ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিকপর্ব ২৩
ইতালির সবুজ হৃদয় – উমব্রিয়া
আজ এক মানুষখেকোর গল্প বলি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর কথা। মধ্য ইতালির গুব্বিও শহরে শুরু হল এক নেকড়ের উৎপাত। শুরুর দিকে সে গৃহপালিত পশু শিকার করলেও ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো মানুষের ওপর হামলা করা অনেক সহজ কাজ। অতঃপর খুব শিগগির সে হয়ে উঠল এলাকার বাসিন্দাদের ত্রাসের কারণ। জনালয়ের বাইরে ওঁত পেতে থাকতো আর অসতর্ক কেউ কাছাকাছি এলেই আর রক্ষা ছিল না। অত্যন্ত চতুর এই প্রাণীটির বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধই কাজ করছিল না। গুব্বিও শহরে সেইসময় বাস করছেন সন্ত ফ্রান্সিস। ততদিনে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার কথা ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। ফ্রান্সিস একদিন দলবল নিয়ে রওনা হলেন হিংস্র শ্বাপদটির ডেরার দিকে। দূর থেকে তাঁদের দেখতে পেয়ে নেকড়েটি ধেয়ে এলো সেদিকে। তার চোখ থেকে তখন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে, মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে লালা। এমতাবস্থায় ফ্রান্সিস অন্যদের দাঁড়াতে বলে নিজে এগিয়ে গেলেন আর যখন তিনি নেকড়েটির মুখোমুখি, তাঁর আলখাল্লার মধ্যে থেকে বের করে আনলেন প্রভু যিশুর ক্রস, তাকে সম্বোধন করলেন ভাই বলে। নেকড়েটি কেমন যেন বিবশ হয়ে গেলো। তার মুখ থেকে লালা পড়া বন্ধ হয়ে গেলো। সে প্রথমে সন্তের পায়ের কাছে বসলো আর তারপর অচৈতন্য হয়ে লুটিয়ে পড়লো সেখানেই। এই ঘটনার সঙ্গে কোনও হেঁশেলের সরাসরি সম্পর্ক নেই, যা আছে তা হল সন্ত ফ্রান্সিসের সঙ্গে গুব্বিও, আসিসি – উমব্রিয়া প্রদেশের এবং এইসব জনপদে তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা নানান কাহিনির, এক বড়লোক বাপের আয়েশি ছেলে থেকে সন্ত হয়ে ওঠার ইতিহাস আর সেই সন্তের কারণে তো বটেই, আরও একটি বিশেষ কারণে প্রাচীন যুগ থেকেই উমব্রিয়ার খ্যাতি। তা হল ‘পরকেত্তা’ (Porchetta) উৎসবের ঐতিহ্য। একটি আস্ত শুয়োরের পেটের মধ্যে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি ভরে সেলাই করে সেটিকে কাঠকয়লার আঁচে ধীরে ধীরে পুড়িয়ে নেওয়ার রীতি এখানে যুগ-যুগান্তের। একসময় যা শুরু হয়েছিল গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন যাপনের প্রয়োজন থেকে, ক্রমশ তা পরিণত হল এক কারনিভালে। অবশ্য শুধুমাত্র ইতালিতেই নয়, স্পেন, পর্তুগাল এমনকি দীর্ঘ স্পেনীয় ঔপনিবেশিক ইতিহাসের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিলিপিন্স-এও ছড়িয়ে পড়ে এই প্রথা, যেখানে তার জনপ্রিয়তা হয় ‘লাচেন’ (Lechon) নামে। সে আলোচনায় পরে আসা যাবে।
বিশ্বের হেঁশেল মানচিত্রে ইতালির যে প্রদেশটির নামডাক জগৎজোড়া, সেটি হল টাস্কানি। আশ্চর্য খাদ্যসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী এই দেশটির প্রতিটি অঞ্চলেরই রয়েছে অভ্রান্ত নিজস্বতা এবং যে বিশেষ চারিত্রিকতা এই লেখকের সীমিত অভিজ্ঞতায় ধরা পড়েছে, তা হল আপন আপন বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের যে আকুলতা। সেই কারণেই হয়ত ইতালি (এবং অবশ্যই ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগাল) তেমন একটি ভূখণ্ড, যার হেঁশেল-সংস্কৃতির ওপরে বিশ্বায়নের যথেষ্ট আগ্রাসন থাকলেও তা আজকের দিনেও অনেকটাই নিরাপদ। এটি খুব বড় ব্যাপার। সবাই এটা পারেনি। ইতালিয়ানরা পেরেছে। মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ইতালির প্রতিটি আলাদা আলাদা মুক্তোসম প্রদেশ নিয়ে যদি একটি মালা গেঁথে ফেলা যায়, টাস্কানি বা পারমার দীপ্তি হবে হীরকসম। কিন্তু উমব্রিয়া? তার পরিচিতি একটু স্বতন্ত্র। সে নিভৃতচারী কোহিনুর। সন্ত ফ্রান্সিসের কথা তো আমরা জানি। আসিসির সঙ্গে তাঁর নাম এক নিস্বাসে উচ্চারিত হয় কিন্তু উমব্রিয়া মানে তো আর শুধু আসিসি নয়। আসিসি, পারুজিয়া, গুব্বিও এবং আরও অনেক ছোট ছোট জনপদ। পাহাড়, ঘন অরণ্য, সেখানে আপন খেয়ালে বিচরণ করে বেড়ায় নানান গৃহপালিত প্রাণী। এলাকার মানুষজন সারমেয় নিয়ে খুঁজতে বেরোয় ট্রাফল্ আর দিনের শেষে ফিরে এসে আগুনের ধারে গোল হয়ে বসে ওয়াইনের গ্লাস হাতে। বাতাসে তখন পোড়া মাংসের ঘ্রাণ। ফেলে আসা সেই সময়ের দিকে একটু তাকানো যাক।
সাবেক রোমে একটা ঘটনা ঘটতো। চাষবাস আর উর্বরতার দেবী ছিলেন চেরেস। তাঁকে তুষ্ট করার জন্য নিবেদন করা হত দুগ্ধপোষ্য শুয়োরছানা। ‘চেরেলিয়া’ নামে বিখ্যাত এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আরও অনেক প্রথা। কালক্রমে এই বিষয়টির চরিত্র গেলো সামান্য বদলে, তা ছড়িয়ে পড়লো ইতালির অন্যত্র এবং টাস্কানি, লাজিও কিংবা উমব্রিয়ার মতো অঞ্চলে সবিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করল ‘পরকেত্তা’ নামে। আসলে উমব্রিয়াতে ছিল শরীরতত্ত্বের ওপর একটা আস্ত লাইব্রেরি আর এখানকার শল্যচিকিৎসকদের দক্ষতা ছিল অনন্য সাধারণ পর্যায়ের – যার প্রভাব পড়লো এই ‘পরকেত্তা’ উৎসবেও। কী অদ্ভুত! এটাই নিঃসন্দেহে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন। এ তো শুধু দুই সংস্কৃতির এক হয়ে যাওয়া নয়, দু-ধরনের দক্ষতা এবং প্রথারও মিলন। উমব্রিয়ায় শরীরতত্ত্বের চর্চা থাকার কারণে পরকেত্তার জন্য শুয়োরশাবকটিকে প্রস্তুত করার জন্য যেটা প্রথম পদক্ষেপ, তা হল নিখুঁতভাবে শরীর থেকে হাড়গোড় সব বের করে নেওয়া, সেই শিল্পটি উমব্রিয়াবাসী দুর্দান্তভাবে আয়ত্ত করেছিলেন। আরেকটা বিষয় ছিল। সেটা হচ্ছে ম্যারিনেশনের সময় একটি বিশেষ উপাদানের ব্যবহার – মৌরি। নুন, মরিচ, রসুন আর রোজমেরির সঙ্গে উমব্রিয়ার যত্রতত্র ফুটে থাকা মৌরি – স্বাদ, গন্ধের কারণে যার চারিত্রিকতা একেবারে অন্যরকম। এই মৌরি নিয়ে কথা বলতে গেলে আবার মহাভারত হয়ে যাবে। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকাতেই এর প্রথম আত্মপ্রকাশ। সম্ভবত গ্রিসে। গ্রিক এবং রোমানরা রান্না ছাড়াও মৌরি ব্যবহার করত চিকিৎসার প্রয়োজনে। এও শোনা যায় যোদ্ধারা সমরাঙ্গনের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে বলবর্ধক পানীয় হিসাবে পান করতেন মৌরি চা! তা উমব্রিয়ার সেই মাটি আর জলহাওয়ার গুণে ওখানে যে বুনো মৌরিগাছের ঝাড় বেড়ে ওঠে, অবিশ্বাস্য মনমাতানো তাদের সৌরভ। আর সেই মৌরিতে মাখামখি হয়ে চামড়াসমেত হাড়গোড়হীন শুয়োরশাবকটি যখন ঢিমে কাঠকয়লার আঁচে তিন-চার ঘণ্টা ধরে পুড়ে যায়, তার বাইরের আস্তরণটি হয়ে ওঠে মুচমুচে আর ভিতরটি থেকে যায় তুলতুলে নরম, রসালো। ভাবতে অবাক লাগে স্পেনীয় ঔপনিবেশিকতার কারণে সুদূর ফিলিপিন্সে ‘লাচেন’ নাম ধারণ করে এই পদটি হয়ে উঠল জনপ্রিয়তম স্ট্রিট ফুডগুলির একটি। এই কারণেই সদা বহমান এবং পরিবর্তনশীল এই রন্ধন সংস্কৃতি এত রহস্যময় এবং আকর্ষণীয়। ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির লক্ষ্যে এক দেবীকে একটি প্রাণী উৎসর্গ করে যে প্রথা শুরু হয়েছিল দু’হাজার বছরেরও আগে, আধুনিক সময়ে তা হয়ে দাঁড়ালো একটি চিত্তাকর্ষক উৎসবে। তখন ‘পরকেত্তা’ হয়ে উঠল ‘পরকেতিয়ামো’ – যা এই অঞ্চলগুলিকে বিশ্বের হেঁশেল অভিধানে আভিজাত্য দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু উমব্রিয়া মানে শুধুই ‘পরকেতিয়ামো’ নয়। আরও আরও কিছু। ট্রাফল্, ওয়াইন ইত্যাদি ইত্যাদি।
এমনিতে অক্টোবর থেকে জানুয়ারি – এই সময়টা হল ট্রাফল্-এর সময়। কিন্তু উমব্রিয়াতে ট্রাফল্ খুঁজতে যাওয়ার কোনও সময় নেই। প্রতিদিন, সারা বছর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে থাকা সবুজের মধ্যে চলে ট্রাফল্ খোঁজার খেলা। এমন পরিবারও আসিসি বা গুব্বিওতে আছে, যারা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছে এই খেলার ব্যাটন, বিগত পাঁচশো বছর কি আরও বেশি সময় ধরে। কী এই ট্রাফল্, যা নিয়ে এত উন্মাদনা? কেনই বা এর দাম এত আকাশছোঁয়া? প্রাচীন এই পরিবারগুলি কেন ট্রাফল্ রান্নার প্রণালীগুলি এত গোপনীয়তায় মুড়ে রেখেছে? প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে যেতে হবে অনেক গভীরে।
পপলার, উইলো বা ওক জাতীয় গাছের মূলে একধরনের ছত্রাক জন্মায়, যা একাধিক রঙ বা গোত্রের হতে পারে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল এই ছত্রাকটির রহস্যময় আচরণ। একইসঙ্গে অপ্রতুলতা। বাছাইকরা একদল সারমেয়কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় মাটির তলায় ঠিক কোন গাছটির মূলে ট্রাফল্ রয়েছে গন্ধ থেকে তা বের করার জন্য। কোনও কোনও সময় সারাদিনের খোঁজাখুঁজির ফল হতে পারে শূন্য অথবা হয়ত প্রাপ্তি যা হল প্রত্যাশার তুলনায় তা অনেক কম। দুর্লভ প্রজাতির একটি ট্রাফল্-এর দাম ভারতীয় মুদ্রায় তিন লক্ষ টাকারও বেশি হতে পারে। কালো এবং সাদা, সাধারণত এই দু’রকম বর্ণেই দৃশ্যমান হয় এই বস্তুটি। ট্রাফল্ দিয়ে হতে পারে অসংখ্য অপূর্ব, স্বাদু রান্না, অলিভের মতো তৈরি করা যায় তেলও বা রুটির ওপর মাখনের মতো লাগিয়েও খাওয়া যায় ট্রাফল্ পেস্ট। এই পর্যন্ত লিখে মনে হচ্ছে ক্যাভিয়ারের সঙ্গে ট্রাফল্-এর একটা সঙ্গত তুলনা হতে পারে অনেক কারণেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় অমিলটা হল এর অনুসন্ধানের পিছনে শতাব্দীব্যাপী পারিবারিক অবদান এবং তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বিনোদনের দিকটি। আরও একটি উল্লেখ্য বিষয়। প্রকৃতি প্রকৃত অর্থেই এই মানুষগুলির কাছে মাতৃসমা। অন্যতর তাৎপর্যে গাছের মূলে জন্মানো একটি ছত্রাক অনুসন্ধান তাদের কাছে শেষ অবধি হয়ে দাঁড়ায় আপন শিকড়ের অনুসন্ধান।
প্রথমবার বার্লিন শহরের এক সুপার মার্কেটে বারবারাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে জানতে পারি প্রকৃতির এই অসাধারণ সৃষ্টির সুলুক-সন্ধান আর কদিন আগে ঘুম থেকে উঠে এই কিস্তিটি আরম্ভ করেও বুঝতে পারিনি শেষ অবধি লেখাটি ট্রাফল্-শিকারি কুকুরের মতোই এই বিন্দুতে পৌঁছে যাবে।