Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in






পর্ব ২৮

ক্রিসমাস যাপন : এদেশ ওদেশ – সান্তা এবং অন্যান্য

ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। মিলান শহরের কেন্দ্রে এক ব্যস্ত বাস টারমিনাসে (ওরা বলে স্টেশন) অপেক্ষারত আমি। ২০১৫ সাল। বিশেষ কারণে সে বছর সরাসরি গিয়েছিলাম মিলান। তারপর সেখান থেকে ওরাৎসিওর সঙ্গে (কখনও কখনও বন্ধু ফাব্রিৎসিও সঙ্গী হয়েছে আমাদের) ইতালির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত চষে ফেলা। দেশটির প্রকৃতি, খাওয়া-দাওয়া, মানুষজন, প্রাত্যহিক যাপন – এসবকিছুর সঙ্গে আমি যেন কেমন একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম, আবিষ্কার করেছিলাম এক আশ্চর্য সুন্দর আর চিত্তাকর্ষক সংস্কৃতিকে, যা রান্নাবান্না নিয়ে আমার এতকালের লালিত রন্ধন জগতে তৈরি করেছিল এমন এক অভিঘাত, যার তীব্র উপস্থিতি আমি টের পাই এখনও এবং এককথায় যা বরাবরের মতো বদলে দিয়েছিল আমার দেখার ভঙ্গীটি। পাঠকের একঘেয়ে লাগলেও এই স্বীকারোক্তিটি বারবার করার মধ্যে একধরনের আনন্দ আছে। যা কারও সঙ্গে ভাগ করা যায় না।

আগেই বলেছি, মাসটা ছিল ডিসেম্বর। পশ্চিমি দুনিয়ার সবথেকে বড় উৎসব ক্রিসমাসের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। আর ক্রিসমাস বলতেই আমরা বুঝি ‘সাদা ক্রিসমাস’। বরফের আস্তরণে চাপা পড়েছে চরাচর, বাড়ির ভিতরে খাবার টেবিলের ওপর সদ্য আভেন থেকে বেরিয়ে আসা রোস্ট টার্কি। চারপাশে সাজানো আনুষঙ্গিক অনেক কিছু, ওয়াইনের গ্লাস ইত্যাদি। হয়তো ক্রিসমাস ক্যারলের আওয়াজও ভেসে আসছে ভিতরের ঘর থেকে। এই বিশেষ উদযাপনের এটাই চিরকালীন আবহ। আসলে যে কোনও কারণেই হোক এই ছবিটি আমাদের মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে বা বলা ভালো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আদপে বিষয়টি কিন্তু সেরকম নাও হতে পারে। যেমন হয়েছিল সেবার।

আমি মিলান থেকে বার্লিনের উদ্দেশে রওনা হই যখন, ইতালিতে তখন বেশ ঠাণ্ডা। কদিন আগেই ভোরবেলা মিলান থেকে পারমা যাওয়ার পথে দুপাশের তৃণভূমি ঢাকা ছিল হালকা তুষারের চাদরে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছিল আমার পরবর্তী গন্তব্য বার্লিনে হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডা পাবো। অন্তত পাওয়ার কথা তো বটেই। মিলান থেকে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে পরদিন সকাল আটটা নাগাদ বার্লিন পৌঁছলাম। বাসের জানালা দিয়ে দেখি আগে হওয়া কথামতো বারবারা বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিতে এসেছে আমাকে। তিরিশ বছর ধরে চলছে এই প্রথা। কিন্তু ডিসেম্বর মাসের সকালে বার্লিনে মাত্র সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস! ভাবা যায়? তখনই মনে হয়েছিল উষ্ণায়নের প্রভাবে এবারে অন্তত ‘সাদা ক্রিসমাস’ হচ্ছে না। কিন্তু এই উদযাপনটি ঘিরে খাওয়া-দাওয়া, পারিবারিক মেলবন্ধনের যে প্রাচীন রীতি, তাতে কোনও ঘাটতি হওয়ার তো কথা নয়! কেমন হয় ক্রিসমাসের ভোজন? দেশ থেকে দেশান্তরে? প্রথমত আদিকাল থেকেই এই দিনটি একটি জাতীয় ছুটির দিন। কিন্তু এটি কোনও সাদামাটা অবসর-দিবস নয়। আমাদের দুর্গাপুজোর মতোই এর নানান দিক – তবে সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষঙ্গই যে এই উৎসবের মূল নিয়ন্ত্রক একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এই অনুষঙ্গগুলিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে, প্রতিটি দেশে তা আলাদা আলাদা চেহারাও নিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ হয়েও কত ভিন্ন হতে পারে খাদ্যাভ্যাস, তা হেঁশেলের দিকে একটু মনোযোগী নজর দিলেই বোঝা যাবে। আপাতত দেখা যাক বড়দিনের উদযাপনকে ঘিরে জার্মান নৈশাহারের ধরনটি কেমন হয়।

প্রথমত যে পদটি প্রায় সর্বত্র দেখতে পাওয়া যাবে, তা হচ্ছে রোস্ট। ইংল্যান্ডের মতো দেশে সাধারণভাবে যা টার্কি। জার্মানিতে দেখা যায় হাঁস। সঙ্গে আলু বা বাঁধাকপির স্যালাড। ক্রিসমাস কুকি। লেবকুখেন। এইবার থামতে হবে। কারণ অভিধান ঘাঁটলে দেখবেন এই লেবকুখেন নাকি জিঞ্জার ব্রেড। বললেই হল? বড়জোর বলা যেতে পারে জিঞ্জার ব্রেড পরিবারের। কিন্তু উপাদান এবং প্রকরণ নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলেই বোঝা যাবে, এই দুই বস্তুর মধ্যে মিলের চেয়ে অমিল অনেক বেশি। জিঙ্গার ব্রেড আদতে ময়দা, নানান মশলা, মধু, চিনি, মাখন, তেল ইত্যাদির মিলমিশে তৈরি হওয়া একপ্রকার ব্রেড অর্থাৎ রুটিই। আর লেবকুখেন? স্বাদের বিশেষত্বের কারণে তাকে রাখতে হবে কেক আর রুটির মাঝামাঝি জায়গায়। আর হ্যাঁ, একটি মৌলিক তফাতও আছে। বাদাম লেবকুখেনের একটি অপরিহার্য উপাদান এবং অভ্রান্তভাবে বলা যেতে পারে এই বাদামের উপস্থিতিই এই বস্তুটিকে একাধারে করে তুলেছে স্বতন্ত্রভাবে জার্মান। মারৎসিপানের কথা কি আপনাদের মনে আছে? উপরিভাগ মুচমুচে কিন্তু নরম, জিভের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায় এর অভ্যন্তর। যাই হোক, আমাদের বড়দিনের খাওয়া কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। লেবকুখেনের পর আসতে পারে ফন্দ্যু (একে নিয়ে সবিস্তারে আগেই লিখেছি) এবং শেষ পাতে স্টোলেন। সঙ্গে পানীয় হিসেবে গ্লুওয়াইন (যাকে মাল্ড ওয়াইনও বলা হয়ে থাকে) বা হ্বাইনাখটস্‌পুনশ অর্থাৎ ক্রিসমাসপাঞ্চ। এই ক্রিসমাসপাঞ্চ পানীয়টি আসলে নানান বর্ণ এবং স্বাদের সমাহার। যার মধ্যে লাল ওয়াইন ছাড়াও থাকে চকোলেট, মারৎসিপান আর রাম। চিনি, আস্ত দারুচিনি, লবঙ্গ, লেবুর রস এবং কমলালেবুর রস সম্মিলিত সৌরভ ভিত্তি তৈরি করে এই বিশেষ পানীয়ের। সুদৃশ্য পেয়ালায় এই বিশেষ পানীয়টি পরিবেশিত হলে সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে ঘরময়। চুপিসারে বলি, এই বিশেষ পানীয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত মোলাকাত হয়নি এখনও। বন্ধুদের মুখে শোনা গল্প আর এ বিষয়ে অল্পবিস্তর বইপত্র নেড়েচেড়ে যেমন মনে হল, তাই লিখে ফেললাম। তবে একেবারে যে এ বিষয়ে কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়নি, এমনও নয়। এর এক তুতো ভাইয়ের (বা বোনের) সঙ্গে অনেক বছর আগে পরিচয় করিয়ে দেয় যশোধরা, আমার এক বোন যশো। কবে থেকে, কেন জানিনা ক্রিসমাস ইভ- এ যশো আর প্রসেনজিতের (আদর করে বলি সাহেব) বাড়ি যাওয়াটা একটা নিয়মে পরিণত হয়েছিল। কোনও এক বছর দেখলাম পৌঁছনোর অব্যবহিত পর আমাদের হাতে এল ওয়াইন-রঙা একটি পানীয়। নাম জানতে চাওয়ায় স্বভাবসিদ্ধ হাসি উপহার দিয়ে যশো জানালো, তার নাম সাংরিয়া। চুমুক দিয়ে বুঝতে পারলাম শুধু ওয়াইন নয়, সেই তরলে লুকিয়ে রয়েছে অন্যান্য সুরাও আর রয়েছে ফলের টুকরো, যারা দীর্ঘ সময় সুরায় নিমজ্জিত থেকে অর্জন করেছে অন্যতর স্বাদ আর গন্ধ। সব মিলিয়ে সে যেন এক অন্য ভুবনে প্রবেশের ছাড়পত্র। কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য পরে সাংরিয়ার সুলুক সন্ধান করতে গিয়ে দেখেছি এর আদি নিবাস স্পেন এবং পর্তুগালে। এই ভৌগলিক সীমার বাইরে এই পানীয়কে সাংরিয়া বলে অভিহিত করা যাবে না। কিন্তু আমাগো ঠেকায় কেডা?

জার্মানিতে বড়দিন পালনের ভোজ নিয়ে যে এতকথা লিখে ফেললাম কিন্তু যদি সব পদের মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নিতে বলা হয়, প্রকৃত খাদ্যরসিকদের দশজনের মধ্যে ন’জন সম্ভবত চোখ বন্ধ করে তুলে নেবেন স্টোলেন – কে। স্টোলেন। জার্মান ক্রিসমাস পুডিং। এইটুকু বললে আসলে কিছুই বলা হয়না এ সম্পর্কে। সত্যিই অতুলনীয় এই সৃষ্টি।

১৩২৯ সাল। ড্রেসডেন অঞ্চলের নাউরুবুর্গের বিশপ আয়োজন করলেন কেক তৈরির এক প্রতিযোগিতা। সেই প্রথম আত্মপ্রকাশ করলো স্টোলেন। বিশপের এতই মনে ধরল নতুন এই কেকটি যে তার ছোটো একটি অংশ রেখে দিতে বললেন পরের বছরের জন্য। সেই থেকে এই সংরক্ষণের ব্যাপারটি পরিণত হল একটি সংস্কার এবং প্রথায়। অনেক জার্মান পরিবার আজও বড়দিনের পার্বণের সময় একটুকরো স্টোলেন সরিয়ে রাখে একবছরের জন্য, যাতে খাদ্যের অভাব ত্রিসীমানাতেও না আসে। সেযুগে স্টোলেন হতো বিশাল আকৃতির। কুড়ি তিরিশ পাউন্ড ওজনের সেই দৈত্যাকার কেককে বয়ে আনার জন্য প্রয়োজন হতো একাধিক মানুষের। আরও একটি জরুরি তথ্য এক্ষেত্রে উল্লেখ করা দরকার। ক্যাথলিক চার্চের অনুশাসনে সেযুগে বড়দিনের আগে একটা নির্দিষ্ট সময় জুড়ে খাবারে মাখন এবং দুধের ব্যবহার বন্ধ ছিল। পরবর্তীকালে পোপের বিশেষ অনুমতিক্রমে ড্রেসডেনে স্টোলেন তৈরির জন্য সেই অনুশাসন শিথিল করা হয়। সুতরাং একথা বলাই বাহুল্য আজকের স্টোলেন আর ছশো বছর আগেকার স্টোলেনের মধ্যে তফাত অনেক। দিন দিন উপাদেয় থেকে উপাদেয়তর হয়ে উঠেছে বস্তুটি। আশ্চর্য, স্টোলেন নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে হঠাৎ অনেক কথা লিখে ফেলে মনে পড়ে গেল স্টোলেনের এক দোসরের কথা। পানেত্তোনে। প্রায় একই মিশ্রণ থেকে তৈরি হলেও উপাদানগত ফারাক আছে। যেমন পানেত্তোনে হালকা ফুরফুরে, লম্বাটে। অন্যদিকে স্টোলেন আয়তাকার, ঠাস বুনোট। পানেত্তোনের ভিতরে থাকে চিনির রসে ডুবিয়ে রাখা কমলালেবুর খোসা আর কিসমিস। স্টোলেনের অন্দরমহল ঠাসা থাকে চিনির রসে মজানো লেবুর খোসা, চেরি আর মারৎসিপান। পানেত্তোনে যেন জার্মান স্টোলেনের ইতালিয়ান উত্তর। গুরুগম্ভীর, ধ্রুপদী জার্মান সিম্ফনির দিকে সামান্য দূরত্ব থেকে যেন করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে আছে ভুবনজয়ী ইতালিয়ান অপেরা। এর মধ্যে কোনটি বেশি মনোহরা, সেই তুল্যমূল্য বিচার নাহয় মুলতুবি থাক। অনবদ্য এই দুই ক্রিসমাস ডেসার্ট অধিষ্ঠিত থাক নিজ নিজ সিংহাসনে। আনা কারেনিনার কালজয়ী লাইনটি মনে পড়ে যায় আবার,‘সব অসুখী রুটিরা একইরকম কিন্তু প্রতিটি সুখী রুটি আলাদা আলাদাভাবে সুখী’।