামে নয় একটা পুরোনো চিঠির খামে ঠেসাঠেসি করে রয়ে গেল।
***
দিন যায়। কলেজ পাশ করে শুভেশ একটা চাকরি যোগাড় করে ফেলল। শুভেশের বাবার মতোই কম মাইনের জাঁকজমকহীন চাকরি। সে যাই হোক চাকরিতো একটা। চাকরি পাওয়াটাই শুভেশের জীবনের সব থেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলা চলত যদি না প্রায় একই সঙ্গে আরেকটা ব্যাপার ঘটে যেত।
শুভেশ প্রেমে পড়ল। মেয়েটির নাম সংকলিতা। ডাকনাম লতি। বড়লোকের মেয়ে, সুন্দরী বলা যায়। এদিকে শুভেশ পাতি মধ্যবিত্ত, চেহারাটাও তেমন কিছু নয়। কিন্তু প্রেমে পড়া ব্যাপারটা তেমন কোনো যুক্তি মানে না। আর ভালোবাসা যে এরকম উদ্ভট হতে পারে তা সকলেই দেখেছে। বাউলরা এই গোলমালটার ওপর ভর করে ঢুঢুং ঢুঢুং করে একতারা বাজিয়ে হাজার হাজার গান বেঁধেছে। দেশ-বিদেশের লেখকরা এই অসম পিরীত নিয়ে কত যে পাতার পর পাতা লিখেছেন তার হিসেব নেই।
শুভেশের মধ্যে কী দেখে কে জানে, সংকলিতাও বেশ মজেছিল। দুই বাড়ি থেকে কেউ রাজি নয়, কারোর মত নেই। একজোড়া পিতা আর একজোড়া জননী – চারজনেই পোড় খাওয়া মানুষ। তাঁরা জানতেন এ বিয়ে সুখের হতেই পারে না। তবু সংকলিতার জেদের ফলে এদের প্রেমপর্ব বিবাহ অবধি গড়াল।
যা ভাবা গিয়েছিল হলো ঠিক তাই। বিয়ের একমাসের ভেতর হাজার ঝামেলা, বহুমাত্রিক ঝগড়া। বহুমাত্রিক মানে নবদম্পতি দুজন এবং তাদের শ্বশুর শাশুড়ি মিলিয়ে আরও চারজনের সম্মিলিত মনোমালিন্য। শেষমেষ শুভেশই কোণঠাসা হয়ে পড়ত। এই নীরব বা সরব ঝগড়া সামলানোর মতো বুদ্ধি বা ব্যক্তিত্ব কোনোটাই তার ছিল না।
কয়েক মাস যেতে না যেতে শুভেশের মা নিজেই শুভেশকে বললেন “তোরা বরং আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে আলাদা থাক। নয়ত তোকে, আমাকে, আর তোর বাবাকে রোজ রাত্তিরে ঘুমের ওষুধ খেতে হবে। তা ছাড়া ঘুম আসবে না। আলাদা হলে খরচা তোর কিছুটা বাড়বে – সে নয় প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা থেকে যা সুদ আসে সেটা তোকে পাঠিয়ে দেব। তোর বাবার পেনশনে আমাদের চলে যাবে।”
অতটা অবশ্য করতে হয়নি। মানে টাকাপয়সার ব্যাপারটা। তবে আলাদা হয়ে গেল শুভেশরা। আলাদা হতেই শুভেশকে ধরলেন সংকলিতার বাবা। এতদিন ঠিক ভালো করে জামাইএর ওপর প্রভাব বিস্তার করা যাচ্ছিল না। একদিন চা আর মটরশুটির কচুরির পর লতির বাবা বললেন “শুভেশ, তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে। হ্যাঁ, একটা চাকরি তুমি নিজের চেষ্টায় পেয়েছ, কাজও করছো, তবে জীবনে সবসময় উদ্যমী হতে হয়। থেমে গেলে চলে না।”
শুভেশের বাবা যে কথাটা বললেন না কিন্তু শুভেশ শুনতে পেল তা হলো – আমাদের জামাই এরকম এলেবেলে হয়ে থাকুক তা আমি বা আমরা একেবারে চাই না। শুভেশ নিজেও কি চায় না উন্নতি করুক – তবে করবে কী করে? একটা রাস্তা শ্বশুরমশায়ই বলে দিলেন। শুনে শুভেশের কেমন কেমন লাগছিল, সে কি পারবে!
সংকলিতা, শ্বশুর আর শাশুড়ির ত্রিমাত্রিক চাপে শুভেনকে অ্যাকাউন্টেন্সির নাইট ক্লাসে ভর্তি হতে হলো।
শুভেশের মন আর্টিস্টের। যে কটা পরীক্ষায় সে কোনোরকমে পাশ করেছে তা ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি এসব মুখস্থ করে। অ্যাকাউন্টেন্সির ক্লাসে ডেবিট-ক্রেডিট আর বড় বড় খাতার পাতা ভর্তি হাজার রকমের হিসেব শুভেশ বিশেষ বুঝতেই পারত না। মানুষের মগজে তো ফোনের মতো অ্যাপ ডাইনলোড করা যায় না যে দরকার মতো হরেক রকম কাজ করানো যাবে! তবে হ্যাঁ। শুভেশ প্রাণপাত করে চেষ্টা করত। সারাদিন আপিসের পর ক্লাসে যেত নিয়মিত। খুব পরিশ্রম হতো। অবশ্য এত করেও মাথায় বিশেষ কিছু ঢুকত না।
এই সময় দুটো ঘটনা ঘটল শুভেশের জীবনে। এক: তার একটি পুত্র সন্তান জন্মালো। দুই: অ্যাকাউন্টেন্সির বছরকারের পরীক্ষায় শুভেশ ডাহা ফেল করল।
অবশ্য এত কিছুর মধ্যেও শুভেশ লতিকে খুশি দেখতে চাইত। কতটা সফল হতো তা বলা যায় না। একবার মাস-মাইনে পেয়ে একটা বিছানার চাদর কিনে এনেছিল। লতি দেখে বলেছিল “তুমি না আর্টিস্ট, এতো ক্যাটক্যাটে রং কী করে নিলে?”
দিন অবশ্য কাটতে লাগলো। শুভেশ সেই পুরোনো চাকরিটাই করে। তার যা বিদ্যেবুদ্ধি তাতে এর থেকে ভালো কিছু পাওয়া সম্ভবও ছিল না। আর একটা ডিগ্রী হলে তবু একটা কথা ছিল। ছেলে বড় হলো। লতি মানিয়ে নিল যতটা পারা যায়। এক এক করে দুদিকের বাবা-মা ওপারে চলে গেলেন।
কোনো এক কবি নাকি বলেছিলেন – প্রেম আর কর্পূর এক জিনিস। গরমে উবে যায়। কর্পূর কবেই উবে গেছে। লতি কবছর সংসার করার পর বুঝে গিয়েছিল, শুভেশের আর বিশেষ কিছু উন্নতি হবে না। তাদের এই রকমই দিন কাটাতে হবে। আসলে শুভেশ আর সংকলিতা না জেনে কী করে যেন বুদ্ধের একটা বাণী অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিয়েছিল। ভগবান বুদ্ধ বলেছিলেন – “কারোর কাছ থেকে কোনো কিছু আশা করবে না। শান্তিতে থাকার মূলমন্ত্র এটাই।”
***
শুভেশ-সংকলিতার ছেলে দূরে অন্য শহরে কাজ পেয়ে চলে গেল। বাড়িতে তারা দুজন। শুভেশ রিটায়ার করেছে, সারাদিন তেমন কিছু করার নেই। প্রভিডেণ্ড ফাণ্ডের টাকা পেয়েছে – সারা জীবন উদয়াস্ত খেটে বেলা শেষে এই কটা টাকা! শুভেশ বসে বসে ভাবে। চেষ্টা তো সে করেছিল। কতলোক কত কথা বলেছে, সে নাইট কলেজে ভর্তি হয়েছিল, প্রাণপণ খেটেও ছিল। কিন্তু হবার নয়, তাই হলো না। আরও কত জায়গায় কাজের চেষ্টা করেছিল, কোনোটাই লাগলো না। কতলোক কত উন্নতি করে, তার ভাগ্যে ওসবের কোনো বালাই নেই। তবু একঘেয়ে চাকরির থেকে ওই পাগলের মতো পরিশ্রমের দিনগুলোই শুভেশের ভালো করে মনে রয়ে গেছে।
সময় কাটে না। শুভেশ একদিন কটা আঁকার কাগজ আর রং কিনে নিয়ে এল। ভেবেছিল বসবে। কিন্তু ছবি আঁকবেটা কী নিয়ে? কিছুই যে মাথায় আসতে চায় না।
একদিন শুভেশ তার ছবি রাখার পুরোনো স্যুটকেসটা বার করেছিল। নাড়াচাড়া করতে করতে সেই ‘গোয়া বাইশ” অ্যালবামটা বেরলো। সব ছবিগুলো দেখল পাতা উল্টে । সেই বয়সে ছবিগুলো কী ভালোই যে লেগেছিল! সুন্দর সমুদ্র, সুন্দর ঢেউ, সুন্দর বালুতট, সুন্দর সূর্যাস্ত। সেই একই ছবিগুলো আজ আর কে জানে কেন তেমন করে মন টানল না। শুভেশের ভেতরে যে শিল্পী ছিল কিংবা আজও আছে, এত বছরের অভিজ্ঞতার চাপে সে কি পাল্টে গেছে? গুঁজে রাখা খামটা খুলল – বাতিল চোদ্দটা ছোট ছবি সেখানে। একটা একটা করে দেখছিল। চোখ আটকে গেল সেই ছবিটায় যেখানে তার ঘোর অনিচ্ছা সত্তেও দাঁড়কাকটা ঢুকে পড়েছিল। শুভেশ ফটোটা দেখতে থাকল একমনে।
একটু পরেই শুভেশ আলমারির মাথায় তুলে রাখা রং আর কাগজ নামাতে গিয়ে খবরের কাগজের কচটায় অসাবধানে হাত লাগিয়ে ফেলল। খবরের কাগজগুলো ঝপঝপ করে পড়ল মেঝেতে। রান্নাঘর থেকে লতি বলে উঠল – “করছটা কী, সাড়ে বারোটা বাজল – চান করে খেয়ে নাও এবার। রাজ্যের জঞ্জাল নামিয়ে কাজ বাড়াচ্ছে …”
শুভেশের কানে অবশ্য বিশেষ কিছু ঢুকল না। শুভেশ মনস্থির করে ফেলেছে আজ সে ছবি আঁকবে। বাতিল হওয়া দাঁড়কাকের ছবি। ফটোটার দিকে আবার তাকিয়ে রইল শুভেশ। চারিদিকে সব কিছু সুন্দর। নীল সমুদ্রের চালচিত্রে ভেসে থাকা পাখিগুলোর ডানায় নাচের মুদ্রার মতো ছন্দময় গতি। মেটে রঙের বালিতে ঢেউএর ফেনা বুড়বুড়ি কেটে মিলিয়ে যাচ্ছে। আকাশে সাদা সাদা সুখের মেঘ।
এসবের মধ্যে একটা দাঁড়কাক। সে এই সব সুখের ভেতর ঢুকতে চাইছে। সমুদ্রের কাছে উড়ে এসেছে ঠিকই কিন্তু কূলকিনারাহীন সমুদ্রে, এই এতো হাওয়ার বিকেলে সে পেরে উঠছে না। প্রাণপণে ডানা ঝাপটাচ্ছে। ছন্দহীন, দিশেহারা। ডানায় তার অত জোর নেই, অত গতিও নেই। শুধু ইচ্ছের জোরে কতটা আর ওড়া যায়। এই ছবিটাই শুভেশ আঁকবে। দাঁড়কাক তার মন টানছে – সাগরবেলার সুচিত্র বর্ণময় দৃশ্যের মাঝখানে এসে পড়া কালো অসহায় পাখিটার মধ্যে সুন্দর কিছু আছে কি? তা জানার দরকার নেই। শুভেশের শুধু মনে হলো এই দাঁড়কাকাটাই তার সব থেকে কাছের, সব থেকে আপন।