Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in






পর্ব ২৭

শোয়াইনস্‌হাক্সে ওরফে শুয়োরের গোড়ালি

‘আমি চান্দেরি সাম্পান যদি পাই, সাত সাগরে পাড়ি দিয়া তরে নিয়া যাই’। শ্যামল মিত্রের মায়াবী কণ্ঠের এই গানটি কেমন যেন স্বপ্নের মধ্যেও কখনও কখনও ঘুরে আসে। তাঁর কণ্ঠস্বরের মাদকতা, অনবদ্য গায়কী একটা অপূর্ব ছবি আঁকে। যে ছবিতে প্রিয়াকে নিয়ে সাত সাগর পাড়ি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কল্পনা করা যাক, কোনও একটি বিষয়, তা যদি হয় হেঁশেল সংস্কৃতির মতো কিছু, তাকে কি প্রিয়ার ভূমিকায় কল্পনা করা যায় না? বেঁচে থাকার প্রয়োজনে, খিদে মেটানোর লক্ষ্যে সব প্রাণীকেই বেছে নিতে হয়েছে নিজ নিজ আহার্য। একমাত্র মানুষই পেরেছে খাদ্যকে নিছক আহার্যের স্তর থেকে শৈল্পিক মর্যাদার ভূখণ্ডে উত্তরণ ঘটাতে। তাকে প্রিয়া ভাবতে অসুবিধা কোথায়? আর সেই প্রিয়ার হাত ধরে দেশ থেকে দেশান্তরে, সাত সাগর পাড়ি দিয়ে এক রান্নাঘর থেকে আরেক রান্নাঘরে ঢুকে পড়ার আনন্দ অবর্ণনীয়।

প্রায় আটশো বছর আগেকার কথা। চিনদেশে তখন মিং রাজত্ব। এক কসাইয়ের ছিল এক অতি সুন্দরী বউ। কিন্তু বিয়ের অনেক বছর কেটে যাওয়ার পরও তাদের কোনও সন্তান না হওয়ায় তৈরি হল এক সংকট কারণ সে দেশের প্রথা অনুযায়ী তখন সন্তান ধারণ করতে না পারা গণ্য হত অপরাধ বলে। অতএব বিচ্ছেদে বাধ্য হল সেই দম্পতি। পাহাড়ের ওপর এক কুঁড়ে ঘরে জায়গা হল সেই মেয়েটির। সেইসময় হঠাৎ একদিন মেয়েটি আবিষ্কার করলো সে সন্তানসম্ভবা। খুশির সীমা রইলো না তার। আগত সন্তান আর তার বউটির যাতে পুষ্টির কোনও অভাব না ঘটে, সেইজন্য কসাই স্বামী তার বিক্রি না হওয়া উদ্বৃত্ত মাংসের টুকরো থেকে রান্না করে আনল শুয়োরের গোড়ালি দিয়ে রান্না করা অভূতপূর্ব এক স্ট্যু। এইরকম আকস্মিকভাবে আবার জন্ম নিল একটি পদ, যা দীর্ঘ যাত্রাপথ অতিক্রম করে শেষ অবধি ত্যাগ করবে তার আটপৌরে পরিধান এবং পৌঁছে যাবে অভিজাতের খাওয়ার টেবিলে। এবং আবার সে পাড়ি দিল এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে। বিশেষত জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলে, বাভারিয়া প্রদেশে তা কালক্রমে হয়ে উঠল সামগ্রিক আঞ্চলিক জীবন সংস্কৃতির এক প্রতীক। চিনদেশের নানান প্রদেশে আজও নবজাতকের আগমনের পর এই স্ট্যু খাওয়ার চল আছে। কিন্তু জার্মানিতে এই খাদ্যটির জনপ্রিয়তার ধরন-ধারণ একটু আলাদা। বাভারিয়ার অক্টোবারফেস্ট, বিশেষ ধরণের সসেজ কিংবা লেডারহোসেনের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে শোয়াইনস্‌হাক্সের নামটি ওয়াকিবহাল মানুষের মুখে চলে আসার সঙ্গত কারণ থাকলেও ওদেশের অন্যত্রও এর চাহিদা কিছু কম নয়। সেই আড্ডায় প্রবেশ করতে হলে সময়ের সরনি ধরে পিছিয়ে যেতে হবে বছর দশেক।

তখন একটু টালমাটাল। তখন দিগন্তে পরিবর্তনের ছায়ার সঙ্গে নতুন সম্ভাবনার কোলাকুলি। সেটা ২০১২। কাঠফাটা গরমের এক দ্বিপ্রহরে বন্ধু অ্যালেক্সের ফোন এলো চেন্নাই থেকে। ‘দ্রুপা’য় যাবে?’ ‘দ্রুপা’? অর্থাৎ মুদ্রণবিষয়ক পৃথিবীর বৃহত্তম প্রদর্শনী! সেখানে যাওয়ার স্বপ্ন তো সেই কবে থেকেই দেখে আসছি। শুনেছি ছাপার টেকনোলজি, কাগজ বা কাগজ ছাড়াও যে যে বস্তুর সঙ্গে ছাপার সুদূরতম যোগ আছে, সেসবের এক মহা মিলনমেলা এই ‘দ্রুপা’। প্রতি চারবছর অন্তর জার্মানির ড্যুসেলডর্ফে এই মেলার দিনগুলিতে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসে কয়েক লক্ষ মানুষ। তো অ্যালেক্সের এই প্রস্তাবে নেচে উঠল মনটা। আর এসব ক্ষেত্রে প্রথম ফোনটা যাকে করে থাকি, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। হানস্‌। আকৈশোর বন্ধুত্ব আমাদের। হানসের সঙ্গে দু’ধরণের পরামর্শের প্রয়োজন ছিল। এক, ড্যুসেলডর্ফের ইয়ুথ হস্টেলে একটা থাকার ব্যবস্থা করা আর দুই, ফেরার পথে হাইডেলবার্গে ওর সান্নিধ্যে কদিন কাটিয়ে আসা। সেইমতো শুরু হল সব প্রস্তুতি। নির্দিষ্ট দিনে ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে ড্যুসেলডর্ফ পৌঁছলাম যখন, তখন অনেক রাত। বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে। বেশ ঠাণ্ডা। ডর্মিটরির চাবিটা হাতে পাওয়ার পর একটা কাজই সেদিনের মতো বাকি ছিল। কম্বলের তলায় ক্লান্ত শরীরটা ঢুকিয়ে ফেলা।

ঘুম ভাঙল একটা ঝকঝকে সকালে। মেলা আমি পৌঁছনোর একদিন আগেই শুরু হয়ে গেছে। অ্যালেক্সে আর ভাল্লাভানও (আমাদের আরেক বন্ধু) পৌঁছে গেছে আগেই। এই অ্যালেক্স আর ভাল্লাভানকে মানিকজোড় বললেও কম বলা হবে। অভিন্নহৃদয় এই দুজনই পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। ছাপার (বিশেষত অফসেট) যন্ত্রের রক্ষনাবেক্ষন এবং মেরামতের জগতে এদের খ্যাতি সেসময় ভারতজোড়া। তা যাই হোক, তৈরি হয়ে মেলার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া গেল। কথা ছিল ওরা দুজন ওখানেই অপেক্ষা করবে আমার জন্য। ট্রাম থেকে নেমে একটু হেঁটে মেলার প্রবেশপথের কাছাকাছি যখন পৌঁছেছি, শুনতে পেলাম অ্যালেক্স ডাকছে ওপর থেকে। কোথা থেকে? ঢোকার ঠিক মুখেই একটি কাফে, তারই দোতলার বারান্দায় বসে মানিকজোড়। আমিও বলাই বাহুল্য যোগ দিলাম ওদের সঙ্গে।

‘দ্রুপা’ নিয়ে আলোচনা এই লেখার বিষয়বস্তু নয় যেনেও সচেতনভাবেই সেদিকে যেতেই হল প্রেক্ষাপটটি তৈরির কারণে। আসল ঘটনাটি ঘটল প্রথমদিন বিকেলেই। মেলার পরে মেট্রোযোগে আমরা তিনজন পৌঁছলাম যেখানে (সেই স্টেশনটির নাম এখন আর মনে করতে পারছি না), সেই জায়গাটি রাইন নদীর একেবারে ধারেই। তীরবর্তী সমগ্র অঞ্চলটি জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য পাব আর কাফের ভিড়। তারই একটার বাইরে চেয়ার দখল করলাম আমরা। অচিরেই টেবিলে এলো বিয়ার আর খিদে মেটানোর কিছু উপকরণ। এই ফাঁকে বলে রাখা ভালো, এই এলাকায় একটি বিশেষ ধরণের বিয়ার পাওয়া যায়, যার নাম আল্টবিয়ার। প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মব্যাপী, সুরক্ষিত এই বিয়ার তৈরির প্রক্রিয়াটি আধুনিক বিয়ারশিল্পের বিপরীতমুখী। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ইস্ট দিয়ে তরলটিকে গেঁজিয়ে তোলা হয় ওপর থেকে, তলা থেকে নয়। এইসব ব্যাপারে অবশ্য কোনও সুরারসিকের মাথাব্যাথা থাকার কথা নয়, এসব নিছকই তথ্য, যা কাজে লাগে অনুসন্ধিৎসু মানুষের। ঈষৎ মিষ্টি, গাঢ় তামারঙা এই বিয়ারের স্বাদ কেমন, তা বর্ণনা করা ভীষণ কঠিন। কেননা এককথায় তা অনন্য। যে দেশে দু হাজারেরও বেশি ধরনের বিয়ার পাওয়া যায় - বিয়ার যেখানে বন্ধুত্বের প্রতীক, বিয়ার সংস্কৃতির প্রতি যে দেশের বাসিন্দাদের আনুগত্য না দেখলে বিশ্বাস হবে না, তেমন দেশেও এই বিয়ারের জায়গাটি স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল।

কথা শুরু হয়েছিল শোয়াইনস্‌হাক্সে - কে নিয়ে। পৌঁছে গেলাম বিয়ারে। এটাই মজা। নিজের অজান্তেই এই যাত্রাপথে একদিন বেরিয়ে পড়েছিলাম লক্ষ্যহীনভাবে। সেই অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলি যখন, কী যে কখন বেরিয়ে পড়ে, আগে থেকে বুঝতে পারিনা কিছুতেই। তা সেদিনের সেই সান্ধ্য বিয়ার-আড্ডা কিছুক্ষণ গড়ানোর পর ভাল্লাভানই মনে হয় প্রস্তাব দিয়েছিল, চলো একটা জায়গায় যাওয়া যাক। কাছেই। কোথায়? ওরা দেখলাম মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। আমি তো কিছুতেই দুই বন্ধুর মতলবটা বুঝে উঠতে পারছি না। ওরা দুজনেই, বিশেষত ভাল্লাভান তার আগেও অনেকবার ‘দ্রুপা’য় এসেছে আর আমি বহুবার ওদেশে নানান কারণে গেলেও, ড্যুসেলডর্ফে সেই প্রথম।

শুনলাম আমাদের গন্তব্য কাছেই। হেঁটেই রওনা দিলাম তিনজন। সামান্য পরে যে রাস্তায় পৌঁছনো গেল, ওই শহরের সেটি এক বিখ্যাত অঞ্চল। দুপাশে অগুন্তি রেস্টুরেন্ট। অনেকটা আমাদের পার্ক স্ট্রিটের মতোই। তবে এটি পার্ক স্ট্রিটের মতো অত বিস্তৃত নয়। অন্য একটি ব্যাপার চোখে পড়লো, যা আমাদের শহরে নেই। রাস্তার দুপাশেই মানুষজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে বিয়ারপান আর গল্পগাছা করছে। সেখানে নজরে এল আরও অনেক চেনা মুখ, যাদের সবাইকেই দিনের বেলা মেলায় দেখেছি। সামনে ভাল্লাভান, পিছনে অ্যালেক্স আর সবশেষে আমি এইভাবে অনেকের পাশ কাটিয়ে আমরা ঢুকে গেলাম একটি রেস্তরাঁর মধ্যে। ভিতরে বেশ ভিড়। প্রতিটি টেবিলেই মনে হল একই গোত্রের কোনও খাবার খাওয়া হয়েছে বা হয়ে চলেছে। একটি কোণে জায়গা পেলাম আমরাও। ভাল্লাভানই অর্ডার করলো। প্রায় আধঘণ্টা (বলা নিষ্প্রয়োজন ততক্ষণে পান করা হয়েছে আরও কয়েক পাত্র বিয়ার) অপেক্ষা করার পর যে বস্তুটিকে দেখতে পেলাম, তার কথা ইতিপূর্বে শুনেছি অনেক কিন্তু সাক্ষাৎ ঘটেনি। শোয়াইনস্‌হাক্সে ওরফে শুয়োরের গোড়ালি।

চীনদেশের যে গল্প দিয়ে এ লেখা শুরু করেছিলাম, তার সঙ্গে এই জার্মান অবতারের মিল থাকলেও অমিল কম নেই। প্রাচীন সেই রেসিপিতে। সেটি ছিল মূলত একটি স্ট্যু আর জনপ্রিয় এই জার্মান পদটির রান্নার পদ্ধতিটি একটু আলাদা। এক্ষেত্রে প্রাণীটির পায়ের (আসলে গোড়ালির কথা বারবার বলা হলেও পায়ের যে অংশটি এই রান্নায় ব্যবহৃত হয় তা হচ্ছে পায়ের পাতা আর পায়ের সংযোগস্থলের মধ্যবর্তী মাংসল জায়গাটি) ওই বিশেষ অংশটি ম্যারিনেট করে রাখা হয় অনেকক্ষণ ধরে। বিয়ার যার একটি অন্যতম উপকরণ। এর পর সেটিকে ঢোকানো হয় আভেনে। সেও অনেক সময়ের ব্যাপার। শেষে কালচে, নরম তুলতুলে এই মাংসখণ্ডটি পরিবেশন করা হয় আলু আর বাঁধাকপির স্যালাড (সাউয়ারক্রাউট) সহযোগে।

জনান্তিকে একথা কবুল করে রাখি উপাদেয় অথচ অতিকায় সেই গোড়ালিটি কব্জা করতে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছিল আমাকে। আমার অন্য দুই বন্ধু সে দৃশ্যে যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলেন। একেই বলে বন্ধুত্ব!