ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(২)
ইউনিভার্সিটি থেকে শেষের দুটো ক্লাস কেটে ঋজু কফিহাউসে পৌঁছে গেল অনেকক্ষনই। একটু পরেই জিৎ, সৌমি আর পুষ্পেনদের দলটা হৈ হৈ করতে করতে এখানে এসে ভীড় বাড়িয়ে দেবে। মেয়েটার একটু আগে আসতে যে কি হয় ? একান্তে একটু কথা বলার লোভে ঋজু অধৈর্য হয়ে নিজের হাতঘড়ি দেখে। ঘড়িটা অবশ্য ওর নিজের নয়। ওর বাবার 'ফেভার লিউভা'টা এই এম এ ক্লাসে পড়তে এসে সবে হাতে পেয়েছে। রাই এর সাথে দেখা হবার থাকলেই ওটা ও পড়ে। না হলে ঘড়ি-ফড়ি পড়া পোষায় না। আজকের দিনটা স্পেশাল। কারণ ঋজুর পকেটে আজ পঞ্চাশ টাকা আছে। গতসপ্তাহ থেকে যে ছেলেটাকে ঋজু বাংলা পড়াচ্ছে এটা সেই বাড়ি থেকে পাওয়া এ্যাডভান্সের ওয়ান ফোর্থ অংশ। এটাতেই আজ কফি আর পকোড়া হয়ে যাবে। তারপর বাড়ি ফেরার জন্য ছ'-সাত টাকা রাখলেই চলবে বাসভাড়ার দিতে প্রয়োজন হবে। তাও শেষে একান্তই ফুরিয়ে গেলে না হয় স্রেফ হন্টন ! ঋজু আজ রাইকে একটা টাকাও খরচ করতে দেবেনা। আসলে বেশীর ভাগ দিন রাই কফি -পকোড়ার দাম মেটায়। অধ্যাপক পিতার একমাত্র আদুরে কন্যাটির কষ্ট করে হাতখরচ বাঁচাতে হয় না।
রাই ক্যাম্পাসের পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসতেই বাবার ব্যাচমেট দীপঙ্কর স্যার ওরফে ডি.সি.র মুখোমুখি পড়ে গেল। উনি রাইদের ক্লাসে ইসলামিক ইতিহাস পড়ান। বড় বড় চশমার ফাঁক দিয়ে চোখদুটো পাকিয়ে ডি.সি বললেন -' এ্যাই পিনাকীর মেয়ে না তুই? কার ক্লাস কাটছিস্ রে এখন? ব্রজেন্দ্রবাবুর বৈষ্ণব পদাবলীর ক্লাস এরপরেই ছিল না?' সন্ত্রস্ত রাই আমতা আমতা করে বলে - 'স্যর..মানে..শরীরটা হঠাআআৎ খ্খারাআপ্ লাআআগছেএএ!' রাই কে অবাক করে দিয়ে ডি.সি হঠাৎ বলে ওঠেন 'হিন্দ্ সিনেমায় শাহরুখ না কি নাম যেন !ওর বইটা কিন্তু দারুণ চলছে, লম্বা লাইন সেই ফ্লাইওভার অবধি !' পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে আবার ডি.সি স্যার বড় বড় চশমায় গম্ভীর হয়ে করিডরের দিকে হাঁটতে থাকেন।
ঋজু দূর থেকে রাই এর আসাটা দেখতে পেয়ে আশ্বস্ত হল।যাক দশ মিনিট অন্তত রাই এর সাথে একলা কথা বলা যাবে। রাই আজ কালো জমির ওপর ক্রীম রঙের কল্কা ডিজাইনের একটা সালোয়ার পড়েছে। শেষ বিকেলের কমলালেবুর মতো রোদ লেগে কি অন্তর্লীন মায়াবী লাগছে রাইকে। ঋজুর বুকে হঠাৎ যেন সহস্রঅশ্বের ক্ষুরধ্বনি ওঠে। ঝকঝকে দৃষ্টি মেলে ঋজু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
****
আজকে দিনটা মেঘাচ্ছন্ন। সারারাত বৃষ্টি হওয়ায় দিনের আকাশেও তার ছাপ রয়ে গেছে। মীরার দুচোখেও সেই জলছাপ। ভালোবাসার উপবাসে তার দুচোখের তলায় কালির পোঁচ এঁকেছে।এতদিনে আর সকলের মত তার স্বামী অার শ্বশুরও নিশ্চয় তাকে এখন আর বিশ্বাস করেনা। এমনকি যে গিরিধারী লালা, তার প্রাণের সম্পদ, চরিত্রের অপবাদ, তিনিও কি সত্যি সত্যি বোঝেন মীরার এই কায়মনোবাক্যের উৎসর্জনকে ? চিতোরের মহারাণী হতে তো মীরা চায়নি; চেয়েছিল অতি সামান্য অথচ ভয়ঙ্কর এক যাচনা। একলিঙ্গেশ্বরের সাথে সমান্তরাল মর্যাদায় তার 'নাগর'এর জন্য ভক্তিনম্র প্রাণের নিবেদনটুকুই। রাণাদের অহং সেটুকুর ছাড়ও মীরাকে সেদিন দিতে অস্বীকৃত ছিল বলেই তো তাকে সবছেড়ে উদাসী হাওয়ার পথে ভেসে এই বৃন্দাবনে চলে আসতে হল। সব ছেড়েও তবু তার প্রেমের গাগরী পূর্ণ হল কই? তীব্র বিচ্ছেদবোধ মীরাকে আচ্ছন্ন রাখে আর কখনো কখনো শরীর জুড়েও অস্থিরতা বাড়িয়ে উচাটন করে তোলে সাধ্বীর সংযম। দুচোখে শ্রাবণের অবিরল ধারা গড়ায় মীরার। দুখানি কম্পিত ওষ্ঠ দয়িতের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করে সমর্পণ, শর্তহীন মিলনের আকূতি।
' হে পিয়! নয়নের সামনে এসে একবারটি দাঁড়াও! আমি ভব সাগরে ভেসে যাচ্ছি'
- "পিরা মঁহারে নৈনা আগে রহ জ্যো জী
নৈনা আগে রহজ্যো, ম্ হাঁনে ভুলমত জাজ্যো জী/ ভৌসাগর মেঁ বহী জাতহুঁ বেগ মঁহারী সুধ নী জ্যো জী...."
****
রাই কৌতুহল চাপতে না পেরে অরাতিদমনের রিকোয়েস্টটা শেষমেশ এ্যাকসেপ্ট করেই নিল। ছেলেটার চোখ দুটোতে সত্যি একটা যাদু আছে। ছবিতে অনেকক্ষণ দেখলে গা শিরশির করে। রাই প্রথমে লজ্জ্বা পায়, তারপরে নিজের ওপর রাগ হয় এই প্রগলভতায়, এমনকি নিজেকে নির্লজ্জ বেহায়াও বলে মনে হয়।
তবুও কি এক অমোঘ নিয়তির মতো মেসেঞ্জারে রাইএর আঙুল দ্রুত টাইপ করে ওঠে - 'হাই! আমি রাই! গুড আফটারনুন! ' তারপর অনেক্ষণ ওপ্রান্ত থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। যদিও মেসেঞ্জজারে সবুজ বিন্দুটা সমানে জানান দিচ্ছে ওপারের জাগৃতির।
ইতিমধ্যে সোমেশ বাজার থেকে ফিরে এল। লেকমার্কেটে আজ ভাল ইলিশ উঠেছে বলে খানিকটা বেশীই কিনে এনেছে। ইলিশভাপা আর কাঁটাচচ্চড়ি ওর প্রিয়,সঙ্গে অবশ্য আলুপোস্তটা মাস্ট।
রাই এর হাতের রান্না সোমেশ পছন্দ করে। তিনবছর আগে মা মারা যাওয়ার সাথে সাথে এইসব ঘরোয়া খাবারদাবার খাওয়াটা হয়তো ঘুচেই যেত, যদি না রাই এগুলো তার মা'র কাছ থেকে বিয়ের পর থেকে বাধ্য ছাত্রীর মত ট্রেনিং না নিত। সোমেশ তৃপ্তি বোধ করে এতে। ওদের বাড়ীঘর, সংসার সবটাতে আজ রাই জুড়ে আছে। অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে আসার জন্যই রাই এতসহজে মানিয়ে নিতে পেরেছে। কমবয়সের একটা ব্লটিং পেপারের মত মন থাকে। রাই তার সার্থক উদাহরণ। কাল ভোরেই আবার শিলিগুড়ি ছুটতে হবে। ওদের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি শিলিগুড়িকে করিডোর করে নর্থইস্ট মার্কেটটাতে ঢুকতে চাইছে। পৈতৃক ব্যবসাটাকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আর তার গত পনের বছরের সমৃদ্ধির পিছনে সোমেশেরই একমাত্র অবদান রয়েছে। ওর ছোটভাই ডাক্তারি পাশ করে বিলেতে। 'রজনী কেমিক্যালস্' নিয়ে তার কোন আগ্রহ না থাকারই কথা। তবুও সে তার ভাইকে তার প্রাপ্য লভ্যাংশ পাঠিয়ে দিয়ে নিজের বিবেকের কাছে সৎ থাকার তৃপ্তিটুকু পায়।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া সারতে সারতে সেই তিনটে বাজলো। ফোনটা হাতে নিতেই একঝলক খুশীর হাওয়া। মেসেঞ্জারে একটা নোটিফিকেশন এসেছে তাহলে! রাই পঞ্চদশীর উত্তেজনা চাপতে পারে না, খুলেই দেখে অরাতিদমন তার দেরী করে উত্তর দেবার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছে এই লাইনগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে,
" বাগানের দুটি গাছ দুরকম ব্যবহার করে।
একজন কাছে ডাকে,অন্যজন, বলে, যাও দূর-
একজন ক্রুদ্ধকন্ঠ, অন্যজন আপ্লুত মধুর..."
আর তার সঙ্গে পাঠিয়েছে একটা ক্ল্যাসিক্যাল ফ্লুট পিস্। চৌরাসিয়া সাহেবের বাজানো, ইমনভূপালী।
রাই মনে মনে বলে -বেশ বাহাদুর ছোকরা তো! যা চোখের যাদু আর হাসির ঢং, অনেকগন্ডা সুন্দরী বান্ধবী আছে নিশ্চয়ই!
রাই প্রত্যুত্তরে আবার লিখলো-
" মানুষ ছিলো নরম, কেটে , ছড়িয়ে দিলে পারতো।
পথের হদিস পথই জানে, মনের কথা মত্ত...
মানুষ বড় শস্তা, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো !"
শক্তি চট্টোপাধ্যায় বরাবর রাই এর খুব প্রিয়। তাই আজও আবেগে অভ্যেসে সবার আগে তিনিই আঙুলের ডগায় চলে আসেন আজও।
****
গোপ পল্লীতে ইদানীং সবারই মনখারাপ। কদিন আগেই সবার প্রিয় কানহাইয়া হঠাৎ তার বাল্যের ক্রীড়াভূমি গোকূল ছেড়ে মথুরায় চলে গেছে। এ যেন বিনামেঘে বজ্রপাত। বৃহত্তর আর্যাবর্তের রাজনৈতিক আহবান আসলে তাকে যে ক্ষুদ্র পরিসরে এখানে যে আর ধরে রাখা যাবেনা,তা যেন অবধারিতই ছিল। তবুও রাধার বারেবারেই কানহাইয়াকে মনে পড়ছে আর কেঁপে কেঁপে উঠছে তার সর্বশরীর। গতরাত্রের প্রবল ধারাবর্ষণে গোকূল কর্দমাক্ত। সেই মলিনতা গ্রাস করে আকাশটিও যেন সমান বিষাদআচ্ছন্ন হয়ে আছে। নিধিকুঞ্জের সবচেয়ে বড় কদমগাছটিতে যে দোলনাটায় সবাই মিলে কানহাইয়ার সাথে কত হইহই করে আনন্দ করেছে, আজ নিষ্ঠুর একাকীত্ব নিয়ে সেটি পরিত্যক্ত হয়ে একাকী কেবল দোল খাচ্ছে। বনের সব পাখিরাও স্তব্ধ। গাছের পাতা থেকে ফোঁটাফোঁটা জল নীরব অশ্রুর মত মাটিতে ঝরে পড়ছে। এর মধ্যে বিশাখা সখী একবার রাধার দরজায় এসে দাঁড়ালো। এইসময় রাধার স্বামী আয়ান ঘরে নেই। বাকি সঙ্গীদের জুটিয়ে বটতলার আড্ডায় পাশা খেলতে বসেছে। আয়ান আসলে এক নির্বিরোধী গৃহস্থ। যদিও পল্লীর অনেকেই তার স্ত্রীর সাথে কানহাইয়াকে নিয়ে অম্লমধুর গুঞ্জন রটিয়ে বেড়ায় তা শুনে আয়ানের মনে ক্ষণিকের জন্য রাগের উদ্রেক হয় ঠিকই, কিন্তু নিজে কখনোসখনো কানহাইয়ার সামনে এসে পড়লে অকারণেই গুটিয়ে যায়। কানহাইয়া নামের সদাহাস্যমুখের বুদ্ধিদীপ্ত কৃষ্ণবর্ণের সদ্যযুবাটির চোখে কি যে এক অদ্ভূত অন্তর্ভেদী মাদকতা আছে!এমনকি আয়ান তাকে নিজেও খুব একটা পছন্দ না করলেও কানহাইয়ার গোপরমণীকূলে জনপ্রিয়তাহেতু তার উপস্থিতিটিকেও অস্বীকার করতে পারেনা।
বিশাখা রাধার মনের ভাব বুঝতে পেরে চুপ করে থাকে। রাধাকে সান্ত্বনা দিতে এসে সে নিজেই ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। বিশাখাও তো তার মতো করে কানহাইয়াকে ভালবাসে। কিন্তু তাদের সবার মধ্যে কানহাইয়ার প্রতি রাধারই অধিকার সবচেয়ে বেশী। তাও তারা কেউ অসূয়াগ্রস্ত হয়না। কানহাইয়া সত্যিই যাদু জানে, ভালোবাসায় কখনো তার কম পড়ে না কারো প্রতিই।
রাধা মনে মনে গগনবিহারী হয়ে ভাবনার জাল বোনে। তার তপ্তকাঞ্চনবর্ণে এই কদিনেই এক অবসন্নতা গ্রাস করেছে।
সে কি তবে কানহাইয়ার সঙ্গে সত্যি প্রেমে জড়িয়ে পড়েছে? নাকি একটা অসুখী দাম্পত্যের ছিদ্র দিয়ে পরকীয়ার লোভ থাবা বসিয়েছে ওর শরীরে, মনে?
আয়ান রাধার চেয়ে বয়সে অনেকটাই বড়, চিরদিনই সে কেমন যেন একটা দূরের মানুষ। কানহাইয়ার মত বন্য অথচ সুরেলা আদর তার দ্বারা কখনোই সম্ভব নয়, কিন্তু অন্যদিকে আয়ান তো রাধার প্রতি বিশ্বস্ত! বরং রাধা ই কানহাইয়াকে মন,প্রাণ,দেহ সব সমর্পণ করে বসে আছে। আর সেই দেহ মনের নিঃশেষিত যাপনের অবশেষে তার নিয়তি তাকে দিয়েছে আজ এই চিরবিরহের শাস্তি।চিরচঞ্চল কানহাইয়াকে সেও বেঁধে রাখতে পারলো কই। রাধাকে তার এই নিষিদ্ধ প্রেমের জন্য সারাজীবন ধরে জ্বলতে হবে। অথচ এদিকে কানহাইয়াকে তার পক্ষে ভাল না বেসে থাকাটাও সম্পূর্ণ অসম্ভব !