Next
Previous
0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in




















(১)

বারবার ফোনটা বেজে উঠছে। কাজের সময় এমনটা হলে কার না বিরক্তি লাগে? ফোনটা আবার সবার সামনে বের করলে লোকের ধারণা পাল্টে যাবে নিমেষেই। এমন ফোন তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একেবারে বেমামান। একটু ইতস্ততঃ করছে দুলাল। হঠাৎ মেজাজ হারাল, "এই-ই বুঝতে পারছিস না? একটু আড়ালের দিকে চ…"

চুটকি ঝুঁকে গেল বাবার কাছে, গলা নামিয়ে বলল, "কী হয়েছে এমন করছ কেন?"

দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, "শুনতে পাচ্ছিস না? ফোনটা বার বার বাজছে? দাঁড়িয়ে গেলি কেন? ঐ দিকটায় নিয়ে চ শিগগির।"

চায়ের দোকানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল দুলাল। চুটকি একটু মনক্ষুণ্ণ হল বটে। তবুও হুইলচেয়ার ঠেলে ঠেলে নিয়ে চলল রাস্তার ওপারে। দোকানগুলোর পিছনে দিকে।

এদিকটা একটু সরু গলি। লোকজন তেমন নেই। দু-একজন পথচারী ছাড়া আর কাউকেই চোখে পড়ছে না। দুলাল তাড়াতাড়ি করে ফোনটা বের করে নিল পকেট থেকে। পাঁচটা মিসড কল! বাড়ি থেকে এতবার ফোন কেন এ সময়ে? উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল মিলন, "হ্যাঁ রে, তোর মা এতবার ফোন করল কেন বলত? কিছু আবার হয়েছে নাকি?"

"আচ্ছা তো, আমি কী করে বলব? তুমি তাড়াতাড়ি ফোনটা করো না।"

ডায়াল করে স্মার্টফোনটা কানে চেপে ধরে আছে দুলাল। ব্যস্ত দেখাচ্ছে। টেনশন হচ্ছে দুলালের, "ব্যস্ত বলছে রে, কাউকে ফোন করছে বোধহয়। নিশ্চিত বাড়িতে কিছু একটা হয়েছে, বুঝলি?"

"আরে বাবা, কথা না বলে আরো একবার করো না…"

আবার ফোন করছে দুলাল। রিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওপর থেকে কানে এল, "শিগগির বাড়িতে আয় খোকা।"

দুলালের খটকা লাগে, "রেবতীর ফোনে মা কথা বলছে, তাহলে সে কোথায়? রেবতীর কি কিছু হল নাকি?"

"দেরি করিস নি বাবা।"

মন যেন অন্য কথা বলছে দুলালের। "রেবতীর কথা কি মাকে একবার জিগ্যেস করব?" নাহ, প্রশ্ন মাকে করতে গিয়ে আটকে গেল সে। কিন্তু বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে দুলালকে। রেগেও যাচ্ছে। বিরক্তি আর ধরে রাখতে পারল না।
"কেন কী হয়েছে কী? সবেমাত্র বোহনি হয়েছে। এক্ষুনি ফিরে গেলে হল? তার চেয়ে বলো না, কি হয়েছে?"

দুলাল একেবারেই রাজি নয়, এক্ষুনি ফিরতে। বোহনিটা আজ অন্যরকম। কড়কড়ে দশ টাকা দিয়ে। পাওয়ামাত্রই মনে মনে উপর-ওয়ালার উদ্দেশ্যে প্রণাম করল সে, "হে ঠাকুর, আজ কার মুখ দেখে যে বেরিয়েছি, দিনটা ভালোই যাবে মনে হচ্ছে।"

চুটকিরও চোখটা নেচে উঠেছিল সঙ্গে সঙ্গে। বাবার সঙ্গে প্রায় আসে সে। কোনো কোনোদিন তারা আবার দু'বোন একসঙ্গে। হুইলচেয়ারে বাবাকে বসিয়ে ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসে। দুলাল হাত দুটো কোনো রকমে নাড়াচাড়া করতে পারে। কিন্তু পা দুটো একেবারেই অকেজো। কোনোদিনই দাঁড়াতে পারেনি সে। কেউ কেউ জোর করে দাঁড় করিয়ে দিল সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ে। ভার বহনে একদম অপারগ। জন্মের বছর দুয়েক পর থেকেই তার এই অবস্থা। ফোনটা কেটে দিলেও একটা উত্তর সে কিন্তু পেল না।
"কিন্তু হঠাৎ এখন ফোন করছে কেন? এই তো কিছুক্ষণ আগে বাড়ি থেকে এলাম!"

আজ সে বছর চল্লিশের। দুই মেয়ের বাপ। অবাক হচ্ছেন তো? খোঁড়ার আবার বিয়ে হল কীভাবে? হবে না কেন? এমন সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় তো ঐ গরিবীপনা। অসহায়, নিঃসম্বল, হাড় হাভাতের মেয়েরা তো আছেই। তাদেরও তো বর দরকার নাকি? দুলালদের মতো যারা, তারা অকৃতদার থাকবে কেন? খোঁজ খবর, যোগাযোগ সবই হয়ে যায় একদিন। কেউ আর পড়ে থাকে না। নহবতের সুর বেজে ওঠে দিন ক্ষণ দেখে। সেই সূত্র ধরে নববধূর সাজে রেবতী এসে ছিল দুলালদের দর্মার ঘরে। গ্রাম ছেড়ে শহরে। বস্তিতে।

প্রথম দিন খুব কেঁদেছিল রেবতী। মনে হয়েছিল সুযোগ পেলেই ওপাশের বড়ো ঝিলে ঝাঁপ দেবে। কিংবা পালিয়ে যাবে, যেদিকে পারে। কিন্তু পেরে ওঠেনি। একদিকে বাপের সম্মান আর অন্যদিকে দুলাল।

বিয়ের সবেমাত্র দুদিন। রাতে ফাঁকা পেয়ে রেবতীকে বলেছিল দুলাল, "চাইলে তুই ফিরে যেতে পারিস। আমার জন্যে তোর জীবনটা নষ্ট হোক, সেটা আমি চাই না। বলতে পারিস, তবে বিয়েতে রাজি হলাম কেন? বিশ্বাস কর, এতে আমার কোনো হাত নেই। মাই-ই সব করেছে। মরণ দিব্যি দিয়েছে আমাকে, রাজি না হলে একদিন গলায় দড়ি…

এটুকু বলতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছে সে, নিজের পঙ্গুত্ব তাকে যেন পিষে পিষে মারছে। ধিক্কার দিচ্ছে ভেতরে ভেতরে। তবুও বলল, "আবেগের বসে, লোকের ভয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করিস না রেবতী।কত মানুষের তো অভাবে অভাবে দিন কাটে, তাই বলে তারাও কি এমন একটা অক্ষম, পঙ্গু, অসহায় মানুষের সঙ্গে তাদের মেয়ের বিয়ে দেবে? আমি কিন্তু এটা মেনে নিতে পারি নি। এক পয়সা রোজগার করার মুরোদ নেই আমার। খাওয়াব কি তোকে? ওরা আজ খাওয়াবে, কাল খাওয়াবে, কিন্তু পরশু খোঁটা দেবে। তাই বলছি, আজ রাতেই তুই পালা। কেউ দেখতে পাবে না। যা…"

খোটকা লাগে রেবতীর। কিন্তু পালায়নি।পড়ে ছিল সেখানে। নিজের ভাগ্যকে ছেড়ে দিয়েছিল অদৃষ্টের হাতে। কিন্তু পুরোপুরি মেনে নিতে পারেনি দুলালকে। তবে একটু একটু করে মায়া পড়ে গিয়েছিল তার প্রতি। অসহায়, উপার্জনহীন মানুষটার জন্য সংসারের কিছু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল, মাস খানেক না যেতে যেতেই।

বাবুর বাড়ির কাজ। বস্তির লোকজন নতুন বউকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। আসতে পারল না, লোকের বাড়ি কাজে ঢুকে গেল ! এতে তারা অবাক হলেও সাধুবাদ দিয়েছিল মনে মনে। বাইপাশের কাছেই ছিল তাদের চায়ের দোকান। শাশুড়ি একাই চালায় সেটা। অন্য ভাইয়েরা ইনকাম করে কম বেশি। একমাত্র দুলাল ছাড়া। তাই তার যেমন মূল্যও ছিল না, তেমনি ছিল না কোনো কদর। ফাঁকা বাড়িতে একাই পড়ে থাকত দুলাল। তার নিত্য দিনের সঙ্গী ঐ হুইলচেয়ার। দুপুর গড়িয়ে গেলেই তার মা ফিরত ঘর। এসে তাকে স্নান করাতো, খেতে দিত। কোনো কোনোদিন তেষ্টায় তার ছাতি ফেটে যেত। কোনোদিন আবার আছাড় খেয়ে পড়ে থাকত মেঝে। কোনোদিন আবার বাইরে গাছ তলায় রেখে যেত তার মা। পড়ে থাকত সেখানেই।

এসব ইতিহাস শুনে শুনে মন বদলে যায় রেবতীর। বাপের বাড়ি ফিরে গিয়ে সেইই তো আধপেটা, অনাহারে দিন কাটানো। সেইই তো বাপ-মায়ের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকা। আর লোকের নিন্দে শুনে কান ভারি হওয়া। তার চেয়ে 'নেই মামার থেকে কানা মামাই ভালো'। এখানে কাজের অভাব নেই। লোকের বাড়ি কাজ করলে দুটো পয়সা আসবে হাতে। সংসারে দুটো টাকা দিলে দুলালকে হয়তো একটু ভালো চোখে দেখবে সকলে।

কিন্তু দুলাল ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি। পাঁচটা লোকের কথা তাকে জর্জরিত করত দিনরাত। পাশের বাড়ির টিঙ্কুর মা'র একদিন ঢেস মেরে শোনাচ্ছিল, কানে আসছিল তার, "কুঁজোর আবার চিৎ হয়ে শোবার ইচ্ছা, ঝাঁটা মারি ওমন ইচ্ছেয়। ইনকাম করার মুরোদ নেই, তার আবার বে'র সাধ। থু…"

সেদিন রাতেই রেবতীকে শোনায় দুলাল, "আমাকে এক জায়গায় দিয়ে আসতে পারবি কাল?"
রেবতী অবাক হয়ে যায়। মনে মনে নানান প্রশ্ন পাক খেতে থাকে। কোনটা ছেড়ে কোনটা সে জিগ্যেস করবে?

"কিরে, চুপ করে রইলি যে? হ্যাঁ কি না বল?"

হঠাৎ বিরক্ত হয়ে গেল রেবতী, "কী হয়েছে টা কী? ঘুমতে দেবে একটু? কটা বাজে শুনি? সকাল সকাল না উঠলে কাজে যাব কী করে? সময় মতন গেলে তারা তো আর আমার মুখ দেখে পয়সা দেবে না।"

আর কিছু বলতে সাহস হল না দুলালের। চুপচাপ শুয়ে পড়ে।

সকালবেলায় রেবতী কাজ থেকে ফিরে আসে। দেখে দুলাল নেই। কাকেই জিগ্যেস করবে সে? বাড়িতে কেউ থাকলে তো জানবে। কেউই ছিল না ঘরে তখন। রেবতী দৌড়ে যায় দোকানে। শুনেই থপ করে বসে পড়ে বেঞ্চে। নানান কথা উঠে আসতে শুরু করল।

"আগে কোথাও গেছে কিনা সেটা ভালো করে খোঁজ নিন।"

"কেউ আবার সঙ্গে করে নিয়ে গেল কিনা, জেনে দেখুন।"

"মাসিমা, থানায় খবর দিন এখনই। খোঁড়া মানুষ যাবেই বা কোথায়?"

"আরে বাবা উবে যাবে না তো?"

"ঘরের পিছনেই তো খাল। সেখানে গড়িয়ে পড়ল কিনা? ভালো করে দেখেছন কি?"

দূর থেকে রিন্টু চেঁচাতে চেঁচাতে আসছে।
"ও পিসি, পিসি, ও… পিসি?" আগের মতোই থ ভেতরের হয়ে বসে রইল দুলালের মা। রেবতী তড়িঘড়ি বেরিয়ে এল বাইরে। তাকে দেখেই রিন্টু আরো জোরে চেঁচাচ্ছে, "বৌদি দাদা কোথায় গেল গো?" কোনো উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে আবার বলে ফেলল, "সেন্টুকে দেখলাম সঙ্গে। ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।"
তার দিকে এগিয়ে এলে রেবতী। বিচলিত হয়ে পড়েছে সে।
"কোথায় দেখলে?"

"ঐ তো সন্তোষপুরের দিকে।"

চমকে ওঠে সবাই। রেবতী দৌড় দেয় সেই দিকে।


(২)

মাথার উপর রোদ গনগন করছে। রেবতী ঘেমে নেয়ে বাড়ি ফেরে। তার শাশুড়ি দোকান বন্ধ করে ফিরে এসেছিল ঘরে। রান্নাবান্নায় মোটেও মন নেই তার। ছেলেটার জন্য মনটা বারবার কেঁদে কেঁদে উঠছে। থেকে থেকে পথের দিকে তাকাচ্ছে। রেবতীকে দেখতে পাওয়া মাত্রই দৌড়ে যায় রান্না ফেলে।

"কিরে সে কোথায়? কোথায় গিয়েছিল? কাউকে বলে যায়নি কেন? সেন্টু কি তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসছে? কাউকে একটু বলে গেলে ওর কী ক্ষতিটা হত বলত?"
অনর্গল প্রশ্ন করে চলেছে তার শাশুড়ি। রেবতী যেন জব্দ হয়ে পড়েছে। পা যেন চলছে না তার। গলায় শুকিয়ে এসেছে।
গামলা থেকে ক্রোশ ক্রোশ জল তুলে নিয়ে চোখে-মুখে দিল।
"কিরে কোনো উত্তর দিচ্ছিস না যে? বলি ও রেবো?"

শুধু কয়েকবার মাথা নাড়ল রেবতী। তারপর ঘরে গিয়ে হেলান মেঝেই বসে পড়ল। হতাশার সঙ্গে বলে চলল, "অনেক অনেক খুজেছি। কোথাও দেখতে পেলাম না মা।"

কেমন যেন সন্দেহ হল তার শাশুড়ির। "এপাড়া ওপাড়া ক্লাব সব জায়গায় খুঁজে এসেছি। কোথাও নেই। এমনকি পিছন দিকটাও দেখেছি। কই কোথাও কোনো চিহ্ন পেলাম না তার। হয়তো আমাদের কেউ ওকে গেছে কোথাও। তবুও মনটাকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না। ছেলেটা গেল আর এখানকার কারোর নগরে পড়ল না?"

"কিন্তু মা রিন্টু ঠাকুরপো যে নিজের চোখে…"

"তুই যাই বল বাপু, ও কাকে দেখতে কাকে দেখেছে কে জানে? এমনিতেই ও সাইকেল চড়ে আসছিল। রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া কম নাকি? তারপর এতটা রাস্তা গেল আর কেউ দেখল না?

"কিন্তু মা রিন্টুই বা মিথ্যে বলবে কেন? নাকি ও তোমার ছেলেকে চেনে না?"


"আমার মনটা খুব কু-গাইছে ছেলেটার কিছু হয়ে গেলে আমি কাকে মুখ দেখাব বল দেখি? দোকানেই সব বলছিল চব্বিশ ঘণ্টা না কাটলে থানা কিছু করবে না। কি যে করি?"

"ভাইদের সব খবর পাঠিয়েছ? ওরা আসুক তারপর নয়…"

সন্ধে সন্ধে ভাব। এমন সময় ক্যাঁচ কোচ আওয়াজ কানে আসতেই রেবতীরা বাইরে বেরিয়ে আসে। মিলনকে দেখে প্রাণ যেন ধড়ে আসে তাদের। রাগে, অভিমানে ফেটে পড়ছে একে একে।
"হ্যাঁ রে, সেন্টু তোর একি আক্কেল বল দেখি? একবার বলে নিয়ে যাবি।"

"কোথায় গিয়েছিলে সব? আমি খুঁজে খুঁজে নাজেহাল।"

"সেন্টু নয় বাইরের ছেলে, তুই তো আমাকে একবার বলে যাবি নাকি? আমাদের চিন্তা হয় না বুঝি? কোথায় ছিলি এতক্ষণ?"

কোনো উত্তর নেই কারোর মুখে। দুলাল এগিয়ে গেল ঘরের সামনে। জল ভর্তি বালতির ঢাকনার মুঠো মুঠো কয়েন বের করে রাখছে পকেট থেকে। সবার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। কয়েনের সঙ্গে দশের, পাঁচের নোটও বেশ কয়েকটা। সবারই মনে একই প্রশ্ন পাক খেতে লাগল, "এসব সে পেল কোথা থেকে?"

তাদের অবস্থা দেখেই সেন্টু বলে ফেলল, "সাউথ সিটি মলের ওখানে নিয়ে গিয়েছিলাম দাদাকে। দেখলে তো…"

কেঁদে ফেলল রেবতী। দুঃখে ভেতরটা হাহাকার করে উঠল তার, "হাত পাতলে লোকের কাছে? শেষে কিনা ভিক্ষে করে আনলে?"
ক্ষোভে রাগে মুঠো করে করে কয়েনগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল রেবতী। সেন্টু গিয়ে আটকানোর চেষ্টা করছে। দুলাল আর চুপ করে থাকতে পারল না, "ফেলতে দে সেন্টু, ফেলতে দে… ওরা তো চায় ওদের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকি। ওদের লাথি ঝাঁটা খাই দুবেলা।"

"কী বললে তুমি? লাথি ঝাঁটা? যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর! এতদিনে এই চিনলে আমাকে?"

রাগ অভিমান কতকিছুই ঘটেছিল তারপর। আলাদা হয়ে গিয়েছিল ভায়েরা সব। তবে তার মা মিশে যায় নি ভাইদের সঙ্গে। ভায়েদের উপার্জন আছে। তাদের নাকি আলাদা একটা সম্মান আছে। তাই তারা কেউই সম্পর্ক রাখতে চায় না তার সঙ্গে।

কিন্তু দুলালের সংসার থমকে যায় নি। সেই যে একবার কাঁচা টাকার মুখ দেখছিল আজও তাই করে চলেছে। রেবতীর উপার্জনে হাত দেয় না সে। দুলালের ইনকাম কম নয়। হোক না সে করুণার দান। তাতেই তার ঠাট-বাট অন্যের চোখে জ্বালা ধরানোর মতো।

রোজই বের হয়। সঙ্গে কোনোদিন ছোটো মেয়ে, নয়তো বড়োটা। বাড়ির চেহারা পাল্টে যায় দুলালের। দর্মার বেড়া নেই আর, এখন পাকা ঘর। চায়ের দোকান নিয়ে নিয়েছে ভায়েরা।

এতদিনে রেবতীর উপার্জনে যা হয়ে উঠেনি, দুলাল তাইই করে চলেছে। পকেট ভর্তি তেরঙ্গা, যখন তখন খায় আর প্যাচ প্যাচ করে ফেলে। আজ সাউথ সিটি মল তো কাল লেক মার্কেট। তো পরশু দিন অন্যত্র। স্থান পাল্টে যেত দিনে দিনে।

মেয়েরা কেউ সঙ্গে থাকলে তার দিন ভালো যায়। লোকের চোখ বদলে যায় তাদের দেখে। হুইলচেয়ারে নির্জীবের মতো বসে থাকে দুলাল। তার করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে এমনিতেই লোকের সহানুভূতি জেগে ওঠে। আরো বিগলিত হয় তার মেয়েকে দেখে। পরনে ছেঁড়া, ময়লা ফ্রক। উস্কোখুস্কো চুল। করুণ আর্তি হৃদয় ছুঁয়ে যায় তাদের, "দুটো পয়সা দাও না গো, ভাত খাব। ওষুধ কিনব। পয়সা দাও না গো দুটো…"

হ্যাঁ, পয়সা শুধু নয়, কেউ কেউ খাবার কিনে দিত। কিন্তু তাদের চোখ ভরত টাকাতে। মেয়েরাও কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু বাড়িতে এলে ভোল বদলে যেত তাদের। পাল্টে যেত পোষাকের ধরন।

মেয়েদের স্কুলে সে ভর্তি করেছিল কেবলমাত্র রেবতীর জ্বালায়। নামেই ভর্তি। সব সময় তাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ত নিজের ধান্দায়। রেবতী তা টের পেত। ঝগড়া করত এ নিয়ে। কিন্তু পেরে উঠত না রেবতী। পয়সার আকর্ষণ অকেজো করে দিয়ে ছিল পড়াশোনার আশক্তিকে। জোর করেই কতদিনই বা চলে লেখা- পড়ার পাঠ? পরিবারের ভূমিকা অনেক অনেক বেশি। সেই বেশির খামতি ছিল এখানে। রেবতীর ভয়ে বসত নামেই। তারপর কাজে চলে গেলেই,
চাষি গেল ঘর
তো, নাঙল তুলে ধর।

লেখাপড়ার পাঠ তুলে দেয় একদিন। তারাও এখন পেশাদার হয়ে উঠেছে দুলালের সঙ্গে।


(৩)

গতকাল সন্ধের সময় মুদিখানা দোকানে বাজার করছিল দুলাল। সঙ্গে বড়ো মেয়ে। বাজার দিতে দিতে দুলালকেই শোনাচ্ছিল, "এ মাসে অনেক বাকি পড়ে গেল রে দুলাল। টাকাটা কিন্তু একেবারেই দিস। আমার দরকার আছে। আমার আবার মহাজনকে মেটাতে হবে। বুঝলি?"

একটু চুপসে গেল দুলাল। কি বলবে ভাবছে। এমন সময় ফোনটা বেজে ওঠে পুচকির। বের করতেই চমকে যায় দোকানদার। "কার ফোন রে পুচকি? বেশ দামি মনে হচ্ছে।"

দামি কথাটা পুচকিকে যেন একটু সম্মানিত করে দিল। পুলকিত হয়ে বলে ফেলে সে, "আমার গো দাদু, ভালো হয় নি বলো? চোদ্দ হাজার নিয়েছে।"

শুনেই চমকে ওঠে দোকানদার, বলিস কি, এত দামে ফোন কিনেছিস?"

দোকানদারের কাছে কেমন যেন খেলো হয়ে গেল দুলাল। ম্যানেজ দেওয়ার চেষ্টা করল, "আসলে কাকা মেয়েটা বায়না করছিল ক'দিন ধরে। ওখানেই তো চোদ্দ হাজার চলে গেল। দিনটা পনেরো সময় দাও। একেবারে দিয়ে দেব।"

এতদিনের শোনা কথাগুলো মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতে চাইল দোকানদার। সেগুলো যেন সত্যি হতে লাগল, বাড়িতে দামি এলইডি টিভি। ইএমআই দেয় মাসে মাসে। লোকের কাছে আবার নাকি টাকা সুদে খাটায়। কদিন আগে রেবতী ও তার মাকে ঘুরতে নাকি পাঠিয়েছিল, পুরীতে।
"হ্যাঁ রে, দুলাল এত টাকা কোথা পাস রে?"

মুচকি মুচকি হাসে দুলাল, "ওই তোমার বউমার কাজের টাকায়… চলে যায় আরকি।"

"কিন্তু বউমা তো কটা বাড়ি কাজ করে মাত্র। তোর মার তো এখন চা-দোকান নেই। তাহলে?"

"বাকি করে দিলাম। মাসে মাসে দেব।"
কিন্তু আসল কথাটা বলতে গিয়ে আটকে গেল দুলাল। লোকের কাছে কোন মুখে বলবে যে, লোকের কাছে হাত পেতে উপার্জন করে সে। দৈন্যের দিনে কেউ পাশে দাঁড়ায় নি তার। অথচ নিন্দে করে বেরিয়েছে লোকের কাছে। অথচ আজ তার দিন ফিরেছে লোকের করুণায়। সে যে যেমন ভাবেই নেক, তার তাতে কিছু যায় আসে না।

পুচকি ফোনটা কেটে ফিরে এলে। বাজারের ব্যাগটা হাতে ধরে নিয়ে বলল,
"বাবা, চলো। হয়ে গেছে।"

সেই পুচকিই আজ সকাল সকাল বেরিয়েছে। রিন্টুর ঠাকমার সঙ্গে, হুইলচেয়ার আনতে গেছে কোন এক সরকারি অফিসে। পাড়ার কাউন্সিলরই সুপারিশ করেছে। ঠিকানা রিন্টুর ঠাম্মার জানা। দুলাল দুপুরে আসার সময়ও খোঁজ নিয়ে দেখেছে, তখনও ফেরেনি পুচকি। রাস্তায় আসার সময় কয়েকবার ফোনও করেছিল, বার বার সুইচ অফ বলছে। ইদানিং রাতে চুপি চুপি ফোন করে কাকে! ভাবগতিক তার ভালো লাগত না দুলালের।
"তবে কী? না না, কি যা তা ভাবছি আমি? ফোনের চার্চ নেই হয়তো! কিন্তু রেবতীর ফোনে মা কথা বলছে কেন?"

কেমন যেন বিচলিত দেখাচ্ছে তাকে। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল দুলাল, "চুটকি বাড়ি চ। নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে বুঝলি। তোর মা ফোনে ঠাম্মা কথা বলছে, পুচকির ফোন অফ। ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে লাগছে। বুঝলি। বাড়ি চ…"

"কিন্তু বাবা?"

"নারে, মনটা কু গাইছে। চ…"

হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে নিল চুটকি।

এ বছরই সে তেরো পার করেছে পুচকি। শরীরের তেমন বাড় না হলেও, মুখশ্রী নজর টানার মতো। লোকের নজর পড়ত তার উপরে। সেই জন্য ইদানিং তাকে আর আনতে চাইনি দুলাল। ঝিম মেরে পড়ে থাকলেও কি হবে, নজর এড়াত না দুলালের। মনে প্রশ্নের ঝড় উঠছে দুলালের, "তবে তাকে কি কেউ? নাকি সে কারোর সঙ্গে? এ বয়সে তার পক্ষে এসব সম্ভব? নাকি রেবতীর কিছু হয়েছে?"

তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে তার। চুটকির উদ্দেশ্যে বলে উঠল, "ওরে একটু জোরে জোরে ঠেল। তাড়াতাড়ি যেতে হবে যে। এমন করলে পৌছাব কখন?"

এমনিতেই গরম। চুটকি ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে তাই। ছোট্ট শরীরে কতই বার জোর তার? হাঁপিয়ে উঠেছে, "ঠে-ঠেলেছি তো।"

"ঠেল মা ঠেল, ওদিকে আবার মেঘ করেছে। কখন কি হয় কে জানে?"

রোদ্দুর মিলিয়ে গেল হঠাৎ। কৃষ্ণচূড়ার রং শ্যামল মেঘের আভায় বেশ টকটক করছে। কেমন যেন থমথমে হয়ে আছে সব। পাকা রাস্তার গাড়িগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে হুস-হাশ করে। ঝড় শুরু হঠাৎ। দমকা হওয়ায় প্লাষ্টিক, ধুলোবালি, শুকনো পাতা পাক খেতে লাগল ঘূর্ণির মতো। চুটকির সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে। দমকা হাওয়া ঠেলে তাদের। গাছপালার মাথা দোলাচ্ছে পাগলের মতো। মট মট করে ডাল ভেঙে পড়ছে। ভয়ে দুলালের বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। শক্ত করে ধরে আছে হাতল।
"ঐ- ঐ দিকে নিয়ে চ চুটকি। ঐ-ঐ পাশটায়।"
চুটকির জোরে জোরে চেঁচাচ্ছে, "আ-আমি পারছি না। ঠে-ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বাবা।"

আরো একটা জোরালো ঝটকা। হুইলচেয়ার সমেত দুলাল ছিটকে গেল দূরে। সামলাতে পারল না চুটকি। আছাড় খেয়ে পড়ল দূরে। "বা-বাবা…"
পিছন থেকে একটা গাড়ি চলে এল হুশ করে। পিষে দিয়ে গেল চুটকিকে।

দূরে পড়ে চেঁচিয়ে উঠল দুলাল, "চুটকি…"

বৃষ্টি শুরু হল মুষল ধারায়। কয়েনের কৌটোটা রক্তজলে কাত হয়ে পড়ে আছে দুলালের মতো। একাকী।