অমৃত সদন - শামিম আহমেদ
Posted in অমৃত সদনএকলব্য একদিন ঘোড়ায় চেপে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এমন সময় নিষাদ পুরুষরা তাঁকে চার পাশ থেকে ঘিরে ধরল। ভালবেসে তারা বলল, এই তো আমাদের রাজা হিরণ্যধনুর পুত্র! এবার একলব্যকে আর ছাড়ছি না, ওকেই রাজা করব। হিরণ্যধনু বুড়ো হয়ে গিয়েছেন, তিনি বৃদ্ধ কথক ঠাকুর সেজে কাহিনি বলবেন।
হইচইয়ের মধ্যে একজন বৃদ্ধ নিষাদ বলে উঠলেন, না! একলব্য চন্দ্রবংশীয়, সে আমাদের রাজা হতে পারে না।
নিষাদ যুবকরা এ ওর মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।
বৃদ্ধ নিষাদ বললেন, আমরা সূর্যবংশীয় ভীল, একলব্য আমাদের ভালবাসার ধন বটে কিন্তু সে রাজা হিরণ্যধনুর পুত্র নয়। রাজা অপুত্রক; রাণী জাম্ববতীও নিঃসন্তান।
বিস্মিত একলব্য ঘোড়া থেকে নামলেন। তাঁর বয়স বেশি নয়, সবে আঠারোয় পা দিয়েছেন গত পূর্ণিমায়। ধনুকের ছিলার মতো কালো শরীরটাকে বাঁকিয়ে তিনি বৃদ্ধ নিষাদকে প্রণাম করে আবার ঘোড়ায় উঠে পড়লেন। বনের পূর্ব দিকে যে শিংশপা গাছের সারি রয়েছে সেখানে রাজার প্রাসাদ, সে দিকেই ঘোড়া ছোটালেন তিনি। প্রাসাদ মানে একটি মাটির বাড়ি, পাতার ছাউনি তার। দাওয়ায় মাটির ঢিপি। সপ্তাহান্তে একদিন সেই ঢিপির উপরে উঠে নিষাদদের সুখ দুঃখ আর সমস্যার কথা শোনেন রাজা হিরণ্যধনু।
ঘোড়া থেকে নেমে প্রাসাদের দাওয়ায় দেখতে পেলেন রাণী জাম্ববতীকে। তিনি উঠোন নিকোচ্ছেন লাল মাটি দিয়ে। ভীলরা গরু পোষে না, তাই গোবর দিয়ে উঠোন কিংবা দাওয়া নিকনো এদের রীতি নয়। একলব্য জাম্ববতীকে প্রণাম করে বললেন, মা! এ কী কথা শুনছি? তবে কি আমি তোমার আর বাবার সন্তান নই? আমার পিতামাতা তবে কারা?
জাম্ববতীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি কাদা হাতের উলটো পিঠে কপালের চুল সরাতে সরাতে বললেন, এই অশৈলি কথা কে বলল তোকে একলব্য? পেটে ধরিনি বলে কি আমি তোর মা নই?
“কে আমাকে পেটে ধরেছিল? আমার পিতাই বা কে?”
এমন সময় হিরণ্যধনু সেখানে এসে পৌঁছলেন। বন থেকে কিছু ফলমূল আর মধু সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন তিনি। ধামাখানি মাথা থেকে নামিয়ে রাজা বললেন, এত দিন আমরাই তো তোমাকে লালনপালন করেছি, তাই আমরাই তোমার মাতাপিতা!
একলব্য ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, তবে যে গ্রামবুড়ো বলল, তোমরা নিঃসন্তান—আমি অন্য লোকের ছেলে!
হিরণ্যধনু বুঝলেন, একলব্য বড় হয়েছে, তাকে সব কথা খুলে বলা দরকার। ইতিমধ্যে জাম্ববতী হাত ধুয়ে মাটির পাত্রে জল এনে দিয়েছেন রাজাকে। রাজা ঢক ঢক করে জল খেয়ে বললেন, শোনো তবে। বড় হলে সব কথা খুলে বলবো, ঠিক করেই রেখেছিলাম। তা যখন নিজে থেকেই শুনতে চাইছো, বলা আমার কর্তব্য।
মথুরায় বাস করেন দেবশ্রবা নামের এক পণ্ডিত মানুষ। জাতিতে ক্ষত্রিয় হলেও তাঁর শাস্ত্রজ্ঞান প্রবল। মথুরার রাজা কংস দেবশ্রবার দাদা বসুদেবের শ্যালক। কিন্তু রাজা বড় অত্যাচারী। যদু বংশের কোনও সন্তান জন্মালেই সে খুন করে ফেলছে। দেবশ্রবারা দশ ভাই, পাঁচ বোন। তাঁদের পিতা হলেন যদুবংশীয় শূরসেন। সবার বড় বসুদেব। বসুদেবের ছয় পুত্রকে হত্যা করেছে রাজা কংস। ধার্মিক বসুদেব কৌশলে সপ্তম ও অষ্টম পুত্রকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা সেখানেই বড় হচ্ছেন। এই রূপ হত্যালীলা দেখে দেবশ্রবা ও তাঁর স্ত্রী মথুরায় থাকতে ভয় পাচ্ছিলেন। দেবশ্রবার স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার পরে পরেই ওই দম্পতি আমাদের রাজ্যে চলে আসেন।
জাম্ববতীর চোখ সজল হয়ে ওঠে। তবে কি পুত্র একলব্য এখন মথুরায় চলে যাবে? রাজা কংসকে বধ করেছেন বসুদেবপুত্র শ্রীকৃষ্ণ। কংসের পিতা উগ্রসেনকে আবার রাজা করা হয়েছে। সে সব কথা শুনেছেন বিদেশি কথক ঠাকুরের মুখে।
রাজা হিরণ্যধনু বলেন, বসুদেবের ভাই দেবশ্রবার পুত্র হলে তুমি। তোমাকে আমাদের হাতে তুলে দিয়ে তাঁরা নিশ্চিন্তে মথুরায় ফিরে গিয়েছেন। শুনেছি তাঁদের আরও দুটি পুত্রসন্তান হয়েছে। মথুরা থেকে হস্তিনাপুর খুব বেশি দূরে নয়। বসুদেবের এক ভগ্নী পৃথার বিবাহ হয়েছে হস্তিনার রাজপুত্র পাণ্ডুর সঙ্গে। শ্রীকৃষ্ণ সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করেন। তিনি সম্পর্কে তোমার জ্যাঠতুতো দাদা।
একলব্যের কোনও ভাবান্তর হয় না। তিনি যেন অচেনা গল্প শুনছেন! যেমন একদিন চন্দ্রবংশীয় রাজাদের গল্প শুনেছিলেন গ্রামবুড়োর কাছে। বুড়ো শুনেছিল কথক ঠাকুরের কাছে। আকাশের চাঁদ কী করে পুত্রকন্যার জন্ম দিতে পারে, তা একলব্যের মাথায় ঢোকেনি, কিন্তু গল্পটি বেশ লেগেছিল তাঁর! চন্দ্রবংশের একটি অংশ হল যদু, আরেকটি কুরু। না, গৌরব হচ্ছে না মোটেও। বরং আরও বেশি করে মনে হচ্ছে, তিনি হিরণ্যধনু-জাম্ববতীর পুত্র—তিনি সূর্যবংশীয়। শিব তাঁর আরাধ্য দেবতা। তিনি চন্দ্রবংশীয়ও নন, বিষ্ণুর উপাসকও নন।
জাম্ববতী খাবার বেড়ে দিলেন একলব্য ও হিরণ্যধনুকে। নিজেও একটি বেতের ঝুড়ি থেকে ফলমূল নিয়ে খেতে শুরু করলেন। সকালের এই সময়টাতে তাঁরা ফলমূল আর মধু খান। একলব্য জাম্ববতীকে বললেন, মা ওই চাঁদ-তারার গল্পটা বলো না একবার! ছেলেবেলায় একটু শুনিয়ে বলেছিলে, বড় হলে সবটা বলবে?
জাম্ববতী বলেন, সে আখ্যান তোর বাপের কাছে শোন! অত জটিল গল্প আমার মনে থাকে না। চাঁদের বংশধর শুনে আবার নতুন করে তোর ওই কিসসা শুনতে ইচ্ছে হল বুঝি?
মায়ের কথা শোনে একলব্য হাসেন। তার পর পিতার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
রাজা হিরণ্যধনু হাত মুখ ধুয়ে কথক সাজলেন। মাথায় বাঁধলেন পাগড়ি, আর হাতে নিলেন একটি লাঠি, তাঁর ডগায় গবয় পশুর লেজের চুল। দাওয়া থেকে একটু দূরে ঘন সবুজ বনে বসে চাঁদ-তারার গল্প শুরু করলেন তিনি। নিষাদরা গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে এমন আসর বড়ই ভালবাসেন। একে একে জড়ো হতে লাগল নিষাদ পুরুষ ও রমণীরা।
অত্রিমুনির পুত্র চন্দ্র দক্ষের সাতাশ জন কন্যাকে বিবাহ করেন। চাঁদ একবার রাজসূয় যজ্ঞ করে প্রবল অহঙ্কারী ও কামাসক্ত হন। দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারার সঙ্গে চন্দ্রের গোপন প্রণয় ছিল। তিনি তারাকে নিয়ে পালিয়ে গেলে বৃহস্পতি অত্যন্ত কূপিত হলেন। তখন ঘোরতর যুদ্ধের উপক্রম হল। ব্রহ্মা সেই মহারণ আটকে দিয়ে তারাকে বৃহস্পতির কাছে ফিরিয়ে দেন। তারার গর্ভস্থ সন্তান চন্দ্রের ঔরসজাত। সেই সন্তানের নাম বুধ। বৃহস্পতির অভিশাপে চাঁদের যক্ষ্মা হয়। চন্দ্রপিতা অত্রিমুনি ছিলেন নামকরা বৈদ্য, তিনি পুত্রকে সারিয়ে তোলেন। চন্দ্রপুত্র বুধ বৈবস্বত মনুর কন্যা ইলাকে বিবাহ করেন।
ইলার কাহিনি ভারি অদ্ভুত। মিত্রাবরুণের কাছে পুত্রের আরাধনা করে মনু একটি সন্তান পান বটে কিন্তু উপাসনায় ভুল থাকায় সেটি কন্যা হয়ে জন্মায়। পরে বিষ্ণুর কৃপায় ইলা পুরুষত্ব পান, তাঁর নাম হয় ইল। তিনি রাজাও হয়েছিলেন। ইল রাজা একবার মৃগয়া করতে গিয়ে ঘন অরণ্যে প্রবেশ করেন, সেখানে মহাদেব ও উমা খেলা করছিলেন। উমার মনোরঞ্জনের জন্য মহাদেব স্ত্রীরূপ ধারণ করেছিলেন এবং তাঁর ইচ্ছায় বনের সব জন্তু এবং বৃক্ষও স্ত্রীভাব প্রাপ্ত হয়। রাজা ইল সেই ঘন বনে ঢুকে নারী হয়ে গেলেন। তখন রাজা ইল শিব ও পার্বতীর সাধনা করতে লাগলেন। মহাদেব বললেন, তুমি পুরুষত্ব ছাড়া অন্য বর চাও, আমি দেব। ইল তখন পার্বতীর কাছে আবেদন করলেন। দেবী বললেন, তুমি অর্ধেক সময়কাল নারী ও অবশিষ্ট সময় পুরুষ হয়ে কাটাবে। স্ত্রীরূপে ইল রাজার নাম হল ইলা। তিনি তপস্যারত বুধের সঙ্গে মিলিত হয়ে এক পুত্রের জন্ম দেন, তাঁর নাম পুরূরবা। তিনি প্রয়াগে রাজধানী স্থাপন করে মায়ের নামে সেই স্থানের নাম দেন ইলাবাস। ওই পুরূরবা একলব্যের পূর্বপুরুষ।
মিত্র ও বরুণের শাপে স্বর্গের অপ্সরা ঊর্বশী মর্ত্যে জন্ম নেন। পুরুরূবা তাঁকে বিবাহ করেন। তাঁদের এক পুত্রের নাম আয়ু। আয়ুর ছেলে নহুষ। নহুষ ছিলেন ধার্মিক রাজা। তাঁর ছয় পুত্রের মধ্যে যযাতি হলেন সবচেয়ে বিখ্যাত। ক্ষত্রিয় রাজা যযাতির ছিলেন দুই স্ত্রী—একজন ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানী, অন্যজন অসুরকন্যা শর্মিষ্ঠা। দেবযানীর দুই পুত্র—যদু ও তুর্বসু। শর্মিষ্ঠার তিন পুত্রের নাম দ্রুহ্যু, অনু ও পুরু। অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর দাসী ছিলেন অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা। দাসীর গর্ভে যযাতি সন্তান উৎপাদন করেছেন জেনে শুক্রাচার্য যযাতিকে জরাগ্রস্থ হওয়ার অভিশাপ দেন। অনেক কাকুতিমিনতি করার পর শুক্র বললেন, যদি তোমার পুত্রদের কেউ তোমাকে যৌবন ধার দেয়, তবেই তুমি জরা থেকে মুক্তি পাবে। রাজা যযাতি তাঁর পুত্রদের কাছে এলেন। যদু, তুর্বসু, দ্রুহ্যু ও অনু কেউ তাঁর কথায় কান দিল না। রাজা যদুকে অভিশাপ দিলেন, তোমার বংশের কেউ রাজা হবে না কোনও দিন। বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণ যদুবংশে জন্মলাভ করেছেন। তুর্বসুর বংশ লোপ পাবে, সে ম্লেচ্ছ ও অন্ত্যজ জাতির রাজা হবে। আমরা হলাম তুর্বসুর বংশের লোক। যদু আর তুর্বসু একই রক্তধারা বহন করেন। যদুর বংশধর হল একলব্য। দ্রুহ্যুর বংশের লোকদের স্থান হয়েছে দুর্গম প্রদেশে। তারাই ভোজ উপাধি নিয়েছে। কংস সেই ভোজের বংশধর। অনু ও তাঁর সন্তানরা যৌবনের পূর্বেই জরাগ্রস্থ হবে।
বাকি রইলেন পুরু। তিনি পিতাকে যৌবন দান করলেন। পুরুর শরীরে একদিকে বইছে চন্দ্রের রক্ত আর একদিকে অসুররাজ বৃষপর্বার খুন। দীর্ঘদিন যৌবন উপভোগ করে পুত্র পুরুকে আবার তা ফিরিয়ে দিলেন যযাতি। পুরু হলেন রাজা, তাঁর বংশের নাম পৌরব। তাঁর তিন পুত্র—প্রবীর, ঈশ্বর ও রৌদ্রাশ্ব। ঈশ্বরের উত্তরপুরুষ দুষ্মন্ত, তাঁর ছেলে ভরত। ভরতের উত্তরপুরুষ বৃহৎক্ষেত্রপুত্র হস্তি। হস্তির নামে হস্তিনাপুর নগর। হস্তির আবার তিন পুত্র। তাঁর চার পুরুষ পর রাজা হন সংবরণ ও তপতীর পুত্র কুরু। তখন থেকে হস্তিনাপুরের রাজারা হলেন কৌরব। কুরুর অধস্তন সপ্তম পুরুষ হলেন প্রতীপ। প্রতীপের পৌত্র ধৃতরাষ্ট্র এখন হস্তিনাপুরের রাজা।
শ্রোতাদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলেন, তবে যদু বংশ কোথা থেকে এল?
রাজা হিরণ্যধনু জবাব দিলেন, সেই কাহিনি অন্য আর একদিন বলব। আপাতত শুনে রাখো, যযাতি ও দেবযানীর পুত্র যদু থেকে বৃষ্ণি নামক এক বংশধর জন্মান। বৃষ্ণির উত্তরপুরুষ দেবমীঢ়, তাঁর পুত্র শূরসেন। শূরসেনের পৌত্র বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণ।
একলব্য মনে মনে ভাবেন, কাহিনি অনুসারে তিনিও শূরসেনের পৌত্র। শূরসেনের তৃতীয় পুত্র দেবশ্রবা তাঁর জৈবিক পিতা। পিতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা চন্দ্র ও তারার পুত্র না হয় বুধ, কিন্তু বুধ তো আসলে বৃহস্পতির ক্ষেত্রজ পুত্র! দেবগুরু বৃহস্পতির আর কোনও পুত্র ছিল না? শুনেছি, হস্তিনায় এক ব্রাহ্মণসন্তান অস্ত্রশিক্ষা দেন, তিনিই নাকি বৃহস্পতির পৌত্র?”
হিরণ্যধনু বলেন, “ঠিকই শুনেছো বৎস! হস্তিনায় রয়েছেন আচার্য দ্রোণ। তিনি ভরদ্বাজের পুত্র। এই ভরদ্বাজ মুনি দেবগুরু বৃহস্পতির সন্তান। সে কাহিনি বড়োই মর্মন্তুদ।”
এক নিষাদ রমণী বললেন, আমরা সেই আখ্যান শুনতে চাই।
জাম্ববতী বললেন, না রে আজ নয়। দেখছিস না রাজামশাই হাঁফাচ্ছে।
জল আনা হল। ঢক ঢক করে সবটুকু পান করলেন নিষাদরাজ। তার পর পাগড়ি খুলে, লাঠি রেখে বসে পড়লেন। হিরণ্যধনুর বয়স হচ্ছে। একটানা অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। বসে বসেই বললেন, দ্রোণাচার্যের আখ্যান কিন্তু না বললেই নয়।
আবার শুরু হল কাহিনি। একঘেয়ে সেই উপাখ্যান নিষাদ রমণীপুরুষেরা বড় ভালবাসে।