সম্পাদকীয়
Posted in সম্পাদকীয়বসন্তের দখিনা বাতাস গায়ে মেখে প্রবল হর্ষধ্বনি আর প্রতিশ্রুতির আবহে শেষ হলো ৪৬তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। একথা আমরা জানি, অনেক কারণেই এই আয়োজন অনন্য। এই মেলা একান্তভাবেই এই শহরের তথা বঙ্গ-জীবনের অচ্ছেদ্য অঙ্গ। যেমন দুর্গাপুজো। বিশ্বের অন্যত্র বইমেলার চারিত্রিকতা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই তালিকার ওপরে যে দুটি নাম, সেই ফ্রাঙ্কফুর্ট আর লন্ডন শহরের মানুষের চেতনায় সেই তরঙ্গ এমন বিপুলভাবে জেগে ওঠে না, যা ঘটে এখানকার বাঙালি মননে। এর প্রধান কারণ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র এ জাতীয় মেলা মানেই হয় সত্বের কেনাবেচা অথবা বড় মাপের বাণিজ্যস্থল।
কলকাতা বইমেলা এক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম ব্যতিক্রম। সুদূর কৃষ্ণনগর থেকে কাঁধে ঝোলা নিয়ে মেলায় এসেছেন একটি তরুণ টিউশনির টাকা দিয়ে জীবনানন্দের ' শেষ খাতা ' সংগ্রহ করবেন বলে, এ দৃশ্য জগতের আর কোনও গ্রন্থমেলায় দেখা যায় না। আমাদের তাই দায়িত্ব ছিল এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে বই ভালোবাসার এই সংস্কৃতিকে জাগর রাখার। দায়িত্ব ছিল আমাদের ভাষাগুলির দৈনন্দিন অবক্ষয়ের পটভূমিতে বাংলাভাষার অবিনশ্বর আয়ু সুনিশ্চিত করতে বইমেলাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার।
কিন্তু কোথায় যেন একটা বদল হয়ে গেছে। ব্যবসার নিরিখে এ মেলার শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে। আশার কথা। কিন্তু মানুষের আনাগোনার ছবিটি কি সর্বদা সত্যি কথা বলছে? বইমেলার কদিন এই প্রাঙ্গণটি বিবিধ মনোরঞ্জন আর সপ্তাহান্তে পারিবারিক মিলনমেলা এবং পিকনিকের জায়গা হয়ে ওঠেনি তো? একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি। সুস্থ সংস্কৃতি মনোরঞ্জনের ক্ষেত্র রচনা করতে পারে অবশ্যই, কিন্তু এর উল্টোটা?
প্রশ্নটা তাই ভারসাম্যের। যার বড় অভাব আমাদের জীবনে। ইউনেস্কোর বিশেষ স্বীকৃতি না পেলেও দুর্গাপুজোর কিছু এসে যেত না। কিন্তু বোধনের অনেক আগে বোধন ঘটিয়ে যেমন পাল্টে দেওয়া হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত এক সামাজিক উৎসবের চরিত্র, বইয়ের পাশাপাশি মনোরঞ্জন ও উদরপূর্তির বিশাল বন্দোবস্ত বইমেলায় টেনে আনছে তাঁদেরও, বই নামক এই সামগ্রীটির সঙ্গে যাঁদের সুদূরতম সম্পর্কও নেই। আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষাপটে অস্বস্তিকর এই প্রসঙ্গগুলির অবতারণা জরুরি মনে হলো।
সুস্থ থাকুন, সৃজনে থাকুন
শুভেচ্ছা নিরন্তর