গল্প - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
Posted in গল্প.
সকাল সাড়ে সাতটার সময় কলিং বেলের আওয়াজে দরজার পাশে দেয়ালে ফোনের সাথে ঝোলানো ছোট্ট টিভি মনিটরে ছবিটা দেখেই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল সুমনা। আজ একটা এস্পার-ওস্পার করেই ছাড়বে। রোজ-রোজ এতো দেরী কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়? ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক মহিলা, মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে। দরজা খুলতেই দেখা গেল ওপারে দাঁড়িয়ে মাঝবয়সী এক মহিলা, প্রতুল্যা, যিনি এবাড়ির কুক, অর্থাৎ আমরা যাকে বলি রান্নার মাসি। প্রতুল্যা মাঝবয়সী এক মহিলা, রোগা লিকলিকে, চোখে গোলগোল কালো ফ্রেমের চশমা, মাথায় বেশ লম্বা। মারাঠিদের মত কাছা দিয়ে শাড়ী পরা এবং শাড়ির আঁচলটি মাথায় দেওয়া। বুকের কাছে হাত জড়ো করে ঘরে ঢুকল, যেন অপরাধের ক্ষমা চাইছে। দেরী করেই এসেছে। সুমনা একটু আগেই রাগত গলায় কিছু বলেই যাচ্ছিল একটানা । প্রতুল্যাকে দেখে একেবারে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল।
--কাহে কো দের?’ গম্ভীর গলা সুমনার, ভুরুও কোঁচকানো।
-ঔর না হোয়েঙ্গা’ প্রতুল্যার বিনীত উত্তর।
-কিত নে বার? ফির আজ কিস বাত কি? বোলো…ইয়ে থা…ওহ্ থা…বোলো, বোলো…’ একটানা বলে চলে সুমনা। আজ সে রেগে গেছে। সকালবেলা নিজেদের দুজনের অফিস, বাচ্চাকে স্কুল পাঠানো, সকলের টিফিন- লাঞ্চ তৈরি করা, ছেলেকে রেডি করা, নিজেরা রেডি হয়ে একসাথে বেরোনো… তাড়াহুড়ো থাকে বলেই না এইসময় লোক রাখা! আর এইসময়েই যদি সে রোজ রোজ দেরী করে আসে, দরকার কি? তুমি দিনের পর দিন দেরী করে আসবে আর হাত জোড় করে দাঁড়াবে—নেহী হোয়েঙ্গা’ বলবে…সুমনা শুনবে না। হয়ত বলতেই যাচ্ছিল---তুম লৌট যাও, নেহি চাহিয়ে কাম’ কিন্তু ততক্ষণে সীতাংশু এসে সামাল দেয়।
--দেখো আম্মা, দের করনে সে ফায়দা তো হ্যায় নহী , গুসসা ভী হোতা হ্যায়। ঔর তুমকো ভী শুন্না পড়তা হ্যায়। যাও, লগ যাও কাম পে…’
--নেই হোয়েঙ্গা বাবা, নেই হোয়েঙ্গা বচ্চী…’ একবার সীতাংশুর দিকে আর একবার সুমনার দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে রান্না ঘরে ঢুকে পড়ে সে। সুমনাকে সে ‘বচ্চী’ বলে ডাকে। আর তাই সুমনার ছেলেও তাকে ডাকে-‘নানী’ অর্থাৎ দিদিমা।
আটটা বাজতে না বাজতেই ঘর খালি করে বেরিয়ে পড়ে তিনজনে। ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে সীতাংশু যাবে নিজের অফিসে। সুমনার চাকরি বাড়িতে বসেই, সে আইটিতে কাজ করলেও তাকে রোজ অফিস যেতে হয়না, কিন্তু মাঝে মধ্যে দরকার পড়লে যেতে হয়। যেমন-আজ। বাড়িতে থাকলে কাজের লোক না এলে অসুবিধে হলেও সামলে নিতে পারে, কিন্তু তাকেও যদি বেরোতে হয়, রাগ হওয়া স্বাভাবিক। এত সব একহাতে এত তাড়াতড়ি করা যায়? কিন্তু প্রতুল্যার যে কি হয় মাঝে মাঝে, ওই জানে! টা টা-বাই বাই পর্ব শেষ করে এক কাপ চা নিয়ে সোফায় এসে বসি। এখানকার ফ্ল্যাটগুলোর সব ঘরেই একটা করে গোটা দেওয়াল সাদা পুরু কাঁচের । দুটো করে পর্দা দিয়ে ঢাকা। একটা স্বচ্ছ সুন্দর নেটের পর্দা, আর একটা গাঢ রঙের মোটা পর্দা। সকালে মোটা পর্দা টেনে সরিয়ে পাতলা নেটের পর্দা কিছুটা সরিয়ে দেয় সুমনা। ঘরের মধ্যে আলো এসে পড়ে, দেখতে ভারি ভালো লাগে। ওদের এই বসার ঘরের কাঁচের দেওয়াল থেকে বাইরের পৃথিবীর অনেক কিছু দেখা গেলেও ওদের যাওয়াটুকু দেখতে পাওয়া যায় না, ওরা অন্য রাস্তা দিয়ে যায়। বসে বসে কাঁচের দেওয়ালের ভিতর দিয়ে শুধু বড় বড় ইমারত দেখি, আকাশ দেখি, পাখিদের ওড়াউড়ি দেখি। সকালের সূর্যোদয় আর বিকেলের সুর্যাস্ত দেখা যায় এই বাড়ির সব ঘর থেকেই। আর দেখা যায় চারিদিকে ইমারতের কারখানা। কে কত বড়, কে কত উঁচু বাড়ি নির্মাণ করতে পারে, যেন তারই প্রতিযোগিতা চলেছে। একটা যদি পঁয়ত্রিশ তলা বিল্ডিং তো পাশেরটা চল্লিশ তলা। আবার তার পাশেরটা হয়ত ছাপান্ন। ভয় করে, ভেঙ্গে না পড়ে। চায়ের কাপে মুখ ডুবিয়ে চারিদিক দেখতে দেখতে এসব কথাই ভাবি।
প্রতুল্যা রান্নাঘর থেকে উঁকি মারে একবার। জিজ্ঞাসা করি—চায় পিয়া?’
মাথা নাড়ে সে। চুপ করে থাকি। চা খায় না, নাকি এখানে রান্নার মাসিকে চা দেবার নিয়ম নেই। সুমনা অফিস থেকে এলে জিজ্ঞেস করতে হবে। আমরা তো ওখানে দিই। রুটি-চা, নিদেনপক্ষে দুটো বিস্কুট, এককাপ চা। দিই না?
কি ভেবে জিজ্ঞেস করি—চায় পিতা নহী, কেয়া?’
এবার দুটো গাজর আর ছুরি হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে প্রতুল্যা। বুঝলাম সে সবজি কাটছে রান্না করবে বলে, সুমনা বলে গেছে । সামান্য একটু এগিয়ে এসে বলে—গুস্সা হোয়েঙ্গা।‘
--কওন, বচ্চী?’
--নাহ্ সিক্রিটি…’ বলেই রান্নাঘরে ঢুকে গেল। বোঝা গেল, এখানে সিকিউরিটি খুব কড়া, সেখান থেকে নিষেধ আছে, জানতে পারলে বকুনি খাবে। নিষেধ এড়িয়ে আমিও আর কিছু বলতে সাহস করলাম না। কিছুক্ষণ পর প্রতুল্যা এসে হাতজোড় করে একবার দাঁড়িয়ে দরজাটা টেনে দিয়ে চলে গেল। মানে নমস্কার জানিয়ে গেল। রান্নাঘরে ঢুকে দেখি রান্নাঘরের একদিকে সব গুছিয়ে রান্না করে রাখা, গ্যাস ধুয়েমুছে পরিষ্কার আর একদিকে যাবতীয় বাসনপত্র মায় ছোট চামচ, ছাঁকনি পর্যন্ত ডাঁই করে সিঙ্কে নামানো। এসব ধোয়ার কাজ করে যে মেয়েটি, মণীষা সে এসে করবে। মণীষাও মারাঠি মেয়ে তার কাজ বাসন ধোওয়া, ঘর মোছা, মেশিন থেকে কাপড় বের করে ঘরে র্যাকে গুছিয়ে মেলে দেওয়া আর সবশেষে বাথরুম পরিষ্কার করে দরজা টেনে দিয়ে চলে যাওয়া। কিন্তু মণীষার আসতে এখনও খানিক দেরী আছে। সে আসে বেলা এগারোটা নাগাদ। আমি আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি।
(২)
সুমনা একালের মেয়ে, শিক্ষিত, কাজেরও। ঘরে-বাইরে খাটতে পারে খুব। হাসিখুশি মুখ সবসময়। কতদিন এসেছে এ-বাড়িতে বৌ হয়ে, কিন্তু এখনও সেই আগের মতই। মেয়েটাকে বড্ডো ভালোবেসে ফেলেছি আমিও। সকাল ছটায় উঠে হাতমুখ ধুয়ে বাসী কাপড় পালটে আগের দিনের সব জামাকাপড় মেশিনে ঢুকিয়ে ঠাকুরকে ধূপদীপ দেখিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। চট্পট্ চা-জলখাবার, ওদের টিফিন, লাঞ্চ, এখানের দুপুরের রান্না সব রেডি করে চা খেতে খেতে ছেলেকে, সীতাংশুকে তোলে। ওরাও ততক্ষণে উঠে পড়ে। প্রতুল্যা এলে এসব কাজে কিছুটা হাত লাগায়। সবাই বেরিয়ে গেলে বাকি রান্না প্রতুল্যাই শেষ করে রেখে যায়। মুশকিল হয় সে না এলে। সীতাংশু ছেলেকে নিয়ে বে্রোলে সুমনা যায় নীচে পুলে সাঁতার কাটতে। সাঁতার থেকে ফিরে এসে স্নান করে জলখাবার খেয়ে সোজা নিজের অফিসের কাজ নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। প্রতুল্যা এলে তাকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায়। দেরী করে এলে কিছুটা অপেক্ষা করতে হয়। না এলে নিজেকেই সবটা করতে হয়। তার নিজের নিয়মে তখন বাধা পড়ে। আর তখনই মেজাজটা গরম হয়, যেমন কাল হয়েছিল। এর মাঝে আমার শরীর, আমার খাওয়ারও খবর নেয়। সবদিকে হুঁশ আছে মেয়েটার। এসবই ভাবি। আকাশপাতাল…কতরকম যে ভাবনা…বসে বসে ভাবতেই থাকি। তার ফাঁকে কখন যে মেয়েটা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে---আবার ভাবছো তো? এই জন্যই ছেলের কাছে বকুনি খাও…কি অতো ভাবো, তুমি? আচ্ছা, এখন কি ভাবছ বলো আমায়…। ‘ বলেই হিহি হাসিতে গড়িয়ে পড়ে। আমিও হেসে উঠি।
আজ সুমনা বাড়িতে। কিন্তু আজ প্রতুল্যা আসেনি। সীতাংশু ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে রান্নাঘরের কাজ কিছুটা এগিয়ে রেখে আমার কাছে এসে বললে—দেখলে তো মা, কাল এতো বকুনি খেয়েও আজ এলো না।‘ কিন্তু তার আর তখন বসে গল্প করার সময় নেই। হাতের কাজ সেরে নিয়ে ঢুকে পড়ল তার অফিসঘরে। আমিও বসে পড়ি অন্য একটা ঘরে আকাশ দেখতে। আগে একদিন বলেছি রান্নার কাজ আমি খানিকটা করে রাখি, তাতে ছেলে-বৌ দুজনেই হাঁ-হাঁ করে উঠেছে। বেড়াতে এসেছ, একেবারে বিশ্রাম নেবে। বেড়াবে আর আনন্দ করবে। যেন রান্না করলে আনন্দে ঘাটতি পড়ে। রাগ করি, কিন্তু কতক্ষণ?
দুপুরে ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে এসে সুমনা ছেলের জামাকাপড় সব পালটে, হাত্মুখ ধুইয়ে খাবার দিয়ে বসিয়ে আমার কাছে এলো। বললে—জানো মা, আজ প্রতুল্যা আসেনি তো, ওকে আজ গুলগুলের স্কুলের উল্টোদিকের একটা অরফ্যানেজের গেটের কাছে বসে থাকতে দেখলাম। কাঁদছিল…না, কাজ থাকতেই পারে, আমায় বলে গেলেই পারতো! আচ্ছা, ও ওখানে কেন যায়, মা? কাঁদছিল কেন, মা?’
ছেলেকে আদর করে সুমনা ‘গুলগুল’ বলে ডাকে। বললাম—ও কি অতো দূর থেকে আসে নাকি? হেঁটে আসে? গুলগুলের স্কুল তো খানিকটা দূরেই!’
--তা জানি না, আমরা যখন গাড়িতে যাই, বেশী সময় নেয় না। তবে অটো তে মিনিট দশ-বারো লাগে, যাওয়া-আসা প্রায় একশ টাকা/ আশি টাকা নেয় মা। ওরা কি পারে রোজ অতো টাকা দিতে? হেঁটেই আসে নিশ্চয়ই…’
---তাই হয়ত দেরী হয়ে যায়। সময় ঠিক রাখতে পারে না।‘ সুমনা কিছু বলল না, চুপ করে রইলো। তারপর গুলগুলকে আমার কাছে দিয়ে তাঁর অফিসের বাকী কাজ সারতে ঘরে ঢুকে পড়ল।
(৩)
পরের দিন কিন্তু প্রতুল্যা এল ঠিক সকাল সাতটায়। ওকে সব বুঝিয়ে দিয়ে সুমনা গেল ছেলেকে -স্বামীকে ডাকতে। সীতাংশুর গলা শুনতে পাই---নিজেই তো অনেকটা করে নাও, শুধু শুধু সে বেচারীকে বকুনি দিয়ে লাভ কি! দেখো হয়ত তোমার ভয়ে কোন কাজ ফেলে রেখে আজ চলে এসেছে…’ আর শুনতে পেলাম না, সীতাংশু বাথরুমে ঢুকল। সুমনা আমার গা ঘেঁসে এসে বসল। আমার হাতের চুড়িগুলো নিয়ে নাড়চাড়া করতে করতে বলল—মা, ওকে বলব?’ ইঙ্গিতে রান্নাঘর দেখালো। বললাম--- এখন না, ওরা চলে যাক, তারপর বলিস।‘
যথারীতি রোজকার মত সব গুছোনোর পালা, ওদের টা টা-বাই বাই পর্ব শেষ হওয়ার পর সুমনা আমার ও তার চা নিয়ে এসে বসল আমার পাশে। তার যেন তর সইছিল না। সে কি কেন আসেনি সেই কারণ জানার জন্য, নাকি কাল কামাইয়ের জন্য রাগ?
সুমনা ডাক দিল---আম্মা, কাল তুমি এলে না কেন? কালকে কিন্তু তোমাকে আমি দেখেছি গুলগুলের স্কুলের উল্টোদিকে একটা স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে। আমায় বলে গেলে না কেন? কেউ পড়ে ওখানে, কে পড়ে?‘ সুমনা ইচ্ছে করেই ‘অরফ্যানেজ’ কথার উল্লেখ করল না। প্রতুল্যা দাঁড়িয়ে আছে। সুমনার যেন হুঁশ ফিরল। খাবার টেবিলের একটা চেয়ার ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বসতে বলল। প্রতুল্যা বসল না। টেবিলের একটা পায়ায় ঠেস দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। সুমনা আবার বলল---তুমি রোজ ওখানে যাও, আর তাই ওখান থেকে আসতে তোমার দেরী হয়…তাই না? তুমি কি রোজ সকালে যাও? কে থাকে ওখানে, ওই স্কুলে কি কেউ পড়ে? তোমার বাড়ি ওদিকে নাকি, তুমি যে বলেছিলে অন্যদিকে?’
প্রথমে ফোঁটা ফোঁটা জল আর তারপর বাঁধভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে প্রতুল্যা। বিস্মিত আমি, সুমনাও কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ল। তারপর তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দি, কোঙ্কনী আর মারাঠি ভাষা মিশিয়ে সে যা বলে গেল আমি তার কিছুই বুঝলাম না। সুমনাই তা উদ্ধার করে যা জানালো তা হল---প্রতুল্যার মেয়ে ছিল একটা। এদের অল্প বয়সেই বিয়ে হয়। প্রতুল্যারও বিয়ে হয়েছিল তের বছর বয়সে, মেয়ে হয় পনেরো বছরে, স্বামী মারা যায় যখন, প্রতুল্যার বয়স তখন মাত্র আঠারো বছর। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তাকে আর রাখতে চায়নি। সেই থেকে সে একাই লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে মেয়েকে বড় করেছে। মেয়ে বড় হয়ে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে একটা অটো ড্রাইভারের সাথে মেয়ের ভাব হয়, বিয়ের ঠিক হয়, কিন্তু বিয়ের আগেই মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হলে ছেলেটির বাড়িতে বিয়েতে রাজি হয় না। বাড়ির লোকেরা রাজি না হলেও ছেলেটি তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু প্রতুল্যার কপাল খারাপ, মেয়েটি বাচ্চা হতে গিয়ে মারা যায়। আর বাচ্চাটির জন্মের সময় তার মা মারা গেলে তার বাবাও তাকে আর ঘরে নিয়ে যেতে চায়নি, কোনরকম সাহায্যও করেনি। কি করে সে মানুষ করবে বাচ্চাকে। সে তো নিজে থাকে একটা পলিথিন ঢাকা দেওয়া চালায় আর পাঁচজন কাজের মেয়ের সঙ্গে, ওখানে মানুষ করবে কিভাবে, তারাই বা বাচ্চাটাকে রাখতে দেবে কেন? তাই উপায় না দেখে ওইখানে দিয়ে এসেছিল তাকে। ওটা তো স্কুল নয়, ওটা একটা অরফ্যানেজ। ওখানেই সে বাচ্চাকে দিয়ে আসে। কিন্তু রোজ সকালে সে তাকে দেখতে যায়, তাই কোন কোন দিন আসতে দেরী হয়ে যায়। আর হবেনা…।‘ একটানা বলে সুমনাও হাঁপিয়ে গেল। প্রতুল্যা তখনও কেঁদেই চলেছে।
তাকে থামিয়ে সুমনা বলল---শোন আম্মা, তুমি তাহলে এবার থেকে বিকেলে এসো, আমার তাতেও কোন অসুবিধে নেই, আমি আগের দিন কাজ কিছুটা গুছিয়ে রেখে দিলে সকালে চালিয়ে নেব। ‘
প্রতুল্যার তাতেও দৃঢ ‘না’… বিকেলে যে অরফ্যানেজের গেটে বসে থাকে, বাচ্চারা খেলা করে, ওকেও দেখতে পায়। সে যেভাবে হোক, সকালেই আসবে। শুধু দেরী হলে বচ্চী যেন মাপ করে দেয়… হাতজোড় করে দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে যায় প্রতুল্যা।
সুমনাও শ্লথ পায়ে অফিসঘরে ঢোকে।
সোফায় বসে থাকি। চারিদিকে বিশাল ইমারতের মাঝে দেখি একটা চারতলা বিল্ডিং, যার গায়ে লেখা ‘মহারাষ্ট্র বিদ্যালয়’। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসছে, খেলা করছে। এসব দেখি আর বুকের ভিতর টনটনিয়ে ওঠে। সেকি ওই বাচ্চাটার জন্য? কি জানি!
সুমনার সঙ্গে সীতাংশুর কি কথা হয়েছিল, জানিনা। বিকেলে অফিস থেকে ফিরে দু’জনে মিলে ছেলেকে নিয়ে বাজারে গেল। যাবার আগে আমায় বলল---আগামীকাল গুলগুলের স্কুলে বড়দিনের পার্টি, বড়দিনের আগে কালকেই শেষ স্কুল, কিছু জিনিস কিনতে হবে, তুমি যাবে, মা? চলো, এইসময় মলগুলো খুব সুন্দর করে সাজায়, দেখে ভালো লাগবে। যাবে?’
আমি ‘না’ বলায় ওরা চলে গেল। একটু রাত করে ফিরল একগাদা বড় বড় কাগজের ব্যাগ নিয়ে। ওরা রাতের খাওয়া খেয়েই ফিরেছে। আমার জন্যও আছে একটা খাবারের প্যাকেট। বড় বড় কাগজের ব্যাগে গুলগুলের জন্য পার্টিতে পরে যাওয়ার লাল জামা, লাল জুতো, মাথায় সান্তার টুপি, দুটো বড় বড় প্যাকেটে চকোলেট সব বন্ধুদের দেবার জন্য। আর একটা কাগজের ব্যাগ আমার হাতে এগিয়ে দিল সুমনা—মা , দেখো কি এনেছি।‘
খুলে দেখি গুলগুলের চেয়ে একটু ছোট আর একটা লাল জামা, একজোড়া লাল মোজা, আর একটা সান্তার টুপি আর একবাক্স বড় চকোলেট। তাকিয়ে থাকি সুমনার দিকে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললে—কাল প্রতুল্যা এলে তুমি ওকে দিও মা, ও যেন স্কুলে গিয়ে বাচাচটাকে দিয়ে আসে।‘
সুমনাকে জিজ্ঞেস করলাম---‘প্রতুল্যা’ কি মারাঠি শব্দ? মানে কি, জানিস?’
সুমনা আমার দিকে চেয়ে বললে—‘অতুলনীয়া।‘
--বাঃ’ কথাটা বলেই সুমনাকে কাছে টেনে নিই। তাঁর মিষ্টি মুখের দিকে চেয়ে বলি--- কাল ওকে ব্যাগটা তুই নিজেই দিস, ও তাতে বেশি খুশি হবে।‘
সুমনা আমার জড়িয়ে ধরল।