ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিকপর্ব ২৪
স্বপ্নের শহর – মিলান
আগের বারের মতো এবারও এক সন্তকে দিয়ে শুরু করতে ইচ্ছে করছে এই লেখা। সন্ত বিয়াজিও। খ্রিস্টধর্ম তখনও শৈশব পেরোয়নি। সেইরকম এক সময়ে তৃতীয় শতকের দ্বিতীয় ভাগে তাঁর জন্ম হয় তৎকালীন আরমেনিয়ার কাপুডোশায়। ছোটোবেলা থেকেই বিয়াজিওর আগ্রহ ছিল নানা বিষয়ে – তার মধ্যে সাহিত্য, চিকিৎসাশাস্ত্র আর পদার্থবিদ্যার প্রতি তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে অবশ্য তাঁর নাম ছড়িয়ে পরে নানান অলৌকিক ক্ষমতার কারণে। এই সন্ত বিয়াজিও একবার একটি ছেলের প্রাণ বাঁচান একটুকরো রুটি দিয়ে। খাওয়ার সময় মাছের কাঁটা গলায় আটকে জীবনসংশয় হয়েছিল ছেলেটির। খ্রিস্টধর্মের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্যের প্রশ্নে রক্ষণশীল এবং ক্যাথলিক – দুই গোষ্ঠীই বিয়াজিওকে প্রদান করেছিল সর্বোচ্চ স্বীকৃতি । দুই সম্প্রদায়ের কাছেই হয়ে উঠেছিলেন সমান আদরণীয়। আর ঠিক এই কারণেই কাপুডোশার শাসকদের কাছে তিনি ছিলেন চক্ষুশূল। বিচারের এক প্রহসন তৈরি করে তাঁকে ৩১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। সেই থেকে এই দিনটি শহীদদিবসের মর্যাদা পায় অনেক দেশেই আর ইতালির অনেকাংশে ক্রিসমাসের সময় থেকে রেখে দেওয়া একটুকরো ‘পানেত্তোনে’ খেয়ে স্মরণ করা হয় মহান সেই মানুষটিকে আর মনে করা হয় গলার যাবতীয় অসুখ থেকে বছরভর রক্ষা করবে রুটির সেই টুকরোটি। কিন্তু যে খাদ্যবস্তুটি এত মাতামাতির কেন্দ্রে, যা একাধারে রুটি এবং কেক, জনপ্রিয়তা, ধর্মীয় আচারের মানদণ্ডে যার গুরুত্ব চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, তার দিকে আলাদাভাবে একটু ফিরে তাকানো যাক।
প্রায় পাঁচশো বছর আগেকার কথা। মিলান শহরের ডিউকের ক্রিসমাসের ভোজসভার ডেসার্ট গেল পুড়ে! টোনি নামে এক রাঁধুনির ওপর দায়িত্ব পড়লো চটজলদি সেই সংকট সমাধানের। জন্ম লাভ করল ‘পানে দি টোনি’র। কালক্রমে যা হয়ে দাঁড়ালো ‘পানেত্তোনে’। আসলে ইতালিয়ান ভাষায় ‘পানে’ শব্দের অর্থ রুটি বা ব্রেড। আবার ‘পানেত্তো’ মানে ছোট কেক। তার সঙ্গে ‘নে’ প্রত্যয় যেই যোগ হল, তার সারমর্ম দাঁড়ালো ‘বড় কেক’। মজার না? আদপে এটি এমন এক বস্তু, যা না রুটি, না কেক। ‘পানেত্তোনে’র মধ্যে রয়েছে কেকের প্রত্যাশিত আর্দ্রতা এবং রুটির অভ্রান্ত চারিত্রিকতা। এই যে না-রুটি না-কেক হাঁসজারু ব্যাপারটি আয়ত্ত করা কি ভীষণ কঠিন, প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে কথা না বললে ঠিকমতো বোঝা যাবে না। এমনিতেই বল্গাহীন আবেগের শিকার না হলে কেউ বেকার হয়না আর হলেও পানেত্তোনে তৈরি করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। পদ্ধতিগতভাবে বেকিং হেঁশেল সংস্কৃতির এমন একটি অধ্যায়, যার প্রত্যেক পদক্ষেপে জটিলতা আর বৈজ্ঞানিক হিসেব-নিকেশ। ভুল করে শুধরে নেওয়ার সুযোগ নেই বললেই হয়। মনে আছে, এই শহরেরই একটি ক্লাবে কয়েক বছর আগে বিখ্যাত ইতালিয়ান শেফ এবং রান্নার বইয়ের লেখক রবার্তা স্কিরা ইতালিয়ান রান্নার এক ডেমোতে এই তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করেছিলেন চমৎকারভাবে। তিনি বলেছিলেন, বেকিং-এর সময় কোনও উপাদানের এক গ্রামের এদিকওদিক প্রকৃতপক্ষে এক টনের সমান। সত্যিই তাই। এ বিষয়ে ন্যুনতম অভিজ্ঞতসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করে নেবেন এই মন্তব্যের সারবত্তা। আর এই মন্তব্যের সূত্র ধরেই আতস কাচের তলায় ফেলতে হবে পানেত্তোনে তৈরির প্রক্রিয়াকে।
আগেই লিখেছি মিলান শহরের এক রাজকীয় ভোজসভায় আকস্মিকভাবে জন্ম হয়েছিল পানেত্তোনের। যাঁর কল্পনাশক্তি থেকে সৃষ্টি হয়েছিল এমন একটি খাদ্যের, এক ইতালিয়ান আইকনের, তিনি নিজেও সম্ভবত অনুমান করতে পারেননি এক সংকটের মোকাবিলা করতে গিয়ে তিনি কী করে বসলেন। নানান দেশের রান্নাঘরের ইতিহাসের সঙ্গে অবশ্য জড়িয়ে আছে অজস্র এ ধরনের নাটকীয় কাহিনী। তুমুল জনপ্রিয় অস্ট্রিয় কফি কেক ‘সাখার টর্টে’র আবির্ভাবও একইরকম পরিস্থিতিতে হয়েছিল। সেকথা আমাদের অজানা নয়।
আজকের পানেত্তোনেকে নিয়ে কোনও আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যাঁর উল্লেখ করতে হবে, তাঁর নাম এঞ্জেলো মোত্তা। ১৯১৯ সালে এই মোত্তার হাত ধরেই মিলান শহরে পানেত্তোনের নবজন্ম ঘটে। এইসব গভীর জ্ঞানগম্যি বইপত্তর ঘেঁটে অর্জন করতে চাওয়ার ইচ্ছের পিছনে উদ্দীপকের কাজ করেছিলেন যিনি, সেই ওরাৎসিও ডি রাইমোন্দো, যিনি আসলে রান্নাবান্না সম্পর্কিত আমার সমগ্র চেতনাটিই বদলে দিয়েছিলেন তাঁর অজান্তেই, তিনিই ন’বছর আগে মিলান শহরের এক ক্যাফেতে প্রথম এই আটপৌরে কিংবদন্তিটির সঙ্গে পোশাকি আলাপ করিয়ে দেন। সাক্ষাৎকারের সময় পার করে অনেক দেরিতে ওরাৎসিও সেদিন হাজির হয়েছিল একগাল ছোঁয়াচে হাসি নিয়ে আর তারপর দেরির জরিমানাস্বরূপ আমাদের নিয়ে গিয়েছিল সেই ক্যাফেতে।
প্রথম দর্শনে পানেত্তোনেকে ছোটবেলা থেকে দেখে আসা ফ্রুটকেকের থেকে তেমন অন্যরকম কিছু মনে হয়নি। ওরাৎসিওকে সেকথা বলায় তার মুখে ফুটে উঠেছিল মৃদু হাসি। সেই প্রথম জেনেছিলাম কেক হয়েও কেন কেক নয় আবার পুরোপুরি রুটিও কেন বলা যাবে না পানেত্তোনেকে। রুটি কারণ এতে Lievito Madre বা প্রাকৃতিক ইস্টের ব্যবহার। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ময়দার মধ্যে সেই ইস্টের প্রয়োগ করে অপেক্ষা করতে হবে দীর্ঘক্ষণ। আবার কেকের মতোই এতে মাখন আর ড্রাই ফ্রুটের অপর্যাপ্ত উপস্থিতি। এখনও পর্যন্ত এইসব তথ্য থেকে এমন কোনও ছবি তৈরি হচ্ছে না, যা থেকে এই কেকরুটি বা রুটিকেকের অনন্যতার ব্যাপারটি ঠিক বোঝা যায়। কেনই বা মিলান শহরের সঙ্গে তার এই গভীর আত্মীয়তা? এখানেই মোত্তা এবং পরবর্তীকালে জুয়াঙ্কিনো আলেমানার ব্যবসায়িক বুদ্ধির তারিফ না করে পারা যাবে না। মিলানের অপূর্ব সুন্দর বিশ্বখ্যাত ক্যাথিড্রালের গম্বুজের সঙ্গে সাদৃশ্য আনার জন্য পরিবর্তন ঘটানো হল পানেত্তোনের আকৃতিতে। লম্বাটে চেহারার পানেত্তোনের আবিষ্কার ঘটল তখনই। কিন্তু এই আকৃতি ধরে রাখা অতি কঠিন কাজ। কারণ ঠাণ্ডা হয়ে গেলেই মাথাটি চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য উদ্ভাবিত হল এক আশ্চর্য পন্থা। আভেন থেকে বের করার পরই হেঁটমুণ্ড করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় পানেত্তোনের দলকে এবং সেইভাবে রেখে দেওয়া হয় যতক্ষণ না সেগুলি সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা হচ্ছে। একবার ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আর আকৃতিগত কোনও বদল হয়না। ক্রিসমাসের আগে অনেক সময়েই যখন মিলানের রাস্তাঘাট বরফে ঢেকে যায়, পেস্ট্রিশপগুলির ভিতরে উজ্জ্বল আলো আর কাচের ধারে থরে থরে সাজানো পানেত্তোনে এক পরাবাস্তব রহস্যময়তা তৈরি করে। এইসময় কোনও ক্রেতা যখন সেই দোকানে প্রবেশ করেন, বিক্রেতা সৌজন্য বিনিময়ের পর তার হাতে তুলে দেন একটুকরো পানেত্তোনে, চেখে দেখার জন্য। সঙ্গে একচুমুক প্রসেকো থাকলে তো সোনায় সোহাগা। অনেক ইতালীয় পরিবারে, বিশেষত উত্তরে, ক্রিসমাসের সময় অতিথি আপ্যায়নের এটিই আদর্শ রীতি বলে ধরে নেওয়া হয়।
কথিত আছে, ছুরি দিয়ে লম্বালম্বি যখন পানেত্তোনে কাটা হয়, তাকে মূল কেক থেকে আলাদা করার জন্য সামান্যতম চেষ্টাও করতে হয়না। কিন্তু কেন? আদিযুগে ময়দা আর মাখনের ভাগ ছিল এক কিলো ময়দায় চারশো গ্রামের মতো মাখন আর বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে ধীরে ধীরে পানেত্তোনে ইতালীয় আবেগের অংশ হয়ে ওঠার পর্বে সেই মাখনের হিসেবটা গিয়ে দাঁড়ালো এক কিলো ময়দায় এক কিলো! অকল্পনীয়। তাই না? এই কারণেই পানেত্তোনে তৈরি করা এত কঠিন! প্রায় তিনদিনের পর্যায়ক্রমিক কঠোর পরিশ্রমের পরই প্রার্থিত ফল পাওয়া সম্ভব। অবশ্য বানিজ্যিক প্রয়োজনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এই সময়ের বিষয়টা এখন অনেক কমে গেছে। তা সত্ত্বেও তাড়াহুড়োর কোনও অবকাশ নেই এই পদ্ধতির কোথাও।
পানেত্তোনে তো তৈরি হল। এর যথাযথ অনুপান কী হবে? প্রোসেকোর কথা তো আগেই লিখেছি। এটি আরেক অনবদ্য ইতালীয় সৃষ্টি, যা স্বতন্ত্র মনোযোগ দাবী করে। ফরাসি শ্যাম্পেন বা জার্মান শ্নাপস্ – এর সঙ্গে সমান টক্কর নিতে পারে উত্তর ইতালির এই মহার্ঘ পানীয়টি। কিন্তু পানেত্তোনের সঙ্গে প্রোসেকো ছাড়াও হট চকোলেট, কফি এমনকি এগনগ খাওয়ারও চল আছে অনেক জায়গায়। এই এগনগ আবার একটি অতি জনপ্রিয় ক্রিসমাসকালীন পানীয়। পণ্ডিতরা বলেন মধ্যযুগের ব্রিটেনে জন্ম এই বস্তুটির। তখন এর পরিচিতি ছিল পসেট বলে এবং ঠাণ্ডা-লাগা বা ফ্লু-জনিত উপসর্গের উপশমের জন্য সে সময়ের মানুষ ডিমের সাদা, চিনি, ক্রিম, দুধ এবং হুইস্কি, রাম অথবা বোরবোর্ন –এর এই অনবদ্য ককটেলটি পান করতেন। কিন্তু পানেত্তোনের ক্ষেত্রে সব অনুপানই শেষ পর্যন্ত অছিলায় পরিণত হতে পারে। এমনই আশ্চর্য এর আবেদন।
আমার বন্ধু ওরাৎসিও আর আমি এক স্বপ্নের সওয়ার হয়ে আমাদের দুই দেশের খাদ্য সংস্কৃতির হৃদয়ের অন্তঃস্থলে পৌঁছতে চেয়ে চষে বেরিয়েছি কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে মুম্বাই থেকে রোম হয়ে মিলান থেকে তুরিন। আমাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগ তেমনভাবে সাড়া জাগাতে না পারলেও আমরা আবিষ্কার করেছিলাম হেঁশেল যাত্রার নতুন থেকে নতুনতর পথ, মানুষের প্রাত্যহিক যাপনশৈলীর অতি তুচ্ছ অথচ অননুকরণীয় আদল আর আমাদের সামনে খুলে গিয়েছিল অনেক গোপন কুঠুরি, যার ঐশ্বর্যের ঔজ্জ্বল্যে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল আমাদের।