প্রবন্ধ - সৌভিক দে
Posted in প্রবন্ধইংরেজিতে 'ধর্মতলা' শব্দটির যত বিভিন্ন বানান ইংরেজরা সৃষ্টি করেছিলেন, সম্ভবতঃ অন্য কোন বাংলা নামের সেই পরিমাণ বানান ও উচ্চারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ধর্মতলার উল্লেখ পাওয়া যায় 'ইংলিশম্যান' পত্রিকাতেও। ১৯২৮ সালের ২৭শে মার্চ তারিখের কাগজে ১৭৯৮ সালের ধর্মতলার বর্ণনা করেছিল ইংলিশম্যান, এইভাবে–
"Dhurrumtolla in 1798 was described as 'an open and airy road'. It was a 'well-raised cause-way' above fields and lines with trees."
ধর্মতলার আশেপাশে ইংরেজ ও ফিরিঙ্গীদের বাস ছিল। এই পথটি ছিল মনোরম, ফাঁকা ও আলোবাতাস যুক্ত। পথের দুইপাশে ছিল বৃক্ষসারি। মুক্তবাতাস বা গাছের ছায়া পেয়েই হয়ত ইংরেজরা ওখানে থাকতে প্রলুব্ধ হয়েছিল। ধর্মতলা নামকরণের সত্যি ইতিহাসটা এখনও দ্বন্দ্বমূলক। তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। 'ধর্ম' শব্দের থেকেই 'ধর্মতলা' সেটা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই, কেননা ধর্মতলায় একাধিক ধর্মক্ষেত্র বা ধর্মঠাকুরের থান ছিল। তখন ধর্মতলা ছিল 'Holy place' বা পূণ্যভূমি। ধর্মতলা ও চৌরঙ্গীর নামকরণ সম্পর্কে পাদ্রী-ফিরিঙ্গীদের অনেক জল্পনা-কল্পনা আছে। যেমন, মুসলমানদের মসজিদ ছিল বলে নাকি 'ধর্মতলা' নাম হয়েছে! স্থানীয় লোকসংস্কৃতি ও গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে কোনো অঞ্চলের ইতিহাসের যোগসূত্র সন্ধান না করে, বাইরে থেকে কিছু আরোপ করতে গেলে যা হয়, সাহেবদের অনেকেরই তাই হয়েছে। ধর্মঠাকুরের প্রাধান্যের জন্যই ধর্মতলার নাম হয়েছে ধর্মতলা, মসজিদের জন্য নয়। মসজিদ বা পীঠস্থানের জন্য বঙ্গদেশের কোনো স্থানের নাম ধর্মতলা হয়েছে বলে আমার জানা নেই এবং পশ্চিমবঙ্গে অন্তত কোথাও তেমনটা চোখে পড়ে নি।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর রাঢ় ও দক্ষিণ রাঢ় থেকে ধর্মঠাকুরের পুজো ভাগীরথীর পূর্বতীরে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কলকাতা পর্যন্ত যে প্রচলিত হয়েছিল, তা আজও বোঝা যায়। দক্ষিণে প্রাচীন আদিগঙ্গার তীর ধরে আজও ধর্মের 'যাত' হয়। কূর্মমূর্তি ধর্মঠাকুর সোনারপুরের বাজারে ডোমপণ্ডিত এখনও পুজো করে। বর্তমান হাজরা রোড ও শরৎ বসু রোডের(পূর্বতন ল্যান্সডাউন রোড) মোড়ে একটি প্রাচীন ধর্মঠাকুরের মন্দির আছে, এখন শিবই সেখানে প্রাধান্য পেয়েছেন। কসবা, বেহালা প্রভৃতি অঞ্চলেও ধর্মঠাকুর আছেন। জানবাজারে রাণী রাসমনির বাড়িটা বাঁ হাতে রেখে, কয়েক পা হাঁটলেই– বাঁ ফুটে ঘুপচি মত একটা ধর্ম ঠাকুরের মন্দির আছে(সঙ্গে দিলাম ছবি)। অনেক গবেষকের মতে এই ধর্মঠাকুরের নামেই আজকের ধর্মতলা। কিন্তু তা প্রমাণিত নয়।
সিমস সাহেবের রিপোর্টে দেখা যায় যে, একশো বছর আগে লালবাজার-রাধাবাজার অঞ্চলে ৩১,৬৮০ বর্গফুট জুড়ে বেশ একটি 'ডোমতালা' ছিল। ধর্মতলার পিছনে ছিল 'হাড়িপাড়া লেন'। পশ্চিমবঙ্গের(রাঢ়ের) ধর্মঠাকুরের বিখ্যাত সেবক বা পণ্ডিত ডোম ও হাড়িজাতির বেশ প্রাধান্য ছিল ধর্মতলা অঞ্চলে; দেড়শো বছর আগেও। যেখানে হাড়ি ও ডোমের এরকম প্রাধান্য ছিল, সেখানে কোনো ধর্মঠাকুর ছিল না– একথা মনে হয় না। সারা কলকাতায় ধর্মঠাকুরের একসময়ে বেশ প্রতিপত্তি ছিল এবং তাঁর গাজনও হত। পরে ধর্মের গাজন শিবের গাজনে রূপান্তরিত ও লুপ্ত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ ধর্মঠাকুরের স্থানগুলির নাম ধর্মতলা। কলকাতার ধর্মতলা তার ব্যতিক্রম হতে পারে না।
এবারে অন্য মতগুলোর দিকে নজর দেওয়া যাক–
বর্তমানে ধর্মতলায় যে মসজিদটি দৃশ্য হয়, তার পাশেই ছিল 'মেসার্স কুক কোম্পানি'র আস্তাবল। এই আস্তাবলের অধিকৃত জমিতে আরও অতীতে আরও পুরানো অন্য একটি মসজিদ ছিল। অনেকের মতে, ওই মসজিদ ও তৎসংলগ্ন দরগাহ থেকেই ধর্মতলা নামটি এসেছে। সেই পুরনো মসজিদেই কলকাতার সর্বপ্রথম কারবালার জনসমাবেশ হয়েছিল। সেই মসজিদ দীর্ঘকাল আগেই কালের গ্রাসে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে যে মসজিদটি দেখা যায় সেটি, মহিশুরের সুলতান টিপু সুলতানের বংশধর 'প্রিন্স গোলাম মহম্মদ' ১৮৪২ সালে তৈরি করান। তখন লর্ড অকল্যান্ডের শাসনকাল। মসজিদের গায়ে একটি পাথরের ফলকে লেখা আছে– "This musjid was erected during the Government of Lord Auckland G. C. B by Prince Golam Mohomed son of the late Tippoo Sultan in gratitude to God and in commemoration of Honourable Court of Directors granting him arrears of his stipend in 1840."
দ্বিতীয় মতের প্রচারক ছিলেন ডা. হর্ণেল। তাঁর মতে, জানবাজারে বৌদ্ধধর্মালম্বীদের তখন যে আড্ডা ছিল, তা থেকেই নাকি ধর্মতলা নামের সৃষ্টি। বৌদ্ধদিগের তিনটি ধর্ম উপদেশের মধ্যে অন্যতম 'ধর্মং শরণম গচ্ছামি' ধর্মতলা নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।
ধর্মতলায় ইংরেজদের একটি গির্জা স্থাপিত হয়েছিল ১৮২১ সালে। ১৮২৮ বঙ্গাব্দের 'সমাচার দর্পণ' পত্রিকায় লেখা হয়– "মোকাম কলিকাতার ধর্মতলাতে শ্রীযুক্ত টোনলী সাহেব এক নতুন গির্জাঘর প্রস্তুত করিয়াছেন, সে গির্জাঘর গত বুধবার খোলা হইয়াছে।" ধর্মতলা প্রসঙ্গে পাদ্রী লং সাহেব লিখে গেছেন যে, মুসলমানদের মসজিদ থাকার দরুণ এই অঞ্চলের নাম হয় ধর্মতলা। পাদ্রী কেরি সাহেবও লং সাহেবের কথাগুলোর প্রতিধ্বনি করে গেছেন প্রায় একই ভাষায়।
যাই হোক, বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত ধর্মপুজোর ধর্মঠাকুরের নাম থেকেই যে ধর্মতলা নামটি এসেছে সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কলকাতার আশেপাশে শুধু নয়, কলকাতার কেন্দ্রস্থলেও যে একদা ধর্মপুজোর প্রচলন ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮৪১ সালে প্রকাশিত 'বেঙ্গল এন্ড আগ্রা এন্যুয়াল গেজেটিয়ার' পত্রিকায় প্রকাশিত কলকাতার পথঘাট ও বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ স্থানের বিবরণের মধ্যে–
"Dhammoh Thekoor: 51, Janbazar Street.
Dinga Bhanga Lane: Between 39 and 40 Dharmatala St.
Doomtollah Street: Between 14 and 15 Radhabazar St."
১৮৪১ সালে শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী জানবাজারে এক ধর্মঠাকুর দেখে তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন এভাবে–
"The Calcutta temple of Dharma, situated at the premises No. 45. Janbazar Street contains six prominent images, namely Dharma on a simhasana ... etc." (Discovery of Living Buddhism in Bengal, Page- 22)
বেঙ্গল এন্ড আগ্রা এন্যুয়াল গেজেটিয়ার পত্রিকায় বর্ণিত ৫১ নং জনবাজার স্ট্রীটের ধর্মঠাকুর এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বর্ণিত ৪৫ নং জানবাজারের ধর্মঠাকুর একই কিনা তা জানা যায় না। ধর্মতলার মধ্যেও একাধিক ধর্মঠাকুরের পূজা ও উৎসব হত। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের পেছন থেকে 'বাঁকা রায় স্ট্রীট' নামে একটা রাস্তা ধর্মতলায় এসে পড়েছে, সেখানে বাঁকা রায়ের একটি মন্দিরও আছে। এই 'বাঁকা রায়' কোন ব্যক্তি বিশেষ নন, তিনি ধর্মঠাকুর। অনেকেই জানেন যে চাঁদ রায়, কালু রায়, দলু রায়, বাঁকুড়া রায়, বাঁকা রায় ইত্যাদি ধর্মঠাকুরের খুব জনপ্রিয় নাম। বর্তমান সময়ের অন্যতম গবেষক ও লেখক শ্রী বিনয় ঘোষ বলেছেন–
"পশ্চিমবঙ্গের ঘাটাল, আরামবাগ অঞ্চল থেকে আগত মৎস ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকে ধর্মতলা অঞ্চলে প্রথমে যখন এসে বসতি স্থাপন করেন, তখন থেকে ধর্মঠাকুরের পূজার প্রচলনও করেন এই অঞ্চলে। কলকাতার মধ্যে তাঁদের প্রভাবও ছিল যথেষ্ট। তাঁদের পশ্চাতে ছিল রাণী রাসমণির ভরসা ও পোষকতা। মহাসমারোহে তাঁরা ধর্মঠাকুরের উৎসব করতেন, তাঁর গাজন হত, মেলা বসত। গঙ্গার ঘাটে সন্ন্যাসীরা যেতেন বর্তমান ধর্মতলা স্ট্রীটের ওপর দিয়ে। 'ধর্মতলা' নাম এখানকার ধর্মঠাকুরের এই আঞ্চলিক প্রতিপত্তি ও উৎসব থেকেই হয়েছে। জেলিয়াপাড়ার প্রাচীন মৎসব্যবসায়ীরা কলকাতার ধর্মতলা অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রচনা করেছেন। অন্য কেউ করেন নি। ধর্মতলার সংলগ্ন আরও অনেক স্থানে ধর্মঠাকুরের পূজা হত বলে অনুমান করা যায়। জানবাজারে তো হতই, ডোমটুলি, হাড়িপাড়া প্রভৃতি অঞ্চলেও হত। ডোমটুলি ছিল ধর্মতলার ঠিক উত্তরে এবং হাড়িপাড়া ছিল তালতলা অঞ্চলে। ডোমপণ্ডিতরা যে ধর্মঠাকুরের পূজারী তা সকলেই জানেন।... একসময় নাথপণ্ডিতরাও কলকাতায় লব্ধপ্রতিষ্ঠ ছিলেন। নাথযোগীরাও ধর্মঠাকুরের পূজা করতেন।"
সুতরাং উপরে উল্লেখিত পূণ্যভূমির উপস্থিতির জন্যই যে ধর্মতলা নাম হয়েছিল, সেই বিষয়ে দ্বন্দ থাকলেও কোন বিভ্রান্তি নেই। ওয়ারেন হেস্টিংসের এক জমাদার জাফরের অনেক জমিজমা ছিল ধর্মতলায়। সেযুগের ধর্মতলায় বাবু হীরালাল শীলের একটা বাজার ছিল। তদানীন্তন ইংরেজ সরকার সাত লক্ষ টাকায় হীরালাল শীলের কাছ থেকে বাজারটি কিনে নিয়েছিল। আরও আগে, অতীতে, ১৭৯৪ সালে আরও একটি বাজারের হদিশ পাওয়া যায়– সেই বাজারের নাম ছিল 'মেম্বা-পীরের বাজার'। ধর্মতলার কাছে হগ সাহেবের বাজার তৈরির কাজ শুরু হয় ১৮৬৬ সালে আর কাজ শেষ হয় ১৮৭৪ সালে। শীলবাবুদের বাজার থাকায়, সেটি হগ সাহেবের বাজারের উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর এই জন্যই ইংরেজরা শীলবাবুর বাজারটি চড়া দামে কিনে নিয়েছিলেন। জমির মূল্য এবং বাজারের গৃহাদি তৈরি করার খরচ মিলিয়ে মোট ব্যয় হয়েছিল ছয় লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার টাকা। হগ সাহেবের বাজার মনের মতন করে তৈরি করেছিলেন ইংরেজরা। রুডইয়ার্ড কিপলিং পর্যন্ত তাঁর 'The City of the Dreadful Nights' গ্রন্থে হগ সাহেবের বাজারের চমৎকার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।
ধর্মতলাতেই প্রথম ভারতীয় হাসপাতালটি চিৎপুর থেকে স্থানান্তরিত করে ইংরেজ সরকার। কেননা ধর্মতলার প্রচুর আলোবাতাস হাসপাতালের পক্ষে উপযুক্ত বলে মনে করা হয়েছিল। ১৭৯৩ সালে তৈরি চিৎপুরের হাসপাতালটিকে যখন ধর্মতলায় স্থানান্তরিত করা হয় তখন সেটির বয়স ছিল পঁচাত্তর বছর। কিন্তু পরে ধর্মতলা অপেক্ষা আরও উপযুক্ত জায়গা বলে গঙ্গার তীরের স্ট্র্যান্ড রোড বিবেচিত হয়, এবং হাসপাতালটিকে ধর্মতলা থেকে স্ট্র্যান্ড রোডে নিয়ে যাওয়া হয়– সেই হাসপাতাল এখনও আছে, 'মেয়ো হাসপাতাল' নামে।
ধর্মতলার উত্তর দিকে একটা খাল ছিল– চাঁদপাল ঘাট থেকে বেলিয়াঘাটার সল্টলেক বা ধাপা পর্যন্ত খালটি প্রবাহিত হত। বর্তমান ওয়েলিংটন স্কোয়ার ও ক্রীক রো'র মধ্যে দিয়ে খালটি হেস্টিংস স্ট্রীটে পৌঁছাত। খালটি এতটাই প্রশস্ত ছিল যে তাতে বজরা-নৌকা পর্যন্ত চলাচল করত। বর্তমান ক্রীক রো'র নিকটস্থ কোথাও এই খালের মধ্যে একটি জাহাজ ও কয়েকটি নৌকা ভেঙে যাওয়ায় এই জায়গার নাম হয়েছিল 'ডিঙ্গিভাঙা'। ১৭৩৭ সালের মহাপ্রলয়ঙ্করী সাইক্লোনে জাহাজটি গঙ্গাগর্ভ থেকে এই খালে ঢুকে যায় এবং তীরে ধাক্কা খেয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। হেস্টিংস স্ট্রীট ও কাউন্সিল হাউস স্ট্রীটের সঙ্গমস্থলে এই খালের উপরে একটা সাঁকো ছিল। ১৮২১ সালের 'ক্যালকাটা গেজেট' থেকে জানা যায়, বর্তমান 'ওয়েলিংটন স্কোয়ার' তখন 'ধর্মতলা স্কোয়ার' নামে পরিচিত ছিল। এই স্কোয়ারটি ওই খালের উপরের জমিতে রয়েছে। 'ক্যালকাটা লটারী কমিটি' এই খাল বুজিয়ে জমিজমা ভরাটের কাজ করেছিল।
ধর্মতলার কাছাকাছি কোথাও 'ধর্মতলা একাডেমী' নামে একটা বিদ্যালয় ছিল। কারণ, ১২৩৬ বঙ্গাব্দের ১৩ই পৌষের 'সম্বাদ কৌমুদি' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল–
"শ্রীযুক্ত ড্রেমন্ড সাহেব ও শ্রীযুক্ত উইলসন সাহেবের ধর্মতলা একাডেমী নামের বিদ্যালয়ের ছাত্রদের পাঠের গত শনিবার পরীক্ষা ও তজ্জন্য অনেক সাহেব ও বিবি লোকের সমাগম হইয়াছিল। শ্রীযুক্ত রিবেরেন্ড উলিএম আদমসাহেব এবং শ্রীযুক্ত ড্রেজেরিও সাহেব পরীক্ষা লইলেন। কুমার অপূর্ব্ব কৃষ্ণ বাহাদুর প্রভৃতি ৮৬ জন বালক অপূর্ব্বরূপে বিবিধ শাস্ত্রের পরীক্ষা নিলেন। পরে বিজ্ঞ অধ্যাপকদের কতৃক কোন ২ বালক পুস্তক ও কেহ ২ রৌপ্য নির্মিত গোলাকৃতি বিশেষ গ্রথিত হার উপহার পাইয়াছেন।"
ধর্মতলায় যাতায়াত আছে, অথচ 'কার্জন পার্ক' চেনেন না এমন লোক কমই আছেন। লেডী কার্জনের স্মৃতিতে কার্জন পার্ক তৈরি করা হয়েছিল। আগে ওই স্থানে একটা বিশাল পুকুর ছিল। ওই পুকুর বুজিয়ে ফেলা হয়েছে– বর্তমানে ওখানে যে ট্রামডিপোটি আছে, সেটা ওই পুকুরের উপরেই তৈরি। কার্জন পার্কে একটা ফোয়ারা আছে, সেটি লেডী কার্জন কলকাতাবাসীদের উপহার দিয়েছিলেন। ফোয়ারার পিছনে গল্পটি হল– ১৯০৪ সালে লেডী কার্জন সাংঘাতিক রকমের অসুস্থ হন, তখন কলকাতাবাসীগণ লেডীকে যথেষ্ট সহানুভূতি প্রদর্শন করেন, তারই প্রতিদান স্বরূপ তিনি ফোয়ারাটি উপহার দেন। ফোয়ারাটি 'লেডী কার্জনের ফাউন্টেন' নামে পরিচিত।
বর্তমানে ধর্মতলায় তিনটে গির্জা দেখা যায়। এখানকার 'দি রোমান ক্যাথলিক' গির্জাটি ১৮৩২ সালে 'মিসেস পাশকোয়া ব্যারেটো ডিসুজা' প্রতিষ্ঠা করেন। 'দি ইউনিয়ন চ্যাপেল' স্থাপিত হয়েছিল ১৮২১ সালে। এছাড়া এই অঞ্চলে ছিল(কিছু বর্তমানেও আছে) বহু প্রাচীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান– শ্রীনিকেতন কুটির শিল্প, অক্ষয় কুমার লাহা, জি. সি. লাহা, পি. সি. দত্তের চুরুটের দোকান, রাধিকাপ্রসাদ দত্ত, অনন্তচরণ মল্লিক, উল হাউস, আশুতোষ দাঁ, কল্পতরু আয়ুর্বেদ, ইন্ডিয়া ওয়াটার প্রুফিং এন্ড ডায়িং, ওয়াছেল মোল্লা, কমলালয় স্টোর্স, সুবেদালি ব্রাদার্স, নন্দী ব্রাদার্স, এইচ. ডি. নন্দী ইত্যাদি। ব্যাঙ্ক, দাঁতের চিকিৎসক, চশমা বিক্রেতা, ইলেকট্রিক, ফটোগ্রাফি, সাইকেল এবং মোটরের কারখানা ছাড়াও ছায়াচিত্রের পরিবেশকদের প্রচুর কার্যালয় অতীতে ধর্মতলায় ছিল আর আজও আছে। ধর্মতলার 'চাঁদনী চক' বিখ্যাত– 'নিউ সিনেমা' আর 'জ্যোতি সিনেমা' নামে এখানে সাম্প্রতিক অতীতের দুটি বিখ্যাত সিনেমাহল ছিল। অতীতে এই পথে দুটো বিখ্যাত রঙ্গালয় ছিল– 'করিস্থিয়ান থিয়েটার' ও 'পার্শী থিয়েটার'। ১৩৮ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রীটের 'দি ডিসুজা হোম' নামের বাড়িটির নাম এখন কেউ জানেন না। বাড়িটি ১৮৭৪ সালে স্থাপিত হয়। প্রথমে দশজন স্ত্রীলোক ও কুড়িজন শিশুকে এই বাড়িতে স্থান দেওয়া হয়েছিল। তখন কেবলমাত্র বিত্তহীন ইউরোপীয়রা এই বাড়িতে জায়গা পেতেন। ধর্মতলায় একটি প্রাচীন আর্ট স্কুল ছিল, মিউজিয়ামের পাশে তা আজও বিদ্যমান। তার বর্তমান নাম গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্ট এন্ড ক্র্যাফট।
গ্রন্থসূত্র :
ক) কলকাতা দর্পন ১ ও ২, রাধারমণ মিত্র, সুবর্ণরেখা।
খ) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, বিনয় ঘোষ।
গ) কলিকাতার কালকথা, রাণা চক্রবর্তী।
ঘ) ধন্য কলকাতা সহর, কৌশিক মজুমদার, আখরকথা।