Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১১



বুঝতে পারছি যে আশ্রমে আমার আর ঠাঁই হবে না। মহারাজেরা ওই ভুখ হরতালের ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেন নি। এর একটা হেস্তনেস্ত করতে চাইছিলেন। মেজ মহারাজ তাঁর পুলিশি অভিজ্ঞতায় বলেছিলেন-- দরকার একটা এগজাম্পল ক্রিয়েট করা। উনি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছিলেন যে অমিয়দা সাস্পেন্ড হয়ে বাড়ি চলে গেলে যে অনশন সুরু হয় তার মাথা ছিল প্রদ্যুম্ন ওরফে পোদো। ওকে এবার সাস্পেন্সন নয়, সোজা ট্রান্সফার সার্টিফিকেট হাতে ধরিয়ে কোলকাতায় ফেরত পাঠিয়ে দিলে মন্দ হয় না।

আবার কিছু নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এরিয়া লাইব্রেরি থাকার সুবাদে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে একটি ডজ ভ্যান আশ্রমকে দান দেওয়া হয়েছিল। সেটায় করে মহারাজেরা বিভিন্ন প্রোগ্রামে যাতায়াত করতেন। কেউ একজন সেটার ইঞ্জিনে একমুঠো চিনি ঢেলে দিয়েছে। ফলে মোটর জ্বলে গেছে। তাতে কার কী লাভ হল?

পরে কানাঘুষোয় শুনেছিলাম যে ক্লাস নাইনের কিছু ছেলে ভেবেছিল এতে সরকারের টনক নড়বে, গাড়ির অপব্যবহার নিয়ে তদন্ত হবে। মাইরি বলছি , কে করেছে জানি না। কিন্তু কিছু ছেলেকে কথায় কথায় জানিয়ে দিলাম – কাজটা যে করেছে সে অত্যন্ত নাইভ, ভাল করে কারক-বিভক্তি পড়েনি। সরকারের তদন্ত করতে বয়ে গেছে।

স্বত্ব ত্যাগ না করে দিলে সেটা দান হয় না। তাই ধোপাকে কাপড় দিলে সেটা কর্মকারক হয়, কিন্তু ভিখারীকে ভিক্ষা দিলে সেটা সম্প্রদান। সরকার একবার ডজ গাড়ি আশ্রমকে দান করেছে, তারপরে কী হল সেটা নিয়ে ওরা মাথা ঘামাবে কেন?

কিন্তু আমার মেসেজ ঠিক জায়গায় পৌঁছতে বোধহয় দেরি হয়ে গেছল, কারণ পাম্প করে পাতকো’র থেকে ওভারহেড ট্যাংকে জলতোলার মোটরটি দু’দিনের মধ্যে একই ভাবে জ্বলে গেল। কেউ মোটরের ডিজেল ট্যাংকে চিনি ঢেলে দিয়েছিল।

কিন্তু এইসব সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে অচলায়তনের দেয়ালের একটা ইঁটও ভেঙে পড়েনি। তবে ভোগান্তি হল আশ্রমের সাধারণ ছেলেগুলোর। দু’দিন কলের জল বন্ধ রইল। স্নান, রান্না, প্রাতকৃত্যের জন্যে জলের টানাটানি! শেষে বাঁকুড়া শহর থেকে ভাল মিস্ত্রি এসে সব ঠিক করে সারিয়ে দেওয়ায় সোয়াস্তি!

কিন্তু কিছু আমোদগেঁড়ে ছেলেপুলে বেজায় খুশি। এক তো রোজের রুটিন জীবনযাত্রায় ভাঁটা পড়ল, প্রথমদিন ক্লাসে যেতে হল না। ঠিকমত নাওয়া-খাওয়া না হলে ওরা স্কুলে যাবে কী করে! দ্বিতীয় দিন সবাইকে মিছিল করে নদীতে চান করাতে নিয়ে যাওয়া হল। ঠিক শিবরাত্রির উৎসবের দিনের মত। কিন্তু আমার ঝামেলা বেড়ে গেল।

কর্তৃপক্ষের সন্দেহ যে আমিই এসবের নাটের গুরু, আর ক্লাস নাইনের আমার ন্যাওটা ছেলেটি, মানে প্রেমাংশু হল আমার কেলে হাঁড়ি, অর্থাৎ হাতেকলমে অপকর্মটি করনেওয়ালা।

এরপরে আরও একটা ঘটনা ঘটল। সন্ধ্যেবেলা যুদ্ধের কারণে ব্ল্যাক -আউট, সরকারের নির্দেশ। রাত্তিরে টিউটোরিয়ালের সময় জানলায় কালো কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখা হত, আর কম ওয়াটের হলদেটে বাল্ব জ্বালানো হত। পাছে পাকিস্তানের বোমারু বিমান ওই আলোকমালা লক্ষ্য করে বোমা ফেলে!

ওই দমবন্ধ অবস্থা থেকে নিস্তার পেতে আমাদের গ্রুপ একটা রাস্তা বের করল। তখন তামার এক নয়া পয়সা পাওয়া যেত। কোন একটা ঘরে হোল্ডার থেকে বাল্ব খুলে ফের বাল্বটি লাগিয়ে সুইচ্‌ অন করলেই গোটা দোতলায় শর্ট সার্কিট হয়ে অন্ধকার এবং ক্লাস ছুটি।

সবাই আমাদের গ্রুপকে সাধুবাদ দিয়ে ওই ম্যাজিকের রহস্যটি জানতে চাইল। আমরা বলিনি, কিন্তু স্বামীজিদের পুরনো স্পাই মানস নাইনের ছেলেদের বলে দিল। ফলটা হল যা তা।

দুটো ছেলে একদিন আমাদের নকল করে ওইভাবে শর্ট সার্কিট করল, কিন্তু ধরা না পড়ার জন্যে যেটা দরকার ছিল-- হোল্ডার থেকে ফের বাল্ব খুলে তামার পয়সাটা বের করে ফের ভালমানুষের মত বাল্বটি আগের জায়গায় লাগিয়ে দেওয়া—সেটা করতে ভুলে গেল। ফলে ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি যতবার সার্কিট ঠিক করে ততবার অন করলেই উড়ে যায়। শেষে ও বিরক্ত হয়ে প্রত্যেকটি ঘরের হোল্ডার চেক করতে শুরু করল। আর পেয়ে গেল কোন ঘরে তামার পয়সা লাগানো হয়েছে।

এবার ছেলেগুলো সতর্ক হয়ে লাইন শর্ট করার পর নিয়মিত তামার এক পয়সাটা বের করে নিতে থাকায় ধরা কঠিন হল যে এগুলো কার কীর্তি। স্বামীজিরা আমাদের ডেকে পাঠালেন। আমাদের বক্তব্য কেউ একজন শয়তানি করেছে বলে গোটা দোতলার ছেলেদের অপরাধী বলে দাগিয়ে দেওয়া বা তাদের শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবা ঠিক নয়।

মেজ মহারাজ মুচকি হেসে বললেন—অ্যানুয়াল পরীক্ষা সামনে। তোমরা পড়াশুনো করে ভালভাবে পাশ করতে চাও কিনা? তাহলে এই যখন তখন লাইট চলে যাওয়ার উৎপাত বন্ধ করার দায়িত্ব তোমাদেরই নিতে হবে।

কথাটা আমাদের মনে ধরল। ঢের হয়েছে। এবার যুদ্ধ বিরাম। ওদিকে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তেও সীজ-ফায়ার, তাশখন্দেও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাহলে আমরা কেন বহুজন হিতায় বহুজন সুখায় মহারাজদের যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাব মেনে নিতে পারব না? প্রায় সবাই একমত।

কিন্তু ভগবানের সৃষ্টি এই আজব দুনিয়ায় কোন কিছুই নির্বিঘ্নে হবার নয়। তাশখন্দে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শাস্ত্রীজি হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। এই মৃত্যু কতটা স্বাভাবিক তা নিয়ে আজও ধন্দ রয়ে গেছে।

আমাদের এখানেও একটা নতুন ফ্যাকড়া। ক্লাস এইটের বিজিত বলে একটা রোগাপ্যাটকা হাসিমুখের ছেলে, যার হাসলে দু’পাটি দাঁতের মাড়ি দেখা যায়, এই নতুন ঘটনার বলি হল। ওকে এইটের সেই বখা ছেলেগুলো কালো বিছানার চাদরে গা ঢেকে সাদা কাগজ কেটে গায়ে আঠা দিয়ে চিপকে কংকাল সাজাল। রাত্তিরে আলো নিভলে বিজিত ছোট বাচ্চাদের ঘরের বারান্দায় ওই সাজে দৌড়ে ভয় দেখাতে লাগল।

নীচের তলা থেকে কান্না ও চিল চিৎকারে আমরা গিয়ে প্রথমে বিজিতকে একচোট বকলাম—আমাদের পরীক্ষার প্রিপারেশনের সময় এইসব চ্যাংড়ামি করার জন্যে। তারপরে ওর নিখুঁত কংকাল চেহারা দেখে প্রাণখুলে হাসলাম।

এরপরে আমরা যে যার ঘরে ফিরে এসে পড়তে বসলাম। কিন্তু মানসের উস্কানিতে বিজিত বার খেয়ে বিবেকানন্দ আবাসে মহারাজদের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। রাত অনেক, বন্ধ দরজা। মানস বন্ধ দরজায় দুম দুম করে দুটো ঢেলা ছুঁড়ে আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। আর কেশব মহারাজ ঘুম চোখে দরজা খুলে বারান্দায় উঁকি দিলে বিজিতের ‘কংকাল’ এমুড়ো থেকে ওমুড়ো হিলবিলিয়ে দৌড়ে গেল। মহারাজ চমকে উঠে অস্ফুট আওয়াজ করলেন।

বিজিত প্রথম সাফল্যে আরও বার খেয়ে দু’তিনবার ওই দৌড় লাগাল। সেটাই ওর কাল হল। এবার কেশব নয়, একজন পুলিশ অফিসার চোখ কুঁচকে তামাশা দেখতে লাগলেন। ওঁর কানে এল লুকিয়ে থাকা মানস এবং কিছু ছেলেপুলের খিক খিক হাসি।

তারপর মাঝরাতে যা হল—একেবারে গণ্ডোলায় গণ্ডগোল কেস!

কেশব দৌড়ে ধরে ফেললেন কংকালের সাজে বিজিতকে। হাঁকডাকে চারদিকের দরজা খুলে ছেলেরা বেরিয়ে এল। একটু পরে আমরাও দোতলা থেকে নেমে এলাম।

কেশব হাঁফাচ্ছেন, বিজিত ভয়ে কাঁপছে।

--আমাকে ভূত দেখানো! দেখ, এবার ভূতের কী হাল করি!

ওনার একটি আপারকাটে বিজিত প্রায় উড়ে গিয়ে একটি বন্ধ দরজার গায়ে আছড়ে পড়ল। কেশব খুশি, আমাদের প্রায় দমবন্ধ অবস্থা। সবাই চুপ করে আছি। উনি ছেলেটার কলার ধরে টেনে তুলে দাঁড় করালেন। তারপর ডান হাতে আর একটা পেল্লায় ঘুঁষি ।

এবার অংক মিলল না। বিজিত আমাদের জুনিয়র টিমের গোলকীপার, ওর অ্যান্টিসিপেশন দুর্দান্ত। ঠিক সময়ে ডাক করে বসে পড়েছে। ফলে কেশবের ফস্কানো ঘুঁষি সোজা গিয়ে লাগল দরজার লোহার কড়ায়।

কাতরে উঠে কেশব মাটিতে বসে পড়েছেন, যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত।

পরের দিন হাসপাতালে এক্স-রে করে দেখা গেল দুটো আঙুলে স্মলবোন ফ্র্যাকচার!

বিজিতের সাসপেনশন ঠেকানো গেল না।

পরীক্ষার দেড়মাস বাকি। রাত্তিরের টিউটোরিয়াল বন্ধ হল। শুধু সকালে চলবে। রাত্তিরে স্বাধ্যায়। আমরা খুশি। ব্ল্যাক-আউট বন্ধ হয়েছে, আমরা খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারছি।

এদিকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর বাজার থেকে চাল -গম-চিনি উধাও, কেরোসিন উধাও। সরকারী রেশন ব্যবস্থায় পাওয়া যায় লালচে মোটা চাল। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য অগ্নিমূল্য। জেলায় জেলায় কর্ডন, মানে এক জেলার চাল অন্য জেলায় যাবে না। আর রেশনেও চালের কোটা কমিয়ে গম নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। ঘরে ঘরে একবেলা রুটি খাওয়ার নতুন রেওয়াজ শুরু হল। আমরা আশ্রমে এর প্রভাব অতটা টের না পেলেও কিছু তো টের পেলাম, বিশেষ করে রুটি খাওয়ার ব্যাপারে।

অধিকাংশ বাঙালি রুটি খেতেন জলখাবার হিসেবে—রুটিতরকারি, চিনি -রুটি, গুড়-রুটি আর চা দিয়ে রুটি।

কিন্তু জোর করে রোজ রোজ একবেলা রুটি খেতে বাধ্য করা? নৈব নৈব চ! মনে হয় এর জন্যেই দু’বছর বাদে বঙ্গে সরকার বদলে গেল।

আশ্রমের ক্লার্ক অচ্যুতদা, দশাশই চেহারা, একদিন কেঁদে ফেললেন। মহারাজ, অন্ততঃ দু-হাতা ভাত দিতে বলুন। দুটো রুটি খেয়ে আমার পেট ভরে না।

মহারাজদের মন গলে নি। বলা হল—দুটোয় পেট না ভরলে ছ’টা খাও, দশটা খাও। তাতে কোন মানা নেই। কিন্তু ভাত? তাও শুধু একজনের জন্যে” ধম্মে সইবে না।

শ্রীমান প্রদ্যুম্ন থুড়ি পোদোর কোন ভাবান্তর নেই। ও আগেও শখ করে একবেলা রুটি খেয়েছে। খারাপ লাগে নি। তারপর একটা বইয়ে পড়েছে যে পরিবর্তিত জলবায়ু বা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারার জন্যেই বিশাল বিশাল ডাইনোসর, ম্যামথ সব পৃথিবীর বুক থেকে অবলুপ্ত হয়ে গেছে। কাজেই অভ্যাস বদলাতে হবে। অ্যাডাপ্ট করতে হবে, নইলে এই ধরার বুক থেকে মুছে যেতে হবে।

কিন্তু আমার যে এই পৃথিবী থেকে মুছে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। বড় ভাল লাগে বেঁচে থাকতে। এখনও সেই বয়েস হয় নি যে দুবেলা ঠাকুরকে ডাকব—আমাকে ডেকে নাও, ভগবান। তোমার কোলে স্থান দাও। আমি যে আর পারছি না।

অচ্যুতদাদের মত বাঙালিরা হয়ত মুছে যাবে, কিন্তু আমি টিঁকে থাকব।

কিন্তু থাকবটা কোথায়? আশ্রমে তো থাকা হবে না। এটা মেনে নিতে সত্যি কষ্ট হচ্ছে। এই অচলায়তনে শুধু মহাপঞ্চক ও অদীনপুণ্যেরা আছেন এমন তো নয়। আছেন পঞ্চক, আছে অপাপবিদ্ধ বালকের দল।

কিন্তু দাদাঠাকুর? তিনি কোথায়? তাঁকে কেন দেখতে পাই নে? তিনি সত্যি আছেন তো? নইলে কিসের ভরসায় আশ্রমে থাকা!

না না; তিনিও আছেন বৈকি। কিন্তু আছেন নানারূপে। খণ্ড খণ্ড করে।

তাঁকে কখনও দেখি গুরু অমিয়দার মধ্যে—সব সমস্যার মুশকিল আসান রূপে। কখনও বা অকুতোভয় রমেনের মধ্যে, যে নির্দোষ নিষ্পাপ বাচ্চাদের মধ্যে একটি শিকারী বাজ বা খট্টাসের মত ঘুরে বেড়ানো দুর্বৃত্তের অণ্ডকোষ টিপে ধরে মেসেজ দেয়—নো মোর!

আছেন ভবদা, যিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন কবিতার রহস্যময় জগতের সঙ্গে।

আর বিপ্লব? ওকে কোন ছাঁচে ফেলব? ও এমন একজন, যাকে আমি চাই, রোজ দেখতে চাই, প্রতিমুহূর্তে কাছে পেতে চাই। কিন্তু আমি যে নিজেই সে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছি। ওকে মেরেছি বিচ্ছিরি ভাবে; লাথি মেরেছি--ছেলেদের যেখানে মারলে সবচেয়ে বেশি লাগে। এটা একেবারে ‘হোয়াট ইজ ডান্‌ কান্ট বি আন্‌ডান’ কেস। ওর সেই যন্ত্রণাকাতর অবাক চাউনি কি আমাকে আজীবন তাড়া করবে?

না, সেই নখদর্পণে ঘড়ি চুরির অভিযোগ থেকে আমিই ওকে বাঁচিয়েছি, অযাচিত ভাবে। কেন করলাম তা নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়। আর এর পরে ও আমার দিকে এগিয়ে এসেছিল, বোধহয় চাইছিল মিটমাট করতে, আগের মতন হতে। আমি মাছি তাড়ানোর মত করে হাত নেড়ে ওসব শেষ করে দিয়েছি।

কেন এমনি করলাম? জানি না, উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছি। কোথাও কি এই রিলেশনশিপে ভয় পাচ্ছিলাম? বা বুঝতে পারছিলাম না। ‘ইস্‌ প্যার কো, ক্যা নাম দুঁ’?

তার চেয়ে দূরে সরে যাওয়াই ভাল। বাবা তো আসছেই পরীক্ষার পর আমাকে এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে। আমাকে আসানসোলে নানুকাকার বাড়িতে থেকে উচ্চ মাধ্যমিক দিতে হবে। ভালই হবে। ওখানকার নামজাদা স্কুলে পড়ব, কো-এড স্কুল। অনেক প্রজাপতি ধরা যাবে।

কিন্তু বিশ্বস্তসূত্রে জেনেছি যে আমাদের স্বামীজিরাও বাবাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন--বাবার উচিত হবে আমাকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ানো এবং গার্জেনের তরফে একটি লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়া যে তাঁর ছেলে এবার থেকে সিধে পথে হাঁটবে, কোন বাঁদরামি করবে না। নইলে আমাকে পত্রপাঠ টিসি ধরিয়ে এই আশ্রম এবং আশ্রমিক স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে।

এই বিশ্বস্তসূত্রটি হল একদা মহারাজদের বিশ্বস্ত স্পাই মানস। ওর মধ্যে আশ্চর্য পরিবর্তন হয়েছে। সেই যে সেবার রাত্তিরে ভাঁড়ার ঘর থেকে কলা চুরির সময় প্রেমাংশু মাস্টার-কী দিয়ে মানসের তালা খুলে ওয়ার্ডেনের দরজায় লাগিয়ে ওনাকে নিজের ঘরে আটকে দিয়েছিল তখন মানস ওর তালা কী করে ওখানে গেল তার কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।

ফলটা হয়েছিল নিদারুণ। কেশব মহারাজ ওকে নির্মমভাবে চাবকে ছিলেন। ও আর ওনাদের বিশ্বাসপাত্র রইল না। ফলে ও ক্রমশঃ আগের সব কথা ভুলিয়ে আমাদের বিশ্বাসপাত্র হয়ে ওঠার করুণ চেষ্টা করতে লাগল।

পরে জেনেছি যে শুধু বিজিতকে উসকিয়ে কেশব মহারাজকে কংকাল দেখানোই নয়, পড়ার সময় বিজলি লাইনে শর্ট সার্কিট থেকে বিভিন্ন মোটরে চিনি ঢেলে অকেজো করা—সবের পেছনে আসল নায়ক হচ্ছে মানস ও প্রেমাংশু।

গুরু এবং প্রশান্তের আপত্তি সত্ত্বেও আমি মানসকে দলে টানার পক্ষপাতী; আমি হৃদয়-পরিবর্তনে বিশ্বাসী।

বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হল। অংকে টেনেটুনে পাশ করে যাব। বাকিগুলো ভালই উতরে গেছে। হোস্টেল খালি হচ্ছে। গার্জিয়ানরা এসে ছেলেদের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। গতকাল বিপ্লব চলে গেল। ওর দাদু ওকে নিতে এসেছিলেন। আমি সেসময়ে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলাম। একটা পায়ের শব্দ দরজার কাছে থেমেছিল, দুটো মৃদু টোকা। আমি চেঁচাই--কে ওখানে?

কোন উত্তর নেই। আবার টোকা পড়ে। আমি উঠি না, দরজা খুলি না। পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে দূরে চলে যায়।

দিনগুলো আর কাটতে চায় না। আমরা নিজেদের বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে নিয়ে তৈরি , কবে বাড়ি থেকে কেউ নিতে আসবে। এমন সময় প্রেমাংশু আমার ঘরে এল, সঙ্গে মানস ।

--চলে যাবার আগে আর একটা অপারেশন সিনেমা করলে কেমন হয়, পোদোদা?

আমি চমকে উঠি, তারপর হেসে ফেলি। কিন্তু হবে কেমন করে? স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। মার্কশীট জমা হয়েছে মহারাজদের কাছে। বাড়ি যাওয়ার সময় গার্জেনদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সঙ্গে শুভকামনা—আসছে বছর আবার আসবেন!

প্রেমাংশু বলে –কোন ঝামেলা হবে না দাদা। মানসদা হেব্বি আইডিয়া দিয়েছে। সন্ধ্যেবেলা প্রেয়ারের পর থেকে খাবার সময়টা পুরো খালি। এখন তো টিউটোরিয়াল নেই। আমরা ছ’টা-ন’টার ইভনিং শো দেখতে যাব। মালঞ্চ হলে চলছে হিন্দি ফিল্ম ‘সাগাই’। দেখে চুপচাপ ফিরে আসব রাত ন’টার মধ্যে। আমাদের খাবার রুমমেটরা নিয়ে ঘরে ঢাকা দিয়ে রাখবে। খেয়েদেয়ে লেপের তলায়। স্বামীজিরা টের পাবেন না।

আমি বিরক্ত মুখে বলি,--হলটা দু’ কিলোমিটার দূরে। যেতে আসতে কেউ দেখে ফেলতে পারে। আর সন্ধ্যেবেলা গেটে বিহারি দারোয়ান, বাইরে যাব কেমন করে?

মানস হেসে ফেলে।

--গেট দিয়ে বেরোব না, পাঁচিল টপকাবো।

--কী ফালতু আইডিয়া! অত উঁচু পাঁচিল! আমরা কি বাঁদর?

মানস প্রেমাংশুর দিকে তাকায় এবং ঠোঁট টিপে হাসে।

--রেগে যাচ্ছ কেন পোদোদা? মানসদা খুঁজে পেয়েছে একটা জায়গা। লাইব্রেরির পাশে একটা নতুন ইউরিনাল হয়েছে না? যেখানে শুধু ডে-স্কলার ছেলেরা যায়? সেটার উপরে উঠলেই দেয়াল খুব কাছে। সেখান থেকে পাশের গলিতে লাফিয়ে পড়লেই হল। সন্ধ্যের সময় অন্ধকার , কেউ খেয়াল করবে না। আজ বিকেলে তুমি আর আমি গিয়ে ওই জায়গাটা , ওর হাইট দেখে আসব’খন।

--আচ্ছা? তারপর ঘুরে বড় রাস্তায় উঠে সেই আশ্রমের মেন গেটেরসামনে দিয়েই যেতে হবে তো! সামনে রূপালী সিনেমা হল, ভীড় থাকবে।

--আরে, দারোয়ানের মুখ তো রাস্তার দিকে নয়, আশ্রমের ভেতরের দিকে। আর শীতের সন্ধ্যায় আমরা আলোয়ানে মাথা ঢেকে পেরিয়ে যাব, কেউ চিনতে পারবে না।

ঠিক পরের দিন সন্ধ্যে। উত্তেজনায় সান্ধ্য আরাত্রিকের গানে মন লাগে নি। বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করছে। প্রেয়ারের পর সবাই যার যার কামরার দিকে হাঁটতে শুরু করলে আমরা তিনজন পিছিয়ে পড়ি। আলোয়ানে মুখ ঢেকে লাইব্রেরির পাশের ইউরিনালের পাশে দাঁড়াই। কেউ আমাদের খেয়াল করে নি।

সবার আগে আমি পাঁচিলে উঠে ওদিকে লাফিয়ে পড়ে হাঁটতে থাকব, তারপর প্রেমাংশু, শেষে মানস।

নাঃ, ইউরিনালের দেয়ালে ওঠার পর পাঁচিল আর তেমন উঁচু নয়। লাফিয়ে পড়ি, গলিতে লোকজন কম। তবু কেউ হেসে ওঠে, দ্যাখ দ্যাখ! কোন কথায় কান না দিয়ে সোজা দ্রুত পায়ে হাঁটি। বড়রাস্তায় উঠে ডানদিকের আশ্রমের লোহার গেট চোখে পড়ে-- অন্ধকার মতন।

একটু এগিয়ে গিয়ে খেয়াল করি—হ্যাঁ, সবুজ আলোয়ান মুড়ি দিয়ে প্রেমাংশু আসছে, কিন্তু মানস কোথায়? প্রেমাংশু কাছে এসে বলে পেছনে আসছে।

মালঞ্চ সিনেমায় গিয়ে ৪০ পয়সার কারেন্ট টিকিটের লাইনে দাঁড়াই, আমরা দু’জন। মনের মধ্যে একটা অসোয়াস্তি, মানস কোথায়? ও কি পাঁচিল টপকাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল? প্রায় কাউন্টারের কাছে পৌঁছে গেছি তখন ওই অসোয়াস্তি বেড়ে গিয়ে মাথার ভেতর বিপদসংকেত বেজে উঠল। আমি লাইন থেকে বেরিয়ে এলাম।

প্রেমাংশু অবাক, কী হল? পকেটে পয়সা নেই?

--শোন, এক্ষুণি এখান থেকে চল। আমাদের কেটে পড়তে হবে।

--সেকী, কেন?

--উই হ্যাভ বীন কমপ্রোমাইজড।একটু পরেই আশ্রমের স্টাফ এসে এখানে আমাদের হাতে নাতে ধরে ফেলবে। মানস আমাদের প্ল্যান করে ফাঁসিয়েছে। শালা রেনেগেড, ওকে বিশ্বাস করাই ভুল হয়েছিল।

আমার মধ্যে কি গুরুর আত্মা প্রবেশ করেছে? এত ইংরেজি ঝাড়ছি কেন?

--কোথাও ভুল করছ পোদোদা। ও এরকম ছেলে নয়।

--আমি কোন চান্স নেব না। শীগগির ফিরে চল।

--কোথায়? আশ্রমে? তোমার কথা সত্যি হলে তো ওরা ক্যাচ লোফার জন্যে রেডি তৈরি হয়েই আছে।

--না, আমাদের মাইন্ড গেমে জিততে হবে। আমরা যাব যেখানে ওরা আমাদের লীস্ট এক্সপেক্ট করবে—ঠিক আশ্রমের নাকের ডগায় রূপালী হলে।

--এঃ, ওখানে বাংলা বই চলছে—‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’, বিশ্বজিৎ-আজরা-কিশোর কুমার। ওই ন্যাকা সিনেমা দেখবে?

--ধেত্তেরি! এখন আমাদের শিরে সংক্রান্তি! না তাগা বাঁধবে কোথায়? শোন, আমরা এখন আশ্রমের গেটের উল্টোদিকে গিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে পড়ে আরামসে সিনেমাটা দেখতে দেখতে পরের স্টেপ ভাবব।

হলের মধ্যে অন্ধকারের রূপালি পর্দার গল্পের মায়ায় খানিকক্ষণ বিপদসংকেত বাজে না। হেমন্তের গলায় ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়’ আর কিশোরকুমারের পিয়ানো বাজিয়ে ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’ মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে গেল।

ইন্টারভ্যালে প্রেমাংশু ধোঁয়া খেতে বাইরে যেতে চায়, আমি বাধা দিই। বলি, এতক্ষণে ওরা হয়ত এটা আন্দাজ করেছে যে আমরা এই সিনেমা হলেও থাকতে পারি।

সিনেমা শেষ। এবার হল থেকে বেরোনোর পালা, ভিড়ের ঠেলাঠেলি। আমি ভাবি-- তাড়াহুড়ো করে গোড়ায় বেরোলে বিপদ। মেন গেটের সামনে নিঘ্‌ঘাৎ ক্লোজ ফিল্ডিং সাজানো রয়েছে। একদম শেষে হাতে গোণা ক’জনের সঙ্গে হলে ধরাপড়ার সম্ভাবনা আরও বেশি।

আমাদের আলোয়ানের রঙ তো কেউ চিনে রাখে নি। কাজেই বেরোলাম মাঝামাঝি সময়ে, যখন ওয়াচ করতে করতে ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। প্রেমাংশুকে বললাম—জাস্ট আমাকে ফলো কর।

আমি জানি, আমার ভেতরে এখন গুরু অমিয়দার আত্মা বিরাজমান। জয় গুরু!

বাইরে বেরোতেই চোখে পড়ল উলটো ফুটপাথে আশ্রমের মেনগেটে সারিবন্দী কালো কালো ছায়া। সেরেছে, কী করি? জয় গুরু।

আমি এদিকের ফুটপাথ ধরে উলটো মুখে হাঁটতে শুরু করলাম। যা থাকে কপালে! একটু এগোতেই দেখলাম উল্টোদিকে আশ্রমের পাঁচিলের গা-ঘেঁষে একটা মিউনিসিপ্যালিটির ময়লা ফেলার পাকা চৌবাচ্চা মত।

প্রেমাংশুকে ‘আয়’ বলে রাস্তা পেরিয়ে চৌবাচ্চার পাড়ে উঠে ফের পাঁচিল এবং ভেতর দিকে লাফ। তারপর পাঁচিলের গা ঘেঁষে আলো-আঁধারিতে স্কুল বিল্ডিঙয়ের ল্যাবের পেছনে। ভাঙা টেস্টটিউব আর বীকারের কাঁচ মাড়িয়ে মজা পুকুরের পাড় ধরে সোজা আমাদের আবাসিক ভবনের পেছনে কলতলায়।

প্রথম কামরায় থাকেন ক্লাস ইলেভেনের শিবুদা, কারও সাতে-পাঁচে নেই, তবে আমাকে খুব ভালবাসেন। জানলায় টোকা দিতেই খুলে গেল, শিবুদার উদ্বিগ্ন মুখ। ফিসফিসিয়ে বললেন—মানস চুকলি করেছে। খাবার হলে রোল কল হল, গোটা হোস্টেলে শুধু তোমরা দু’জন অ্যাবসেন্ট। ঘরে এসে ছোট মহারাজ সুনীলদা আর ওয়ার্ডেন রণজিৎদা মশারি তুলে চেক করলেন—লেপের ভেতরে কেউ নেই! তোমরা দুজন মানসের তালা খুলে ওয়ার্ডেনের ঘরের দরজায় লাগিয়ে দিয়ে ওকে বেত খাইয়েছিলে! আজ সেটার প্রতিশোধ নিল।

আমি ভাবছি, এখন কী করা উচিত ? বাথরুমের দিকে এগোতেই দোতলার অন্ধকার থেকে একটা টর্চের আলো সোজা আমার মুখের উপর।

--প্রদ্যুম্ন, পালাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। আমি নীচে আসছি।

ওয়ার্ডেন রণজিৎদা! দোতলার কোন ঘরে অন্ধকারে আমাদের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে ছিলেন। কী সর্বনাশ! উনিও কি ওঁর বিছানায় পায়খানার অ্যাসিড ফেলার বদলা নিতে চান?

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)