ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক৭
শুধু রণজিৎদা নয়, মানস নয়, বদলে গেল অনেক কিছু, বদলে যাচ্ছিলাম আমিও।
শেষ শনিবারে প্রশান্ত বাড়ি গেছে। পরের শনিবারে হস্টেল বন্ধ হয়ে যাবে। এদিকে আমাদের গুরু পেটের অসুখে সিকরুমে ভর্তি হয়ে পেঁপে সেদ্ধ খাচ্ছে আর ভাবছে কবে ছাড়া পাবে!
গোটা ঘরে খালি আমরা দুজন। আমি আর বিপ্লব।
সেই এডিটোরিয়াল মিটিংয়ে ওর আমাকে নিয়ে সবার সঙ্গে তাল দিয়ে হ্যা--হ্যা একটুও ভাল লাগেনি। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে বিপ্লব যেভাবে আমার সাহিত্যবোধ বা কবিতাপ্রীতি নিয়ে ছ্যাবলামি করছিল, খোরাক করছিল। আমি তো বরাবর ওর জন্যে স্ট্যান্ড নিয়েছি। অন্যদের সঙ্গে ঝগড়া করেছি। । এত তু ব্রুটি!
আমি ওকে এড়িয়ে চলতে লাগলাম। ও আলাদা করে কথা বলার চেষ্টা করছিল, আমি পাত্তা দিইনি।
আমি টিউটোরিয়াল অব্দি ঘরেই এলাম না। বিপ্লব আমার দিকে বারবার অনুনয়ের চোখে তাকাচ্ছে। শেষে খেয়ে দেয়ে ঘরে এসে মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়লাম। ও বলল-- একটু কথা ছিল।
--কাল সকালে, এখন ঘুম পাচ্ছে।
রাত কত জানি না, কেমন দমবন্ধ হয়ে ঘুমটা ভেঙে গেল। বুকের উপর একটা চাপ। হাঁসফাঁস করে জেগে উঠি।
বিছানায় কেউ ঢুকেছে, ওর ওজনটা আমার গায়ের উপর এবং একী !আমাকে চুমো খাচ্ছে।
ধড়মড়িয়ে উঠে বসি। জোর করে বুকের উপর থেকে চাপটা নামিয়ে দিই।
বিপ্লব! এখানে কেন?
--রাগ করেছিস লাকি?
--চুপচাপ নিজের বিছানায় ফিরে যা!
-- এত রাগ করে না। আমাকে দুটো থাপ্পড় মার, কিন্তু কথা বন্ধ করিস না লাকি। তুই এমন করলে --!
উঃ কী অসহ্য ন্যাকা কথা বার্তা। কেমন যেন অম্বলের মত কিছু উঠে আসে। আমি মশারি থেকে হাত বাড়িয়ে লাইট জ্বালানোর চেষ্টা করি। ও আমাকে জড়িয়ে টেনে ধরে।
--কেন অমন করছিস? তুই চাইলে আমার সঙ্গে যা খুশি করতে পারিস।
-- আমি যা চাইব তুই দিবি/ সত্যি করে বল।
--এই তোকে ছুঁয়ে বলছি। বল তুই কী চাস?
--- অনেক কিছু। চাই তুই এক্ষুণি নিজের মশারির ভেতরে গিয়ে ঢুকবি। চাই কাল থেকে আমাকে প্রদ্যুম্ন বলেই ডাকবি, কোন লাকি-মিতা নয়। কুকুরের নামে ডাকা আমার পছন্দ নয়।
ও অবাক হয়ে বসে থাকে।
আমি বিছানা থেকে নেমে লাইট জ্বালিয়ে দিই।
-- কী হল , যা!
ও কেমন লাথি খাওয়া নেড়ি কুকুরের মত ভয় ও আশায় আমার দিকে তাকায়। তারপর নেমে যায়। আমি কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে নিয়ে ঢকঢক করে খাই। তারপর আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ি।
পরের দিন থেকে আমাদের মধ্যে কথাবার্তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।
********************************************************
গরমের ছুটি কাটল একটা ঘোরের মধ্যে।
স্কুল খুললেই হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা। বাংলা ইংরেজি ঠিক আছে। ইকনমিক্স ও সংস্কৃত চলেগা। কিন্তু অংক?
সেই যে বছরের গোড়ায় সরস্বতীপুজোর সেক্রেটারিগিরি করার আনন্দে পিছিয়ে পড়েছিলাম, তারপর ক্রমশঃ -আমি যত চলি তত, যাই চলে যাই বহুদূরে।
ট্রিগোনোমেট্রির কম্পাউন্ড অ্যাংগেল কি যথেষ্ট নয়? আবার মাল্টিপল/সাব-মাল্টিপল এসব কেন? এগুলো কী কাজে আসে? তারপ্র দেকার্ত বলে দার্শনিকের মাথায় পোকা নড়েছিল, তাই একটা বিন্দুর লোকাস না সঞ্চারপথ নিয়ে সংজ্ঞা বানাতে গেলেন, কেন রে বাবা? ভগবান টগবান নিয়ে ভাবা কি যথেষ্ট নয়? একটা স্ট্রেট লাইন -- তাকে কতরকম ভাবে বলা? গ্র্যাডিয়েন্ট, ইন্টারসেপ্ট, প্যারালাল, পারপেন্ডিকুলার ডিসট্যান্স--যা তা!
কিন্তু এসবকে ছাড়িয়ে উঠেছে একটা অপরাধবোধ, একটা ভয়। এই হোস্টেল-লাইফ কি আমাকে ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক করে দিচ্ছে? যৌনতা , স্বাভাবিক/অস্বাভাবিক আমাদের কুরে কুরে খায়।
শরীর বদলে যাচ্ছে, আমরাও কি বদলাচ্ছি না ? যাদের গোঁফের রেখা নাকের নীচে মন্দমন্থরে দেখা দিচ্ছে তারা বন্ধুদের সার্কেলে হীনমন্যতায় ভোগে। মাকুন্দ বলে একটি নতুন অভিধার সঙ্গে পরিচয় হয়। একজন আঙুলের ডগায় ঘি নিয়ে আরেকজনের নাকের নীচে গালে ঘসে দেয়, সে শিউরে ওঠে। ব্যাপারটা হাতাহাতি পর্য্যন্ত গড়ায়। কেননা সবাই বিশ্বাস করে ঘি লাগালে গোঁফদাড়ি গজাবে না। গাল থাকবে মেয়েদের মত নরম পেলব হয়ে।
না, আমরা কেউ মেয়ে হতে চাই না, কিন্তু মেয়েদের চাই।
এদিকে কথা হয় দেখা না দেখা স্বপ্ন নিয়ে। রমেন কমিক ঢঙে আবৃত্তি করে পাঠ সংকলন থেকে বিহারীলাল চক্রবর্তীর 'অরণ্য'।
"নিঃস্তব্ধ গম্ভীর ঘোর নিবিড় গহন,
ঘনপত্র ঝোপে রুদ্ধ রবির কিরণ"।
তারপর এক ঝটকায় প্যান্ট নামিয়ে দেয়। ও আমাদের চেয়ে এক বছরের বড়। আমরা সুন্দরবন দর্শন করে শিহরিত হই।
আরও বুদ্ধিমান কেউ আশ্রমের পাঁচিলের বাইরে শুকতারা সিনেমার ফুটপাথ থেকে জোগাড় করে এনেছে 'সচিত্র কোকশাস্ত্র'। কোন কাশ্মীরি কোকা পন্ডিতের লেখা নাকি। সপ্তাহের ভাড়া আট আনা। সিনিয়ররা বোঝায়--এখন এটাই ঠিক টেক্স্টবুক; বড় হলে কামসূত্র পড়বি।
পাতলা চটি বইটা হাতে হাতে ঘোরে। তারপর বইওলা ফেরত নিয়ে নেবে।
এইভাবে আমরা সমস্ত পুরুষ ও নারীকে চার -চারটি ক্যাটেগরিতে ভাগ করতে শিখি। নিজেদের আত্মদর্শনও হয়।
এইসব নবলব্ধ জ্ঞান আমার মনে আরও আতংকের সৃষ্টি করে। স্কুলের পরীক্ষায় পাশ করতেই হবে, ভাল ভাবে। নইলে কলেজে অনার্স পাব না। কিন্তু বৃহত্তর জীবনের পরীক্ষায় ? সেখানে কি পাসকোর্সই নিয়তি?
গরমের ছুটিতে তাই কোলকাতায় ফিরে পার্কসার্কাসের ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করি। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ময়দানে ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাই, সমর্থনে গলা ফাটাই।
আর বারবার আউড়ে চলি--আমি নর্ম্যাল। বিপ্লব লাকি/মিতা এসব ফালতু। এদের থেকে দুরে সরে যেতে হবে। আমি বিপ্লবের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করেছি। বেশ করেছি, ঠিকই তো। পুরনো খবরের কাগজ ওজনদরে বেচে দিয়ে সেই পয়সায় দেখি ' ওয়ার্ল্ড বাই নাইট', 'ওরিয়েন্ট বাই নাইট', 'আমেরিকা বাই নাইট' । কিন্তু এসব দেখে মুখ থেকে বেরোয়-- ধুর বাল।
আমি এখন আর পোদো নই, প্রদ্যুম্ন।
মেট্রো সিনেমায় সোফিয়া লোরেনের "টু উইমেন" দেখতে গেলে হাফপ্যান্ট পরা প্রদ্যুম্নকে ছ'ফিটের প্রবাদপ্রতিম গেটকিপার ঘাড় ধরে ৬৫ পয়সার লাইন থেকে বের করে দেয়।
সমবেত হাসির মাঝে ও আবার পোদো হয়ে যায়, কিন্তু হাল ছাড়ে না। কোন এক রোববারের মর্নিং শোতে গড়িয়াহাটের আলেয়া সিনেমায় একই সিনেমা ৪১ পয়সায় দেখে নিয়ে পুরোপুরি প্রদ্যুম্ন হয়ে ওঠে।
গরমের ছুটির পরে হোস্টেল খুলতেই আবার চমক। প্রদ্যুম্নদের 'গ্যাং অফ ফোর"কে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। নাটের গুরু অমিয়দা ও তার তিন কেলে হাঁড়ি --যথা ডান হাত প্রশান্ত ও বাঁ-হাত প্রদ্যুম্ন ও তার সাথী বিপ্লব সব আলাদা ঘরে। এবং প্রত্যেকে নিজের নিজের ঘরে ক্যাপ্টেন। এদের ঘরে অন্য চারজন নাইন ও সেভেনের। ফলে এদের কামরায় কোন ভালমন্দ কিছু ঘটলে এরাই ক্যাপ্টেন হওয়ার সুবাদে দায়ী থাকবে।
নিকুচি করেছে ক্যাপ্টেনগিরির!
প্রদ্যুম্ন বোকার মতন মেজমহারাজকে বলতে গেল যে ক্যাপ্টেন হতে চাই না-- এবং গুছিয়ে প্যাঁক খেল। মেজমহারাজ পুলিশি ভোল পাল্টে মুচকি মুচকি হেসে ওকে বোঝালেন যে ওর মধ্যে লীডারশিপ কোয়ালিটি, পার্সিভিয়ারেন্স, ট্রুথফুলনেস এই সব দেখেই ওকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ও যেন এমন সুযোগ হেলাফেলা করে নষ্ট না করে।
-- আরে তুমি তো আশ্রমের ভাল চাও। কোন অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ কর। আমাদের কাছে কম্প্লেন নিয়ে আসতে থাক। মহারাজ এ হয়েছে, সে হয়েছে--একটা বিহিত করুন। তাই মনে হল তোমার মত ছেলেদেরই দায়িত্ব দেওয়া হোক।
--- কিন্তু মহারাজ, আমাদের রুমে নিজেদের ক্লাসের কোন ছেলে নেই, সব জুনিয়র। তাই বলছিলাম কি অন্ততঃ একজন নিজের ক্লাসের না হলে--।
--- দেখ, টিউটোরিয়াল তো ক্লাস-ওয়াইজ হবে। তোমাদের মত ইন্টেলিজেন্ট ছেলেদের জন্য ওটাই যথেষ্ট।
--- কিন্তু ক্লাস এইটের ছেলেদের তো প্রশ্রয় দিচ্ছেন। ওরা তো আগের মত নিজেদের ব্যাচের ছেলেদের সঙ্গেই রুম পেয়েছে।
-- আরে কোথায় তোমাদের মত পড়ুয়া সুপার-ইন্টেলিজেন্ট ছেলেদের গ্রুপ আর কোথায় ক্লাস এইটের বখা ছেলের দল! ওদের সঙ্গে তুলনা করে নিজেদের ছোট কর না। তাছাড়া ওরা হল ছোট, যখন তোমাদের মত লায়েক হবে--।
রাগে গরগর করতে করতে পোদো নিজেদের রুমে ফিরে এল।
এছাড়া ওদের দোতলা থেকে নামিয়ে একতলায় রুম দেওয়া হয়েছে, আর ক্লাস এইটের ছেলেরা দোতলায়। ফলে ছোট ছাদের আড্ডা আর সিগ্রেট খাওয়ার স্বাধীনতা ওদের একচেটিয়া হয়ে গেল। এখন রণজিৎদা ওদের ওয়ার্ডেন।
আর পোদোদের কপালে জুটেছে জনৈক বীরেশদা, যিনি সিনিয়র বেসিক স্কুলে পড়াতেন। রবীন্দ্রনাথের নাটক ও অন্যান্য আধুনিক নাটক বেশ ভাল পরিচালনা করেন। পোদো ওর 'শারদোৎসব' ও 'হাস্যকৌতুক' প্রযোজনার মুগ্ধ ভক্তদের একজন। তবে ইদানীং উনি সন্ন্যাস নেবেন বলে সাদা পোষাক আর কাছা না দিয়ে ধুতি পরা শুরু করেছেন। মাথা কামিয়ে নিয়েছেন, নাম হয়েছে ব্রহ্মচারী প্রাণচৈতন্য।
বোঝা যাচ্ছে যে এই নতুন ব্যব্স্থার সঙ্গে আন-সলভড্ অ্যাসিড কান্ডের নিবিড় সম্পর্ক।
পরের দিন গুরু অমিয়দার ঘরে মিটিং। সবাই মিলে পোদোকে খোঁচাল-- কেন না ভেবে মহারাজের কাছে দরবার করতে গিয়েছিলি? মেজমহারাজ খুব খুশি, ভাবলেন যে তোকে আমরাই ডেলিগেট করে পাঠিয়েছি। আর এও বুঝলেন যে তির লক্ষ্যভেদ করেছে। নতুন ব্যবস্থায় আমরা খাবি খাচ্ছি।
আর এদিকে আমাদের স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে নির্বিকার থাকা, দেখানো যে কোন অসুবিধে হচ্ছে না। তোর গাধামিতে এইটের ছোকরাগুলো হাসির খোরাক পেয়ে গেল। না জিগ্যেস করে একা একা কিছু করবি না , বুঝলি?
পোদোর মাথায় টিউবলাইট জ্বলে ওঠে।
--- গুরু, আমিই ঠিক।
--মানে?
-- ভেবে দেখ, যদি ওরা বোঝে যে আমরা বিচলিত, নতুন ব্যবস্থায় কষ্টে আছি তো যারপরনাই খুশি হবে, তাই তো?
-- হ্যাঁ; তো? এতে তোর কী লাভ হল?
--- লাভ এই যে ওরা আর আমাদের পেছনে লাগবে না। যদি ভাবে যে আমরা দিব্যি আছি, কোন প্রবলেম নেই তো ওরা ভেবে ভেবে নতুন প্রবলেম তৈরি করবে। নতুন ফিকির খুঁজবে যাতে আমরা সত্যি সত্যি অসুবিধেয় পড়ি। তার চেয়ে-- ।
গুরু কোন কথা না বলে ওর প্যাকেট থেকে পোদোকে দুটো পানামা এগিয়ে দেয়।
যাই বলি আর যাই করি, ভেতরে ভেতরে বুঝতে পারি যে হেরে গেছি।
মনটা ছটফট করতে থাকে কিছু একটা করে দেখিয়ে দিতে, ছেলেদের কাছে বাহবা পেতে। করব শালা একটা গেরিলা অ্যাকশন। কাউকে বলব না , গুরুকেও না। দেখিয়ে দেব যে আমি ডানহাত না বাঁহাত। কিন্তু একাই করব? যদি স্ট্র্যাটেজিতে কোন ভুল হয়? ক্লাস এইটের সংস্কৃত বইয়ে একচক্ষু হরিণের গল্পের মত?
ইউরেকা! পেয়েছি। আমারই রুমের ক্লাস নাইনের ছেলে প্রেমাংশু। ও একটু আমার ন্যাওটা, বই পড়ে, কিন্তু খেলাধূলোয় কম যায় না। হোস্টেলের বারান্দায় রবারের বল দিয়ে ফুটবল খেলার সময় ওইটুকু জায়গার মধ্যে অসাধারণ ইনসাইড ড্রিবল করে। ওকে আস্তে আস্তে কাল্টিভেট করতে হবে।
একদিন ও আমার কাছে ট্রিগনোমেট্রির হাইট এন্ড ডিস্ট্যান্সের অংক বুঝতে এল। আমি বললাম-- একটা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাপ্লিকেশন দেখবি? কাউকে বলবি না তো?
--এই বিদ্যা ছুঁয়ে বলছি, কাউকে না।
ওর চোখ চক্চক করে।
--- বেসিক হল পিথাগোরাস থিওরেম। হাইট, বেস, হাইপোটেনিউস।
-- কিছু বুঝলাম না, প্র্যাকটিক্যালটা কী?
-- বলছি। মনে কর, ভাঁড়ার ঘর থেকে এককাঁদি কলা সরাতে হবে। দরজায় তো তালা। কী করে করবি? এন্ট্রি পাথ কোথায়? একটু ভাব দেখি।
-- কলতলার দিকের খোলা জানলা।
-- করেক্ট। জানলার নীচের পাট বন্ধ, ওপরের পাট খোলা। এবার?
-- জানলার শিক ভাঙবো?
--- ধ্যেৎ; জানলা দিয়ে একটা লম্বা, মুখ বাঁকা লোহার শিক ঢুকিয়ে কলার কাঁদিতে ফাঁসিয়ে জানলা অবদি টেনে আনব। তারপর কলাগুলো একটা একটা করে ছিঁড়ে বের করে নেব। ব্যস্।
-- দারুণ তো! কিন্তু এর মধ্যে আবার পিথাগোরাস কেন?
-- আরে শিকের সাইজ ? ছোট হলে চলবে না। বেশি বড় হলে নিয়ে যাওয়া মুশকিল। কত বড় দরকার কী করে বের করবি? আঁক কষে। এই বার যা পড়িয়েছি সেটা ভাব একটু।
ও খানিকক্ষণ চুপ করে মেজের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর উত্তেজিত হয়ে আস্তে আস্তে বলে--একটা কথা মাথায় এসেছে , রাগ করবে না, বলি?
দেখ, ফ্লোর লেভেল থেকে জানলার হাইট হল সমকোণী ত্রিভুজের লম্ব; জানলার উচ্চতা থেকে ফ্লোরে রাখা কলার কাঁদিতে তাকালে সেটা হবে অ্যাংগেল অব ডিপ্রেসন। আর ভূমি হল লম্বটির ফ্লোরের উপরের বিন্দু থেকে কলার কাঁদিটির দুরত্ব। তাহলে জনলা থেকে কলার কাঁদিটির দুরত্ব হল অতিভুজ বা হাইপোটেনিউস। এখন জানলার হাইট বাইরে থেকে মেপে নেওয়া যাবে। ভুমির মাপ চোখের আন্দাজে হয়ে যাবে। আর পিথাগোরাস থিওরেম থেকে হাইপোটেনিউস এর মাপটাও আন্দাজ করা জাবে। তাহলে লোহার বাঁকামুখ শিকের দৈর্ঘ্য ওই অতিভুজের চেয়ে সামান্য বেশি রাখতে হবে।
এমন গুরুমারা চ্যালার মুখোমুখি হয়ে আমার মুখে কথা ফোটে না। খালি বলি-- দু'দিনের মধ্যে শিকটা জোগাড় করে কলতলার কুয়োর পাশে ফেলে রাখ আর আমাকে দেখিয়ে দে। আর অংকটা কষা হয়ে গেলে আমাকে আগে দেখাবি।
প্রেমাংশুর এলেম আর উৎসাহ আছে। চোখের আন্দাজ থেকে লম্ব ও ভূমির মাপ ও তার থেকে হাইপোটেনিউসের দৈর্ঘের হিসেব কষে ফেলে আমাকে দেখায়। জোগাড় করে ফেলে শিক। মাপে একটু বড়, সেটাই তো দরকার। তারপরে এল সেই দিন।
অপারেশন কলার কাঁদি!
সময় ঠিক করেছি রাত দুটো। সবাই গাঢ় ঘুমে। বারান্দায় কোন লাইট নেই। আর ওকে বলেছিলাম মশারি না টাঙিয়ে শুতে, আমিও তাই। ফলে মশার কামড়ে আন্দাজ দেড় থেকে দুটোর মধ্যে ঘুম ভাঙবে।
ঠিক তাই হল। দুজনে ঘুম থেকে উঠে এক এক করে কলতলার পাশের বাথরুমে চলে গেলাম। তার পর কুয়োর পাড় থেকে শিকটি তুলে সোজা ভাঁড়ার ঘরের পেছনে।
জানলার কাঠের ফ্রেমে পা দিয়ে উঠে একটু ঠেলতেই কপাট খুলে গেল। সেখান থেকে শিক ঢুকিয়ে একটা বড় সড় কাঁদি টেনে জানলার কাছে এনেও শিকের ফাঁক দিয়ে বের করা গেল না।
অতঃ কিম্?
- আমি কাঁদিটা টেনে রাখছি, তুই একটা একটা করে ছিঁড়ে শিকের ফাঁক দিয়ে বের কর। গোটা পনের বের করা গেল।
তখন অন্ধকার কুয়োর পাড়ে বসে দুজনে মিলে সেগুলো শেষ করলাম।
- প্রদ্যুম্নদা, অতগুলো খেতে পারছি না। পেট আইঢাই করছে, ট্রাংকে লুকিয়ে রাখি?
-- খবরদার না; কাল সবার বাক্স সার্চ হবে, বামাল ধরা পড়ার সম্ভাবনা। যা পারিস খেয়ে নে, বাদবাকি জানলা গলিয়ে আবার স্টোররুমে ফিরিয়ে দিলেই হবে। খাবার জিনিস নষ্ট করা ঠিক নয়।
অপারেশনের সাফল্যে আমাদের আনন্দ আর ধরে না। হাসি কুলকুলিয়ে ওঠে।
কুয়োর পাড়ে কলা খেতে খেতে প্রেমাংশু জিগ্যেস করে--- আচ্ছা, তোমার ভূতের ভয় করে না? এই অন্ধকার কৃষ্ণপক্ষের রাত!
--- করত; এখন আর করে না।
-- আবার দেখ, একটা কালো কুকুর ঘুরঘুর করছে। আচ্ছা, কালো কুকুররা নাকি আসলে পিশাচ, নাকি প্রেতাত্মা? সত্যি ভয় করে না?
-- যত্ত বাজে কথা।
শোন, বছর দুই আগে বাথরুম পায়খানা ওই পুকুরপাড়েই ছিল। একবার রাত্তিরে পেটে দিল আমাশার মোচড়। মাঝরাত; ভয়ের চোটে চোখ বুজে মশারির মধ্যে মাথা গুঁজে পড়ে রইলাম। কিন্তু আমাশা বলে কথা।
উঠে চোখ বুঁজে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পুকুরপাড়ের দিকে দৌড় লাগালাম। পায়খানা পর্যন্ত পৌঁছনো গেল না। প্যান্ট নষ্ট হবার জোগাড়। পুকুরপাড়ে মাটিতে বসে পড়লাম। ওদিকে মজাপুকুরের পাড়ে সারি সারি নারকোল গাছ হাওয়ায় দুলছে। একটা কালো কুকুরও জুটে গেল, সে আমার পেছন পেছন চেটে চেটে মাটি সাফ করে চলেছে। ব্যস্, আমাশার কাছে ভুতের ভয় হেরে গেল।
এবার চোখ ঘুমে ঢুলে আসছে।
কিন্তু প্রেমাংশুর উৎসাহ বেশ সংক্রামক।
--- প্রদুম্নদা, একটা কথা বলি? স্ট্যান্ডে ঝোলানো ঘন্টা খুলে নিলে কেমন হয়?
উত্তরে আমি কোন কথা না বলে সোজা ওটা খুলে নামিয়ে নিয়ে এলাম।
--এবার?
--- চল, সোজা বড় পাতকো'র মধ্যে ফেলে দেব।
যেই ভাবা, সেই কাজ।
--চল, এবার শুয়ে পড়ি।
--- দাঁড়াও, আমার একটা আধা মাস্টার কী মত আছে। স্টোরের তালা না খুললেও অন্য একটা ঘরের তালা খুলে যায়।
--অ্যাই কাদের ঘরের?
--মানসদাদের।
-- চুপচাপ খুলে নিয়ে আয়। তারপর ওয়ার্ডেন রণজিৎদার ঘরে লাগিয়ে দে। আমি গার্ড দিচ্ছি।
পরের দিন সকালে আমাদের ঘুম ভাঙল বেলা করে। উঠে শুনি তুলকালাম কান্ড।
হস্টেলের ঘন্টা গায়েব! আদ্দেক ছেলে প্রেয়ার হলে যেতে পারেনি। ওয়ার্ডেন রণজিৎদা সকালে দরজা খুলে বেরোতে পারেন নি। বাইরে থেকে কেউ তালা মেরে দিয়েছে। ঘুমচোখে তলপেটে চাপ নিয়ে উনি ঘরে আটকে!
অন্য কর্মচারিরা অফিস থেকে ডুপ্লিকেট কী এনে তালা খোলে। ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছল।
অন্যায়! ঘোরতর অন্যায়! তদন্ত হোক, দোষীরা শাস্তি পাক!
কিন্তু বিকেল বেলায় মানস বেদম বেত খেল। ও এক্সপ্লেন করতে পারল না কী করে ওর ঘরের তালা মাঝরাত্তিরে ওয়ার্ডেনের ঘরের দরজায় লেগে গেল।
কুখ্যাত চামচ বা দালাল মানসের সাতদিন সাসপেনশনের খবরে আশ্রমে মলয় পবন বহিতে লাগিল। (চলবে)