গল্প - আর্যা ভট্টাচার্য
Posted in গল্প''' আউর কিতনা টাইম লাগেগা ভাইয়া... বাসের হেলপার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো মধুজা। আর কত যে দেরী পৌঁছোতে!
‘বাস্, আধাঘন্টা’-বাইরের দিকে চোখ রেখেই জবাব দেয় ছেলেটি।
মধুজাও আবার জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। মানালী থেকে বেড়িয়েছে, তা প্রায় আট, ন’ঘন্টা হয়ে গেল। মাঝে অবশ্য চা, জল, খাবারের জন্য কয়েকবার থেমেছে বাস। কিন্ত তাও, এতটা সময় চুপ করে বসে থাকা সত্যিই কষ্টকর। তার ওপর মধুজার মতো আলাপী মেয়ে হলে। মা বলে, বকবক না করলে, তোর ভাত হজম হয়না।
মা! কতদূরে এখন সে মায়ের থেকে! মধুজার মনটা যেন একছুটে কলকাতায়, তাদের বাড়িতে চলে যায়।বাবা নিশ্চয় এখনো অফিস থেকে ফেরেনি। মা কি করছে কে জানে! তার জন্যে মন খারাপ করছে কি? তার মনটাও তো একটু; মা মা করছে।
কিন্তু ছাতার মাথা এখানে তো টাওয়ারই পাওয়া যায়না। দূর ছাই! সেই কবে কলকাতা থেকে বেরিয়েছে ! মনে হয় যেন একজন্ম আগে। যদিও দিনের হিসেবে দিন তিন চার মাত্র। আর ক’দিন বাদেই তো পুজো। আবার সেই লোকজন আলো আওয়াজ; আর প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে মানুষের উন্মত্ত ঠ্যালাঠেলি। উঃ,পুজোর এই ভিড় ভাট্টার সময়ে কলকাতায় থাকতে একেবারে অসহ্য লাগে। এটা একটা ভালো হয়েছে। এবার ওই ঝামেলা থেকে বেরিয়ে আসতে পারা গেছে। উ:! বাঁচা গেছে।
আর এই দারুণ সুযোগ টা হাতে এসে গিয়ে তাকে এই বছরের মতো বাঁচিয়ে দিয়েছে। গড তুসি গ্রেট হো!সত্যি, এখনও যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না! আছে তো? আছে তো চিঠিটা! তাড়াতাড় ব্যাগ খুলে বের করে, বোধহয় একশো বার পড়া চিঠি টা, আরো একবার পড়তে থাকে মধুজা । এই তো, স্পষ্ট লেখা আছে। তার আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। সেপ্টেম্বরে একমাস এই মনাস্ট্রীতে থেকে মধুজা সান্যাল পড়াশোনা, রিসার্চ সবই করতে পারবে। মনাস্ট্রীর লাইব্রেরী ও সে ব্যবহার করতে পারবে। শর্ত এই যে, তাকে মনাস্ট্রীর গেস্টহাউসে একটা ঘর দেওয়া হবে। হতে পারে সেই ঘর তাকে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। মনাস্ট্রীর সবাই যা খায় , তাকেও তাই খেতে হবে। খুব সাধারণ বিলাসহীন জীবন যাপন করতে হবে। কোনো স্পেশাল ট্রিটমেন্ট সে পাবেনা। এটা যদি তার পক্ষে সম্ভব হয় তবেই যেন সে আসে।
সাধারণ জীবনযাপন…দূরর্,সেটা কোনো ব্যাপার ই না। এই দূর্দান্ত সুযোগের জন্যে, সে আরও অনেক, অনেক কিছু করতে পারে। প্রাচীন বৌদ্ধ মনাস্ট্রীতে থাকা, বৃদ্ধ সন্ন্যাসীদের কাছে বসে পড়া, পুরোনো সব পুঁথি হাতে ধরতে পারা…. ওঃ,যেন স্বর্ণখনি হাতে পাওয়া! থ্রিলিং!
কী যে একটা অথেনটিক, অসাধারণ রিসার্চের সুযোগ সে পাচ্ছে, ভেবেই আনন্দে চোখে জল টল চলে আসে মধুজার। আর এর কাছে, একমাসের একটু কৃচ্ছ্রসাধন! কিস্যুনা। কিস্যুনা।
আনন্দ মাখানো মুখে চিঠিটা যত্ন করে আবার ব্যাগে তুলে রাখে। ওখানে পৌঁছে, চিঠিটা দেখাতে হবে তো। একটা হিম হিম ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। উলেন স্কার্ফটা মাথায়, কানে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে, বাইরের পাহাড়গুলোর দিকে আবার তাকায় মধুজা। রোটাংপাস তো সেই কখন পেরিয়ে এসেছে। এখন খানিকটা সমতল মতন জায়গা দিয়ে বাসটা যাচ্ছে। দূরে শেষ বিকেলের আলোয়, কালচে পাহাড়ের চূড়ায় অল্প বরফ। রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধ গাছ, আর যতদূর চোখ যায়, ‘ফল’ কালার। গ্রীষ্মে, শীতে এমনকি একবারবর্ষায়ও পাহাড়ে গেছে মধুজা। কিন্ত শরতে এই প্রথম। কী যে সুন্দর! কী যে মোহময় এই সময়টা! চারিদিকের এই কমলা লাল আগুন রঙে, শরত যেন সব ঋতুকে ছাড়িয়ে গেছে। এই যে এতো রঙের হোরিখেলা, ব্যস্ আর অল্প কিছুদিন। তারপরেই সাদা বরফে চারদিক ঢেকে যাবে। সে আর এক পাগল করা সৌন্দর্য!
‘ইঁহা উতারনা হৈ বহনজী। ইসকে বাদ থোড়ি দূর পয়দল যানা হোগা। বস্, তব্ হী মনাসটি মিল যায়েগী’ । বাসের হেল্পার ছেলেটি জানায় মধুজাকে।একটু হেসে, ‘শুক্রিয়া ভাইয়া'; বলে, বাস থেকে নেমে আসে মধুজা।
তারপর ভারী ব্যাগটাকে টানতে টানতে বাসের ছেলেটির দেখিয়ে দেওয়া ডানদিকের খানিকটা পাথুরে, খানিকটা মাটির রাস্তা ধরে চলতে শুরু করে। আশেপাশের শোভা যতই আকর্ষক হোক্ সারাদিনের ধকল, আর তার ওপর ভারী ব্যাগ! শরীর যেন ভেঙে আসছে। মা তো ঠান্ডা, ঠান্ডা বলে কতো যে জিনিস ঠেসে দিয়েছে! এখন টানতে টানতে দম বেদম। আর এই সাতমনি ব্যাগটাকে এই এবরো খেবরো রাস্তা দিয়ে ঠিকমতো টানাও যাচ্ছেনা। ট্রলীব্যাগের এ্যায়সি কি ত্যায়সি।
‘ আপনি কী মনাস্ট্রীতে যাচ্ছেন?’- চোস্ত ইংরেজি শুনে পেছন ফিরে তাকায় মধুজা।
পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন এক সৌম্যদর্শন, মুন্ডিতমস্তক গেরুয়া পরা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী।
‘হ্যাঁ,..মানে..’
‘আপনার হাতের ব্যাগটা আমাকে দিন। আপনি কলকাতা থেকে আসছেন তো?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কেন? আপনি কী করেই বা বুঝলেন যে আমি কলকাতা থেকে এসেছি?’-অবাক বড় বড় চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে মধুজা।
‘অনেক প্রশ্ন।‘- একটু হালকা হাসির আভাস যেন সন্ন্যাসীর গলায়।
'আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর, এই রাস্তায় মাল বয়ে নিয়ে যাওয়া, আমাদের অভ্যেস আছে। আপনার নেই’।
‘আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর-মনাস্ট্রী থেকে যে ইনভিটেশন লেটার পেয়ে আপনি আসছেন, সেটা আমারই টাইপ করা। আর আমি আপনার সঙ্গে ওই বাসেই ছিলাম।একটু পেছনের সীটে। একটা কাজে মানালী যেতে হয়েছিল। এই ফিরছি। এবার তাহলে যাওয়া যাক'
একটু হেসে মধুজার ওই ভারী ব্যাগটাকে অনায়াসে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেন সন্ন্যাসী।
‘হাই! আমি মধুজা। মধুজা রায়। আপনি?’’
‘আমি লাখপা রিনপোচে। ওয়েলকাম টু দ্য মনাস্ট্রী’
আর কোনো কথা না বলে, তারা দুজনেই চুপচাপ পথ চলতে থাকে ।
মধুজা একবার চোরাগোপ্তা দেখে নেয় সন্ন্যাসীকে। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের তো লামাই বলে।
‘রিনপোচে লামা’ -নিজের মনেমনে নিঃশব্দে একবার বলে, কেন কে জানে, কেমন যেন ফানি লাগে। লুকিয়ে একটু হেসে ফেলে মধুজা। মিনিট সাত আটের মধ্যেই তারা মনাস্ট্রীতে পৌঁছে গেল। আর সেখানে পৌঁছে অন্য, আরেকটু অল্পবয়সী এক লামার হাতে মধুজাকে গচ্ছিত করে, অন্য দিকে চলে যায় রিনপোচে ।
সব ফর্মালিটি হয়ে যাবার পরে ওই তরুণ লামাটি, যার নাম মধুজা এখন জানে- থন্ডুপ, মধুজাকে মেয়েদের উইং এর গেটে তাকে পৌঁছে দিয়ে গেলো।
এখানে ব্যবস্থা খারাপ নয়। এখন ভিড় নেই, তাই মধুজার জন্য একখানা পুরো রুমই বরাদ্দ হয়েছে। তার একপাশের ঘরে একটি জাপানি মেয়ে এবং অন্য দিকে দুজন আমেরিকান মেয়ে রয়েছে। তাদের সঙ্গে আলাপ হলেও গল্পসল্প করার কোন অবস্থা নেই। কারণ সন্ন্যাসীদের মতন গেস্টদেরও অকারণে কথাবার্তা বলা, গল্প করা একদমই নিষেধ। ‘ঠিক আছে। কোই প্রবলেম নেই’- বিছানায় ধপ করে ক্লান্ত শরীরটাকে ফেলে দিয়ে বলে ওঠে মধুজা।
কিন্তু যতোই ক্লান্তি লাগুক, এতো আর বাড়ি নয় যে মা সব করে দেবে। অগত্যা সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত শরীরটাকে কোনো রকমে টেনে তুলে হাতমুখ ধুয়ে, আনপ্যাক করে, মা কে মেসেজ করে এখানকার নিয়ম সম্বলিত পাতলা বইটা পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে একদম বুঝতেই পারেনি ।
ঘুম ভাঙ্গলো একটা ঘন্টার আওয়াজে । বোধহয় খাবারের ঘন্টা। আরো একটু গড়িমসি করে সে সবে বিছানায় উঠে বসেছে তখনই একটা বছর বারোর বাচ্চা এসে ঢাকা দেওয়া একটা থালা টেবিলে রেখে জানিয়ে গেলো, ‘ আপ কা খানা’
‘এখানে কেন ? খাবার ঘরে যেতে হবেনা ?’ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে মধুজা।
কারণ ইনস্ট্রাকশনে স্পষ্ট লেখা আছে, খাওয়া দাওয়া সব খাবার ঘরে।
একটু লাজুক হেসে বাচ্চাটি জানায়, তাই নিয়ম বটে, কিন্তু মধুজা তো খুব ক্লান্ত তাই আজকের মতো তাকে ঘরেই খাবার পৌঁছে দেবার কথা বলেছেন ছোটা লামা।
ছোট লামাটি কে, কে জানে ! তবে যেই হোন, তাঁকে মনে মনে অজস্র ধন্যবাদ দিয়ে খাওয়া শুরু করে মধুজা। সত্যিই আজ আর তার নড়ার ক্ষমতা নেই। খাবার খুবই সাধারণ রুটি, ডাল, একটা সবজি। কিন্তু খিদের মুখে তাই অমৃততুল্য! কোনো রকমে খাওয়া সেরেই কম্বলের নীচে ঢুকে পড়ল মধুজা। ঘুম ভাঙলো এক্কেবারে পরদিন সকালে নানারকম পাখির ডাক আর ঘন্টার আওয়াজে।
কম্বলের ভেতর থেকে মুখটুকু শুধু বের করে বাইরে তাকিয়ে দেখে, জানলার বাইরের বরফ পাহাড়গুলো ভোরের কমলা আলোয় কেমন যেন মায়াময় হয়ে উঠেছে। কী পবিত্র দেখাচ্ছে! ইস্, কলকাতায় যে কেন এমন একখানা ভোর পাওয়া যায়না! এই ভোরের জন্যেই সারাজীবন সে এখানে থেকে যেতে পারে।
কিন্ত না, আলসেমি করার জায়গা এটা নয়। মনাস্ট্রীর একটা নিয়ম আছে। একটা ডিসিপ্লিনড লাইফ। তাকেও সেই নিয়ম অবশ্য ই মেনে চলতে হবে।সকালের প্রথম সেশন প্রার্থনা দিয়ে শুরু হয়। প্রধান লামা রিনচেন সোনাম নিজেই সেই প্রার্থনা সভা পরিচালনা করেন। আর তার পাশে ছোট লামার আসন। ও, আচ্ছা, রিনপোচে তাহলে ছোট লামা…ও ক্কে…গট ইট।
এখানে সকলে প্রধান লামাকে অভিবাদন করে, তার আশীর্বাদ নিয়ে দিন শুরু করে। আর সেদিন থেকে মধুজাও তাই করতে লাগলো । মনাস্ট্রীর নিয়ম সে নিষ্ঠার সঙ্গে ই পালন করবে। তাই সেদিন থেকে রোজ সকালে মধুজা প্রধান লামাকে অভিবাদন করেই তার দিন শুরু করে।
সকাল নটা থেকে দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত প্রধান লামা হলঘরে বসে বক্তৃতা দেন, সকলের সাথে কথাবার্তা বলেন, গেস্টদের সুবিধা অসুবিধার খবর নেন। আর এ সবের ফাঁকে ফাঁকেই চলে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে, বৌদ্ধ দর্শন সম্পর্কে আলোচনা।আর এই সময়টা মধুজা কোনোও ভাবে মিস্ করতে চায়না। এ সব যে অমূল্য সম্পদ! এর জন্যে ই তো মধুজার এতো দূরে আসা।
মনাস্ট্রীর অন্যান্য সকলেই সেখানে, খুব অসুবিধা না হলে, উপস্থিত থাকে। রিনপোচেও থাকে। আর সেখানেই প্রতিদিন রিনপোচের সঙ্গে মধুজার দেখা হয় । অবশ্য যদি তাকে দেখা হওয়া বলে। ইন ফ্যাক্ট মধুজাই তাকে লক্ষ্য করে। রিনপোচের এক্সপ্রেশন থেকে তারা যে পরস্পরকে চেনে এমন কোনো আভাসও পাওয়া যায়না। তার তীক্ষ্ণ অথচ ভাবালু চোখদুটো যে কী দেখছে কিছুই বোঝা যায়না। আর এই অদ্ভুত নৈর্ব্যক্তিক হাবভাব দেখেই তার প্রতি মধুজার কৌতুহল আর আগ্রহ বেড়েই যেতে থাকে।
আরো তো লামারা রয়েছে। কই, তারা তো এরকম না। হ্যাঁ, গল্প কেউ করেনা। কিন্ত হলঘরে দেখা হলে প্রত্যেকেই মিষ্টি হেসে সকালের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। কিন্তু এ ব্যাপারেও রিনপোচে কেমন যেন উদাসীন । কিন্তু কেন ? ও কি খুব কড়া সাধক? এমনি মুখটাতো বেশ অমায়িক । আর হেল্পিং ও যে খুব, সে তো মধুজা নিজেই দেখেছে।
হঠাৎ যেন চটকা ভেঙে মধুজা রিয়ালাইজ করে সে বড্ড বেশি রিনপোচের কথা ভাবছে। তাই না? আররে, ছোটলামা বলে না ভেবে সে কখন থেকে মাথার ভেতরে ওকে ‘রিনপোচে’ বলে ডাকছে, ভাবছে! ধ্যাৎ…মধুজা নিজের কাছেই নিজে লজ্জা পেয়ে যায়। তবে মাথার ভেতর থেকে রিনপোচের চিন্তা মুছে ফেলতে পারেনা। ছেলেদের সঙ্গে তো সে কম মেশেনি। অসহ্য লাগে। ছাগল সবকটা। স্যুডো আঁতেল যতো। আর রিনপোচে কে দ্যাখো, শান্ত, গম্ভীর, কনসিডারেট…ঠিক যেন হিমালয়ের প্রতিচ্ছবি। কী আকর্ষণীয় গলার স্বর, হ্যাঁ, একটু খেঁদা খেঁদা টাইপ.. কিন্তু কী সুন্দর দেখতে! একদম পবিত্র। থন্ডুপের কাছ থেকে শুনেছে বিদেশে নাকি পড়াশুনাও করেছে, আবার কিছুদিন পড়িয়েওছে। জাস্ট ফ্যানটাস্টিক!
এই তো সেদিন, লাইব্রেরীতে যখন সে একটা বৌদ্ধ পুঁথি নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে, তখন একটু সাহায্য চাওয়াতে, ওই এতক্ষণ দন্তস্ফূট করতে না পারা অংশটুকু অতি প্রাঞ্জলভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছিল। কী গম্ভীর কন্ঠস্বর! কী অপূর্ব ব্যাখ্যা! এককথায় ক্যরিসম্যাটিক। রিনপোচের স্বর শুনতে শুনতে, তাকে দেখতে দেখতে মধুজা কেমন যেন বিভোর হয়ে যাচ্ছিল। একটা অদ্ভুত আকর্ষণ! কিন্তু তারপর ?
হঠাৎ রিনপোচের চোখে চোখ পড়তেই দেখে, তীব্র কঠোর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে রিনপোচে। আর ঠিক তারপরেই আকস্মিক ভাবেই পড়ানো বন্ধ করে ,তার দিকে আর একবার ও না তাকিয়ে, হনহন্ করে লাইব্রেরী ছেড়ে বেড়িয়ে গিয়েছিল।
তারপর থেকে আর একবারের জন্যও রিনপোচেকে লাইব্রেরী তে দেখতে পায়নি মধুজা।
রিনপোচে কী তার ভালোলাগাটা বুঝতে পেরে গেল?! কিন্ত সেই বা নিজেকে সংযত করতে পারছেনা কেন? সন্ন্যাসীর প্রতি ভালোলাগা জন্মানো ঠিক নয়। অনৈতিক। নাঃ, নিজের ফিলিংসকে তার কন্ট্রোল করতেই হবে। এটা ঠিক নয়।
অনেক চেষ্টা করে, রিনপোচের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে, মধুজা অন্য কাজে মন দিতে চেষ্টা করছিল। আর কাজ ও তো অনেক। সকালে প্রার্থনায় যোগ দেওয়া, তারপর ঘরদোর পরিষ্কার করা, লাইব্রেরীতে পড়াশুনো, নোট নেওয়া ছাড়াও খানিকটা বইপত্র আ্যরেন্জমেন্টের দায়িত্ব ও তাকে দেওয়া হয়েছে।একটু অবসর পেলে সে বাচ্চা লামাদের সঙ্গে গল্প করে। তাদের ইংরেজী শেখায়।
আমেরিকান মেয়েদুটি আর জাপানি মেয়েটির সঙ্গে এরমধ্যে তার ভালোই আলাপ হয়ে গেছে। জাপানি মেয়েটির নাম সুবাকি। আসলে ৎসুবাকি , কিন্তু সেটা একটু খটমট বলে ওরা সুবাকি বলেই ডাকে। সুবাকি ওসাকায় থাকে। ও টাকা জমিয়ে তিন চার বছর বাদ বাদ ই ভারতের নানা মনাস্ট্রীতে এসে থেকে যায়। একটু শান্তির আশায়। ওর বিবাহিত জীবন নাকি ভয়ঙ্কর ছিল, তাই এই শান্তির ওর খুব প্রয়োজন । এসব বলতে বলতে সুবাকির চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। ভারী কষ্ট হয় মধুজার।
আমেরিকান মেয়েদুটি ও বেশ মিশুকে। ওদের নাম ক্লারা আর জোয়ানা। ক্লারাও পড়াশোনার জন্য এসেছে। ও বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে রিসার্চ করতে চায়। তাই ওরিজিনাল পুঁথি নিয়ে পড়াশুনো করতে এসেছে। রিনপোচে এবং আর একজন লামা যার নাম সেনজু তাদের দুজনের পড়ানোর প্রশংসায় তো ক্লারা একেবারে পঞ্চমুখ। আর সেই বিগলিত প্রশংসা শুনে মধুজার বুকের ভেতর টা হিংসেয় কেমন যেন চিনচিন করে ওঠে।
জোয়ানা অবশ্য পড়তে নয় খানিকটা শান্তির সন্ধানে, খানিকটা অন্যজীবনের খোঁজে এসেছে। ওরা খুব ধনী। এতোদিন দুহাতে দেদার টাকা উড়িয়েছে। ক্লাব, বুজ, ড্রাগ…কী নয়! আর এ সবকেই ভেবেছে, এনজয়িং লাইফ। কিন্তু আর না। বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। নো, দিস ইস নট লাইফ। এবার সে অন্য জীবনের স্বাদ পেতে চায়। যে জীবনে শান্তি আছে , আনন্দ আছে, মানুষকে সেবা করার ভাবনা আছে।
ওদের সবার জন্য ভারী কষ্ট হয় মধুজার। বেচারারা কেউ সুখী নয়। এদের তুলনায় তার জীবন তো স্বর্গ! মা বাবার আদরে, স্নেহে, আবদারে দারুন সময় কাটে। আর মাঝে মাঝে টুকটাক ডেটিং ফেটিং। বিন্দাস লাইফ। নো কমপ্লিকেশনস। অন্তত এখানে আসার আগে পর্যন্ত ছিলনা।
ধুত্তেরি কমপ্লিকেশনস। সময় চলে যাচ্ছে। লাইব্রেরি ছাড়া আর কোনো দিকে সে এখন মন দেবেনা। আর সেনজু লামা সত্যিই খুব ভালো মানুষ। রিনপোচের মতন অহংকারী নন। উনিই লাইব্রেরীটা দেখেন। আর কী সুন্দর ব্যবহার! প্রত্যেককে হেল্প করেন ইনক্লুডিং মধুজা।মধুজার কাজ ও তরতর করে এগোচ্ছে।
এই ভাবেই, এসবের মধ্যে দিয়েই, কোথা থেকে যে একটা মাস কেটে গেল যেন টেরই পাওয়া গেল না। এরমধ্যে আমেরিকান মেয়ে দুটি চলে গেছে। জাপানি টিও যাবে, যাবে করছে।
সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মধুজা দেখে আগের দিন রাতে দূরের পাহাড়ে স্নো ফল হয়েছে। পাহাড়গুলো বরফে ঢেকে গেছে। ভ্যালিতে এখনোও বরফ পড়া শুরু হয়নি।
কিন্ত চারদিকটা এমন উজ্জ্বল সাদা হয়ে গেছে যে সরাসরি তাকালে চোখ যেন ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। অথচ এমন তার অমোঘ আকর্ষণ, যে কিছুতেই চোখ ফেরানো যায় না। ঠিক যেন রিনপোচের মতো।
বাগানে দাঁড়িয়ে এই অসাধারণ দৃশ্য দেখছিল মধুজা। হঠাৎ ই কারো উপস্থিতি টের পেয়ে, মুখ ফিরিয়ে একেবারে চমকে উঠলো। তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে রিনপোচে।
আর তার দৃষ্টি মধুজার দিকে! আর সেই দৃষ্টি যেন মধুজার বুকের ভেতরে একটা ভূমিকম্প নিয়ে আসছে। চোখে চোখ রাখা মাত্রই মধুজার মুখটা কী এক আবেগে লাল হয়ে উঠলো! কোনোরকমে নিজেকে সামলে , ঠোঁটে একটা হাল্কা হাসি নিয়ে রিনপোচের দিকে আবার তাকানো মাত্রই ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরে, আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে, সম্পূর্ণ অন্য দিকে সে হাঁটা লাগালো, মধুজাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। যেন মধুজা বলে কেউ সেখানে নেই। ছিলনা কখনো।
অপমানে মধুজার মুখটা একেবারে লাল হয়ে গেল। কেন? কেন সে হাসিমুখে তাকিয়েছিল? রাগে , অপমানে নিজের গালেই ঠাটিয়ে ক’টা চড় মারতে ইচ্ছে করলো।
মাথা নীচু করে আস্তে আস্তে হলঘরের দিকে রওনা দিল মধুজা। প্রার্থনার সময় হল যে।
আর এমন গেড়ো, হলঘরে গিয়ে মধুজা শোনে, প্রধান লামার আজ শরীর ভালো নেই; আর যেহেতু রিনপোচে প্রধান লামার উত্তরাধিকারী তাই আজ রিনপোচেই প্রার্থনা পরিচালনা করবে।
এটা শুনেই মধুজার মাথাটা গরম হয়ে গেল। আবার তার সাথে সাথেই একটা দখিনা পবন তার বুকের মধ্যে থেকে উঠে এসে তার গালে একটা মিষ্টি ছোঁয়া দিয়ে যেন চলে গেল। তার মনটা একটু আগের অপমান ভুলে কেমন যেন ফুরফুরে হয়ে উঠলো।
মাথার মধ্যে আব্দুল করিম খাঁ গেয়ে উঠলেন, ‘পিয়া কি মিলনকে আস’…। কী এক আবেগে তার বুকের ভেতর টা ভরতি হয়ে যেন উপচে যেতে চায়। রিনপোচেকে কী সে ভালোবাসে? ‘হোলি ক্র্যাপ’, মনে মনেই বলে ওঠে মধুজা।
আর ঠিক সেই সময়ই হলঘরে ঢুকে আসে রিনপোচে। কোনোওদিকে না তাকিয়ে নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে গিয়ে বসে পড়ে সে।
সেদিন রিনপোচে বলতে থাকে। মারের গল্প। কেমন ভাবে মার সুন্দরী মেয়ে সেজে গৌতম বুদ্ধকে পথভ্রষ্ট করতে এসে নিজেই পরাজিত হয়ে ফিরে গেছিল, সেই কাহিনী। যদিও ছোটোর থেকেই এই কাহিনী মধুজার জানা, কিন্তু রিনপোচের মুখে সেই একই গল্প বিছুটি পাতার মতো যেন গায়ে ফুটছে। তাকে শুনিয়েই যেন এই কাহিনী বলছে রিনপোচে।
আরো একবার অপমানে, মধুজার চোখের পাতা ভিজে আসে। নাঃ, আর যে ক’টা দিন আছে, আর সে রিনপোচের কথা ভাববেনা। যতো ভাবে পারে আ্যভয়েড করবে।
মুখোমুখি এসে গেলেও সে মুখ ঘুরিয়ে নেবে। ঠিক আছে সে একজন লামা। সন্ন্যাসী। তা’বলে এতো অহংকার! মানুষ কে মানুষ বলেই জ্ঞান করেনা! হ্যাঁ, তার মনে রিনপোচের প্রতি একটা আকর্ষণ… প্রেম প্রেম ভাব জন্মেছে। আর সেটা যদি রিনপোচে বুঝেও থাকে, এতোটা রিএ্যাক্ট করার তো কিছু নেই। আর তাছাড়া অনেক লামাদের ই তো বিয়ে করা এ্যালাউড।থন্ডুপ বলেছে তাকে। আচ্ছা ঠিক আছে, এটা নাহয় সে একটু…ও.কে…একটু না..অনেকটা বেশিই ভেবে ফেলছে, কিন্তু তার জন্য তাকে এভাবে অবজ্ঞা, অপমান করার কী কোনো দরকার আছে ? নেই তো।
আর ও না বৌদ্ধ? পরিশীলিত ব্যবহার আর ক্ষমাই যাদের পরম ধর্ম?
কেন যে সেই আসার দিন দেখা হলো!তাকে হেল্প করলো! সেটাই সব সর্বনাশের মূল।
নিজের মনে মনেই গজ্ গজ্ করতে থাকে মধুজা।
তাও, কেন যে, কেন যে এত অসহায় লাগে! রিনপোচে কে দেখলে, তার কথা ভাবলে মনটা কেমন যেন টলটল করে। ভরে যায়। তার যে বয়ফ্রেন্ড ছিল না তাতো নয়। কিন্ত মনের মধ্যে কখনো ঠিক এমন তোলপাড় করেনি।
যাকগে, সে তো নেক্সট উইকে চলেই যাচ্ছে। তারপর সে ই বা কোথায় আর রিনপোচেই বা কোথায়! দুদিন বাদে এ সব তার মনেই থাকবেনা। তাইনা?.. তাছাড়া আবার কী?
নিজের মনেই প্রশ্ন ও করে, আর উত্তর ও দেয় মধুজা।
ধীরে ধীরে মধুজার ফেরার দিন চলে আসে। প্রধানলামাকে অভিবাদন ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয় মধুজা। চারপাশে তাকিয়ে কোথাও রিনপোচেকে দেখতে পায়না। হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত।থন্ডুপকে জিজ্ঞেস করে মধুজা জেনেছিল রিনপোচে নাকি আজকাল প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেড়োয়না। কী একটা পুঁথি ইংরেজি তে অনুবাদ করছে। তা ছাড়াও পরের বছর ধর্মশালায় গিয়ে , কিছুদিন থাকার অনুমতিও চেয়েছে প্রধানলামার কাছ থেকে। তাই রিনপোচে গভীর সাধনায় ব্যস্ত এখন।
হয়তো সেইজন্যেই। অথবা হয়তো মধুজার আশপাশে আসায় তার প্রবল অনীহার কারণেই অন্যান্য লামাদের মতো তাকে বিদায়টুকু অবধি জানালোনা রিনপোচে।
শেষবারের মতো মনাস্ট্রির দিকে তাকিয়ে প্রায় জলভরা চোখে থন্ডুপের হাত থেকে স্যুটকেসটা নিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাসে উঠে পড়লো মধুজা।মনে মনে বললো,
'বাই রিনপোচে’।
মধুজা ফিরে যাবার পর বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। প্রধান লামার শরীর খুব একটা ভালো নয়। ডাক্তার তাঁকে কাজের চাপ কমাতে বলেছে। তাই আজকাল রিনপোচে প্রায়ই প্রার্থনা সভা পরিচালনা করে। তাছাড়া প্রধান লামাকে করেসপন্ডেন্স এ ও হেল্প করে। খুব গুরুত্বপূর্ণ মেইল বা চিঠি না হলে সে ই উত্তর দিয়ে দেয়।
মে মাস প্রায় শেষ। চারদিকের বরফ গলতে শুরু করেছে। সারাদিনের কাজ শেষ করে সন্ধ্যে নাগাদ প্রধান লামার ঘরে গিয়ে বসে রিনপোচে। একতারা চিঠি তার হাতে দিয়ে তিনি বলেন,’ এই যে , এই চিঠি ক’টা আলাদা করে রেখেছি। উত্তর দিয়ে দিও’।
ঘরে ফিরে একটা একটা করে চিঠিগুলো পড়তে থাকে রিনপোচে।
হঠাৎ চিঠির ভিড়ে, একটা কার্ড দেখে একটু অবাকই হয়ে যায় সে। কার্ড তো কেউ পাঠায়না। একটু কৌতূহল নিয়ে ই কার্ডটা খুলে ফেলে রিনপোচে। বিয়ের কার্ড। মধুজা বলে যে রিসার্চ স্কলার এসেছিল, তার বিয়ে। পরের মাসে। প্রধান লামাকে কৃতজ্ঞতা ও প্রণাম জানিয়ে, আগামী বিবাহিত জীবনের জন্য তাঁর আশী্র্বাদ প্রার্থনা করেছে ।
হঠাৎ একটা বর্শা যেন রিনপোচের বুকটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে, সেখানেই আটকে যায়।সে যেন দম নিতে পারছেনা। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আঁকুপাঁকু করতে করতে, একটু অক্সিজেনের জন্য টলতে টলতে , ঘর থেকে বেড়িয়ে, বাগান পেরিয়ে, আশ্রমের সীমানায় এসে হাঁপাতে থাকে রিনপোচে।
শেষ প্রদোষে পাহাড়গুলোকে বিষণ্ণ, মরা গোলাপী রঙে রাঙিয়ে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। উজ্জ্বল দিন শেষ।
একদৃষ্টে কালচে গভীর খাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রিনপোচে। সময় হিসেব বিহীন। তার বুকেও এখন ঠিক ঐ রকম একটা গভীর কালো গহ্বর। সূর্যহীন নিকষ অন্ধকার। তার চোখে কোনো দৃষ্টি নেই, ঘ্রাণশক্তি নেই-কোনো সেনসেশন-কোনো অনুভূতিই নেই। বুকের ভেতর একটা বিরাট গহ্বর। একটা অসীম শূন্যতা।একটা আর্তনাদ , মৃত্যুর মতন একটা কষ্ট তার পুরো শরীরটা একবারে দুমড়েমুচড়ে ফেলছে, কিন্তু বেড়িয়ে আসতে পারছেনা। খাঁচার ভেতর আহত পশুর মতো, অশরীরী আত্মার মতো শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে, আর খেয়েই যাচ্ছে।
কখন যে সন্ধ্যে হয়ে গেছে, ইভিনিং প্রেয়ারের ঘন্টা বেজে গেছে- কিছুই সে বুঝতে পারলো না। তার সম্বিত ফিরল থন্ডুপের ডাকে।
‘প্রেয়ারের সময় হয়ে গেছে। সবাই অপেক্ষা করছে। প্রধান লামাও এসে গেছেন। এখন শুধু আপনার আসার অপেক্ষা। আপনি আসছেন তো ? ‘
তার গলায় উত্তর দেবার মতো যেন কোনো স্বর অবশিষ্ট নেই। যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে নিশ্চল স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে রিনপোচে।
নি:শব্দ কয়েকটি মুহূর্ত।
‘আসছি’ -অনেক কষ্টে ক্লান্ত ভাবে বলে রিনপোচে।
আর তারপর নিষ্প্রাণ দেহের মতো , অনিচ্ছুক অবশ পা দুটিকে টানতে টানতে প্রেয়ার রূমের দিকে নিয়ে চলে সন্ন্যাসের কঠোর সংযমে নিজেকে বাঁধতে চাওয়া রিনপোচে।
রিনপোচে লামা।।