গল্প - কৌশিক চট্টোপাধ্যায়
Posted in গল্প-বাবা অফিস থেকে আসেনি বৌদি? সাড়ে আটটা বাজছে…
বাইকে হেলান দিয়ে সপ্তক প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়৷ রান্নাঘরের জানলা দিয়ে বৌদিকে দেখে সপ্তক প্রশ্নটা করেছে৷
নীলিমার গা পিত্তি জ্বলে যায়৷ প্রতিমাসের প্রথমদিনই সপ্তক আসবে ৷ বাবার মাসমাইনের টাকাটা নিয়ে বাইক চড়ে ধাঁ৷
ব্যাস !
দিলু কাকুর লক্ষ্মী প্রতিমার মত বৌ অকালে ক্যান্সারে মরে যেতেই সাজানো সংসার ভেঙে একেবারে তছনছ হয়ে গেল৷ যে দিলুদা সবসময় দামী পোষাক পরে থাকত সেই দিলুদা এখন ভিখারী আর পাগলের মত থাকে৷
একমুখ অনেকদিনের না কামানো দাড়ি ,গোঁফ৷চিরুণি না পরা অবিন্যস্ত কাঁচা-পাকা চুল ঘাড় অব্ধি নেমে এসেছে৷ একমাত্র ছেলে সপ্তক ৷মাত্র ছবছর বয়সেই মাতৃহারা৷কাজেই পার্মানেন্টলি বাবার আশ্রয় ছেড়ে দাদু দিদা অর্থাৎ মামার বাড়ী৷আর কে না জানে সেখানে ভারী মজা কিল চড় নেই৷ এখন সপ্তক বাইশে পড়েছে ৷ইয়ারদোস্ত আর বাইক নিয়ে মজা, আর অনাবিল লাগামছাড়া আনন্দর কোনও তুলনাই নেই৷ইচ্ছাপূরণের জাদুকাঠি তো আছেই সপ্তকের৷সবকিছুর স্পনসরার যে বাবা ৷
দিলুদার আকাচা পোষাকে ময়লার আস্তরণ পড়ে ৷পাল্লা দিয়ে চুল , দাড়ি আর বৈরাগ্য বাড়তে থাকে৷পাল্লা দিয়ে দিলুদার ঘরে কড়িকাঠ থেকে ঝুল নামতে থাকে,অযত্নে দেওয়ালের পলেস্তারা খসে খসে পড়ে৷
খৈনি আর দেশী মদ, খিদে আর মনের কষ্ট ভুলিয়ে দেয় ৷পেটের খিদে তুচ্ছ আর অমলিন হয়ে যায় মনের খিদের কাছে ৷ ফাঁকা বাড়ীটা অসীম নৈঃশব্দ নিয়ে রাত্রে যেন দিলুদাকে গ্রাস করতে থাকে৷
যৌথ বাড়ীর দিলুদার অংশে ফাটল ধরে , পাঁচিল ভেঙে যায় ৷ দিলুদা উদাসীন ভাবে দেখে যায়৷ নিশ্চেষ্ট, নির্বিকার দিলুদার দরজা দিন রাত খোলাই থাকে৷ তেলচিটে তোষক -বালিশে শুধু রাত্রিযাপন৷ নিশিকুটুম্ব দিলুদার ঘরে ঢুকে তল্লাশি চালায় অবশেষে ভগ্ন মনরথ হয়ে চম্পট দেয়৷নেশাতুর দিলুদা টেরও পায়না৷ পরদিন সকালে উঠে দিলুদা ভাঙা মন আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে আবার দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয় ৷ ট্রেনে সহযাত্রীদের টিপ্পুনি এখন নিত্যনৈমিত্তিক৷দিলুদা নিরুত্তাপ দেখে সহযাত্রীদেরও উৎসাহে ভাঁটা পড়ে৷ ৷দিলুদার হাতে টাকা নেই ,ভয়ও নেই ৷ যার নিজের বলতে কিছু নেই তার আবার ভয় -লজ্জা ! মাইনের টাকাটা ছেলের জিম্মায় আর ছেলে ছাড়া দিলুদার আর কেই বা আছে?
ছেলের দুলাখি বাইকের ইএমআই যায় মাসে মাসে ৷
সপ্তকের ফোন কুশল বিনিময় নয় , বাবার কাছে ডিম্যান্ড ৷একেবারে একফোনে কুড়িহাজার৷ বাবার এটিএম কার্ডই ভরসা৷
দশদিন যেতে না যেতেই ভাইপো অখিলের কাছে দু একশো টাকার জন্য হাত পাততে হয় দিলুদাকে ৷ এ যেন সমুদ্রে জাহাজ নিয়ে যাত্রাপথে তৃষ্ণায় কাতর যাত্রী জলের সন্ধানে যেন সচেষ্ট ৷ চারদিকে জলই জল অথচ তা পানযোগ্য নয়৷ অখিল না বললেও নিলীমা গজগজ করে, আবার ভালো রান্না করলে ছুটির দিনে ছেলের হাত দিয়ে কেন যে দিলুদাকে দেয় তা নিলীমা নিজেও বুঝতে পারে না ৷খাবার অবস্থায় দিলুদা না থাকলে খাবারে মাছি ভনভন করতে থাকে৷ বেশীর ভাগ দিনই রাতে দিলুদা খাবার অবস্থায় থাকে না৷
দিলুদা ট্রেন থেকে বাড়ী ফেরার সময় কখনো বা পঙক্তিভোজনে ভবঘুরে ,হকারদের পাশে রাস্তায় বসে পাত পেড়ে খায়৷ অখিলের চোখেও দুএকবার পড়েছে৷ অখিল কড়া করে বংশমর্যাদার কথা বললে দিলুদা কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে৷ অখিলেরই তাতে কষ্ট বাড়ে ৷
বুকিং ক্লার্ক খগেন মরলে ছেলে চাকরী পায় রেলে৷
দিলুদার চিন্তা বাড়ে ৷পাল্লা দিয়ে বাড়ে সুগার৷ রেললাইনে ইচ্ছাকৃত অমনোযোগে বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গিয়ে দিলুদার কষ্ট আরও বাড়তে থাকে ৷
বাপের চাকরির সময় যে শেষ হয়ে আসছে…
ছেলের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা না করে গেলে যে দিলুদার শান্তি নেই…
দুদিন নিলীমারা বাড়ীতে নেই ৷ কাজেই নো টেনশান !ইনসুলিন নিয়ে নেশার তরলকে আশ্রয় প্রকারন্তরে চিরনিদ্রাকে আবাহনেরই সামিল৷ এ মৃত্যু আর যাইহোক কাঙ্খিত মৃত্যু দিলুদার কাছে৷ চিরতরে অন্ধকার নামার আগে দিলুদার মনে পড়ে যৌবনে জ্যোতিষী দিলুদার ভাগ্য গণনা করতে গিয়ে বলেছিল "তোমার দুর্বলতাই তোমার মৃত্যুর কারণ হবে৷"
হঠাৎ দিলুদার ভীষণ শীত করতে থাকে৷ সপ্তক তো তার দুর্বলতাই৷ বড় অন্ধকার লাগছে চারপাশটা৷ মৃত্যুর রঙ কী গভীর কালো হয় ?
মাছিগুলো মরা মুখের উপর ভনভন করতে থাকে৷ হাতে খালি বোতল ধরাই থাকে৷ পরদিন দুপুরে বাড়ী ফিরে নিলীমার চোখেই প্রথম ধরা পড়ে দিলুদা চিরনিদ্রায় চলে গেছে সারা জীবনের মত৷ অখিলকে ডেকে এনে দেখায় ৷ সপ্তককে খবর দিতে হবে৷
আর মাত্র একমাস হলেই চাকরীর মেয়াদ শেষ হত দিলুদার৷ সপ্তকের চাকরীটা ফসকে যেত৷এ সুযোগ হেলায় হারানো যায় না ৷
সে সুযোগ দিলুদা আর ছাড়ে ?
এককালীন অনেক কটা টাকা আর ছেলের চাকরী তার জন্য আত্মহত্যা আর কী কঠিন ব্যাপার? যতই হোক নিজের রক্তের সন্তান …
ডাক্তার তো ঘরের কাছেই ৷রুটিনমাফিক লিখে দেওয়া মৃত্যুর কারণ কার্ডিয়াক ফেলিওর … স্বাভাবিক মৃত্যু৷
………………………………………………….
-"বিক্রম, বাবা গাওয়া ঘি'র লুচি খেতে ভালোবাসতেন৷ চিংড়ি মালাইকারী ,ভেটকি পাতুরী আর নবদ্বীপের লাল দই যেন মেনুতে থাকেই৷ জিনিষ এবং রান্না যেন একনম্বর হয়৷টাকা নিয়ে চিন্তা নেই৷আর ঢালাও ব্যবস্থা অন্তত হাজারের কাছে লোক খাবে৷"
সপ্তকের কথা শুনে রাগে গা জ্বলে যায় নিলীমার৷ বিনা আয়াসে সরকারী চাকরী আর প্রায় লাখ বত্রিশ টাকা সপ্তককে কোথায় নিয়ে যেতে পারে ভাবতে থাকে নিলীমা ৷
শুধু বলে ওঠে -"মরণ…"