Next
Previous
4

গল্প - গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্য

Posted in




















১৯৫৮ সাল। সেই শেষবারের মতো আসা। তারপর প্রায় ষাট বছর কেটে গেছে...

তাই তো, সত্যিই ষাটটা বছর পার হয়ে গেল?

সোমেশবাবু চোখ বন্ধ করেন। আবার খোলেন। স্মৃতির সঙ্গে বাস্তবকে মেলানোর চেষ্টা করেন। সব কেমন গোলমাল হয়ে যায়।

ষাট বছর...

পুলোভারটা কানের ওপর তুলে দিতে দিতে রাধিকা মনে মনে ভাবে।

প্রায় ষাট বছর ধরে সোমেশবাবু ছবিটা আলমারির কোণে রেখে দিয়েছেন! ষাট বছর তো একটা গোটা মানুষের আয়ুর সমান। রাধিকার নিজের দাদুই তো বাষট্টি বছর বেঁচে ছিল।

পাশে বসা সন্টুর দিকে তাকিয়ে রাধিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

ইশ, নাতি যদি দাদুর একটা গুণও পেত...

ভাবতে ভাবতেই চেক পয়েন্টে গাড়ি থেমে যায়। উর্দি পরা পুলিশ এসে পরিচয় পত্র দেখতে চায়।

শ্রীনগরে আসার এই এক ঝামেলা। ঘন ঘন আই ডি বের করে দেখাতে হয়। সন্টু ভোটার কার্ড বের করছে এই ফাঁকে সোমেশবাবু সামনের সীটের জানলা দিয়ে মুখ বের করেন।

“রাস্তায় সবাই মিলে বসে হুঁকো খেতে দেখছি না?”

পুলিশ সে কথার উত্তর না দিয়ে গম্ভীর মুখে আই ডি ফেরত দিয়ে দিল।

“দাদু তোমায় বলেছি না, অপ্রয়োজনে বেশী কথা বলবে না?” পেছনের সীট থেকে সন্টু হাল্কা ধমক মারে।

“ভুলটা কি বললাম শুনি? আগে গাছতলা থাকলেই দেখা যেত তিন চারজন মিলে বসে একটা হুঁকো থেকে টান মারছে, আর গল্প করছে। কেউ গিয়ে বসলে তার দিকেও হুঁকোর নল এগিয়ে দেওয়া হত। তারা কোথায় গেল?”

সন্টু উত্তর দিতে পারে না।

“ক্ষিদে পেয়েছে দাদু? বিস্কুট খাবে?” রাধিকা জিজ্ঞেস করে।

“কেন আমি কি বুড়ো নাকি, থেকে থেকে বিস্কুট খাব?”

কাঁপা কাঁপা হাতে সোমেশবাবু একটা সিগারেট ধরালেন। সন্টু আর রাধিকা চোখাচোখি করে। সোমেশবাবুকে শেষ কবে সিগারেট খেতে দেখা গেছে? প্রায় কুড়ি বছর তো হবেই – সন্টু তখনো হাফ প্যান্ট পরত।

আসলে কাশ্মীরে পা দিয়েই যেন সোমেশবাবুর বয়সটা হযবরল-এর বুড়োর নিয়মে উল্টো দিকে ঘুরে গেছে। ধুতি ছেড়ে প্যান্ট আর জ্যাকেট ধরেছেন, একদিন লাঠি ছাড়া ঘর থেকে বেরতে গিয়ে সন্টুর কাছে ধমক খেয়েছেন। এখন দেখা গেল কোন ফাঁকে যেন সিগারেটও কিনেছেন। থেকে থেকেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠছেন,

“ওই দ্যাখ, ওখানে ফ্লোরা রেস্টুরেন্ট ছিল, তার পাশে ছিল কাপুর এন্ড কো..ওখানে চীপ জন পাপিয়ের ম্যাশের দোকান ছিল, তার সামনেই টাঙ্গার স্ট্যান্ড ছিল...ওখানে সাইকেল সারানোর দোকান ছিল...”

এখন অবশ্য সে সব কিছুরই কোন অস্তিত্ব নেই।

“বাব্বা, আজো তোমার এতো পুরনো কথা মনে আছে!”

সোমেশবাবু নিজেও জানতেন না তাঁর এতো কথা মনে আছে।

নিজের অতীতটাকে বাক্সবন্দী করে কবেই তুলে দিয়েছিলেন তিনি...

রূপকথার ঢঙে বলতে গেলে, সে অনেকদিন আগের কথা। সদ্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা সোমেশ্বর মজুমদার সরকারি চাকরিতে ঢুকেছে, আর প্রথম পোস্টিংই শ্রীনগরে। ঝিলাম নদীর ওপর দিয়ে একটা ব্রিজ তৈরি হবে, তার আগে সোমেশকে গিয়ে গবেষণা করে একটা রিপোর্ট লিখতে হবে।

সিনিয়র সহকর্মী মিস্টার রায়না বললেন, “ইশবেরের কাছে আমার একটা বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে। মোটে তো তিন মাসের ব্যাপার, তুমি আমার বাড়িতেই থাক।”

পুরনো ঘিঞ্জি শহর থেকে দূরে ইন্দো-ইয়োরোপীয় স্টাইলের দোতলা বাড়িটা দেখেই সোমেশ প্রেমে পড়ে গেল। চারপাশে অচিন গাছের সবুজ বন, দূরে বরফে মোড়া সাদা পাহাড়। বাড়ির নাম 'হায়াত'।

কোলকাতার ছেলে সোমেশ কাশ্মীরে এসে যেন খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচল। কাজের চাপ বেশী না, বিকেলের আগেই ছুটি হয়ে যায়। তারপর অখণ্ড অবসর। ডাল ঝিলের পাশ দিয়ে হাঁটা, দোকানে দোকানে ঢুঁ মারা, সন্ধে হলেই কারুর না কারুর বাড়িতে নেমন্তন্ন – অল্প সময়েই কত পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল! মিস্টার সাপ্রু, মিস্টার রাজদান, মিস্টার মির্জা, গুল মহম্মদ...বাকি সবার নাম এখন মনেও নেই। সোমেশ টের পাওয়ার আগেই এক মাস কোথা দিয়ে কেটে গেল।

এই সময়ে কাশ্মীরে প্রায়ই বিদেশীদের দল বেড়াতে আসত। তাদের অধিকাংশই ছিল মিশুকে স্বভাবের, স্থানীয় মানুষদের বিষয়ে কৌতুহলী। সোমেশেরও অন্য দেশ, সেখানকার জীবনযাত্রা নিয়ে কৌতুহলের শেষ ছিল না। তাই সে প্রায়ই সেসব দলের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলত।

তেমনি একটা দলের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে -

“ভদ্রমহিলার নামটা যেন কি?” সন্টু ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে।

“লুডমিলা কোভালস্কা,” রাধিকা চাপা গলায় উত্তর দিল।

“পোলিশ মনে হয়।”

সোমেশবাবু মুচকি হাসেন। আজ কতদিন পরে আবার 'তার' নামটা শুনতে পেলেন। আবার বুকের ভেতর কি যেন তোলপাড় হয়ে গেল।

একটা বৃটিশ দলের সঙ্গে সে এসেছিল। লম্বা চুল, ঠোঁটে হাল্কা হাসির রেখা, গভীর বাদামি চোখ...

“আমি তোমাদের ট্যুর গাইড হব,” সোমেশ হঠাৎ হিন্দী সিনেমার ঢঙে বলে বসল।

দলের এক যুবক (কি যেন নাম ছিল) হেসে উঠল।

“আর ইউ সিরিয়াস?”

“অভ কোর্স। এখানকার সব দ্রষ্টব্য তোমাদের দেখাব, সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। তোমরা অতিথি বলে কথা!”

যুবকটি হালকা হেসে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল।

“আলরাইট দেন।”

গাইড তার কথার খেলাপ করেনি। ডাল ঝিল, নিগীন ঝিল, শালিমার বাগ, জামা মসজিদ, হজরতবাল..সবই সে অতিথিদের খুব ভালো করে দেখিয়েছিল। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে এটা করা, সেটা সফল হল না। লুডমিলার সঙ্গে তার আলাপ বেশী দূর এগোল না।

উলটে যুবকটির সঙ্গে ভাব হয়ে গেল (দূর ছাই, কি নাম ছিল ছেলেটার?)। তার অনুরোধে সোমেশ ছুটি নিয়ে দলটার সঙ্গে গুলমার্গ, আনন্তনাগও ঘুরে এল। তারপর এল বিদায়ের বেলা। কাশ্মীর ছেড়ে দলটা রাজস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা হবে।

সোমেশের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। রোমান হলিডের এখানেই ইতি হয়ে গেল? শুরু হওয়ার আগেই দি এন্ড? না, এ কিছুতেই হতে পারে না!

হঠাৎ সে লুডমিলাকে বলে বসল, “তুমি কোথাও যেয়ো না, আমার সঙ্গে এখানে থেকে যাও।”

“ওয়াট?”

লুডমিলার বন্ধুরা উদ্বিগ্ন মুখে তার দিকে তাকাল। যেন সোমেশ পাগল হয়ে গেছে।

লুডমিলা শান্তভাবে সোমেশকে একবার আপাদমস্তক মেপে নিল। তারপর বলল,

“বেশ, থেকে যাব।”

“মাত্র দু' দিনের আলাপ, ওর সঙ্গে থেকে যাবে?” এক বান্ধবী ইংরেজিতে প্রশ্ন করল। “দেশে ফেরার কি করবে?”

লুডমিলা সোমেশের দিকে তাকাল।

“আমার ভিসার মেয়াদ মোটে এক মাসের। তারপর আমাকে দিল্লি থেকে ফ্লাইট ধরতে হবে। আমার বন্ধুরা রাজস্থান, মথুরা, আগ্রা দেখে দিল্লি থেকেই ফ্লাইট ধরবে।”

সোমেশের বুক ধুকপুক করছে। ঝোঁকের বশে সে কি করতে চলেছে?

“তোমার কোন চিন্তা নেই লুডমিলা, আমি তোমাকে নির্দিষ্ট দিনে দিল্লি পৌঁছে দেব। আমি সেই দায়িত্ব নিচ্ছি।”

“অলরাইট।”

“ওয়েল,” লুডমিলার বন্ধু কাঁধ ঝাঁকায়, “তুমি চিরকালই নিজের তালে নাচো। আশা করি দিল্লিতে অন্তত সময় মতো পৌঁছে যাবে।”

সেই রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে লুডমিলা সোমেশের সঙ্গে হায়াতে চলে এসেছিল। তারপর একান্ত নিভৃতে, মায়ের চোখ রাঙানি আর আত্মীয়দের কৌতুহলী দৃষ্টির থেকে বহু দূরে, শুরু হয়েছিল দু'জনের খেলার সংসার।

“যাই বল, তখনকার দিনে এরকম একটা পদক্ষেপ নেওয়া কিন্তু সাহসের ব্যাপার ছিল,” রাধিকার চোখে সম্ভ্রম খেলে যায়।

সন্টু হতবুদ্ধির মতো মাথা নাড়ে।

“মাঝে মাঝে আমার মনে হয় দাদুকে আমি চিনিই না।”

ওদের কথা শুনে সোমেশবাবু মনে মনে হাসেন। নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ হয়। রঙিন জ্যাকেটের বুক পকেট থেকে চুপিচুপি মিলার ছবিটা বের করে দেখেন।

মিলার হাত ধরলে কি আবার তিনি যৌবনের ঘোরের মধ্যে চলে যেতে পারবেন? জীবনের সেই সময়টায় – যখন মনে হয় হাত বাড়ালে চাঁদও ছোঁয়া সম্ভব?

প্রথম প্রেমের উন্মত্ততায় বোনা সেই দিনগুলো ছিল স্বপ্নের পশমিনা চাদরে তোলা এক একটা নকশার মতো।

সকাল হলে সোমেশ কাজে বেরিয়ে যায়। সারাদিন অপেক্ষায় থাকে কখন বাড়ি ফিরবে আর মিলা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরবে। ভারতীয় উনুনে রাঁধতে মিলা সড়গড় নয় তাই রান্নার ভার সোমেশকেই নিতে হয়। সন্ধেবেলা অধিকাংশ দিন দু'জনে কাওয়া হাতে জুন ডুবে গিয়ে বসে। 'জুন ডুব' মানে চাঁদ দেখার বারান্দা। কাঠের পিঞ্জরকারি কাজের মধ্যে দিয়ে চাঁদের আলো মিলার মুখের ওপর এসে পড়ে। সোমেশ হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। হাতের কাওয়া হাতেই ঠান্ডা হয়ে যায়।

কোনদিন বা দু'জনে চলে যায় নিশাত বাগে। গোধূলির আভা ডাল ঝিলে ছড়িয়ে পড়ে। মিলা তার নাম দিয়েছিল 'ল্যাভেন্ডার সানসেট'। চারশো বছরেরও পুরনো চিনার গাছের পাতা, ফোয়ারার জল, কতরকমের ফুল আর পেছনে হিমালয় পাহাড়...দু'জনকে যেন এক আলাদা জগতে নিয়ে যেত।

বাঙালির ছেলে সোমেশ মাঝেমাঝে বিয়ের কথা তুলে ফেলে। কিন্তু মিলা কিছু শুনতে চায় না।

“আমার যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন আমার মা বাবাকে ওরা কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে নিয়ে গেছিল। আমি সে সময়ে ব্রিটেনে মাসীর বাড়িতে ছিলাম তাই বেঁচে গেছিলাম, কিন্তু ওরা বাঁচতে পারে নি।” মিলার চোখে ছায়া নেমে আসে।

পাঁচ বছরের মিলা আর কোনদিন দেশে ফিরে যেতে পারেনি। ফিরতে পারেনি এগারো বছর আগে 'দেশের ভিটে' ছেড়ে আসা সোমেশও।

“আমার মা বাবা একটা মুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখত, যেখানে ইহুদি আর ক্রিশ্চিয়ানের সমান অধিকার থাকবে,” মিলার কণ্ঠস্বর ধূসর হয়ে ওঠে, “আজ সেই স্বপ্ন দেখা চোখগুলো কবরের নীচে চিরতরে ঘুমিয়ে আছে। তাই আমি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি না। প্রতিদিন আমার যেটা করতে ইচ্ছে করে আমি সেটাই করি। দেখনা, কেমন তোমার এক ডাকে সাড়া দিয়ে তোমার সঙ্গে থাকতে চলে এলাম।”

সোমেশ মিলাকে দু'হাতে জড়িয়ে নেয়।

“আর কাল যদি তোমার ইচ্ছে করে আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে?”

মিলা হেসে ওঠে।

“তবে তোমার সাধ্য নেই আমাকে আটকে রাখার।”

“বটে!” সোমেশ নকল রাগ দেখায়, “আমিও দেখব কেমন করে তুমি উড়ে পালাও!”

মিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

“তুমি খুব ডেঞ্জারাস, স্যামি। তোমার তৈরি করা খাঁচাটা খুব সুন্দর, খুব আরামদায়ক। মাঝে মাঝে তাই খাঁচা বলে মনেই হয় না।”

“খাঁচা বলে কি মনে করতেই হবে? তোমার নিজের বাড়ি, তোমার হোম বলে ভাবতে পার না?”

মিলা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ে।

“খাঁচা কখনো কারুর হোম হয় না।”

চিনারের পাতায় পাতায় তখন বিদায়ী সূর্যের সোনালী আলো খেলা করছে, আর গ্রামোফোনে বাজছে ভিভালদির ফোর সীজনস।

রেকর্ডটা গুল মহম্মদ ধার দিয়েছিল।

“তোমার বন্ধু গুল মহম্মদের বাড়ি যাবে নাকি?”

সন্টুর কথায় সোমেশবাবুর সম্বিৎ ফিরে আসে।

“না না, গুল মহম্মদ তো ছেলের কাছে কানাডায় চলে গেছে।”

ড্রাইভার আবদুল বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে।

“সবাই কানাডায় চলে যাচ্ছে। এখানে চাকরির অবস্থা খুব খারাপ...আপনারা পেহেলগাঁও, গুলমার্গ ঘুরতে যাবেন না?”

সন্টু জানাল যে তারা যাবে।

“গাড়ি ঠিক করে ফেলেছেন? নাহলে আমি যেতে পারি...”

শ্রীনগর থেকে পেহেলগাঁও...

ঝিলাম থেকে লিড্ডার...

মিলার বায়না রাখতে তিন দিনের ছুটি নিয়ে সোমেশ কোলহাই গ্লেসিয়ারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। দু দিকে পাইন আর ফারের বন, মাঝে নীল লিড্ডার নদী, আর দূরে রুপোলী বরফে মোড়া হিমালয়। রাতে লিড্ডারের পাশেই তাঁবু খাটিয়ে থাকার ব্যবস্থা। সঙ্গে আরো কয়েকটা বিদেশী দল ছিল। সবাই মিলে ক্যাম্প ফায়ার জ্বালিয়ে রান্না করা হল। তারপর তারা ভরা আকাশের নীচে ব্যাঞ্জো বাজিয়ে গান শুরু হল। সোমেশ আর মিলা এক কম্বলের তলায় শুয়ে, পরস্পরকে গভীর আশ্লেষে জড়িয়ে আছে।

“জান মিলা,” সোমেশ অস্ফুটস্বরে বলেছিল, “এই মূহুর্তটা এত সুন্দর, এত পারফেক্ট, কাল যদি আমি মরেও যাই আমার কোন আক্ষেপ থাকবে না।”

মিলা ওর মাথাটা সোমেশের বুকে নামিয়ে দিয়েছিল।

“এই মুহূর্ত গুলোর বাইরে তো কিছু নেই, স্যামি। আমাদের কোন দেশ নেই, কোন শিকড় নেই...আমরা বেঁচে থাকি শুধু কয়েকটা মুহূর্তের ভেতরে। বাচ্চাদের ওড়ানো বুদবুদ দেখেছ? কেমন তৈরি হয়, সূর্যের আলো পড়ে রামধনুর মতো রং খেলে, তারপর শূন্যে মিলিয়ে যায়? আজকের এই সন্ধেটা, এই আকাশ, নদীর আওয়াজ, ক্যাম্প ফায়ার, গান – এ সবই বুদবুদের মতো। এই মুহূর্তটার মধ্যে নিজের সবটুকু অস্তিত্ব ঢেলে দাও, স্যামি। কাল আর এদের কোন অস্তিত্ব থাকবে না।”

অনেক বছর পরে সোমেশের সঙ্গে মিস্টার সাপ্রুর দেখা হয়েছিল। তদ্দিনে তাঁর কাশ্মীরের পাট চুকে গেছে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে দিল্লিতে বসবাস করেন। কিন্তু মনের মধ্যে তখনও শ্রীনগর বাসা বেঁধে আছে। সোমেশ বলেছিল,

“থাকতে যদি নাও পার, গিয়ে নিজের পৈতৃক ভিটেটা দেখে তো আসতে পার।”

মিস্টার সাপ্রু আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নেড়েছিলেন।

“কি করব গিয়ে? সু মাহোল, সোমেশ...কাঠ আর পাথরের বাড়িগুলো হয়তো পড়ে আছে, কিন্তু ওই মাহোল, ওই মুহূর্তগুলো তো আর নেই।”

বুদবুদের মতো সেই মুহূর্তগুলো সময়ের অতলে হারিয়ে গেছে।

“সন্টু, কোলহাইয়ের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিস?” সোমেশবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

“এই তো, আবদুলের কাছেই জিজ্ঞেস করে নিচ্ছি। আবদুল, এখনো কোলহাই গ্লেসিয়ার যাওয়া যায়?”

আবদুলের চোখমুখ সাবধানি হয়ে ওঠে।

“না যাওয়াই ভালো। বরফ প্রচুর গলে গেছে। বরং পেহেলগাঁও ঘুরে আসুন না। তবে বড় রাস্তা ধরে যাবেন। এদিক ওদিক না যাওয়াই ভালো। আর কাঁটাতারের বেড়া পেরোবেন না।”

সোমেশবাবু মনে মনে একটু দমে যান। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন। যা দেখেন কিছুই চিনতে পারেন না। তাঁর চেনা শ্রীনগর হঠাৎ যেন কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এ এক অন্য দেশ - যেখানে আর কেউ গাছতলায় বসে হুঁকো খায় না। নেডু’স হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে। তারা ভরা আকাশের নীচে শুয়ে থাকা নিরাপদ না। লিড্ডারের ধারেও আর বোধহয় ব্যাঞ্জো বাজে না।

“তাহলে এখন কি করবে?” সন্টু মাথা চুলকোয়। “তোমার চেনা কিছুই তো এখানে নেই। এখানে যা আছে তার মধ্যে কি দেখবে বল?”

“এ-একবার শাহ স্টুডিওতে নিয়ে যাবি নাকি? এই আবদুল, শাহ স্টুডিও কি আজো আছে?”

“জরুর আছে। কিন্তু বেশী দেরী করবেন না। বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে।”

আবদুল গাড়ি জিরো ব্রিজের দিকে ঘুরিয়ে দিল। পাহাড়ের মাথায় নেমে আসা কুয়াশার মতো সোমেশবাবুর চারপাশে অতীতরা ভিড় করে আসে।

সেদিন মিলা ডাল ঝিলের এক ফুলওয়ালার কাছ থেকে ফুলের মুকুট কিনে পরেছিল।

“চলো শাহ স্টুডিও তে, তোমার একটা ছবি তুলে রাখি!” সোমেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল।

“যাব, কিন্তু তোমাকেও আমার সঙ্গে ছবি তুলতে হবে।”

“ধুর, আমাকে তোমার পাশে মানাবে নাকি!”

“বেশ, তাহলে আমিও তুলব না।”

মিলার চাপাচাপিতে শেষে সোমেশ ছবি তুলতে রাজি হল। স্টুডিওতে গিয়ে নিজেদের স্বামী স্ত্রী বলে পরিচয় দিল।

“এই শাহ স্টুডিও তে আমাদের সঙ্গে এক বৃটিশ দম্পতির আলাপ হয়েছিল,” সোমেশবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে সন্টু-রাধিকাকে বলেন, “মিলার সঙ্গে ওদের কথা হল পরের দিন গাগরিবাল পয়েন্ট থেকে ডাল ঝিলে সাঁতার কাটবে। আমার একটু হিংসেই হল, কিন্তু লেকের কনকনে জলে সাঁতার কাটার মতো বুকের পাটা নেই। যাই হোক, সাঁতার টাতার তো খুব হল তারপর বিকেল না হতেই মিলার এল তেড়ে জ্বর। আমি তো চিন্তায় অস্থির। বাড়িতে কারুর অসুখ বিসুখ হলে মা-ই সামলেছে। বিদেশ বিভুঁইয়ে মা পাব কোথায়? ছুটলাম গণপতিয়ারে চান্নার ওষুধের দোকানে। ডক্টর মাট্টু বলে এক ডাক্তারের খোঁজও পেলাম। তখন রাত আটটা বেজে গেছে, চেম্বার বন্ধ। আমি ছুটলাম ডাক্তারের বাড়ি।”

“একেবারে বাড়ি অবধি ছুটে গেলে?” রাধিকার চোখ গোল হয়ে ওঠে। মিতভাষী দাদাশ্বশুরকে এত গল্প করতে দেখে সে তো অবাক।

“এই যে পুরনো বাড়িগুলো দেখছি, এরকম বাড়ি? এগুলোর ভেতরটা কেমন হয় তুমি দেখেছ?” এতক্ষণে সন্টুরও উৎসাহ জেগেছে। সে পেশায় আর্কিটেক্ট। পুরনো বাড়ির বিষয়ে অদম্য কৌতুহল।

“কাশ্মীরের সাবেকি আর্কিটেকচার দুই ধরনের - তাক আর ধজ্জি দিওয়ারি। এই ধরণের বাড়ি চার পাঁচ তলা উঁচু হলেও ভূমিকম্প সহ্য করতে পারে। পণ্ডিতদের বাড়ি সাধারণত তিন তলা হত, কারণ তিন সংখ্যাটা ওরা শুভ বলে মনে করে। একতলায় থাকে রান্নাঘর আর লাগোয়া বৈঠক। রান্নাঘরের গরমটা আসে বলে এই বৈঠকটা বাড়ির সব চেয়ে গরম ঘর। দোতলায় একটা আট ফিট মতো লম্বা করিডোর থাকে, যার এক পাশে শোয়ার ঘর থাকে। তিন তলার ঘরগুলোয় বড় বড় কাঁচের জানলা থাকে। সাধারণত এই ঘরগুলো বসন্ত বা গ্রীষ্মকালে ব্যবহার হয়। শীতকালে সবাই একতলার গরমে নেমে যায়। ডক্টর মাট্টুর বাড়িও এইরকম ছিল।”

“ডাক্তার লুডমিলাকে দেখতে রাজি হলেন?” রাধিকার আর্কিটেকচারের থেকে মানুষের ব্যাপারে বেশী আগ্রহ।

“হ্যাঁ, দেখে ওষুধ দিয়ে দিলেন। আমি দুই রাত জেগে বসে আছি। ওষুধ খাওয়াই, স্যুপ বানাই, কখনো জলপট্টি করে দিই। ভয় করে, নিউমোনিয়া না হয়ে যায়। শেষে দুই দিন পরে তার জ্বর নামল। আমারো ধড়ে প্রাণ এল।”

“কই ঠাম্মির বেলায় তো তোমায় এতকিছু করতে দেখিনি!” সন্টু অভিযোগ করে।

“তোরা তো ছিলি, তাকে দেখার জন্য।”

সভ্য সমাজ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া সোমেশ আর মিলার পরস্পর ছাড়া আর কে-ই বা ছিল?

আবদুল ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। “ইয়ে রহা শাহ স্টুডিও।”

সবাই নেমে পড়ল। ঝিলামের ধারেই শাহ স্টুডিও। সাদার মধ্যে লাল কালি দিয়ে বেশ কায়দা করে নাম লেখা। ভেতরে ঢুকতেই-

ওমা, কোথায় স্টুডিও?

দেওয়াল ভর্তি পুরনো দিনের সাদা কালো ছবি। মেঝেতে টেবিল চেয়ার পাতা, তার থিমও সাদা কালো। এক পাশে তাকের ওপর সারি সারি কাপ আর কফির বয়াম, অন্য পাশে একটা কাউন্টার।

“মে আই হেল্প ইউ?”

কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ানো ফর্সা, সুঠাম চেহারার ভদ্রলোককে দেখে সন্টুর মনে হল তিনিই ক্যাফের মালিক।

“এখানে একটা স্টুডিও ছিল কি?” সে একটু ইতিস্তত করে ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করল।

“ওঃ শাহ স্টুডিও...অজিত শাহের স্টুডিও ছিল। কিন্তু ব্যবসা মার খাচ্ছিল। মোবাইলের যুগে আর ক'জন স্টুডিওতে আসে? আমরা এখন পার্টনারশিপে স্টুডিও ক্যাফে খুলেছি। এই দেখুন, দেওয়াল জুড়ে আমাদের কালেকশনে থাকা পুরনো শ্রীনগরের ছবি। আমার নাম হুসেন বেগ। প্লিজ হ্যাভ আ সীট।”

“মাইসেল্ফ সোমেশ্বর মজুমদার,” সন্টুর দাদু এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দেন। “১৯৫৮ সালে আমি আর আমার বান্ধবী এখানে একটা ছবি তুলিয়েছিলাম। তার কপি পাওয়া যাবে কি?”

হুসেন বেগ গালে হাত বুলিয়ে নিলেন।

“১৯৫৮? সে তো অন্য যুগের কথা! অজিত সাহেবকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আপনারা কি তিন চারদিন কাশ্মীরে আছেন?”

সন্টু জানাল যে তারা আছে।

“তাহলে নাম আর ফোন নম্বরটা দিয়ে যান, ছবিটা পেলে আমরা জানাব।”

“অনেক ধন্যবাদ।”

হুসেন বেগ নিজেই চারটে স্যাফ্রন টী অর্ডার দিয়ে সন্টুদের সঙ্গে বসে পড়লেন।

“কাশ্মীরের বিখ্যাত চা, না খেলেই নয়!”

“দাদু এখানে অনেক দিন আগে পোস্টেড ছিলেন,” সন্টু গল্পে গল্পে জানায়। “আমরা তাই আজ ওনার পরিচিত জায়গাগুলো দেখতে বেরিয়েছি।”

“ওঃ ভেরি গুড! আমার অবশ্য পুরনো শ্রীনগর সম্বন্ধে খুব পরিষ্কার ধারণা নেই। তবে ঝিলামের ধার ধরে জিরো ব্রিজ অবধি যেতে পারেন। পথে একটা পুরনো বৃটিশ ক্লাব আছে। যদিও এখন বন্ধ হয়ে গেছে।”

“দাদু বলছিল একবার গণপতিয়ারে যাবে।”

হুসেন বেগের হাসি ম্লান হয়ে গেল।

“যেতে পারেন, তবে পুরনো পরিবার একটাও আর ওখানে নেই। নব্বইয়ের কাণ্ডের সময়ে সবাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। রাজদান, সাপ্রু, কাক – কে জানে কে কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে! নতুন লোক কিছু বাড়ির দখল নিয়ে নিয়েছে, বাকিগুলো খালি পড়ে আছে। রঘুনাথ মন্দির বন্ধ হয়ে গেছে। গণপত ঘাটও তার দিয়ে আটকে দিয়েছে...ওই তো চা এসে গেছে!”

পরিচারক টবিলে চা রেখে চলে গেল। জাফরানের গন্ধে চারিদিক ম ম করে উঠল। সন্টু আর রাধিকা যে যার কাপ তুলে নিয়ে চুমুক দিল। কিন্তু সোমেশবাবুর সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি এক দৃষ্টিতে পুরনো লাল চৌকের একটা ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন।

ওই তো তাঁর চেনা লাল চৌক! ওই তো সেই টাঙ্গা আর ফ্লোরা হোটেল...কিন্তু সেসব এখন 'ভিন্টেজ' কাশ্মীর। জীবন্ত স্মৃতি নয়, নিস্তব্ধ সাদা কালো জগতের বাসিন্দা। সোমেশবাবু নিজেও কি ওই ছবিগুলোর মতোই ভিন্টেজ হয়ে গেছেন?

ষাট বছর কম সময় না। সোমেশবাবু সময়ের ধারাকে নিজের রক্তে রক্তে অনুভব করেছেন। বুঝেছেন, শ্রীনগর আর সেই শ্রীনগর নেই। সন্ধের সেই আসরগুলো আর বসে না। মিস্টার রায়না দরাজ গলায় গান ধরেন না –

“গস্তে ওয়েসিয়ে লাল ছুম দূরে

মে ছু মুরে ললভুন নার...”

গুল মহম্মদও আর তর্জমা করে দেয় না। তাহলে কোন আশায়, কিসের খোঁজে সোমেশবাবু কাশ্মীর অবধি ছুটে এসেছেন?

মাফলারের বাঁধন হঠাৎ গলা টিপে ধরে। সোমেশবাবু দোকান থেকে বেরিয়ে এসে ঝিলামের টাটকা হাওয়া বুকে টেনে নেন।

“এবার কোথায় যাবে, নিশাত বাগ না গণপতিয়ার?” সন্টুও দাদুর পেছন পেছন বাইরে চলে এসেছে।

“কোথাও না,” সোমেশবাবু গাড়িতে উঠে পড়েন। “তোরা শুধু আমাকে একবার হায়াতে নিয়ে চল্।”

গাড়ি ছুটতে থাকে। আয়নায় সোমেশবাবুর দৃষ্টি পড়ে যায়। ঝাপসা দুটো চোখ বিড়াশি বছরের শ্মশ্রুল চেহারার আড়ালে কি যেন খুঁজতে থাকে, প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চায় এমন কিছু যা বদলায় নি, বার্ধক্য যাকে ছুঁতে পারে নি। অস্থির আঙুলগুলো পরস্পরের গায়ে জড়িয়ে যায়, আবার পরের মুহূর্তে ছিটকে সরে আসে। সিনেমার রিলের মতো টুকরো টুকরো দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

দুধসার নালা পার করে সোমেশ আর মিলা অবশেষে কোলহাইতে পা রেখেছে। চারিদিকে বরফের স্বপ্নরাজ্য। কে যেন পৃথিবীর বুকে সদ্য কাচা সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। মিলা আনন্দে লাফালাফি করছে, বরফের গোলা বানিয়ে ছুঁড়ছে। কিন্তু সোমেশের বুকের ভেতর কাঁটা বিঁধে আছে। মনে মনে বলছে, 'যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে'। মিলার ভিসার মেয়াদ আর মোটে পাঁচ দিন। তারপরেই সোমেশকে নরম লেপের আরাম ছেড়ে উঠে কনকনে কালো জলে লাফিয়ে পড়তে হবে।

“আবার কবে দেখা হবে?”

জামা কাপড় গোছাতে গোছাতে মিলা কাঁধ ঝাঁকায়। পরের দিনই সে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হবে। হায়াতের মধ্যে আসন্ন বিচ্ছেদের ঠান্ডা ছায়া ঘুরপাক খাচ্ছে।

একটা কাগজ আর কলম নিয়ে মিলা খসখস করে কি সব লিখল। তারপর সোমেশের হাতে সেটা গুঁজে দিল।

“আমার মাসীর ঠিকানা। তুমি এই ঠিকানায় চিঠি লিখ। আমি যেখানেই থাকি চিঠি পেয়ে যাব।”

তবু সোমেশ আস্বস্ত হয় না। মনের ভেতর থেকে কে যেন বলতে থাকে মিলার সঙ্গে এই শেষ দেখা।

“চিঠি পেলে তুমি উত্তর দেবে?”

মিলা মিষ্টি করে হাসে।

“প্রমিস।”

তবুও...তবুও...

এয়ারপোর্টে মিলাকে ছাড়তে গিয়েও সোমেশের মনে কু ডাকতে থাকে।

এই শেষ...এই শেষ...

ইতিমধ্যে শ্রীনগরের পাঠ চুকেছে সোমেশেরও। চার দিনের মাথায় কাশ্মীর, রায়না, সাপ্রু, গুল মহম্মদ সবাইকে বিদায় জানিয়ে সে কোলকাতায় ফিরে চলল।

“কোলকাতায় ফিরে লুডমিলার সঙ্গে যোগাযোগ করলে না কেন?” সন্টু জিজ্ঞাসা করল।

“করেছিলাম একবার।”

জেল পালানো কয়েদীকে আবার হাতকড়া পরিয়ে জেলে ঢোকালে যেমন অবস্থা হয়, কোলকাতায় ফিরে সোমেশের অবস্থা ঠিক সেইরকম হয়েছিল। দিনরাত চোখের সামনে নাচছে কাশ্মীর আর মিলা। মায়ের কাছে একবার ঘুরিয়ে মিলার কথাটা তুলেছে কিন্তু মা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, সেরকম বউমার সঙ্গে তাঁর পক্ষে ঘর করা সম্ভব নয়। সোমেশের সেই মতলব থাকলে আগেই যেন তাঁকে কাশীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

তবুও সোমেশ মিলাকে চিঠি লিখে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল।

“চিঠির জবাব এল ছ'মাস পরে। মিলা লিখেছিল, তার আর ভারতে যাওয়ার কোন পরিকল্পনা নেই। সে এখন আমেরিকা দেখতে বেরতে চায়। আমি তার সঙ্গে আসতে চাইলে সে খুব খুশী হবে। কাশ্মীরের দিনগুলোর কথা সে রোজ মনে করে।”

চাকরিজীবী বাঙালির পক্ষে গ্লোব ট্রটার হয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সাধ আর সাধ্যের মধ্যে যে বিরাট ব্যবধান।

“তারপর?”

“তারপর আর কি? মিলাকে উত্তরে জানালাম বাড়িতে বিধবা মা আছে, অবিবাহিত বোন আছে। তাদের ফেলে যাই কি করে? আমার পিছুটান অনেক।”

তখন মিলা স্মারক হিসেবে তার একটা ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই শেষ যোগাযোগ।

বাস্তবের গুঁতো আর মায়ের চাপাচাপিতে সোমেশ রাঙাপিসির ননদের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল।

তারপর পুরীতে হানিমুন, ছেলেমেয়েদের জন্ম, বড় হওয়া, নাতি নাতনি, পত্নীবিয়োগ – জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে দেখতে দেখতে ষাটটা বছর পার হয়ে গেল। এভাবেই বাকি জীবনটাও কেটে যেত যদি রাধিকা সেদিন আলমারি ঝাড়ার সময়ে মিলার ছবিটা না বের করত।

দু'হাত দিয়ে ঠেলে বন্ধ করে রাখা একটা দরজা যেন হঠাৎ দমকা হাওয়ায় খুলে গেল। স্মৃতির তুষারঝড় সেই দরজা দিয়ে হইহই করে ছুটে এসে সবকিছু ঢেকে দিল। সোমেশের মাথায় একটাই ভূত চেপে বসল – যে করে হোক আরেকবার শ্রীনগর যেতেই হবে। জীবনের সমস্ত সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাওয়ার আগে একবার সেই সম্ভাবনাময় প্রথম অধ্যায়ের মুখোমুখি হতে হবে।

প্রস্তাবটা পাশ হতে বেশী বেগ পেতে হয়নি। রাধিকার অনেক দিন ধরেই কাশ্মীর দেখার ইচ্ছে ছিল। সন্টুও রাজি। শুভ দিন দেখে তিন জনে রওনা হয়ে গেল।

“দাদু তুমি বাড়িটা চিনতে পারবে তো?”

সন্টু ব্যাকসীট থেকে প্রশ্ন করে। গাড়ি তখন ইশবেরে পোঁছে গেছে।

“আলবাত পারব।”

সোমেশের নির্দেশ অনুযায়ী আবদুল চলতে থাকে, কিন্তু কোথায় হায়াত? শুধুই তো আগাছার জঙ্গল। একটা আধুনিক বাড়ি আছে বটে, কিন্তু সোমেশ বলল এ বাড়ি সে বাড়ি নয়।

“তুমি ঠিক জায়গায় এসেছ তো?” সন্টু সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ে। “এত বছর বাদে হয়তো তোমার গুলিয়ে গেছে।”

“আরে না রে না,” সোমেশ দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ে, “আমার বাড়ির পথ আমি চিনব না!”

অদূরে গাছের নীচে এক প্রৌঢ় কাওয়ার সরঞ্জাম নিয়ে বসে আছে। ঠিক হল তাকেই একবার জিজ্ঞেস করে নেওয়া হবে।

“সেই সঙ্গে তোদের আসল কাশ্মীরি কাওয়াও খাওয়াব,” বলে সোমেশবাবু দ্রুত পায়ে এগিয়ে যান।

বিক্রেতার নাম ইউসুফ। কাছেই হজরতবালে বাড়ি। রাধিকা নিমেষে তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল।

জানা গেল ইউসুফের বড় ছেলে অসুখে মারা গেছে। ছোট ছেলেকে উগ্রপন্থীরা জোর করে নিজেদের দলে ভর্তি করেছে। এখন আবার আর্মির লোক তাকে খুঁজছে। সে ছেলে বেঁচে আছে কি না তাও ইউসুফ জানে না।

“এখানে একটা বাড়ি ছিল, হায়াত। বাড়িটার কি হয়েছে বলতে পারেন?” সোমেশ একটু আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে।

“হায়াত? রায়না সাহেবের বাড়ি?” ইউসুফের অভিব্যক্তি বদলায় না। “সে তো নব্বই সালেই জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওই যেখানটায় আগাছা গজিয়েছে সেখানে ছিল। এখনো হয়তো পাথরের ভিতটা আছে।”

“জ্বালিয়ে দিয়েছে?” সোমেশের গলা নিজের কানেই কর্কশ প্রতিধ্বনি তুলে ফেরত আসে। তার জীবনের একটা আস্ত অধ্যায়ের সাক্ষী যে বাড়ি, সেটাই জ্বালিয়ে দিয়েছে?

“এই ওয়াদি কি ছিল, আর এখন কি হয়েছে,” ইউসুফ শিড়া ওঠা শীর্ণ হাতদুটো উলটে বলে, “কাকে দোষ দেব, হায়াত-মউত সব আল্লাহর ইচ্ছায়।”

সোমেশবাবু ততক্ষণে আগাছার ঝোপ ভেঙে রওনা দিয়েছেন। আগে খেয়াল করেন নি কিন্তু সত্যিই ওখানে একটা ধ্বংসস্তূপ লুকিয়ে আছে।

কল্পনার চোখ আগাছার মধ্যেই ঘর বাড়ি তুলতে থাকে। একতলায় রান্নাঘর, আর তার পাশেই বৈঠক। টীক কাঠের সিঁড়িটা দোতলায় উঠে গেছে। ওখানে শোয়ার ঘর, বৈঠকে গ্রামোফোন বাজছে, পিঞ্জরকারি করা জুন ডুব দিয়ে চাঁদের আলো আসছে...

বাস্তবের মেঘ এসে কল্পনার চাঁদ ঢেকে দিল।

মিলার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো সোমেশ এতদিন ধরে পুঁটলি বেঁধে আলমারিতে তুলে রেখেছিল। তারা নিরাপদ মনে করে সংসারের কাজে নিজেকে ঢেলে দিয়েছিল। সে জানতেও পারেনি কখন তারা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে! আর তাদের সঙ্গেই জ্বলে শেষ হয়ে গেছে বছর পঁচিশের এক বেপরোয়া তরুণও। বার্ধক্যের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা মিলার ছবি যাকে কিছুক্ষণের জন্য বাঁচিয়ে দিয়েছিল, সময়ের স্রোতে সে কবেই বুদবুদের মতো মিলিয়ে গেছে।

সোমেশবাবুর শুন্য চোখ পৃথিবী আর আকাশের দূরত্ব মাপতে থাকে। হৃদয়ের আর্তনাদ ধূসর আকাশে প্রতিধ্বনিত হয়ে গর্জন করে ওঠে।

“দাদু, গাড়িতে উঠে পড় বৃষ্টি আসছে!”

দূর, অনেক দূর থেকে সন্টুর গলা ভেসে আসে।

“ওই আবর্জনার মধ্যে আর কি দেখবে?”

আবর্জনা? ও হ্যাঁ, তাই বটে। পৃথিবীর দুই প্রান্তের বাসিন্দা দুই তরুণ তরুণীর তৈরী করা জীবন্ত জগত তো নয়, শুধুই আবর্জনা। সাদা কালো ভিন্টেজ...

পকেট থেকে সোমেশবাবু সিগারেটের প্যাকেটটা বার করলেন। তারপর সেটা সজোরে ছুঁড়ে মারলেন আগাছার স্তূপের ভেতর।