গল্প - সনাতন সিংহ
Posted in গল্প( ১ )
"আরে, দাঁড়ান… দাঁড়ান…" পিছন থেকেই লোকটা চেঁচাচ্ছিলেন। কিন্তু আওয়াজ কানে গেল না রিনির।
ততক্ষণে তার শরীর রেললাইনে পিষে, কেটে, টুকরো হয়ে গেছে। কাটা হাতটা ছিটকে এসে পড়েছে লাইনের বাইরে, ঠিক কানুর পায়ের কাছে। সেটা নড়ছে এখনও।
কানুর চোখ এক্কেবারে নিথর। মুখে কোনো কথা নেই। মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল সেখানে। ভাবলেশহীন। চক্ষু স্থির। লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচি যেন কানে ঢুকছে না তার। নিজের মগজটাই যেন আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেছে। অনুভূতিহীন।
প্ল্যাটফর্ম থেকে কয়েকজন ছুটে এল। যে যার মতো বলতে শুরু করল–
"গাড়ি ঢুকছে তবু লাইনে উঠে পড়ল! দেখতে পায় না, নাকি?"
"আমি চেঁচাচ্ছি। তবু শুনল?"
"সাংঘাতিক! একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে রে!"
"নাও, এবার অফিস যাওয়া গেল। অবরোধ শুরু। যত্ত সব…"
এসব কথার মাঝেই হঠাৎ পিছন থেকে চিৎকার ভেসে এল।
"দিদি…"
লোকজন হকচকিয়ে গেল। পিছন ফিরে দেখে, সেই কাটা হাতটা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদছে কানু।
"এ কি হয়ে গেল দিদি! এটা কী করলি তুই? একটু দাঁড়াতে পারলি না?
"আপনার দিদি?
"দেখছে ট্রেন ছুটে আসছে, তাও…"
কানু কাঁদতে কাঁদতে বলল,
"দি-দিদি অন্ধ। দেখতে পায় না।"
হা-হুতাশ, টিপ্পনি, অনুকম্পা স্তব্ধ হয়ে গেল। নিজেদের কানকে তারা যেন বিশ্বাস করতে পারল না।
"কি বললেন? কানা? দেখতে পান না!"
কানু উত্তর দেবে কী? শুধুই কাঁদছে। নিজেকে খুব খুব অপরাধী বলে মনে হচ্ছে তার। হওয়াটাই অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনি এমনি তো সে আর কানা হয়নি, সে ঘটনায় তারও যেন হাত ছিল বলে মনে হয় বারবার। এখন তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে তা...
রেললাইনের উপরেই খেলছে কানু। সঙ্গে তার দিদি, রিনি। সেদিনই তাদের সঙ্গে সে এসেছে প্রথম। তখন রিনির বয়স ঐ বছর সাতেকের। কানু তার থেকে প্রায় বছর দেড়েকের ছোটো। তবে তার প্রায় মাথায় মাথায়। লাইনে তারা ছাড়াও আরো কয়েকজন রয়েছে। সবাই অবশ্য তারা ওদের পাড়ার। গুপ্তেল, পেচ্কুল, নান্টু আরো অনেকে।
লাইনের উপরেই তারা পাথর রেখে রেখে আসছে, সারি সারি করে। ট্রেন ছুটে আসছে দুরন্ত গতিতে। চাকার ঘর্ষণে পাথর ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে বুলেটের মতো, একের পর এক। আনন্দে ফেটে পড়ছে তারা। বেশ মজা পেয়ে গেছে কানুরা।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায় এভাবে। রিনিদের আনন্দ থামছে না। বেড়েই চলেছে। এবারে পাথর দিয়ে আর অন্য লাইন টপকে যেতে পারল না। এপার ওপার দুই লাইনেই ট্রেন ছুটে আসছে সমান গতিতে। লাইন টপকালেই বিপদ। দুই লাইনের মাঝে শুয়ে পড়ল গুপ্তেলরা। এটা তাদের কাছে এখন জলভাত। তবে রিনির কাছে নতুন। এত বছর এখানে থাকা সত্ত্বেও সে কোনোদিন পা ফেলত না এদিকে।
এসব দেখলে তার ভয় চেপে বসত সারা শরীরে। সাহস করে একবারের জন্যও একা লাইনে উঠত না। কখনো কখনো বা দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্যদের দেখত। নিজে 'নৈব নৈব চ'। আজ কানুর ইচ্ছের কাছে সে হার মেনে ছিল। ভাইয়ের স্নেহের আবদারে উঠে এসেছিল রেল লাইনে।
কিন্তু এখন সে টের পাচ্ছে।
ভয়ে কাঠির মতো দাঁড়িয়ে থাকল একা দুই লাইনের মাঝখানে। ঘর্ঘর ঘর্ঘর করে ট্রেন ছুটে আসছে। হঠাৎই বুলেটের মতো ছিটকে এল পাথর। তীব্র গতিতে ঢুকে গেল তার বাঁ চোখে। চিৎকারে ফেটে পড়ল রিনি। হাত দিয়ে চোখটা চেপে ধরল সজোরে। কুঁকড়ে বসে পড়ল সেখানে। লাইন কাঁপিয়ে, বাতাস দুলিয়ে ট্রেন বেরিয়ে গেল দুদিকে। রিনি যন্ত্রণায় ছটফট করছে। সারা গা থরথর করছে কানুর। গুপ্তেল চেঁচিয়ে উঠল,
"ওরে, রক্ত বেরচ্ছে। চ, চ। ওকে ধর। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।"
লাইনের ঢিল ছোঁড়া দূরত্বেই তাদের বস্তি। বাসন্তি পল্লী। ঝুপড়িতে ঝুপড়িতে ঠাসা। কানুর মা ঘরে ছিল না। আর এখন থাকার কথা নয়, পরের বাড়িতে বাসন মেজে খেতে হয় তাদের। ঘরে কি তাদের বসে থাকলে চলে? বাধ্য হয়ে তারা রিনিকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গেল তপন ডাক্তারের কাছে। দেখেই তিনি শিউরে ওঠেন। তাঁর মতো হাতুড়ে ডাক্তারের পক্ষে এ চিকিৎসা করা সম্ভব নয়।
"ওরে, তোরা ওকে হাসপাতালে নিয়ে যা। দেরি করিস না।" সঙ্গে বিস্ময়ে ফেটে পড়লেন তিনি, "এমনটা হল কী করে? এ কী সর্বনাশ ঘটালি সব?"
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল তারা সবাই। হঠাৎ নান্টুই বলে ফেলল, "লাইনের পাথর ছিটকে এসে… আমাদের বস্তির ওখানেই ঘটেছে। একটু দেখো না তাড়াতাড়ি।"
নিচে নেমে এলেন ডাক্তার। কিন্তু গায়ে হাত দিলেন না।
"সাংঘাতিক রক্ত বেরুছে যে! এখানে সম্ভব নয়। তোরা ওকে নিয়ে যা। নয়তো..."
রিনির চিৎকার ছড়িয়ে পড়ছে বস্তিতে। কানু কাঁদছে জোরে জোরে।
"খুব যন্ত্রণা হচ্ছে ওর। কিছু একটা করো না, তপনকাকু।"
"আমি এ ট্রিটমেন্ট করতে পারব না রে। যা দেখছি, এ তো অপারেশন করতে হবে। দাঁড়া একটু। একটা ওষুধ দিচ্ছি। এখনই খাইয়ে দে। আর তাড়াতাড়ি নিয়ে যা। না তো চোখটা হয়তো বাঁচানো যাবে রে। যা শিগগির।"
( ২ )
বস্তির বড়োরা কয়েকজন মিলে গেল তাদের সঙ্গে। রিনিকে ভর্তি করল হাসপাতালে। তবে অনেক ঝক্কি ঝামেলার পর। কিন্তু চোখটাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়ে ওঠেনি কোনোভাবেই।
সপ্তাখানেক হাসপাতালে ভর্তি ছিল রিনি। ডাক্তার তার মাকে বলে দিয়েছেন, "ডান চোখটাও হয়তো কিছু দিন পরেই...
মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি কথাটা আটকে নিলেন ডাক্তার। তবুও বললেন, "তবে হ্যাঁ, কিছুদিন অন্তর অন্তর চেক আপ করিয়ে নিয়ে যাবেন কিন্তু।"
দূরে দাঁড়িয়ে শুনেছিল কানু। ডাক্তারের সব কথাই কানে আসে। শোনামাত্র বুকটা কেঁপে ওঠে তার। বিস্ময়ে মন ভরে যাচ্ছে।
"দুটো চোখ কি তাহলে একেবারেই…"
বাড়ি ফিরল রিনি। অভাবের সংসার। মায়ের উপার্জনে তাদের সংসার চলে কোনোরকমে। মেয়ে কানা হলে দেখবে কে? মায়ের এ কথার গভীরে রিনি প্রবেশ করতে না পারলেও কিছু যে একটা খারাপ তা সে অনুমান করে। কেমন যেন কান্না কান্না পায়। চোখ ছলছল করে। শুয়ে বসে কত কিছুই সে ভাবতে থাকে। এ চোখে কোনোদিন সে আর দেখতে পাবে না। ভাবলেই বাইরের সব কিছু ঝাপসা হয়ে যায়। সেই রিনি আর সেই রিনি নেই। দৌরাত্ম কমে গেছে। চুপ করে থাকে। প্রয়োজনের বেশি কথা বলে না। সারাক্ষণ যেন নিজের মধ্যে নিজেই বুদ হয়ে যায়।
দিন পনেরো পর চোখ খুলল রিনি।
"বাম চোখটা ঝাপসা ঝাপসা লাগছে কেন, মা?"
ডাক্তার বললেন, "আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে রিনি। ও হ্যাঁ, আপনাকে বলছি, আগে যা বলেছিলাম, সেটা কিন্তু মনে রাখবেন। সামনের সপ্তায় ওকে আমার কাছে একটু পাঠাবেন।"
কিছুদিন পর থেকেই বাঁ চোখটা ক্রমশ বুঝে আসছে রিনির। দৃষ্টি ঝাপসা থেকে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। বাম চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। কানুও কেমন যেন নীথর হয়ে যাচ্ছে। আরো কিছুদিন যেতে না যেতে জল পড়াও বন্ধ হয়ে যায়। বাঁ চোখে আর কিছুই দেখতে পায় না। চোখের ভেতরে কেমন যেন অন্ধকার বাসা বেঁধে বসেছে।
রিনিকে যতই দেখে, কানু তত কুঁকড়ে যায়। সব সময় নিজেকে যেন দোষী দোষী মনে হয় তার। বার বার তার মনে হয়,
"সেদিন যদি দিদিকে না নিয়ে যেতাম, তাহলে হয়তো…"
এদিকে বছর না কাটতে কাটতে রিনির ডান চোখটাও ঝাপসা হতে শুরু করে। দুহাতে চোখ কচলায়। আবার দেখে, যে কে সেই, ঝাপসা… ঝাপসা… ঝাপসা… মায়ের কাছে কান্নাকাটি করে, "ও মা, সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। স্পষ্ট করে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। চোখ বেয়ে আগের মতো জল গড়াচ্ছে। তবে কি এই চোখটাও…"
তার মা খেঁকিয়ে ওঠে।
"থাম দিকিনি। সব সময় ম্যা, ম্যা। ঝাপসা হয়ে আসছে… কিছু দেখতে পাচ্ছি না… যা না রেললাইনে যা। মর না গিয়ে। কোথা থেকে আপদ এসে জুটেছে। মর না, মর। আপদ মরলে বাঁচি।"
থামল না সে। বঁটিতে চোখ রেখে আনাজ কুটতে কুটতে তবু গজগজ করছে,
"এখন এই কানা মেয়েকে ঘরে পুষে খাওয়াই আরকি। সেদিন যদি বিদেয় করে দিতুম…"
কানু ঘরেই ঢুকছিল তখন। মায়ের কথা শুনে ফেলে, "কাকে সেদিন বিদেয় করে দিতে মা?"
কানু যে এত তাড়াতাড়ি ঘরে চলে আসবে তা বুঝতে পারেনি তপতী। আমতা আমতা করতে লাগল, "ও… ও… কি-কিছু নয়। তোকে অত জানতে হবে না। যা।"
কানু একটু মনোক্ষুণ্ণ হলো বটে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অন্য কথা বলে, "বোতল আজ বেশি হয়নি মা। এক বস্তা হয়েছে।"
"মাত্র এক বস্তা!"
"হ্যাঁ, মা। আজ ভালো লাগছিল না। দিদি যদি থাকত তো অনেক হতো। ও তো আর… ওর জন্য মন কেমন করছিল।"
"ভাই, আমি আর কোনদিন তোর সঙ্গে যেতে পারব না, নারে? আমার ডান চোখটাও কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। ওটাও মনে হয় নষ্ট হয়ে যাবে।"
রিনির চিবুক বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে টপটপ করে। গলা ধরে আসে তার।
"তোকে, মাকে ভালো করে দেখতে পাই না। তোরাও কেমন ঝাপসা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিস। মা, ও মা? তুমি আমাকে বই কিনে এনে দেবে বলে ছিল না? আনতে হবে না আর। আমি তো আর দেখতে পাবো না। কী হবে আর এনে?"
সবাই চুপ। রিনির কথায় তার মার চোখ দুটোও ভিজে গেল। সারা ঘরটা ঝাপসা হয়ে গেল নিমেষে। রিনিকেও ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না। মুখে কাপড় চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল তার মা। মায়ের ফোঁফানির আওয়াজ কানে আসছে রিনির। গলার ভেতরটায় ভারি কষ্ট হচ্ছে তার। কান্নাটা যেন সেখানে আটকে আটকে যাচ্ছে।
"মা, ও মা? তুমি কাঁদছ? এই ভাই, মাকে কাঁদতে বারণ কর না? মা কাঁদলে আমারও খুব খুব কান্না পায়, জানিস। থামা না, মা'কে।"
তপতি এসে জড়িয়ে ধরল রিনিকে। কানুও ফোঁপাতে ফোঁপাতে এসে জড়িয়ে ধরল তাদের। সারা ঘর জুড়ে এখন কান্নার শব্দ অনুরণিত হচ্ছে।
"মা, আমি আর কোনো দিন পড়তে পারব না, না?"
"কাঁদিস না রিনি। তোকে আমি ঠিক পড়াবো দেখিস।"
নিজের আঁচল দিয়ে রিনির চোখ, মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে ঘন ঘন নাক টানছে তপতি। "ডাক্তার বলেছে, যদি কেউ চোখ দেয়। তবে… না তো আমি আছি। তুই কাঁদিস না রিনি।"
( ২ )
এখন নিজের গালে ঠাস ঠাস করে চড় মারতে ইচ্ছে করছে কানুর। "হাতটা না ছাড়লে এমনটা ঘটত না কিছুতেই। এ কী করলাম আমি?"
কানু আজ আফসোস করে কী করবে? রিনির এ পরিণতির জন্য তাদের কী কোনো ভূমিকা নেই? রয়েছে তো। তারা চাইলে অনেক কিছু হয়তো হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। এর পিছনে তাদের সংসারটাই যেন বড়ো হয়ে উঠেছিল রিনির থেকে। সংসার সংসার করে সে বা তার মা, দিনের পর দিন শুষে নিয়েছে রিনিকে।
তাদের মূল আকর্ষণ হয়ে গিয়েছিল রিনির টাকা। চাকরি করত রিনি। মাস মাইনেটা এনে তুলে দিতে মা'র হাতে। তার মা কী যে খুশি হতো, তা সে মায়ের কথার সুর শুনেই অনুমান করা যেত। যে মা তাকে দুবেলা দূর দূর করত, সেই মা কেমন যেন পাল্টে গেল।
অথচ কাজের বাড়ির ডাক্তার যেদিন রিনিকে নিয়ে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দিল, ব্লাইন্ড একাডেমিতে। সেদিন কেঁদেছিল খুব। সে হয়তো কুমিরের কান্না হতে পারে! কিন্তু সেদিন হাঁপ ছেড়ে বেঁচে ছিল তপতী। যেন ভার মুক্ত হয়েছিল সে।
হোস্টেলে পড়া, থাকা, সব, সব খরচ একেবারে মুকুব রিনির। চাপ মুক্ত হল তার মা। আর সেদিন যদি স্কুলে ভর্তি না হতো, আজ এই টাকাটা কি তুলে দিতে পারত মায়ের হাতে? এই পড়াশোনাটুকু না করলে তার নিজের দশা কী হতো, সে হয়তো উপরওয়ালা মাত্র জানে।
সময়ে সময় গড়াল। স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে কলেজে পা ফেলল রিনি। হোস্টেল ছেড়ে যাতায়াত সুরু করে ট্রেনে, বাসে। তখনই তার চোখ হয়ে ওঠে কানু। যেখানেই যাক, কোনোদিন দিদির সঙ্গ ছাড়েনি সে।
এ ভাবেই হঠাৎই একদিন ট্রেনেই তার আলাপ হলো রূপেশ সেনের সঙ্গে। রূপেশ সেন, রেলে চাকরি করে। তার সঙ্গে আবার গ্রুপ থিয়েটার চালায়। তাদের একটা নাটকের দল আছে, 'দৃষ্টি-প্রদীপ'। বেশ জনপ্রিয়। অবশ্য কলাকুশলীরা প্রায় সবাই দৃষ্টিহীন। কেউ কেউ আবার প্রায়-অন্ধ। এমনকি রূপেশের দৃষ্টি শক্তি ক্ষীণ। হয়তো কয়েক বছরের মধ্যেই নিশ্চিত রূপে পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তি হারাবে সে। ডাক্তার তো তাই বলেছেন। কিন্তু তার 'দৃষ্টি-প্রদীপ'- এর কী হবে? হ্যাঁ, রূপেশের বেঁচে থাকার অন্যতম প্রেরণা এই একাডেমি। তারই তৈরি এই নাট্য-গোষ্ঠী। দৃষ্টিহীনদের নিয়েই তার এই দল। তবে তাদের খুঁজে পেতে বেশি বেগ পেতে হয়নি তাকে। লোকের পরিচয় থেকে যেমন তাদের খুঁজে নেওয়া, তেমনি এই ট্রেন-বাসও এইসব অন্ধের উৎসভূমিও বলতে পারেন। তবে রিনিই আর বাদ যায় কেন? প্রথমে আলাপ, পরে একদিন রিনিকে নিয়ে গেলেন তার আখড়ায়।
তার এই অন্ধের দল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা রাজ্য জুড়ে। স্টার, মধুসূদন, শিশিরমঞ্চ। একের পর এক কেঁপে উঠছে হাততালিতে। সরকারও সাহায্য করছে তাদেরকে। আজ ছিল 'বৃহন্নলা' নাটকের রিহার্সাল। রূপেশই পইপই করে বলে দিয়েছিল,
"কারোর যেন আজ কোনো রকম দেরি না হয়। বিদেশ থেকে সব নামকরা লোক আসছেন। আমাদের রিহার্সেল দেখবেন সরাসরি। পছন্দ হলেই ব্যস! একেবারে বিদেশে শো।"
কিন্তু ট্রেনের জন্য রিনিদের আজ দেরি হয়ে গেছে বেশ। তাই তারা শর্টকাট রাস্তা বেছে নিয়েছিল। এদিকের রেললাইন টপকে গেলে গন্তব্য অনেকখানি কমে যাবে। সময়ও লাগবে কম। তাই এই পথে পা বাড়ায়। কিন্তু বাধ সাধল কানুর জুতো। কি যেন একটা ঢুকে গেছে ভেতরে। তাই সে হাতটা ছেড়ে দিয়ে ছিল রিনির। ব্যস, ততক্ষণে যা ঘটার ঘটে গেছে।
লোকজন ঘিরে ধরেছে তাকে। ট্রেনও থমকে আছে প্ল্যাটফর্ম লাগোয়া। কতক্ষণে বডি সরাবে কে জানে! কানু একেবারে ভেঙে পড়েছে। কাটা হাতখানা এখনো জ্যাপ্টে ধরে আছে বুকে। অপরাধবোধ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। মনটা তাকে ক্ষত বিক্ষত করছে, তাদের জন্যই তো আজ রিনির এই পরিণতি।
তবে তাদের একেবারে দোষ দেওয়া যায় না। তার জন্য রিনিই খানিকটা দায়ীও বটে। যদি সে তার মা'র কথা শুনত, এমনকি কানুর কথাটাও যদি গুরুত্ব দিত, তাহলে তার জীবনটা এতদিনে হয়তো পাল্টে যেত। শুনলে অন্তত এমনটা ঘটতো না।
কানু আজ হাত কামড়াচ্ছে, "রূপেশদার সঙ্গে জোর করে পাঠিয়ে দিলেই ঠিক হতো। তাহলে অন্তত এমনটা দিন দেখতে হতো না তাকে।"
এক সময় রূপেশই প্রস্তাব দিয়েছিল রিনিকে। বিয়ে করে তাকে ঘরে নিয়ে যেতে চায়। তপতীর কথা ভেবে একদিন বিয়েও করে নেয় রিনি।
ঋতু গেল বদলে। পাতা ঝরে ঝরে পড়ল… দিন থেকে মাসে। কানুও বিয়ে করে উঠল বস্তিতে। যেন খুব তাড়াতাড়ি পাল্টে গেল সব। তার থেকে বেশি পাল্টে গেল তপতী। দিন দিন কেমন যেন মন-মরা হয়ে থাকে। শুকিয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। আগের মতো কথা বলে না। কাজ কমিয়ে দিয়েছে। কানুর ফেরার আশায় পথ চেয়ে বসে থাকে। বাড়িতে দুবেলা অশান্তি। কানু কাজের খুঁজে বেড়ায়। সারাদিন ঘুরে ঘুরে বাড়ি ফেরে। বিষণ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে তপতী আরো আরো নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সংসারে অভাব থাবা বসাতে শুরু করে।
রিনি আর এমুখো হয় না। মাস তিনেক কেটে গেল। তপতীকে আজকাল আর কেউ কাজে নেয় না। কানু কাজ জোটাতে পারেনি আজও। দিন কয়েক করে ঠিকে খাটে। তারপর যে কে সেই।
ওদিকে বাড়ির জন্য রিনির মন খারাপ করে করে বেশি বেশি করে। একদিকে অফিসের কাজের চাপ। অন্যদিকে রূপেশ আজ নয় কাল করেই যাচ্ছে। মা'র জন্য ইদানিং খুব কান্না পায়।
তপতীদের অভাবের বহর ক্রমশ বেড়েই চলল। রিনির অভাব আজকাল খুব খুব বেশি টের পায় সকলে।
একদিন অফিস ফেরার পথে মা'র কাছে আসে রিনি। একা। রূপেশকে ছাড়া।
( ৩ )
কানুরা বেশ কয়েকদিন বাড়িতে নেই। শ্বশুরবাড়ি গেছে। তপতী একা। ভালো করে চলাফেরা করতে পারছে না। পিঠের নিচটায় বেশ ব্যথা। মাঝে মাঝে টনটন করে ওঠে। এক এক সময় মনে হয়, এই বুঝি মরেই যাবে।
সামনের বাড়ির কাজল এসে এ ক'দিন তাকে দেখে দেখে যাচ্ছে। কখনও বা অনেকক্ষণ থেকে যায়। এটা ওটা গল্প করে দুজনে। তবে তারা খুব কাছের মানুষ। দীর্ঘদিন পাশাপাশি রয়েছে বোনের মতো। আপদে বিপদে পরস্পরের ভরসা তারাই। কাজল এখনো বেশ ডাঁটো আছে। তপতীর হাল তার মতো নয়। এখনো সে লোকের বাড়ি কাজ করে। কত রকমের কাজ। খরচ নিজে চালায়। কারোর কাছে হাত পাততে হয় না তাকে।
আজ কাজলের কাজ নেই। বাবুরা সব বেড়াতে গেছে। তার ছুটি। তপতী নিজের বিছানায় বসে বসে সে পান চিবুচ্ছে।
"দেখলি তো, আজ আমার কথা কেমন সত্যি হয়ে গেল। এল তোর রিনি? বুঝলি না! কুমির, কুমির, একবার খাল পার হয়ে গেছে তো! আর আসবে?"
কষ্ট করে তারই দিকে পাশ ফিরে শুতে শুতে বলল তপতী, "তুই থাম দিকি কাজল। ভর সন্ধেয় মেয়েটটার নামে এমন করে বলিস নি। ওর অমঙ্গল হবে।"
কাজলের মুখটায় তাচ্ছিল্যে ভরে গেল। তবুও নিজের মত মিলে যাওয়ার অহংকারে স্বমহিমায় গদগদ হয়ে উঠল সে, "অমঙ্গল আবার কিসের লো শুনি? তখনই বলেছিলুম ও আপদ বিদেয় কর। না, কোলে পিঠে করে মানুষ করলি? ও আম গাছের ছাল জাম গাছে লাগে রে?"
রিনি সেই সময় ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল, কিন্তু কথাগুলো শুনেই থমকে গেল বাইরে। কিন্তু কাজলের কথা থামেনি। রিনি বাইরে থেকে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, "এখন বর পেয়েছে, ঘর পেয়েছে। আর কি সে এমুখো হবে? এখন তো শুনি টাকা দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। মা, ভাই খেল কী খেল না, তার খোঁজ করছে একদিনের জন্য?"
সত্যিই এ দুমাসে তপতী টাকা হাতে পায়নি। কানুও বেকার। উপার্জন নেই । তপতী নিজেও অসুস্থ। সংসারের অবস্থা শোচনীয়। মনে মনে তারও অভিমান জন্মায়। পিঠের ব্যথায় নিজেও এই যায়, এই যায় ভাব। দানা বাঁধা অভিমান অনুযোগের হাত ধরে বেরিয়ে আসে,
"সে পর-ঘরী কাজল। তার নিজের একটা সংসার হয়েছে। সে আর কোন দিক সামলাবে শুনি? মেয়ে যতদিন ঘরে থাকে ততদিনই নিজের। বিয়ে হয়ে গেল, তো গেল!"
"তাই বলে মা'র খোঁজ নেবে না? এ কেমন মেয়ে দিদি? তাছাড়া ও তো জানে তোমাদের সংসারের হাল। ভাইটাও বেকার, বাউন্ডুলে। তার উপর তুমি অসুস্থ মানুষ। একটু ওষুধপত্রও কেনার পয়সাও নেই। টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিল একেবারে। তোমাদের কথা ভাবলো না একটুও!"
"তুই থাম দিকি। সেও কেমন আছে? কী অবস্থায় আছে? তা কি জানি?"
"যাই বলো দিদি, পর পরই।"
কাজলের কথাটা ফেলনা নয়। সে তপতী খুব ভালো করে জানে। সেদিনের কথা মনে পড়লে ছবির মতো তা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। গভীর রাত। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে বস্তিতে। রেলের জমিতে বস্তি, অনেক ঘর। বাতাস ভরে উঠছে আর্ত-চিৎকারে, "ওরে, সব কায়দা করে আগুন লাগিয়েছে রে। সবাইকে তাড়াবে বলে এই প্লান করেছে ওরা।"
"আমাদের সব শেষ করে দিল একদম।"
আগুন যে ভাবে ছড়িয়েছে দর্শকের মতো দেখা ছাড়া আর কারোর কোনো উপায় নেই। এক সময় ব্যর্থ চেষ্ঠায় নিরাশ হয়ে পড়ল সবাই। হা-হুতাশ করতে করতে আশ্রয় নেয় রেল লাইনে। কোথাও কোথাও আগুন লেগে দরমার বেড়া, প্লাসিকের চাল দাউ দাউ করে জ্বলছে। কালো কালো কুন্ডলীকৃত ধোঁয়া সাপের মতো পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে শূন্যে।
উদ্ভ্রান্ত সবাই। মাথার ঠিক নেই কারোর।
রাতেই অবরোধ শুরু হলো। থমকে গেল দূরপাল্লার গাড়ি। সেই সুযোগে বুঝেই কারা যেন লুটপাট শুরু করে দিল। একসঙ্গে কয়েকটা কোম্পার্টমেন্ট থেকে যাত্রীদের চিৎকার, কান্না ভেসে আসছে অন্ধকার
শরীরে। প্রাণের মায়ায় কেউ কেউ লাফিয়ে পড়ছে নিচে। কে যে বস্তির লোক, আর কে যে যাত্রী, তা এখন বুঝে ওঠা কষ্টকর। লুটপাটে ঘটনায় বস্তির নিরাশ্রয় মানুষগুলো আরো আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। ড্রাইভারও কাঁপছে থরথর করে। প্রাণের মায়া কার নেই? বাঁচতে কে না চায়? আপন প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ তো প্রায় সবারই। হর্ন বাজিয়ে দিল ড্রাইভার। গাড়ি স্টার্ট করতেই তার কেবিনে অনেকেই ওঠার চেষ্টা করল। কেউ গেল পড়ে। কেউ রইল ঝুলে। ব্যর্থতায় মরিয়া হয়ে উঠল অনেকেই। পাথর ছুঁড়তে শুরু করল বৃষ্টির মতো। কিন্তু গাড়ি যে যেভাবে ছাড়বে, অন্ধকারে তা অনেকেই বুঝে উঠতে পারেনি। লাইন কাঁপিয়ে ট্রেন গেল বেরিয়ে জোরে।
"ওরে কাটা পড়েছে। কাটা পড়েছে সব। হে ভগবান, একি কী হয়ে গেল রে!"
"শেষ হয়ে গেল সব। ওরে কে কোথায় গেলি?"
লাইন জুড়ে মৃত আর কাটা মানুষ। যেদিকে তাকাও রক্তের মাখামাখি। অসহায়ের আর্তনাদ। মুহূর্তে তোলপাড় হয়ে যায় সব কিছু। ক্ষেপে ওঠে বস্তির মানুষজন। যে যা পেয়েছে তাই নিয়ে হাজির, লাইন উপড়ে ফেলবে তারা। মরিয়া চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে সবাই। কিন্তু তাদের উদ্যোমে জল ঢেলে দেয় জি আর পি দল। কোথা থেকে দুটো গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে গেল, দূরে। জিআরপিতে ভরে এল লাইন চত্ত্বর। বেধে গেল খন্ড যুদ্ধ। ছত্রভঙ্গ হল সবাই। বাঁচার আর্তনাদ, বস্তিহারা মানুষের বেদনদীর্ন আকুতি ছড়িয়ে পড়ল রাতের গভীরে।
একে ঘর পোড়া, আশ্রয়হীন। তার উপর খন্ড যুদ্ধে অনেকেই আহত, রক্তাক্ত। যে যার মতো আশ্রয় নিল, গাছের তলায়, প্ল্যাটফর্মে শেডের নিচে। কেউ বা লাইনের তলায়, আন্ডার পাশে।
তপতীর ঘুম ভেঙে যায় ভোরেই। কানুকে ডাকতে গিয়ে চমকে ওঠে। "একি! কানুর পাশে ওঠা কে? ওমন করে শুয়ে আছে! কানুর থেকে হয়তো একটু বড়ো হবে তো মেয়েটা। গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে শুরু করে তপতী। "এই মেয়ে এখানে কেন? ওঠ বলছি? ওঠ না…"
বলেই ঠেলে দেয়। কোনো সাড়া দিল না সে। ধুলো, কালি লেপে রয়েছে মুখ জুড়ে।
আবার ডাকে তপতী, "এই মেয়ে, ওঠ না… কোথা থেকে এসে আবার উঠকো ঝামেলা বাধলো। এই মেয়ে…"
চোখ ঘষতে ঘষতে উঠে বসে মেয়েটা। কান্না শুরু করে দেয়, "আমি মায়ের কাছে যাবো, আমার মা কোথায়? আমি মায়ের কাছে যা…"
"চুপ চুপ… আমি মায়ের কাছে যাবো। কে তোর মা শুনি? কোথায় সে গব্বধারিণী? একে নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তারপর ম্যা, ম্যা করছে। যা… যা না। খুঁজে নে গে যা।"
কে কাকে খুঁজবে? রাতের ট্রেন লুট, গন্ডগোল, লাশের পর লাশ, রক্তারক্তি, সব ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। কয়েকটা লাশও পড়েছে এখনো। কে কে আছে আর কে কে নেই, সে হিসেব দেবে কে? তার মধ্যে ওর মা-বাবা আছে কিনা সেটাই বা কে জানে?
কিন্তু সে যাই হোক। বস্তির লোক জানাজানি হয়ে গেলে থানা-পুলিশ, কম ঝক্কি? আবার স্বেচ্ছায় থানায় গেলে ছেলে চুরির দায়ে ফটকে না ঢুকিয়ে দেয়! ঐ ঝক্কির থেকে মনকে জোর দেয় তপতী, "মেয়েটাকে নিয়ে নানা কথা উঠলে উঠবে! যে বলবে সেই তাহলে তার দায়িত্ব নেক।"
কেউ দায়িত্ত্ব নিল না। পুচকুর মা অবশ্য বলেছিল, "ওলো, ওকে পুলিশে দিয়ে আয় তপতী।"
কাজল চুপ করনে-ওয়ালী নয়, খড়খর করে উঠল, "হ্যাঁ, দিতে যাক আর চুরির দায়ে জেলে যাক। তাই তো?"
"জেলে গেলে কানুর কি হবে? ও কি বানের জলে ভেসে যাবে নাকি?" বলেই তপতী কানুকে জ্যাপ্টে ধরে।
"ওর থেকে তুই নিজের কাছে রাখ তপতী। পরে কিছু হলে দেখা যাবে 'খন।"
সেদিনই কেমন যেন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল তপতীর। কাউকে না জানিয়ে দুপুরে মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে উঠল কুসুম কলোনিতে।
বছরখানেক পরেই আবার ফিরে আসে, বাসন্তী কলোনিতে। সরকার থেকে ঘর করে দিয়েছে ক্ষতিগ্রস্তদের। তপতীও পেয়েছে একটা।
কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ রিনির খোঁজ করেনি।
হোস্টেল থেকে ফিরে এসে ওঠে মা, ভাইয়ের ঘরে, বাসন্তী কলোনিতে। কলেজ পাশ করেই চাকরি পায় রিনি। খুশিতে ফেটে পড়ে কানু,
"দিদি, শোন না। তুই এবার বিয়ে কর।"
কানুর কথায় লজ্জা পেলেও চুপ করে থাকেনি রিনি, "তুই না? সবে চাকরি পেয়েছি। এখন নয় ভাই। তাছাড়া কে বা বিয়ে করবে? আর আমি গেলে তোকে, মাকে দেখবে কে বল শুনি? তোর একটা কাজ হোক আগে, মার শরীরটা ভালো হয়ে উঠুক, তখন ভেবে দেখব।"
"তাই বলে তুই…"
"তাছাড়া এসবের কী দরকার? তোরা তো আছিস।"
"তাই বলে তুই বিয়ে করবি না?"
"কানা মেয়ে কে বা বউ করে নিয়ে যাবে বলতো?"
"সে আমি দেখব খন। তুই রাজি হ।"
একদিন রাজি হয়ে গিয়েছিল। রূপেশের সঙ্গে বিয়ে হয়ে ছিল তার। বিয়ের পর আজ একা একা এসেছে সে এখানে। কিন্তু ঘরে পা ফেলার আগে এ কী শুনল সে? "কানু, মা আমার নিজের কেউ আমার নয়? নিজের কানকে সে বিশ্বাস করতে পারল না। সংশয়ে দাঁড়িয়ে রইল বাইরে। হঠাৎ কাজল বেরিয়ে এল। চমকে উঠে রিনিকে দেখে। আমতা আমতা করতে থাকে কাজল, "তু-তুই, ক-কতক্ষণ? বা-বাইরে কে-কেন ভেতরে আয়।"
"না, এই তো। আসছি। মা ও মা?"
"ভেতরে যা, তোর মা'র শরীর ভালো নয় রে। পারলে একটা ডাক্তার দেখিয়ে নেস।"
কাজলের কথা শুনতে শুনতে ভেতরে ঢোকে রিনি।
শুয়ে ছিল তপতী। এতদিন পরে মেয়েকে দেখে উঠে বসতে চাইল। কিন্তু উঠতে গিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তবুও জোর করে উঠল। ঠেস দিয়ে বসল দেওয়ালে।
"কেমন রোগা রোগ হয়ে গিয়েছিস। কতদিন দেখিনি তোকে।"
চোখ ভিজে আসছে তপতীর। মায়ের কথায় গলা ভারী হয়ে আসল রিনির, "ভাবছ আমি পর হয়ে গেছি না? আর হয়তো আসব না, তাই তো? আচ্ছা, আমার খবর নাই বা নিলে? কিন্তু তোমার শরীর খারাপ একবারের জন্য খবরও দিলে না আমাকে? ভাই কোথায়?
"শ্বশুরবাড়ি গেছে।"
"তোমাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে…"
"আমাকে নিয়ে তারা সর্বক্ষণ কী পড়ে থাকবে? তাদেরও তো শখ-আহ্লাদ আছে, নাকি?"
"তাই বলে…"
"এসব বাদ দে রিনি। তুই কেমন আছিস বল?"
রাগ হয়েছে রিনির। মুখ ভারী হয়ে গেছে। মাকে ফেলে রেখে কানু শ্বশুরবাড়ি… ভাই যে এমন করতে পারে ভাবতে পারেনি রিনি। তাই তপতীর কথার উত্তর দেওয়ার আগেই সে বলে ফেলে, "ওঠো তো, ডাক্তারের কাছে যাব। ওঠো…"
একটা রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রিনিরা।
( ৪ )
কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে তপতীর। না পাল্টালে বেশি দিন বাঁচবে না আর।
বেশি দেরি করেনি রিনি। ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজের সব টেস্ট করিয়ে নিয়ে ছিল। সে জেনে গিয়ে ছিল, একটা কিডনি নিয়ে মানুষ তো বেঁচে থাকতে পারে। তাই স্থির করে ফেলেছিল যদি একটা কিডনি মাকে দিই, তাতে ক্ষতি কী? সর্বোপরি মা তো! "
কিন্তু তপতী রাজি হয়নি। মন সায় দেয় না তার, "এই ভাবে মেয়েকে শেষ করে দিতে পারব না কিছুতেই। নাই বা হলো সে আমার নাড়ি ছেঁড়া ধন, তাই বলে… না, না। এতে যদি মরে যাই, সেও ভালো। আর মরে গিয়ে মেয়েটাকে যদি চোখ দুটো দিয়ে যেতে পারি, তাহলে হয়তো মরেও শান্তি পাবো। আমার চোখেই নয় সে জগত দেখবে।"
দিন যায়। মা মেয়ে শলাপরামর্শ করে। কিন্তু কেউ কিছুতেই রাজি নয়। কানুও ফেরে। শুধু আলোচনা হয়। সমাধান হয় না কোনোমতেই। যে যার জায়গায় অনড়।
একদিন রূপেশ এসে হাজির। বেশ রাগান্বিত সে। শুরু কথা কাটাকাটি।
"এইভাবে আর কতদিন চলবে রিনি? এখানে দিনের পর দিন পড়ে আছ। আজকাল অফিস কামাই করছ প্রায়ই। রিহার্সেলেও আসছ না। বাড়ি আর ফেরার ইচ্ছে নেই নাকি?"
শেষের কথাটা রিনিকে বেশ নাড়িয়ে দিল। "কী বলতে চাইছ তুমি?"
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল রূপেশ, "যা বলছি তা বুঝতে পারছ না? মা, ভাই তার সংসার করে করে নিজে শেষ হবে নাকি? আর কী তোমার অন্য কাজ নেই? এখানে পড়ে আছ?"
মা, ভাই, সংসার নিয়ে কথা? আত্ম ধিক্কারে কেঁপে উঠল রিনি, "এতদিন এরাই তো ছিল আমার সব। তখন তুমি কোথায় ছিলে শুনি? এদের অভাবে, অনটনে আমি মুখ ফিরিয়ে নেব আজ?"
"আর, আমি কেউ না? আমার সংসার? আমাদের স্বপ্নের…"
"তোমার স্বপ্ন আর আমাদের স্বপ্ন এক নয় জেনো। আমার স্বপ্ন এরা, এদের ভালো থাকা। এসব তুমি বুঝবে না। তাছাড়া একদিন এরাই আমাকে রেললাইন থেকে…"
কথা আটকে গেল তার। আবেগের বসে কী বলে ফেলছিল সে?
তপতী চমকে ওঠে। যে কথা এতদিন চাপা ছিল, আজ কেমন করে প্রকাশ্যে এল? "রিনি, এসব কী বলছিস তুই?"
"ঠিকই বলছি মা। সত্যটা তুমি ভালো করেই জানো। এতদিন কেন লুকিয়ে রাখলে আমার থেকে?"
তপতী চুপ।
কিন্তু এ কী শুনছে রূপেশ? মন তোলপাড় হচ্ছে তার, "রিনি এদের মেয়ে নয়! সেজন্যই কী রিনিকে হোস্টেলে রেখে দিয়েছিল? আর চাকরির টাকাগুলো হাতিয়ে নিয়েছে মাসে মাসে?"
রূপেশ উঠে দাঁড়াল। তপতীর উদ্দেশ্যে শোনালো, "যা শুনলাম, সব সত্যি মা? বিয়ের আগে কই আমাকে একবার শোনালে না তো?"
তপতী কাঁচুমাচু করছে, কী উত্তর দেবে সে? এতদিন যাকে বুকে আগলে রাখল, মানুষ করল, পেটে ধরেনি বলে সে পর? তার মেয়ে নয়?
ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারল না রূপেশ। তার মনে হল, কোথায় যেন সত্য
গোপন করা হয়েছে তার থেকে। মনে হল, কোথায় যেন এই সংসার শুধুই রিনিকে ব্যবহার করেছে এতদিন, এত বছর। এগিয়ে গেল রিনির দিকে, "বাড়ি চলো রিনি। আর এখানে নয়।"
হঠাৎ রূপেশের মনে হতে লাগল, "কানু কী তাহলে এই জন্যই কোনো কাজকর্ম খুঁজেনি? দিদির উপার্জনে ভর করে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে? বিয়েটাও করল কী রিনির ভরসায়? মায়ের কোনো দায়িত্ব পালন করল না এ যাবত?"
কোনো হেলদোল নেই রিনির। পাথরের মতো নিথর। রূপেশ আবার বলল, "কী হল, যাবে না নাকি? আর এক মুহূর্ত নয় এখানে। চলো…"
"না। আমি আর কথাও যাব না। তুমি ফিরে যাও", ধীর স্থির শান্ত সমাহিতের মতো উত্তর করল রিনি।
"এর পর এখানেই পড়ে থাকবে?" বিস্ময়ে ফেটে পড়ল রূপেশ।
"হ্যাঁ, হ্যাঁ… এর পরেও…"
কানুর বউ বেরিয়ে এল বাইরে। একটা মেয়ে হয়ে আরো একটা মেয়ের জন্য প্রাণ উদ্বেলিত হলো তার, "দিদি, ছোটো মুখে বড়ো কথা হয়তো হয়ে যাবে, রূপেশদা ঠিকই বলছে, তুমি দাদার সঙ্গে ফিরে যাও। নিজের জীবনটা গুছিয়ে নাও গিয়ে।"
"কোন মুখে ওর সঙ্গে ফিরে যাই বল তো? যাদের এতদিন আঁকড়ে বাঁচলাম, এতদিন পরে জানলাম, তারাই আমার কেউ নয়। এক মুহূর্তে তারা সবাই কেমন যেন পর পর হয়ে গেল।"
"দিদি…"
"হ্যাঁ, রে… এই যে তোরা, মা, ভাই, তুই, সবাই দূরে ঠেলে দিলি আমাকে। যাকে এতদিন মা বলে ডেকে এলাম, জানলাম সে আমার নিজের মা নয়… বুকটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে রে…"
রূপেশ এসে হাত ধরে রিনির, "বাড়ি চলো রিনি। আমি তো আছি…'
"তা আর হয় না… তুমি ফিরে যাও…"
"বেশ, তোমার জীবন তোমারই। তবে ফিরে আসার জন্য আমার পথ তোমার জন্য খোলা থাকবে চিরকাল। চলি…"
বলেই নিচে নেমে এল রূপেশ।
কানুর জিহ্বা যেন এতক্ষণ আড়ষ্ঠ হয়ে ছিল। নিজেকে বারবার ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে তার। নিজের পুরুষত্বে নিজেই মুখ লুকিয়ে ছিল যেন। একবারের জন্য এগিয়ে গেল না দিদির কাছে। জোর করে বলতে পারল না, "দিদি, তুই ফিরে যা। দেখিস, আমি এবার একটা কাজ ঠিক জোগাড় করে নেব। মায়ের ওষুধ ঠিক ঠিক কিনে দেব।"
রূপেশের পথ আটকাতেও পড়ল না সে। এখন রিনির কাছে গিয়ে বলল, "তুই, আমার দিদি, নাই বা হলাম আমরা একই মায়ের পেটের। আমাকে, মাকে একটু মানিয়ে নিতে পারবি না? হ্যাঁ, মা তোকে ছোটোবেলায় খুব গালাগালি দিত, দূর ছাই করত। কিন্তু এক থালায় ভাত মেখে গালে তুলে দিত। একবারও তোকে পর বলে সরিয়ে দিয়েছে কি, বল?"
রিনির চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে টপটপ করে। কানুর কথাগুলো গিয়ে বুকে বাজছে বেদনার আঘাতে, "তুই থাম কানু, থাম… তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে? তোদের ছেড়ে আমিও কোথাও যাব না রে…"
কানু গিয়ে জড়িয়ে ধরল দিদিকে। কান্নার
রোলে ভরে উঠল বাতাস। রিনি ফোঁফাতে ফোঁফাতে বলল, "কিরে আমাকে এখানে তোরা একটু থাকতে দিবি তো? মা, কানুকে বলো না, আমাকে যেন তোমার কাছে থাকতে দেয়।"
ঘরের ভেতর থেকে তপতীর কান্না ফুঁপিয়ে উঠল জোরে।
অথচ আজ কানুর মনে হচ্ছে যদি জোর করে রূপেশদার সঙ্গে পাঠিয়ে দিত, তাহলে রিনির এই পরিণতি ঘটত না। কাটা হাতখানা এখনো বুকে জ্যাপ্টে ধরে বসে আছে লাইনের মাঝে।
"বলছি কি, ওঠা দিন, লাশটার সঙ্গে বেঁধে নেই। দিন…"
কাটা হাতটা কানু এগিয়ে দিল তাদের দিকে। পাথরের মত নিশ্চল হয়ে বসে রইল সেখানে। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তার।
বেশিক্ষণ লাগেনি প্লাস্টিকে মুড়ে ফেলল লাশটা। তারপর ঝুলিয়ে নিল বাঁশে। লোকজন সরতে শুরু করল। ট্রেন ছাড়ল হর্ন বাজিয়ে।
কাঁদতে কাঁদতে তাদের পিছু নিল কানু।