প্রবন্ধ - প্রমিত বসু
Posted in প্রবন্ধ‘প্রতিটি অক্ষর আর সুর মেপে চলি
প্রতি নিঃশ্বাসে সুকুমার রায় বলি’ - কবির সুমন
অনেকে বলে থাকেন ‘শিশুসাহিত্য আসলে শিশুদের জন্য নয়’। সুকুমার রায়ের রচনা পড়লে বহুলকথিত সেই আপ্তবাক্যটাই প্রথমে মনে পড়ে।
নিছক হাস্যরসিক কিংবা শিশুসাহিত্যিক নন, সুকুমার রায় নামক মহীরুহের লেখায় পাওয়া যায় একাধিক স্তর যার প্রতিটিতে রয়েছে নিবিড় সচেতনতার ছোঁয়া। স্তরগুলো খুঁড়লে দেখা যাবে উৎসমূলে রয়েছে মানুষের প্রবৃত্তিগুলোর প্রকাশের ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি অথবা কোনো অন্তর্নিহিত সমাজচেতনা। কিন্তু এত সব কিছুর ওপরে থাকে এক লঘু হাস্যরসের মোড়ক। তাই আপাতভাবে সেটা শিশুদের পাঠের উপযুক্ত আর উপভোগ্য হয়ে উঠলেও তার ভেতরে প্রাপ্তমনস্করা খুঁজে পায় এক সহজাত বার্তা বা উপদেশ। কিন্তু সেই বার্তা বা উপদেশ কখনোই নীতিকথার আদলে বাইরে থেকে নিক্ষিপ্ত নয়, বরং তা যেন ভেতর থেকেই প্রকাশ পায়, তাই উপভোগের মাত্রা কোনোভাবেই ব্যাহত হয় না।
যেমন ‘বাবুরাম সাপুড়ে’তে ‘যে সাপের চোখ নেই, শিং নেই, নখ নেই’ তাকেই ‘তেড়ে মেরে ডান্ডা, করে দিই ঠাণ্ডা’ গোছের বীরত্ব দেখানো সমাজের অনেক আপাতসাহসী চরিত্রের আসল রূপটা এক ঝটকায় সবার সামনে এনে ফেলে।
ছায়াবাজি কবিতায় ‘চাঁদের আলোয় পেঁপের ছায়া ধরতে যদি পার, শুঁকলে পরে সর্দিকাশি থাকবে না আর কারো।’ পড়লে মনে হয় এটা যেন আর একটা টোটকা নিদানকারী ব্যবসায়ীর প্রতারণামূলক প্রচার যা আজও আমরা দেখে চলেছি, শুধু তার বিন্যাস বা মাত্রার তারতম্য হয়েছে এই যা।
‘ভয় পেয়ো না’ কবিতায় প্রথমে ভালোমানুষের ভেক ধরে একরকমের নিশ্চয়তা প্রদান--- ‘মাথায় আমার শিং দেখে ভাই ভয় পেয়েছ কতই না/ জানো না মোর মাথার ব্যারাম, কাউকে আমি গুঁতোই না?’ তারপর এল আসল প্রস্তাব, ‘এস এস গর্তে এস, বাস ক’রে যাও চারটি দিন’। তাতেও কাজ না হওয়ায় আসল রূপ বেরিয়ে এসে চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি, ‘অভয় দিচ্ছি শুনছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দু’টা?/ বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা!’ শৈশবে যেমনই লাগুক, সাবালক হয়ে নতুন করে পড়তে বসলে পাঠকের মনে যেন সত্যি ভয় ধরে যায়। কি অনায়াসে আজকের দিনে চারপাশের বহু ঘটনার সাথে মিলে যায় এই লক্ষণগুলো।
তেমনি আবার এত বছর পরেও ‘প্যাঁচা আর প্যাঁচানি’ পড়লে মনে হয় এর চেয়ে ভাল প্রেমের কবিতা আর কী আছে? যেখানে পেঁচির চ্যাঁচানিও প্যাঁচার কাছে ‘চাঁদমুখে মিঠে গান’ হয়ে ওঠে।
‘ভুতুড়ে খেলা’ কবিতার চিত্রাঙ্কনে ভূতের চেহারায় যেন দেখা যায় আপাতদৃষ্টিতে সমাজের একজন প্রান্তিক অসুন্দর মায়ের ছবি। কিন্তু ‘ওরে আমার বাঁদর-নাচন আদর-গেলা কোঁত্কা রে, অন্ধবনের গন্ধ-গোকুল, ওরে আমার হোঁত্কা রে!’ পংক্তিতে সন্তানস্নেহের যে চিত্র ফুটে ওঠে তা দেশ-কাল নির্বিশেষে মাতৃত্বের এক চিরন্তন প্রতিচ্ছবি।
আবার অতি পুরোনো পরিচিত রামায়ণের গল্পে এক নতুন মাত্রা যোগ হয় যখন দেখি ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’-এ বিভীষণ আর সুগ্রীবের মধ্যে চলে একটা সূক্ষ্ম ইগোর লড়াই। তারা দু’জনেই রাজা বা সম্ভাব্য রাজা। যতই এক শিবিরে থেকে একসঙ্গে যুদ্ধ করুক, ভেতরে ভেতরে চলতে থাকে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার পালা--- সুযোগ পেলেই একে অপরকে খোঁচা দিতে কেউ ছাড়ে না। কিন্তু সবটাই থাকে নির্দোষ লঘু হাস্যরসের এক অদৃশ্য সীমানার মধ্যে।
যুদ্ধের সময় সুগ্রীবকে হাঁটতে দেখে বিভীষণ বলে ওঠে, ‘দেখ, হাঁটছে দেখ - বাঁদুরে বুদ্ধি কিনা! ধ্যুৎ! যুদ্ধ করতে এসেছিস, এমনি করে হাঁটলে লোকে বাঙাল বলবে যে! এমনি করে হাঁট।’ উত্তরে সুগ্রীব বলে, ‘রেখে দাও তোমার ভড়ং! আমাদের দেশে ওরকম হাড়গিলের মতো করে হাঁটে না!’
শিশু বয়সে পড়ে ঘটনাগুলোর উপরিগত লঘুতায় যেমন হাসি পায়, বয়:প্রাপ্তির পর পড়লে উপভোগের মাত্রাটা একই থাকে, কিন্তু জন্ম হয় অনেকগুলো নতুন উপলব্ধির। বুঝতে পারা যায় তাঁর লেখার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে সময়ের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের ব্যবহারের ধারাবাহিকতার কথা।
সুকুমার রায়ের লেখা পড়তে গিয়ে বেশ কিছু জায়গায় অচেনা নাম বা পরিস্থিতির উল্লেখ দেখে বেশ হোঁচট খেতে হয়। প্রশ্ন জাগে এরা কারা বা ঘটনাটার প্রসঙ্গটা আসলে কী? যেমন ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’এ রাবণ বলে, ‘আমি পালোয়ান স্যান্ডো সমান/ তুই ব্যাটা তার জানিস কী?/ কোথায় লাগে-বা কুরো পাটকিন/ কোথায় রোজেদ ভেনিস্কি?’ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে এই কুরো পাটকিন বা রোজেদ ভেনিস্কি কারা? অনেক খোঁজাখুঁজির পর বুঝতে পারা যায় যে রোজেদ ভেনিস্কি আসলে Zinovy Rozhestvensky, রাশিয়ার নৌবাহিনীর admiral। জাপানের সাথে Battle of Tsushima তে রাশিয়ার নেতৃত্বে ছিলেন। আর কুরো পাটকিন হচ্ছেন Aleksey Kuropatkin, এককালে রাশিয়ার যুদ্ধমন্ত্রী ছিলেন।
কিছু কবিতায় এতটা স্পষ্ট করে বলা না থাকলেও কতিপয় সমকালীন ঘটনার একটা অভ্যন্তরীণ বিবরণ আছে। যেমন 'লড়াই খ্যাপা' কবিতাটা হয়ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সৈনিকদের বীরত্বের ওপর ভিত্তি করে রচনা। আবার 'একুশে আইন' হয়ত বা ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার আরোপিত রাওলাট আইনের উদ্দেশ্যেই রচনা। এই ব্যাপারে নীলাদ্রি রায়ের 'আলোয় ঢাকা অন্ধকার' বইটিতে আবোল তাবোলের কবিতাগুলোর সঙ্গে সমসাময়িক কোনো ঘটনা বা সামাজিক প্রথার সঙ্গে মিলিয়ে খুব বিশদে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
সুকুমারের কাব্যপ্রতিভা, রসবোধ বা সমাজচেতনার বাইরে রয়েছে ওঁর নিজস্ব অর্জিত ইন্দ্রিয়জ্ঞান, সেখানে বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গুলো সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়ে তৈরী করে এক নতুন চেতনার। ‘শিল্পে অত্যুক্তি' প্রবন্ধে এক জায়গায় তিনি বলছেন, 'আমাদের ভিন্ন-ভিন্ন ইন্দ্রিয়গুলি প্রত্যেক ঘটনা সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন রকমের সংবাদ দেয়। বাহির হইতে আলোচনা করিয়া দেখিলে রূপ রস গন্ধ স্পর্শ এগুলি সমস্তই স্বতন্ত্র ব্যাপার বলিয়া ঠেকে কিন্তু মনের মধ্যে এই সমস্ত যখন একটা অখণ্ড 'রসমূর্তি'তে পরিণত হয়, তখন তাহার মধ্যে কতখানি চাক্ষুষ, কতটা শ্রুত, আর কতটা অন্য কিছুর প্রতিধ্বনি, তাহা বিচ্ছিন্ন করিয়া বাহির করা একরূপ অসম্ভব হইয়া পড়ে।'
আর সেই 'রসমূর্তি' কে আজীবন লালন করে গেছেন সুকুমার অবিচ্ছিন্ন ভাবে, যেখানে সব ইন্দ্রিয় এক সাথে মিশে গিয়ে মনের মধ্যে থেকে বেরিয়ে পরে এই বাহ্যিক পৃথিবীতে পড়ে। তাই কখনো তিনি লেখেন 'আলোয় ঢাকা অন্ধকার/ ঘন্টা বাজে অন্ধকার' অথবা কখনো লেখেন 'ঠাস ঠাস, দ্রুম দ্রাম, শুনে লাগে খটকা/ ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পটকা!/ শাঁই শাঁই পনপন, ভয়ে কান বন্ধ -/ ওই বুঝি ছুটে যায় সে-ফুলের গন্ধ?'
আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের প্রতি সমাজ অনেক সহানুভূতিশীল হচ্ছে, তাঁদের কথা আলাদা করে ভাবা শুরু হচ্ছে, তাঁদের সমতার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এক শতাব্দী আগেই সুকুমার তাঁদের জগৎকে আলাদা করে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। অনুকম্পা দিয়ে নয়, বরং সমান স্বীকৃতির সাথে জীবনে তাঁদের নিয়ে একসাথে পা মেলানোর কথা বলেছিলেন। অন্ধ মেয়েকে দেখে তাই তাঁর জন্য দুঃখ হয় না, বরং আবিষ্কার করেন যে তার পৃথিবীটাও সুন্দর, অনেকটা আলাদা আমাদের চেয়ে, তাতে নাইবা থাকল কোনো রূপের বাহার। ‘অন্ধ মেয়ে দেখছে না তো - নাই বা যদি দেখে/ শীতল মিঠা বাদল হাওয়া যায় যে তারে ডেকে!/ শুনছে সে যে পাখির ডাকে হরষ কোলাকুলি,/ মিষ্টি ঘাসের গন্ধে তারও প্রাণ গিয়েছে ভুলি!/ দুঃখ-সুখের ছন্দে ভরা জগৎ তারও আছে,/ তারও আঁধার জগৎখানি মধুর তারই কাছে।’
কোনও research বা consulting করার সময় সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হয় solutioning-এ। মানে মোদ্দা কথা হল একটা সমস্যার সঠিক সমাধান খুঁজে বার করতে হবে। সে উদ্দেশ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রয়োজন পড়ে lateral thinking এর। সেটা করতে গিয়ে প্রায়শই দেখা যায় কত আজগুবি, কত হাস্যকর সমাধান বেরিয়ে আসে যা আসল সমাধান থেকে যোজন দূরে অবস্থিত। ‘অবাক জলপান’ নাটিকায় দেখি জলপানের মতো একটা সহজ ছোট সমস্যাকে নিয়ে সুকুমার কী অনায়াসে এই রকম একটা ঘটনাপ্রবাহ তৈরী করে ফেলেন। জল চাইতে গিয়ে কেউ কথার মারপ্যাঁচে ‘জল পাই’ কে বানিয়ে ফেলে ‘জলপাই’, কেউ বা জলের নাম শুনে ‘চোখের জল’, ‘হুঁকোর জল’, ‘ঝর্ণার জল’, ‘ফটিক জল’, ‘গায়ের রক্ত জল’ আরও হাজার রকম জলের কথা বলে। কেউ বা জলের সাথে ছন্দ মিলিয়ে বলে ওঠে ‘কাজল, উজ্জ্বল, চঞ্চল, ছলছল’ আরও কত কি! আবার কোনো বিজ্ঞানী বুঝিয়ে দেয় জলের রাসায়নিক বিশ্লেষণ আর জৈবিক রকমফের। প্রসঙ্গ জল থেকে বেরিয়ে ‘বৈকাল’ আর ‘নৈপাল’-এর অন্ত্যমিলে পৌঁছে গেলেও মূল সমস্যাটা কিন্তু থেকেই যায়--- তৃষ্ণার্ত পথিক খাওয়ার জল আর পায় না।
কবিতা, নাটক আর গল্পের বাইরেও রয়েছে সুকুমারের এক বিশাল ব্যাপ্তি যার প্রচ্ছন্ন বিচ্ছুরণ দেখি তাঁর প্রবন্ধগুলোর মধ্যে। বিদেশী মনীষীদের জীবনী যথা ‘দানবীর কার্নেগী’ বা ‘ডেভিড লিভিংস্টোন’ বা ‘ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল’ এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয় পাঠককুলের কাছে। এর সঙ্গে থাকে বিজ্ঞানের সব বিভাগের ওপর তৈরী সাবলীল বাংলায় লেখা প্রবন্ধ, যেমন ‘পৃথিবীর শেষ দশা’, ‘শরীরের মালমশলা’, ‘শনির দেশে’ বা ‘জানোয়ার ইঞ্জিনিয়ার’। প্রাক-ইন্টারনেট যুগ পর্যন্ত এই লেখাগুলোর মূল্যগুণ থেকে যায় একই রকম অমূল্য।
বইয়ের আকারে প্রকাশিত না হওয়া সুকুমার রায়ের এমন অনেক প্রবন্ধ রয়ে গেছে যা কিছুদিন আগে পর্যন্ত পাঠককুলের কাছে অজানাই ছিল (হয়ত এখনও কিছু অজানাই রয়ে গেছে)। ওঁর 'দৈবেন দেয়ম', 'ক্যাবলের পত্র' বা 'ভাষার অত্যাচার' নতুন করে পরিচিত করায় ওঁর পাণ্ডিত্য, চিন্তাশীল জীবন দর্শনের সঙ্গে।
‘ভাষার অত্যাচার’ প্রবন্ধে ''সনাতন' শব্দ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন ‘এক একটা কথা ধুয়া আমাদের স্বাভাবিক চিন্তাশক্তিকে আড়ষ্ঠ করিয়া দেয়। মানুষের যে কোনও আচার অনুষ্ঠান চালচলন বা চিন্তাভঙ্গির প্রতি কটাক্ষ করিয়া লোকে জিজ্ঞাসা করে 'তুমি কি সনাতন ধর্মবিধিকে উড়াইয়া দিতে চাও?" তখন যাহা কিছু যথেষ্ট জীর্ণ ও পুরাতন, তাহাই আমাদের কাছে সনাতনত্বের দাবি করে এবং আমাদের কল্পনায় সনাতন ধর্ম জিনিষটা যে কোনও বিধি নিয়ম আচার অনুষ্ঠানাদির সমারোহে শজারুবৎ কণ্টকাকীর্ণ হইয়া ওঠে।’
তেমনই আবার 'দৈবেন দেয়ম' প্রবন্ধে তিনি নস্যাৎ করে দেন অদৃষ্টবাদ বা কর্মবাদের মতন বহুযুগ ধরে চলে আসা প্রচলিত ধারণাগুলোকে, ভরসা রাখেন পুরুষকারে। অদৃষ্টবাদ নিয়ে বলেন ‘কতকগুলি অস্পষ্ট ও অচিন্তিত সংস্কার যখন কথায় নিবদ্ধ হইয়া জীবনের ঘাড়ে চাপিয়া বসে, তখন তাহার প্রভাব কতদূর মারাত্মক হইতে পারে তাহার সবচাইতে বড়ো দৃষ্টান্ত আমাদের এই অদৃষ্টবাদ। তাই জীবন সংগ্রামের সহস্র তাড়নার মধ্যে নিশ্চেষ্ট মানুষ সুখে হতাশ, দুঃখে হতাশ, বিচার নাই, উদ্যম নাই, হাত-পা গুটাইয়া বসিয়া থাকে আর বলে 'দৈবেন দেয়ম'। দৈবে ঘটায়, অদৃষ্টের ফেরে পাই, অদৃষ্টের ফেরে হারাই।... দৈবে যাহা আনিয়া দেয়, ঘাড় পাতিয়া লও। সে দৈব যে কে, সে যে কোথা হইতে কিরূপে দেয়, তাহা দৈবই হবে, তোমার আমার কিছু বলিবার নাই, কিছু করিবার নাই। ...আগুন জ্বলিয়া ঘর যায়, বাড়ি যায়, কী করিব? দৈবের লিখন। আগুনের মধ্যে দু-কলসি জল ঢালিবার চেষ্টাও যেন দৈবের নিষিদ্ধ। ... ইহার চাইতে মানুষ যদি চার্বাকের মতো বেপরোয়া নাস্তিক লইয়া বলিত, 'যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ", জীবনের ষোলো আনা আদায় করিয়া লও, জীবনের পক্ষে তাহাও আশার কারণ হইত, অন্তত বোঝা যাইত যে প্রাণের আশা এখনও এসে ছাড়ে নাই।’
এই সমস্ত রচনার মধ্যে থেকে পাঠকের পরিচিতি ঘটে ব্যক্তি সুকুমারের, তাঁর নিজস্ব ভাবাদর্শের সঙ্গে। যেখানে ব্যক্তি সুকুমার আস্থা রাখেন কর্মে, বুদ্ধিতে, উদ্যমে, চ্যালেঞ্জ করতে পিছপা হন না কোন প্রতিষ্ঠান বা প্রাতিষ্ঠানিক তত্বকে।
রবীন্দ্রনাথের সমকালীন খুব অল্প সংখ্যক সাহিত্যিক ছিলেন যাঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্বেও যাঁদের লেখা ছিল সম্পূর্ণভাবে রবীন্দ্র-প্রভাব মুক্ত, সুকুমার ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। পারিবারিক বন্ধুত্বের সূত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুকুমারের পরিচয় ছিল অল্প বয়স থেকেই। লণ্ডনে ছাত্র থাকাকালীন 'The Quest' পত্রিকায় ১৯১২ সালের অক্টোবর সংখ্যায় (নোবেল প্রাপ্তির আগেই) লেখেন 'The Spirit of Rabindranath Tagore'। রবীন্দ্রনাথের কবিতা সম্পর্কে বলেন 'Rabindranath’s poetry is an echo of the infinite variety of life, of the triumph of love, of the supreme unity of existence, of the joy that abides at the heart of all things.'।
'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য' নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেন 'The conflicting claims of faith and knowledge, of love and renunciation, of action and detachment, melt away before the supreme assurance of his poetry and the beautiful directness with which he carries us straight to the harmony that signs at the heart of the life. What could be nobler or simpler, what more supremely comprehensive that his ideal of nationality, as expressed in his own English prose-rendering (in the Gitanjali)?'। আবার নিজে থেকে অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু কবিতা, বেরিয়ে এসেছে 'I am restless, I am athirst for the great beyond.'... 'O Beyond! Vast Beyond!' মতো কিছু লাইন।
নিজের জীবনেও সুকুমার ছিলেন এমন চঞ্চল, সুদূরের পিয়াসী। বিপুল সুদুরকে কাছে নিয়ে এসেছেন, তাকে ভেঙেচুরে আবার নতুন করে সৃষ্টি করেছেন, তাতে যোগ করেছেন নতুন মাত্রা। সুকুমারের লেখার তল খুঁজে পাওয়া তাই কোনো সহজ ব্যাপার নয়, ব্যঙ্গরসের প্রহেলিকার আড়ালে তিনি রয়ে যান পাঠকের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ব্যক্তিগত জীবনে সুকুমার ছিলেন যথার্থই ব্রাহ্ম, যিনি জীবনের অর্থ খুঁজতে গিয়ে আনন্দের মধ্যেই ব্রহ্মকে খুঁজে পান। ‘উপেন্দ্রকিশোর রায়’ প্রবন্ধে পিতার অন্তিম মুহূর্তগুলো সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে বলছেন, ‘কায়মনোবাক্যে যিনি কোনওদিন সত্যকে লঙ্ঘন করেন নাই, শাশ্বত চিরজাগ্রত সত্য আজ তাঁহাকে রক্ষা করিতেছে। যে আনন্দের আস্বাদনে বিভোর হইয়া তিনি বলিয়াছেন, “আমি আনন্দে আছি, আনন্দেই থাকিব”--- সেই আনন্দ তাঁহার অনন্ত জীবনপথের শাশ্বত সঙ্গী হইয়া চলিয়াছে।
আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে
আনন্দেন জাতানি জীবন্তি'
আর নিজের চলে যাওয়ার কয়েক দিন আগে লেখেন আনন্দের কবিতা 'স্বপন দোলা হাওয়ায় দোলে/ সুরের নেশায় ঝরণা ছোটে/ আকাশ কুসুম আপনি ফোটে/ রঙিন আকাশ, রঙিয়ে মন/ চমক জাগে ক্ষণে ক্ষণ।' তিনি সুকুমার রায় বলেই হয়ত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও আনন্দ আর দুঃখকে এক পঙক্তিতে বসিয়ে আপন করে নেওয়াতে এত সাবলীল। মৃত্যুশয্যায় রবীন্দ্রনাথের কাছে শুনতে চান 'দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো' বা 'আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু' র মতন গান।
পাঠকের এক জীবন হয়ত যথেষ্ট নয় সুকুমার রায়কে বুঝতে। যখনই পাঠকের মনে হয় সুকুমার রায়কে কিছুটা হলেও রপ্ত করা গেছে, তখনই যেন নতুন মাত্রার সাথে হাজির হন সুকুমার। ওঁর চলে যাওয়ার প্রায় এক শতাব্দী পার হয়ে যাওয়ার পরও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভাবতে থাকে কেন দীর্ঘায়ু হলেন না সুকুমার, বাঙালির যে অনেক পাওনা বাকি থেকে গেল।
আজ চারদিকে সব কিছুর মধ্যে যত দেখা যায় 'আলোয় ঢাকা অন্ধকার', ততই যেন আমাদের কাছে প্রকট হয়ে ওঠেন সুকুমার।