Next
Previous
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















২৪

সবুজ ট্রাকভ্যানের ইঞ্জিনটা অসাধারণ। গাড়ির সামনে দু জন চালক আছে। তারা পালা করে চালায়। নিজেদের মধ্যে খুব একটা কথা বলে না তারা। যখনই বলে গাড়ির ইঞ্জিনের ব্যাপারেই বলে যায়।

‘দারুণ, সলিড জিনিস!’ … মাঝে মাঝেই বলে তারা। মাথা ঝাঁকায় বিস্ময়ে। কান পেতে শোনে ইঞ্জিনের ছন্দময় এবং একটানা শক্তিশালী গুঞ্জনধ্বনি। সেই ধ্বনির মধ্যে কোনো সরু মোটা, নকল ফালতু আওয়াজ নেই। রাত্তিরটা বেশ গরম, অন্ধকার। একটানা উত্তরদিকে চালিয়ে যাচ্ছিল তারা। পথে যানজট ছিল। আর্মির গাড়ি, ঘোড়ায় টানা গাড়ি এমনকি আর্মির পদাতিক বাহিনী অবধি ছিল পথে। দু দু’ বার ব্রেক কষতে হল তাদের। অন্ধকারে আরেকটু হলে সৈনিকদের অবয়বহীন পদাতিক বাহিনীর উপরে গিয়ে পড়ত ভ্যানটা। ভাগ্য ভালো যে হেডলাইটের আলোয় অন্ধকারে ঠাহর করে শেষ মুহূর্তে ব্রেক কষে দুর্ঘটনা এড়ানো গেছে। রাস্তাটা তার উপরে বেশ সরু। ফার্নিচার ভ্যান, ট্যাঙ্ক, মার্চ করে চলা সেনাবাহিনী এসবের জন্য মোটেই প্রশস্ত নয়। তবে তারা যতই উত্তরের দিকে যাচ্ছিল, রাস্তাটা ফাঁকা হয়ে আসছিল। অনেকটা সময় তারা ভ্যানটাকে পথে কোনো বাধাবিঘ্ন ছাড়া ফুল স্পিডে ছোটাতে পেরেছে।

গাড়ির হেডলাইট শঙ্কু আকৃতিতে জোরালো আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। চারপাশের গাছ পালা, বাড়িঘর সবকিছুর উপরে আলো পড়ছে। হঠাৎ হঠাৎ রাস্তার কোনো কোনো বাঁকে দেখা যাচ্ছে চাষের জমি। ভুট্টা, কিম্বা টমেটোর গাছ প্রচুর দেখা যাচ্ছে। অবশেষে রাস্তাটা একদম ফাঁকা হয়ে এসেছে। চালকদের একটু একটু হাই উঠছে। গ্রামের শেষে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে তারা বিশ্রাম নেবার জন্য রাস্তার ধারে গাড়িটা থামায়। হ্যাভারস্যাক খুলে ক্যান্টিন থেকে ফ্লাস্কে ভরে নিয়ে আসা কড়া এবং গরম কফিতে চুমুক দেয় আয়েস করে। পাতলা গোল টিনের ক্যান খুলে চকলেট আর মাখন লাগানো স্যান্ডুইচ বের করে। তারপর মাখনের টিন থেকে রুটির উপরে আরও মাখন লাগায়। রুটির উপরে রাখে বড় সসেজের টুকরো। লালচে সসেজের মধ্যে গোলমরিচের গুঁড়ো মেশানো আছে। লোক দুটো ধীরে সুস্থে খাবার খায়। ওদের ক্লান্ত, ধূসর মুখগুলো অদ্ভুত দেখায়। যে লোকটা বাঁ দিকে বসেছিল, তার খাওয়া আগে শেষ হয়। খাওয়া শেষ করে লোকটা মৌজ করে একটা সিগারেট ধরায়। সিগারেট খেতে খেতে জামার পকেট থেকে একটা চিঠির খাম বের করে লোকটা। সেটা খুলে লোকটা একটা ফটো বের করে। ফটোতে দেখা যাচ্ছে যে একটা মিষ্টি বাচ্চা মেয়ে মাঠের মধ্যে খরগোশের সঙ্গে খেলছে। সে পাশের লোকটাকে ছবিটা দেখায়।

‘দ্যাখো, কী মিষ্টি, কী সুন্দর… তাই না? আমার ছোট্ট সোনামণি!’ লোকটা হাসে… ‘ছুটির বাচ্চা’।

আরেকটা লোক জবাব দেয়… ‘খুব ভালো। ছুটির বাচ্চা? তাহলে বাচ্চার বয়স এখন কত?’

‘তিন বছর।’

‘তোমার কাছে বউয়ের কোনো ছবি নেই?’

‘হ্যাঁ’… বাঁ দিকে বসে থাকা লোকটা পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে হঠাৎ থমকে যায়, বলে… ‘কিন্তু একবার শোনো… এরা তো পাগল হয়ে গেছে মনে হচ্ছে…’ … সবুজ ট্রাকভ্যানটার ভেতর থেকে ভারি জড়ানো স্বরে গোঙানির শব্দ আর এক মহিলার কণ্ঠে চিলচিৎকার শোনা যায়। স্টিয়ারিংএ বসে থাকা লোকটা চেঁচিয়ে ওঠে … ‘চোপ!’ আরেকজন লোক গাড়ির দরজা খুলে গ্রামের রাস্তার দিকে দেখতে থাকে। বাইরে বেশ গরম। অন্ধকার। গ্রামের বাড়িগুলোতে কোথাও আলো জ্বলছে না। গোবরের গন্ধ চারিদিকে। বিশ্রী গন্ধ। কোনো একটা বাড়িতে কুকুর ডেকে উঠলো। লোকটা গাড়ির দরজা খুলে বাইরে আসে। গ্রামের দুর্গন্ধ, রাস্তার কাদা সবকিছুকে মনে মনে শাপশাপান্ত করতে করতে গাড়িটা প্রদক্ষিণ করে একপাক ঘুরে আসে। গাড়ির বাইরে গোঙানির শব্দটা বেশি আসছে না এখন, হালকা শব্দ। কিন্তু গ্রামের মধ্যে দুটো কুকুর ডেকে উঠল। না, দুটো নয়। তিনটে। গ্রামের একটা বাড়ির জানালা আলোকিত হয়ে উঠল। একটা মানুষের অবয়ব দেখা গেল জানালাতে। যে ড্রাইভার বাইরে বেরিয়ে এসেছে, তার নাম শ্র্যোডার। তার খুব একটা ইচ্ছে নেই ট্রাকের পেছনের গদি আঁটা দরজাটা খুলবার। বেকার যত ঝামেলা এখন কে সামলাবে! সে নিজের মেশিনগানের কুঁদোটা দিয়ে গুঁতো মারে দরজায়। ট্রাকের ভেতরের গোঙানির শব্দটা বন্ধ হয়ে যায়। শ্র্যোডার টায়ারের উপরে লাফ দিয়ে চড়ে পরীক্ষা করে যে ট্রাকের দরজার উপরে আঁটা ছিটকিনির উপরে জড়ানো কাঁটাতারের গুচ্ছটা ঠিকঠাক আছে কি না।

তারের গুচ্ছটা স্বস্থানে আছে। সে ড্রাইভারের কেবিনে ফিরে যায়। আরেকজন লোকের নাম প্লোরিন। তার খাওয়া শেষ। সে এখন আয়েস করে কফিতে চুমুক দিতে দিতে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। তার সামনে তিন বছরের বাচ্চা মেয়েটার মাঠের মধ্যে খরগোশ নিয়ে খেলা করার ছবি।

‘সত্যিই খুব মিষ্টি বাচ্চা!’ সে বলে। তারপর সে গাড়ির ভিতরের দিকে ইঙ্গিত করে… ‘যাক, সব চুপচাপ!—বউয়ের ছবি নেই সঙ্গে?’

‘হ্যাঁ’… শ্র্যোডার আবার পকেট থেকে ওয়ালেটটা বের করে। ওয়ালেট খুলে একটা ঝরঝরে ছেঁড়া ছবি বের করে আনে। ছবিটা ফার কোট পরা এক মহিলার; ছোটখাট দোহারা গড়নের চেহারা। মুখে কেমন যেন বোকা বোকা একটা হাসি, তবে মুখটা কেমন যেন বয়স্ক, ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ছবিটা দেখে যে কারো মনে হবে যে বেশি উঁচু স্টিলেটো পরেছে কালো রঙের, সেইজন্য পায়ে ব্যথা করছে। গাঢ় ব্লন্‌ড চুল ফাঁপিয়ে আঁচড়ানো বলে মাথাটা বিরাট দেখাচ্ছে।

‘সুন্দরী মহিলা!’ বলে প্লোরিন… ‘চলো, যাওয়া যাক।’

‘হ্যাঁ’ বলে শ্র্যোডার, ‘এগিয়ে চলো।’ সে আবার বাইরে তাকায়। গ্রামে এখন অনেকগুলো কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। অনেকগুলো বাড়িতে জানালায় আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। গ্রামে লোকজন অন্ধকারের মধ্যে নিজেদের নাম ধরে ডাকাডাকি করে কী যেন বলছে।

‘বাদ দাও!’ শ্র্যোডার গাড়ির চালকের কেবিনের দরজাটা জোরে বন্ধ করে… ‘এগিয়ে চলো।’

প্লোরিন গিয়ার বদলাতে শুরু করে। গাড়ির ইঞ্জিন সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন করে ওঠে। প্লোরিন একটু ইঞ্জিনটা চালিয়ে রেখে, তারপর অ্যাক্সিলেটারে চাপ দেয়। গতি বাড়িয়ে সবুজ ট্রাকভ্যানটা গ্রামের পথে চলতে থাকে।

‘দারুণ জিনিস!’ বলে প্লোরিন… ‘সলিড! খাসা ইঞ্জিন!’… গাড়ির ভেতরটা ইঞ্জিনের গুমগুম ছন্দোময় শব্দে ভরে থাকে। কিন্তু কিছুদূর যাবার পরে, ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে গাড়ির পেছনের ভিতর থেকে আবার গোঙানির শব্দটা শোনা যায়।

‘একটা গান গাও!’ প্লোরিন বলে শ্র্যোডারকে। শ্র্যোডার গান ধরে। তার গলা জোরালো এবং ভরাট। খুব শ্রুতিমধুর বা সঙ্গীতের ব্যাকরণ সব ঠিকঠাক মিলছে এমন নয়, তবে তার গলা ভারি দরদী। আবেগী কিছু গান সে গাইতে শুরু করে। এতটাই দরদ দিয়ে সে গায়, একেক সময় মনে হয় যেন সে এখনই কেঁদে ফেলবে। তবে সে কাঁদে না, গেয়ে যায়। তার ভীষণ প্রিয় একটা গান হল ‘হাইডে মারি’। প্রায় ঘণ্টাখানেক জোরালো গলায় গেয়ে যায় সে। এক ঘণ্টা পরে তারা জায়গা বদল করে। শ্র্যোডার গাড়ি চালায়। এখন প্লোরিন গান ধরে।

‘বাঁচা গেছে যে এখন বুড়ো আমাদের গান শুনতে পাচ্ছে না।’… প্লোরিন হাসিতে ফেটে পড়ে। শ্র্যোডারও হেসে ওঠে। প্লোরিন আবার গান ধরে। শ্র্যোডার যে গানগুলো গাইছিল, সেও বেশির ভাগ সেগুলোই গায়। তবে তার বেশি পছন্দ ‘গ্রে কলাম’। সে বারেবারে এই গানটা গেয়ে যায়। ধীরে ধীরে গায়, দ্রুত লয়ে গায়; সেই জায়গাগুলো বিশেষ দরদ দিয়ে, জোর দিয়ে ধীরে ধীরে গায় যেখানে বীরের জীবনের একাকিত্ব এবং মহত্ব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। বারেবারে গায় সে বিশেষ করে এই স্তবকগুলি।

শ্র্যোডার, যার হাতে এখন স্টিয়ারিং, সে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে। গাড়িটা পূর্ণ গতিতে ছোটায় সে; গানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে শিস দেয়। এখন আর তারা গাড়ির পেছন থেকে, গাড়ির ভিতর থেকে কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। যত এগোচ্ছে তারা, ঠাণ্ডা যেন বেড়ে চলেছে। তারা নিজেদের পা কম্বলে ঢাকে। মাঝে মাঝে কফিতে চুমুক দেয়।

তারা এখন আর গান গাইছে না। গাড়ির ভিতর থেকেও আর কোনো শব্দ আসছে না। চারদিক নিস্তব্ধ। গ্রামগুলো ঘুমন্ত। গ্রামের রাস্তা ফাঁকা, ভিজে। এদিকে বোধহয় বৃষ্টি হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। যে গ্রামগুলোর মধ্য দিয়ে গাড়িটা চলছে, মনে হচ্ছে যেন গ্রামগুলো মৃত। এক আধটা বাড়ি, কিম্বা গির্জায় আলো জ্বলছে। আলো সমেত বাড়িগুলো পথের ধারের অন্ধকারে হঠাৎ জেগে উঠছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।

ভোর চারটে নাগাদ তারা দ্বিতীয়বার থামল বিশ্রাম নেবার জন্য। দুজনেই এখন ক্লান্ত; মুখ শুকিয়ে গেছে। নোংরা, ধূসর দেখাচ্ছে চোখমুখ। রাস্তার ধারে অল্পসময়ের জন্য গাড়িটা দাঁড় করায় তারা। শ্নাপ দিয়ে মুখ মুছে নেয় একটু। কোনো মতে গলাধঃকরণ করে স্যান্ডুইচ। একটুখানি খেয়ে ফ্লাস্কের বাকি ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কফি ফেলে দেয়। সরু টিন থেকে বাকি চকলেট খেয়ে নেয়। তারপর সিগারেট ধরায়।

এখন একটু ভালো লাগছে ওদের। আবার পথ চলা সম্ভব এখন। শ্র্যোডার স্টিয়ারিংএ বসে। শিস দিয়ে সুর ভাঁজে। পাশে প্লোরিন কম্বল মুড়ি দিয়ে ঝিমোতে থাকে। সবুজ ট্রাকভ্যানের ভিতরটা এখন নিস্তব্ধ। হালকা ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। প্রধান সড়ক ছেড়ে গ্রামের সরু পথ পেরিয়ে, ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে তারা একটা জঙ্গলের পথ ধরেছে এখন। গাছপালায়, ঝোপঝাড়ে অন্ধকার হয়ে রয়েছে চারদিক। চাপ চাপ কুয়াশা ঘন হয়ে রয়েছে। জঙ্গলের বাইরে এসে একটা উপত্যকা পেরিয়ে শুরু হল ব্যারাকের বাড়িগুলি। তারপর আবার একটা ছোট জঙ্গল, আরেকটা উপত্যকা পেরিয়ে গাড়িটা একটা কাঁটাতারে ঘেরা ক্যাম্পের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হর্ন বাজাতে শুরু করল। গেটটা বিশাল। কাঠের পাটাতন, তার উপরে কাঁটাতার জড়ানো। গেটের পাশে লাল, সাদা, কালো রঙের খুপরি ঘর, সৈন্যসান্ত্রী, পাহারাদার এদের বসবার জন্য। খুপরির পাশে উঁচু নজর মিনার। নজর মিনারের উপরে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে; লোকটার মাথায় স্টিলের হেলমেট, হাতে মেশিনগান। একজন পাহারাদার এসে খুলে দিল গেট এবং চালকদের কেবিনের দিকে তাকিয়ে হাসল একবার। গেটের মধ্য দিয়ে গাড়িটা ধীরে ধীরে ঢুকে গেল। চালক তার পাশে ঝিমিয়ে পড়া সহকর্মীকে হালকা ধাক্কা দিল… ‘আমরা এসে গেছি।’

গাড়ির চালকের কেবিন খুলে নিজেদের মালপত্র নিয়ে নেমে এল তারা। জঙ্গলে ভোরের পাখিরা গান গাইছে। সূর্য উঠছে পুবের আকাশে। জঙ্গলের সবুজ গাছপালার উপরে এসে পড়ছে সূর্যের কিরণ। একটা হালকা কুয়াশার ওড়না এখনও ছড়িয়ে আছে চারপাশে।

নজর মিনার পেরিয়ে হা ক্লান্ত শ্র্যোডার এবং প্লোরিন একটা ব্যারাকের দিকে এগোতে লাগল। কয়েক ধাপ উঠে হেঁটে গিয়ে তারা দেখতে পেল যে ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তায় অনেকগুলি ভ্যানের একটা বিশাল কনভয় অপেক্ষা করছে। ক্যাম্পে অদ্ভুত একটা নৈঃশব্দ্য। কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। কিচ্ছুটি নড়ছে না। শুধু দূরে গণচিতার চুল্লির চিমনি থেকে বিশাল মেঘের মত ঘন কালো ধোঁয়া উঠছে।

(চলবে)