গল্প - দীপারুণ ভট্টাচার্য
Posted in গল্পঅরুণাভ উঠতে যাচ্ছিল। মন্ত্রী মশাই বললেন, ‘একটু বসে যাও। আজ তোমাকে একটা উপহার দেব’। অরুণাভ ঘাড়ি দেখল রাত একটা বাজে। এই মন্ত্রীর সঙ্গে রহস্যময়ভাবে তার আলাপ হয়েছিল দুই বছর আগে। একদিন রাতে ভদ্রলোক নিজেই ফোন করে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘আমার কাছে অনেক গল্প আছে কিন্তু লেখার মত স্কিল নেই। তোমার লেখার হাত আছে। আমি পত্রিকায় পড়েছি। রাজি থাকলে একটা ডিল করতে চাই’। অনাকাঙ্ক্ষিত এই ফোনটায় অরুণাভ কয়েক মুহূর্ত আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলো! সে একটা বেসরকারি ব্যাঙ্কে চাকরি করে। বছর দুয়েক আগে করোনায় স্ত্রী বিয়োগের পর বয়স্ক মা আর বছর দশের ছেলেকে নিয়ে তার ছোট্ট ও সুন্দর সংসার। কাজের পাশাপাশি অরুণাভ গল্প লিখছে বেশ কয়েক বছর ধরে। প্রথম প্রথম পত্র পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখতে তার ভালো লাগত। লিখতে লিখতে এখন খানিকটা পরিচিতি হয়েছে। অফিসের লোকজন, পুরনো বন্ধুরা, পাড়ার মানুষ প্রশংসা করে। মাঝে মাঝে সাহিত্য সভায় গল্প পাঠ কিংবা আলোচনার জন্যে ডাকও আসে। এখনো পর্যন্ত তার সাহিত্য জীবন এইটুকুই। সত্যি বলতে অরুণাভর এইটুকুতেই খুশি। যে জানে বড় লেখক হতে সে আসেনি। তাই এখনো তার কোন গল্পের বই নেই। পরিচিতরা প্রশ্নটা তুললে অরুণাভ মুচকি হেসে এড়িয়ে যায়। নিজের পয়সায় বই ছাপাতে সে কিছুতেই রাজি নয়! যেদিন কোন প্রকাশক নিজে উদ্যোগ নেবেন, সেদিন বই হবে।
অরুণাভর মনে হল সে অনেকটা সময় চুপ করে আছে। মোবাইলের উল্টোদিকে মন্ত্রী মশাই বারবার বলছেন, ‘হ্যালো, হ্যালো… তুমি কি আমার কথা শুনতে পারছ না?’ মস্তিষ্ক মুহূর্তের মধ্যে কোটি কোটি ভাবনা তৈরি করে দেয়। আমাদের মন তার ক্ষুদ্র অংশ কেবল ধারণ করতে পারে। উপচে পড়া পাত্রের মতো, মনের গা বেঁয়ে প্রতি মুহূর্তে অগণিত ভাবনা গড়িয়ে যাচ্ছে ভাবনার মহা সমুদ্রে। আমরা চেষ্টা করেও তাদের ধরতে পারছি না। এই চেষ্টা ক্রমাগত করতে করতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যারা মনকে আলগা ভাবে ছেড়ে দিতে জানে, তারাই উপভোগ করতে পারে জীবনের আসল আনন্দ। নিজের জীবনে অরুণাভ এটা ভালোই রপ্ত করেছে। তবুও তার মনে হচ্ছে এই ‘ডিল’ নামক বস্তুটি তাকে বিপদে ফেলবে। এমন ভাবনার মধ্যেই মন্ত্রী সাহেব বললেন, ‘ডিলটা শুনে নাও। রাজি হওয়া কিংবা না হওয়া তোমার উপর। তবে বিষয়টা তোমাকে গোপন রাখতে হবে। নইলে কিন্তু তোমার সর্বনাশ হবে, সেটা আগেই বলে রাখছি’। মন্ত্রীর ডাক উপেক্ষা করা কঠিন। পরদিন কথা হল সামনাসামনি। আলোচনা হল একান্তে। এমন ডিলের কথা অরুণাভ স্বপ্নেও ভাবেনি। তাকে গল্প লিখতে হবে মন্ত্রী সাহেবের দেওয়া প্লটের উপর। পছন্দ হলে মন্ত্রী মশাই লেখাটা দাম দিয়ে কিনবেন। তারপর সেগুলো নিজের নামে পত্রিকায় ছাপাবেন কিংবা বই করবেন মন্ত্রী মশাই। ‘এমন বিচিত্র ডিলের প্রয়োজন কি?’, জানতে চেয়েছিল অরুণাভ। মন্ত্রী মশাই হেসে বলেছিলেন, ‘উন্নতি করতে গেলে অনেক রকম লেজুড় লাগে। ও তুমি বুঝবে না!’ বিষয়টা বোঝার জন্যে অরুণাভ যখন তার ভাবনাকে আরও গভীরে নিয়ে যাচ্ছে তখন মন্ত্রী বললেন, ‘তোমাকে আমার জন্যে একটা লেখার স্টাইল তৈরি করতে হবে। তাছাড়া প্লটগুলো আমার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত হবে। কাজেই গল্পগুলো যে আমার লেখা এটা আপাত দৃষ্টিতে লোকে মেনেই নেবে’। এই কাজটাকে একটা খেলা ভেবে রাজি হয়েছিল অরুণাভ। তেমন কোন ঝুঁকি তার চোখে পড়েনি। বরং ধরা পড়ে গেলে তার ফ্রী পাবলিসিটি হতে পারে!
দেখতে দেখতে গত দুই বছরে মন্ত্রীর দেওয়া প্লট নির্ভর প্রায় ছয় ডজন গল্প সে লিখে দিয়েছে। পাশাপাশি অবশ্য নিজের লেখাও সে চালিয়ে গেছে। যাকে বলে মৌলিক রচনা। মন্ত্রী মশাই বলেছিলেন, ‘পাশাপাশি তুমি লিখে গেলে পাঠকদের আর সন্দেহের জায়গাই থাকবে না’। তার প্রথম দিকের গল্প নিয়ে ‘সামান্য জীবনের অসামান্য মুহূর্ত’ নামে একটা ছোটগল্পের বই দিয়ে মন্ত্রী মশাই বাজারে নামলেন। প্রকাশক মাঝারি হলেও বইয়ের বিক্রি দুর্দান্ত। মন্ত্রীকে খুশি করতে দলের অনেকেই বইটা কিনেছেন। লেখার নিরপেক্ষ প্রশংসাও এসেছে। এরপর থেকেই মন্ত্রী মশাই নানান পত্রিকায় লেখা পাঠান। আর কিছুদিন পরপর সেগুলোকেই বাজারে আনেন বই আকারে। কাজেই পাঠক মহলের বিশ্বাস হয়েছে যে, মন্ত্রী মশাই নিয়মিত লেখেন। এখন প্রায় সব বাণিজ্যিক কাগজগুলোই তার কাছে লেখা চায়। দাবী মেটাতে গত পুজো সংখ্যায় একটা উপন্যাস পর্যন্ত অরুণাভকে লিখতে হয়েছে। চাপ এমন যে নিজের লেখার জন্যে এখন তেমন সময় হয় না। অরুণাভ অবশ্য সেনিয়ে বিশেষ চিন্তিত নয়। মাঝে মাঝে সে মৌলিক রচনাও মন্ত্রী মশাইকে দিয়ে আসে। ওগুলোর দাম বেশি। টাকা পয়সার পাশাপাশি মন্ত্রী মশাই নানানভাবে তাকে খুশি করার চেষ্টা করেন। একটা সরকারি চাকরির প্রস্তাব অনেকদিন থেকেই তিনি দিয়ে রেখেছেন। নেহাত অরুণাভ রাজি হচ্ছে না!
‘অনেক রাত হল। কাল সকালে ছেলের স্কুলে পিটিএম আছে’, উঠতে গেল অরুণাভ। মন্ত্রী তাকে টেনে বসিয়ে বললেন, ‘আঃ উপহার আসছে!’ একটু অবাক হয়ে অরুণাভ বলল, ‘কি উপহার?’ মন্ত্রী চোখ নাচিয়ে বললেন, ‘দুই বছর বউ নেই। বিয়ে করবে না। প্রেম করো না। সাহিত্য মনের খিদে মিটতে পারে কিন্তু শরীর বলে তো একটা জিনিস আছে না কি! তোমার জন্যে তাই ফুল আসছে। পুজো দিয়ে যাও। যতদিন তুমি সতেজ থাকবে ততদিন আমার গল্পও তাজা থাকবে’। অরুণাভ ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না’। মন্ত্রী মশাই এবার নিচু গলায় বললেন, ‘এক পুলিশ ইনস্পেক্টর একটু পরেই তার স্ত্রীকে নিয়ে আসবেন। আমি পুলিশের সঙ্গে উপরে বসে ঘণ্টা দুয়েক পান ভোজনে ব্যস্ত থাকবো। ততক্ষণ তুমি মেয়েটার সঙ্গে ঐ ঘরে… আঃ কিছুই যেন বুঝতে পারছ না!’ নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে অরুণাভর। সে কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় মন্ত্রী বললেন, ‘আমি টেস্ট করেছি ভাই। লা-জবাব! টাকা, প্রোমোশন অনেকেই পেতে চায়। কিন্তু সবার ঘরে তো আর এমন বউ থাকে না’! অরুণাভর বাক রুদ্ধ তাকিয়ে আছে দেখে মন্ত্রী তার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, ‘ভয় পেয় না, উপভোগ করো। তোমাকে খুশি না রাখলে, আমার অকল্যাণ হবে’।
ডোর বেল বেজে উঠলো। মন্ত্রী নিজেই উঠলেন দরজা খুলতে। ইচ্ছে করেই আজ কাজের লোকদের ছুটি দিয়েছেন। অরুণাভর বুকের যন্ত্রটা পুরনো ইঞ্জিনের মত শব্দ করছে। উত্তেজনায় সে উঠে দাঁড়াল। আর ঠিক তখনই দেখা গেল আগন্তুক দম্পতির মুখ। বেলুনে ছুঁচের ছোঁয়া লাগলে যা হয়। সেই ভাবেই সোফায় বসে পড়লো অরুণাভ। ইনস্পেক্টরের সঙ্গে যে মহিলা ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন সে তার প্রথম প্রেম, সুপর্ণা। তখনো ব্যাংকের চাকরিটা পায়নি অরুণাভ। সুপর্ণা তাগাদা দিয়ে বলতো, ‘মাস দুয়েক সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে চাকরি না পেলে আমাকে অন্য ব্যবস্থা দেখতে হবে’। ছাড়াছাড়ির পর ওদের আর দেখা হয়নি। লোকে বলে প্রথম প্রেমের সুতো কোথাও না কোথাও থেকে যায় জন্ম-দাগের মত। সুপর্ণার কথা মাঝে মাঝে ভাবতো অরুণাভ। ভাবতো কোনদিন হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে কোথাও। কিন্তু তাই বলে এখানে! এমন পরিস্থিতিতে! মনে হচ্ছে মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে! অরুণাভ এখন নির্ভুল উপলব্ধি করছে তার মনের গা বেঁয়ে গলগল রক্তের মত ভাবনারা বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে কিছুতেই তার মনকে আলগা করতে পারছে না।
স্বাভাবিকভাবে উল্টোদিকের সোফায় বসে পড়ল দম্পতি। সুপর্ণার মুখের ভাবে কোন পরিবর্তন নেই। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, তার স্নায়ু যথেষ্ট কঠিন। এতদিনে নিশ্চয়ই তারও এক বা একাধিক সন্তান হয়েছে। হয়তো ডিনার শেষে ছেলে-মেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে তবে মা-বাবা নেমেছেন এই নিশাচর পেশায়। মন্ত্রী মশাই সবে পরিচয় করাতে যাবেন এমন মুহূর্তে অরুণাভ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার মাথায় একটা মৌলিক গল্প তৈরি হচ্ছে স্যার। সেটাকে লেখার জন্যে আমাকে এখুনি বাড়ি যেতে হবে। আপনার উপহার আমার মনে থাকবে’। খালি রাস্তা দিয়ে বেশ জোরেই বাইকটা চলছে সাইলেন্সারের ধোঁয়া ছড়িয়ে। অরুণাভর যেন দেখতে পাচ্ছে মস্তিষ্ক থেকে উপচে পড়া ভাবনারা তার শরীর আর বাইক ভিজিয়ে বয়ে যাচ্ছে কালো রাস্তার উপর দিয়ে। এখন তার কোন কষ্ট হচ্ছে না। কেননা ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার আগেই সে নিজের মনকে আলগা করে দিয়েছে।