Next
Previous
0

গল্প - আর্যা ভট্টাচার্য

Posted in


কফির জলটা বসিয়ে দিয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে, বাইরে তাকালো রুক্মিণী। আজ , এখানে আসার পর এই প্রথম পরিষ্কার আকাশ। এক ফোঁটা মেঘ নেই কোথাও। আর সেই নির্মেঘ আকাশের গায়ে ভর দিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছেন তিনি। সবাই বলে ' ঘুমন্ত বুদ্ধ' । সূর্য এখনো ওঠেনি। এই উঠবো উঠবো করছে। পুবের আকাশে হাল্কা রঙের খেলা।

কফির মাগটা দুহাতে সাপটিয়ে নিয়ে জানলার কাছে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গেই কাঞ্চনজঙ্ঘার কপালে সূর্য দেব সিঁদুরের ফোঁটা ছুঁইয়ে দিলেন। আর কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন লজ্জায়, আনন্দে গোলাপী হয়ে উঠলো। আর তারপরেই রং মেলানোর খেলা। ম্যাজিকাল!

‘ পুরোনো হয়না। কখনো পুরোনো হয়না এই দৃশ্য।‘ নিজের মনেই ভাবে রুক্মিণী।

যতবার দার্জিলিং এ এসেছে , কখনো ফাঁকি দেয়নি কাঞ্চনজঙ্ঘা।

শুধু এবার ই প্রথম দিন থেকে চারদিক মেঘে ঢাকা আর থেকে থেকেই অঝোরে বৃষ্টি।

মেঘ নামা অন্ধকার, ঝাপসা হয়ে যাওয়া রাস্তা ঘাট, স্যিলুটের যত বাড়িঘর , চার্চ.. এর ও একটা আলাদা, অসাধারণ চার্ম আছে।

কিন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা তো কাঞ্চনজঙ্ঘাই। বিশেষত ভোরবেলাকার রঙীন হোরী খেলায়।

তবু ভালো, শেষের দিনে তিনি দর্শন দিলেন।

এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সে হাত চালিয়ে জিনিসপত্র গোছগাছ করতে থাকে।

আর কিছুক্ষণ বাদেই বেরিয়ে পড়তে হবে। বাগডোগরা থেকে তিনটের ফ্লাইট। আর আজকাল যা জ্যাম হচ্ছে রাস্তায়।‘ তবু আর একবার বাগান থেকে দেখে আসি …জাস্ট পাঁচ মিনিটের জন্যে'

নিজের কাছেই নিজেকে জাস্টিফাই করতে করতে চাদরে আপাদমস্তক মুড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে রুক্মিণী। বাগানের একেবারে কিনারায় গিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকে। কাঞ্চনজঙ্ঘা এখন রূপোর পাহাড়।

‘ ম্যাডাম'-পেছন দিক থেকে একটা আওয়াজ শোনা যায়।

তাকিয়ে দেখে হোটেলের আধবুড়ো বেয়ারা, কী যেন নাম?, ও হ্যাঁ, বোধহয় তেজবাহাদুর, দাঁড়িয়ে রয়েছে।

‘ম্যাডাম, আপনার তো আজ চেক আউট, হ্যায় না'?

‘ হ্যাঁ, কিন্তু চেক আউট তো দশটায়। আমি তার অনেক আগেই রুম ছেড়ে দেব'- একটু বিরক্ত হয়েই বলে রুক্মিণী।

এত দামী হোটেল। এত পয়সা দিয়ে লোকে থাকছে, অথচ ভদ্রতা বলে কিছু নেই। সাতসকালে বেয়ারা কে দিয়ে হুড়ো মারতে পাঠিয়েছে! যেখানে চেক আউট টাইমের এখনো অন্তত ঘন্টা দুয়েক বাকী!

বিরক্তিতে রুক্মিণীর ভুরু দুটো কুঁচকে ওঠে। এত সুন্দর সকালের মেজাজটাই নষ্ট করে দিলো।

এমনিতে এই লোকটাকে খুবই পছন্দ রুক্মিণীর। কিন্ত এখন বিরক্ত লাগছে।

‘ না ম্যাডাম সেকথা বলছিনা', রুক্মিণীর অসন্তোষ আন্দাজ করে একটু বিনীতভাবেই বলে সে, “ আসলে ম্যাডাম আজ হয়তো আপনি নামতে পারবেন না। সকালে শিলিগুড়িতে পাহাড়ের এক নেতা খুন হয়েছে। তাই দল থেকে আজ গাড়ির বন্ধ ডাকা হয়েছে। মানে চাক্কাজাম।আর শুধু আজ নয় ম্যাডাম। টানা পাঁচ দিনের বন্ধ্।“

‘ সে কী বলছো? কবে খুন হলো? কোনো গাড়িই কী চলবেনা? তাহলে আমার মতো যাদের ফ্লাইট ধরতে হবে তারা কী করবে?’রুক্মিনীর প্রশ্নের তোড়ের সামনে পড়ে তেজবাহাদুরের বুদ্ধি শুদ্ধি সব কেমন যেন গুলিয়ে যায়। হতভম্ব মুখে রুক্মিণীর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কাতর গলায় বলে ওঠে,' ম্যানেজার সাব কো পুছ লিজিয়ে'

আর রুক্মিণী ও পড়ি কী মরি করে রিসেপশন ডেস্কের দিকে দৌড়তে থাকে।

রিসেপশন ডেস্কে ম্যানেজার আছে এবং অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলছে।

কিন্ত এটা ভদ্রতা করার সময় নয়। এমার্জেন্সি সিচুয়েশন। তাই কোনো দিকে না তাকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে একনিঃশ্বাসে বলে ওঠে,' আচ্ছা, আজ নাকি গাড়ি বন্ধ?’

‘ হ্যাঁ, ম্যাডাম। আজ শুধু নয়। আগামী পাঁচ দিন।“ “কিন্তু আমার…আমার তো আজ টিকিট বাগডোগরা থেকে। কী করবো?’

অসহায় দুচোখ মেলে ডেস্ক ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে থাকে রুক্মিণী

‘ ম্যাডাম, চাইলে আপনার ফ্লাইটের টিকিট আমরা এখান থেকে পোস্টপন করে কয়েকদিন পরের করে দিতে পারি'

' থ্যাঙ্কস্ । সে আমি নিজেই করে নেবো। কিন্তু অন্য মুশকিল ও তো আছে।আপনারা বলেছিলেন আজ আপনারা ফুললি বুকড্। সেইজন্য তো আমাকে আজকে চলে যেতে হচ্ছিল। এখন তো তাহলে আবার অন্য হোটেল খুঁজতে যেতে হবে'

“না, না, ঘর আপনাকে ছাড়তে হবেনা। কারণ, যাদের বুকিং ছিল, এই স্ট্রাইকে কেউ তো আর পাহাড়ে আজ উঠতে পারছেনা। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।‘

ম্যানেজারকে আর একপ্রস্থ ধন্যবাদ জানিয়ে রুক্মিণী ঘরের দিকে রওনা দেয়।এখনো যখন আরো পাঁচ ছ’দিন থাকতে হবে, তাহলে আনপ্যাক করে ফেলা যাক্। তারপর ব্রেকফাস্ট, স্নান সব সেরে ম্যালের দিকটায় ঘুরতে যাবো। তার আগে অবশ্য একটা কাজ করতে হবে। বাগডোগরা আর মস্কোর টিকিটদুটো রিশিডিউ্ল করতে হবে।

এইসব সাত পাঁচ তার মাথায় চলতে থাকে।

যাওয়াটা বানচাল হয়ে যাওয়ায অবশ্য এখন আর আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা হচ্ছে না। বরং মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছে। এতগুলো দিন এক্সট্রা পাওয়া গেল।

ব্রেকফাস্ট , স্নান টান সেরে জিনস্ আর প্রিয় মাস্টার্ড কালারের কোটটা পরে গলায় ভালো করে স্কার্ফ জড়িয়ে নিয়ে হোটেলের সামনের ঢাল বেয়ে নেমে ম্যলের দিকে হাঁটা লাগাতেই মনটা একেবারে ফুরফুরে হয়ে গেল।

এপ্রিল পড়ে গেছে। এই সময়ে এতটা ঠান্ডা এর আগে রুক্মিণী পায়নি। অনেক বার ই তো আসা হলো তার এই প্রাণের শহরে। এবার ঠান্ডা একটু বেশিই। তবুও কেমন যেন একটা বসন্ত বসন্ত আমেজ ও এসে গেছে।

অনেক টা চড়াই উৎরাই করা হয়েছে, ম্যালে পৌঁছে এবার একটু কফি না খেলেই নয়। ভাবতে ভাবতে সামনের কাফেটায় ঢুকে , ভালো করে চেয়ার টেনে সবে বসেছে এমন সময় চোখ চলে গেল একটু দূরের চেয়ারে বসা ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক না বলে ছেলে বলাই বোধহয় ভালো। লম্বা চুল, দাড়ি, কোটে, পেছন থেকে যেন আনা তড়খড়ের সঙ্গে আলাপের সময়কার রবিঠাকুর। বেশ ইন্টারেস্টিং লুকিং।

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে,মুখটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করে রূক্মিণী। ঠিক দেখা যাচ্ছেনা। বিশেষ করে সামনে যে লোকটা দাঁড়িয়ে বিগলিত হয়ে কিছু বলছে, সেই আদ্দেকটা আড়াল করে রেখেছে।

‘ আচ্ছা, আসি তাহলে। ওই কথাই রইল। যদিন গ্যাংটকে যাবেন, তার আগের দিন এই নাম্বারে একটা ফোন করে দেবেন।“-বলে লোকটা চলে যেতেই রুক্মিণীর সঙ্গে একেবারে চোখাচোখি হয়ে গেল।

ছেলেটির বয়স সত্যিই বেশি না। পঁচিশ ছাব্বিশ বছর হবে হয়তো। লম্বা চুলে পনিটেল, চোখে চশমা, লম্বা দোহারা চেহারা। কিন্ত মুখখানা খুব চেনা চেনা। কোনো এক্স স্টুডেন্ট কী?

ছেলেটিও তো তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

“ বন্ধে আটকে পড়লেন?”, হঠাৎ ই হেসে জিজ্ঞেস করে ছেলেটি।

“ হ্যাঁ, …মানে…হাউ ডু ইউ নো”?-আপনি তুমি বাঁচিয়ে বলে রুক্মিণী।

“ আপনি যখন হোটেলের রিসেপশন ডেস্কে ব্যতিব্যস্ত হয়ে নানা প্রশ্ন করছিলেন, আমি ওখানেই ছিলাম।“

এমন আগাথা ক্রিস্টির রহস্য ফাঁস করার মতো মুখ করে বলে ছেলেটি, যে রুক্মিণীর মুখেও এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।

“ আমি শুভায়ু। শুভায়ু চ্যাটার্জি ।

“ বাঃ, সুন্দর নাম। কে রেখেছেন? মা? না বাবা?”

“ পাড়ার দাদু” শুভায়ুর কথা বলার ভঙ্গিতে আবার ও হাসি পেয়ে যায় রুক্মিণীর।

কী যেন আছে ছেলেটার হাবেভাবে, কথাবার্তায়। মন টানে।

“আর একটা কফি হয়ে যাক্। ইটস্ অন মি। ” উঠে এসে রুক্মিণীর উল্টোদিকের চেয়ারে বসতে বসতে বলে শুভায়ু।“

“ওকে। বাট নো শ্যুগার”

দুটো বিনা চিনির ক্যাপাচিনো অর্ডার দিয়ে দেয় শুভায়ু।

“আপনার নামটা কিন্তু জানা হয়নি এখনো।‘

“রুক্মিনী ভট্টাচার্য। ইউ আর ওয়ে জুনিয়র টু মি। তাই তুমিই বলছি। তোমাকে কী আগে কোথাও দেখেছি?”

“ উমম্…মনে হয় না।“ কফিতে চুমুক দিয়ে বলে শুভায়ু।“ আমি বর্ন এন্ড ব্রট আপ ইউ এস এ তে। আমার জ্ঞান হবার আগেই আমার ফ্যামিলি আমেরিকায় শিফট করে গেছিল”

“আচ্ছা” ।

ছেলেটা, মানে শুভায়ু, কেমন একটা করে সমানে সরাসরি তাকিয়ে আছে রুক্মিণীর মুখের দিকে। প্রায় অপলক বলা যায়। এই শেষ চল্লিশে এখোনো তার আকর্ষণ থাকতে পারে ভেবে একটু ভালো লাগলেও, একটা ভীষণ অস্বস্তি ও হচ্ছে। আস্তে আস্তে শুভায়ুর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে খানিকটা অন্যমনষ্ক ভাবে কাঁচের জানলার বাইরে তাকায় রুক্মিণী।

সকালে এতো রোদ। অথচ এরমধ্যেই চারপাশের পাহাড়গুলোয় কেমন কালচে ছায়া পড়তে শুরু করেছে।

“ গাড়ি তো আজ পাওয়া যাবেনা। চিড়িয়াখানায় যাবে নাকি? পায়ে হেঁটে?”

শুভায়ুর হঠাৎ প্রশ্নে ভুরুটা একটু কুঁচকে যায় রুক্মিণীর। পড়ানোর মাঝখানে কোনো স্টুডেন্ট ডিসটার্ব করলে যেমন হয়।

“ যাওনি তুমি আগে?’’

‘ নাহ, গতকাল বিকেলেই তো এলাম'

এতদিন বিদেশে হয়ে গেল, এখনো বয়সে ছোটরা নাম ধরে ডাকলে একটা অস্বস্তি হয় কেন রুক্মিণীর কে জানে!

তারা বয়সে বড়দের কাকী, জ্যেঠী বলতো। নিদেন পক্ষে দিদি। আজকালকার ছেলেমেয়েরা অবশ্য সেসব পাট তুলে দিয়েছে।

“ হুঁ, গেলে হয়। চলো তাহলে। চেকটা দেবেন প্লীস”..

রুক্মিণীর কথা শেষ হবার আগেই হাঁ হাঁ করে ওঠে শুভায়ু। “একদম না”

“শোনো, আমি বড় তোমার থেকে। সুতরাং বিলটা আমিই পে করবো”।

“ আহা, ব্যস্ত হচ্ছো কেনো?”, হেসে বলে শুভায়ু, “ গ্লেনারিসে লাঞ্চ টা না হয় তুমিই খাওয়াবে। বড় হবার খেসারৎ দাও তাহলে”

ওর কথার ভঙ্গী দেখে, রুক্মিণীও হেসে ফেলে। বেশ ছেলেটি। চট্ করে মানুষকে আপন করে নেয়।

কাফে থেকে বেরিয়ে চিড়িয়াখানার পথে রওনা দেয় দুজনে।

প্রথমে চিড়িয়াখানা, তারপর গ্লেনারিসে খাওয়া, আবার একপ্রস্থ স্টেশন পর্যন্ত হাঁটা শেষ করে হোটেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধে পার। একেবারে ডিনার করে, গুডনাইটের পালা সেরে যে যার ঘরে যখন ঢুকে পড়লো, ঘড়িতে তখন সাড়ে নয়।

জলাপাহাড়, তিব্বতী বাজার, চা বাগান , বোটানিক্যাল গার্ডেন সব পায়ে হেঁটে দেখে আর আড্ডা মেরে তাদের দিন চারেক দিব্যি মজায় কেটে গেল। রুক্মিণী স্বভাবতঃই গম্ভীর স্বভাবের। হয়তো এতো বছর বিদেশে একা একা থাকা, ইউনিভার্সিটি রিসার্চ ..এ সবের জন্য ই। শুভায়ু আবার তাকে কখন যেন গপ্পুরে, আড্ডাবাজ, হৈ হৈ করা রুক্মিণী বানিয়ে তুলেছে। রুক্মিণী বুঝতেও পারেনি।

আর এই ঘোরাঘুরি খাওয়াদাওয়া র মধ্যে দিয়ে তাদের মধ্যে এতো অল্প দিনেই একটা বেশ ভালো অসমবয়সী বন্ধুত্ব ও গড়ে উঠেছে।।

নাকি হালকা আকর্ষণ?

রুক্মিণীর জানা হয়ে গেল, শুভায়ু একজন পেইন্টার। রীতিমত পাশ করা।এখান থেকে ফিরে প্যরিসে যাবে আর্টের উপর একটা কোর্স করতে।

কিছু বকবক করতে পারে ছেলেটা। হাসি, গল্প ঠাট্টায় একবারে জমজমাট চারটে দিন। এমন আনন্দ কী আর সে কখনো পেয়েছে -মাঝেমাঝে ভাবে রুক্মিণী। বোধহয় না।

এরমধ্যে এক কান্ড।

শুক্রবার মাঝরাতে রুক্মিণীর ঘুম ভাঙলো মোবাইলের শব্দে।

“হ্যালো, রুক্মিণী, সরি টু ডিসটার্ব ইউ এ্যট দিস আওয়ার”

রুক্মিণী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বাজে ঠিক সোয়া দুটো।

শুভায়ুর গলাটা কেমন ভাঙা ভাঙা, ক্লান্ত শোনাচ্ছে না?

“ না, ঠিক আছে। বলো… কী হয়েছে?’, হাই চাপতে চাপতে আধ ঘুমন্ত ভাবে বলে রুক্মিণী ।

“ আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে। আমি বোধহয় মরে যাব। তোমার কাছে কোনো ওষুধ আছে”?

“ কী হয়েছে তোমার সেটা তো বলো”

“জানিনা। আমি মরে যাচ্ছি’.. হাঁপাতে হাঁপাতে প্রায় কাঁদ কাঁদ স্বরে বলে ওঠে শুভায়ু।

শুভায়ুর মুখে এই কথাটা শুনে, রুক্মিণীর বুকের ভেতর কেমন যেন একটা মোচড় দিয়ে ওঠে। যেন তার ই নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে যাবে এখুনি।

নিজের অনুভূতিতে নিজেই আশ্চর্য হতে হতেও, ফোনের এপার থেকেই শুভায়ুকে একটা জোরে ধমক দিয়ে ওঠে ,” কী সব আজেবাজে কথা বলছো। দরজাটা খুলতে পারবে? আমি যাচ্ছি”।

কোনো রকমে চাদর জড়িয়ে শুভায়ুর ঘরে গিয়ে ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখে তুমুল জ্বর। থার্মোমিটার নেই। জ্বর মাপা যাচ্ছেনা। কিন্ত গায়ে হাত দিয়ে ই বোঝা যাচ্ছে, জ্বরটা বেশিই।

নিজের ঘর থেকে প্যারাসিটামল এনে খাইয়ে দিয়ে রুক্মিণী যখন বেড়িয়ে আসছে, তখন জেদী শিশুর মতন দুহাতে তার নাইটির কোনা চেপে ধরে শুভায়ু বারবার বলতে থাকে,” যাবেনা, তুমি যাবেনা। তুমি গেলেই আমি মরে যাবো”।

এটা যে জ্বরের ঘোরে বলা, সেটা রুক্মিণী বুঝতে পারে, কিন্তু কী এক মায়ায় চলে যেতে পারেনা। আস্তে আস্তে তার বিছানার পাশটাতে বসে পড়ে।

“ছেড়ে যেওনা, আমাকে কখনো ছেড়ে যেওনা” বলতে বলতে হঠাৎই রুক্মিণী কে আকুল ভাবে জড়িয়ে ধরে শুভায়ু।

রুক্মিণী দু একবার হালকা হাতে ধাক্কা দেয় । কিন্ত কিছুতেই জোড়ে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারেনা। অসুস্থ বলেই কী?

এরপর শুভায়ু আরো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রুক্মিণী কে। তার বুকে মুখ চেপে ধরে রাখে। মুখে সেই এক কথা-“ যাবেনা তুমি আমাকে ছেড়ে যাবেনা”।

রুক্মিণী, তার নাইটির মতো, নিজেও ক্রমশঃ যেন এলোমেলো হয়ে পড়ছে। কতদিন, কতদিন কেউ তাকে ছোঁয়নি। সারা শরীরে এক আশ্চর্য কাঁপন ধরে যাচ্ছে। শরীরটা যেন অবশ হয়ে আসছে। অথচ সারা শরীরে জ্বলন্ত উনুনের তাপ।

একেবারে প্রায় শেষ মুহূর্তে সমস্ত শক্তি জড়ো করে হ্যাঁচকা টানে শুভায়ুর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় রুক্মিণী। আর প্রায় দৌড়ে তার ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলে যায়,” চুপচাপ শুয়ে থাকো। হোটেলের অন কল ডাক্তারকে খবর দিচ্ছি”

ঘন্টা খানেক বাদে, শুভায়ুর চেক আপের পরে , রুক্মিণীর দরজার নক্ করে ডাক্তার বললেন, “ চিন্তা করবেননা। আপনার রিলেটিভ কাল দুপুরের মধ্যে একদম ঠিক হয়ে যাবেন। এবার ঠান্ডা টা এখনো খুব বেশি। প্লেন থেকে এসে ঠিক মতো প্রিকশান না নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেরালে কারুর কারুর এ রকম হয়। ভয়ের কিছু নেই। ওষুধ দিয়েছি। এখন ঘুমোচ্ছেন। ডোন্ট ওরি”

আস্তে করে মাথা নাড়ে রুক্মিণী। ডাক্তারকে ধন্যবাদ জানিয়ে দরজা বন্ধ করে , পর্দা সরিয়ে কাঁচের জানলার ওপর ক্লান্ত ভাবে মাথা রাখে। কাঞ্চনজঙ্ঘার ঠিক মাঝখানটায় তখন উজ্জ্বল বাতি জ্বলে উঠেছে। এখনই কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে প্রথম সূর্যের হোলী খেলা শুরু হবে।

আর সেদিকে তাকিয়ে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে রুক্মিণী, কেন যে তা সে নিজেও বুঝতে পারেনা।

“কাল তোমায় খুব জ্বালিয়েছি না?”

বিকেলে রুক্মিণীর সঙ্গে জলাপাহাড়ের দিকে হাঁটতে হাঁটতে শুকনো হেসে জিজ্ঞেস করে শুভায়ু।

“ এখন ঠিকঠাক লাগছে তো?” উত্তর টা এড়িয়ে গিয়ে বলে রুক্মিণী।

আরো কিছু টা পথ একসাথে চড়াই উৎরাই ভাঙার পরে, খানিকটা যেন তাদের মধ্যেকার জড়তা কাটাতেই শুভায়ু বলে ওঠে, “ হঠাৎ কেমন মেঘলা করে গেল। শীতটাও কেযন বেড়ে গেল না?”

“ হুঁ” বলে রুক্মিণী যেমন হাঁটছিল, হাঁটতে থাকে।

“ দ্যাখো, পথটা কেমন গুরাস ফুলে ছেয়ে গেছে। ঠিক মনে হচ্ছে না, তোমার জন্যেই এতো আয়োজন। তুমি তো একদম আলাদা। সবার থেকে”

এবার আর না হেসে থাকতে পারলো না রুক্মিণী। শুভায়ুর দিকে তাকিয়ে বললো,” অনেক হয়েছে। আর নয়। এই ক'দিনে তুমি তো আমাকে একেবারে চিনে বসে আছো।“

“আছিই তো। আমার মনে হয় তুমি আমার খুব চেনা। “

তারপরেই সটান রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে একটা ডাঁটি শুদ্ধু গুরাস ফুল রুক্মিণীর সামনে ধরে, ধরা গলায় বলে,” তুমি আমাকে ভালোবাসবে? উইল ইউ লাভ মি রুক্মিণী?”

বুকের ভেতর টা কেঁপে উঠলেও, সেটা বুঝতে না দিয়ে, খুব জোরে হেসে উঠে, খানিকটা রসিকতার সুরে বলে ওঠে রুকমিণী, “অনেক হয়েছে পাগল ছেলে। এবার রাস্তার নোংরা থেকে উঠে পড়ো তো। খালি বাঁদরামি”

শুভায়ু কেমন একটা মুখ করে “ তুমি না খুব খারাপ” বলে একটু চুপচাপ ই ফেরার পথ ধরে।

হোটেলে পৌঁছনো পর্যন্ত কেউই আর কোনো কথা বলেনা।

রিসেপশনের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে, সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে পড়ে, একটা মস্ত নিঃশ্বাস নিয়ে রুক্মিণীর চোখে চোখ রেখে শুভায়ু বলে, “ আজ ডিনার আমি খাওয়াবো” রুক্মিণী আপত্তি করতে যেতেই , আলতো করে তার মুখে নিজের হাতটা রেখে শুভায়ু বলে ওঠে, “ উঁহু, কোনো আপত্তি নয়। আজ আমার বার্থ ডে”

আর কথাটা শোনা মাত্রই রুক্মিণীর মাথার ভেতর দিয়ে যেন একটা বিদ্যুতের ছড় টেনে দিল কেউ।

হ্যাঁ, আজই তো পাঁচই এপ্রিল!

কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে , যতোটা সম্ভব খুশি গলায় এনে বলে ওঠে, “ হ্যাপি বার্থডে শুভায়ু ! মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস। খুব ভালো কাটুক বছরটা”

“থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ”

উজ্জ্বল হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলে শুভায়ু ,” শোনো, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। খুব সুন্দর সাজবে কিন্তু। অবশ্য তুমি এমনিতেই এতো সুন্দর”

শুভায়ুর এইটুকু প্রশংসাতেই বুকের ভেতর টা গলে জল হয়ে যায় রূক্মিনীর ; আর মুখটা লজ্জায় লাল।

“ আর শোনো, আমিও রেডি হয়ে নিচ্ছি। ঠিক আটটায় নক করব কিন্তু। একদম রেডি থেকো” বলে রুক্মিণীর পিঠের দিক থেকে একটু জড়িয়ে ধরে, রুক্মিণী কে রিএ্যক্ট করার কোনো সুযোগ না দিয়েই, নিজের রুমে ঢুকে যায় শুভায়ু।

ঘরে এসে সত্যিই খুব যত্ন করে সাজে রুক্মিণী। পিঙ্ক সাটিনের শাড়ি, হালকা মুক্তোর গয়না, পিঙ্ক লিপস্টিক, আইলাইনার। কী নয়। সে এই টোটাল সেটটা নিয়ে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু পড়ল আজ ই প্রথম।

ডাইনিং রুমে যাবার পুরোটা পথ শুভায়ুর মুগ্ধ প্রশংসা থামতেই চায়না।

ডাইনিং রুমে ঢুকতেই ম্যানেজার নিজে এসে তাদের নিয়ে গিয়ে বসার জায়গা দেখিয়ে দিলেন। একটা কর্নার খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। দুটো চেয়ার টেবিল, মোমবাতি, কেক, ফুল , সব মিলিয়ে এলাহী ব্যাপার। বার্থ ডে কেক কাটার পরে আরো যে কয়েকজন গেস্ট ডাইনিং রুমে ছিলেন তাঁদের সবার টেবিলেই কেক পাঠাবার ব্যবস্থা করলো শুভায়ু।

টুকটাক খেতে খেতে শুভায়ুর দিকে তাকিয়ে রুক্মিণী জিজ্ঞেস করে, “ বাবা, মা উইশ করেছেন “ ?

“ আমার মা নেই। আমার এক বছর যখন বয়স কার ক্র্যাশে..’”

“ওহ্, আই অ্যম্ সো সরি”

“ স্যরি হবার কিছু নেই। আই ডোন্ট ইভন্ রিমেমবার হার। তবে আই হ্যাভ আ স্টেপ মম'

রুক্মিণী বুঝতে পারে, শুভায়ুর চোখ মুখ কেমন রাগী শক্ত হয়ে উঠেছে এইসব আলোচনায়। সেও আর কথা না বাড়িয়ে খেতে শুরু করে।

একটু বাদে মুখ তুলে শুভায়ু জিগ্যেস করে,” তুমি কোথায় থাকো, কী কর কিছুই তো বললে না”

“ ঐ একটা বিদেশী ইউনিভার্সিটি তে পড়াই। আপাতত ভিজিটিং প্রফেসর হয়ে অন্য একটা ইউনিভার্সিটিতে আছি। কিন্ত আজ আমার কথা শোনার দিন নয়। তোমার কথা বলার দিন।“

খুব সুন্দর করে হেসে বলে রুক্মিণী।

“ হ্যাপি বার্থডে “

তারা দুজনে ই তাকিয়ে দেখে এক বয়স্ক স্বামী স্ত্রী , যারা অন্য কোনোয় বসেছিলেন, তাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন। “কেকটা খেতে চমৎকার ছিল। এদের বেকারির ?”, শুভায়ুর দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেন।

শুভায়ু উত্তর দেবার আগেই তাঁর স্ত্রী,মাসীমা মাসীমা মুখের ভদ্রমহিলা রুক্মিণীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন,” এটি কী ছেলে? না ভাই? আপনার মুখখানা একেবারে কেটে বসানো”

এক মুহুর্তে রুক্মিণী যেন পাথর হয়ে যায়। হাত থেকে কাঁটা চামচ সশব্দে মেঝেতে পড়ে গেলেও ,সে যেন তা শুনতেই পায়না। তার মাথায় এখনি কেউ যেন একটা ভারী ভোঁতা কিছু দিয়ে মেরে অবশ করে দিয়েছে।

“ চুপ করো। চলো তো।“ বলে একটু যেন অপ্রস্তুত হয়েই, ভদ্রলোকের স্ত্রীকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে যাওয়া, ভদ্রমহিলার কথায় শুভায়ুর বিরক্ত হয়েও হাসি সামলাতে না পারা, কিছুই রুক্মিণী র মাথায় রেজিস্টার করেনা। বারবার মাথায় ঘুরতে থাকে,'পাঁচই এপ্রিল' ' একেবারে এক মুখ'

‘ তোমার বাবার নাম কী?’ রুক্মিণীর এই হঠাৎ প্রশ্নে একটু হকচকিয়ে গিয়ে , “ বাবা? বাবার নাম” বোকা বোকা ভাবে বলে ওঠে শুভায়ু “, হ্যাঁ, সেটাই তো জিগ্যেস করছি”। কেমন যেন উদ্বিগ্ন খসখসে শোনায় রুক্মিণীর গলা।

“ রমেন্দ্র চ্যাটার্জী। কিন্ত কেন বলো তো?”

আচ্ছা, এখানে কী ভূমিকম্প হচ্ছে ? নাহলে রুক্মিণীর চারপাশটা এমন দুলছে কেন? প্রাণপণে নিজেকে সামলে নিয়ে ,” আর মা? মার নাম কী?” প্রায় হিসহিসে গলায় বলে রুক্মিণী।

“ বার্থ মাদার? অর স্টেপ মাদার?’

“দুটোই। দুটোই”

“ আমার মায়ের নাম অতসী। আর স্টেপ মাদার রিণা। আর, আমি একাই। কোনো ভাইবোন নেই। এবার এটাই জিগ্যেস করতে তো। বাট হোয়াই আর ইউ আস্কিং ওল দিইস্? ইন্টারভিউ নিচ্ছ? কী? ফেল করলাম না পাশ করলাম?’

একটু বিরক্ত হলেও, সেটা বুঝতে না দিয়ে, খানিকটা মজার সুরেই বলে ওঠে শুভায়ু।

রুক্মিণীর দিক থেকে কোনো জবাব ই আসেনা। শুধু অপলক চোখে শুভায়ুর মুখটা আকুল হয়ে দেখতে থাকে সে।

একটা কিছু যে হয়েছে রুক্মিণীর। কী যেন একটা পালটে গেছে। শুভায়ু সেটা অনুভব করতে পারছে। কিন্ত ধরতে পারছেনা।

হঠাৎ ই উঠে দাঁড়িয়ে, “ আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। রুমে যাচ্ছি।“, বলেই ঝড়ের গতিতে ডাইনিং রুম ছেড়ে বেড়িয়ে যায় রুক্মিণী।

ঘরে এসে আলোগুলো সব নিভিয়ে দেয় সে। তরপর ধপ্ করে মেঝের কার্পেটের ওপরেই বসে পড়ে।

কতো দিনের পুরোনো কথা সব সিনেমার মতো রূক্মিণীর মাথার মধ্যে চলতে শুরু করে। যেন তার মাথার ভেতরে একটা স্ক্রীন আছে , আর সেখানে পরপর ছবি চলছে…চলছে তো চলছেই।

সে তখন সবে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে। শুধু পাশ করেনি, গ্রাম্য পুরোহিত যার ভালো করে পেট চলেনা, তার মেয়ে হয়ে গ্রামের অগা স্কুল থেকে সব মেয়েদের মধ্যে তৃতীয় হয়েছে। আর সবার মধ্যে নবম। এমন রেজাল্ট সেই গ্রামের স্কুল থেকে কস্মিনকালেও কেউ করেনি। তাই স্কুলের হেড দিদিমনি নিজে সঙ্গে করে নিয়ে এসে কলকাতার নামী কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। তবে কলেজ, ফ্রী হলেও, হস্টেলের খরচ,আরো এদিক ওদিক কিছু খরচা তো ছিলই। তাই ট্যুইশানির খোঁজ করছিল রুক্মিণী। আর তখনই রমেন্দ্র চ্যাটার্জির সঙ্গে আলাপ।

একটা বেসরকারি সংস্থা থেকে হায়ার সেকেন্ডারিতে স্ট্যান্ড করা স্টুডেন্ট দের সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। আর সেই সম্বর্ধনা সভার স্পেশাল গেস্ট ছিলেন রমেন্দ্র চ্যাটার্জি। ওখানেই রুক্মিণী শুনেছিল, উনি নাকি বিশাল ইনডাস্ট্রিয়ালিস্ট। টাকার গাছপাথর নেই। আর ফিলানথ্রফিক অ্যক্টিভিটিস ও অনেক রকম করেন। কৃতী ছাত্র ছাত্রীদের শুধু সম্বর্ধনা দেওয়া ই নয়, প্রতি বছর একজন গরীব স্টুডেন্টের খরচ ও উনি স্পন্সর করেন। সেদিন গ্রামের দুঃস্থ পরিবারের মেয়ে হয়েও নিজের চেষ্টায় এতো ভালো রেজাল্ট করেছে, তাই তাকে পাশে বসিয়ে তার বাড়ির সব কথা, জীবন যুদ্ধের কথা, রমেন্দ্র চ্যাটার্জি খুব মন দিয়ে শুনেছিলেন।

তারপরে স্টেজে উঠে অ্যনাউন্স করেছিলেন, উনি অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও একজন নীডি স্টুডেন্ট কে স্পনসর করবেন। আর এবার সেই সুযোগ পাচ্ছে, রুক্মিণী।

সেই দিন থেকে রুক্মিণী কে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মধ্যবয়সী নিঃসন্তান দম্পতি তাকে সুখে, ঐশ্বর্যে, ভালোবাসায় একেবারে ভরিয়ে রেখেছিল।

পড়াশুনা ও দারুণ চলছিল। পার্ট ওয়ানে ফার্সক্লাস ফার্স্ট। পার্টুতেও যে তেমনই রেজাল্ট হবে, এ নিয়ে তার বা অন্য কারোর ই কোনো সংশয় ছিলনা। আর তারপর হায়ার স্টাডিজের জন্য বিদেশ। এইসব পরিকল্পনা, এইসব উচ্চাশা, বিশ্বাস এই তিনবছর ধরে রমেন্দ্র চ্যাটার্জি আর তার স্ত্রী অতসী কাকিমা তার মাথায় ঢুকিয়েছিলেন। এই ছবি এমনভাবে মাথায় বসে গেছিল যে অন্য কোন জীবন সে কল্পনাও করতে পারতোনা। পার্ট টুর আগেই রমেন্দ্র চ্যাটার্জি তার জন্য ভিয়েনার ইউনিভার্সিটি থেকে ফর্ম আনানো থেকে শুরু করে, যা যা ফর্মালিটি করা দরকার , সব করে ফেলেছিলেন। কথায় কথায় বলতেন,” স্কলারশিপ তো তুমি পাবেই। আর যা খরচা খরচ লাগবে সব আমি দেব। তুমি শুধু পড়াশোনা টা মন দিয়ে করো।“

পরীক্ষার আগে একমাস টানা সে ওদের বাড়িতেই থাকছিল।

তারপর এলো সেই দিন। পরীক্ষার পরে রুক্মিণীকে ডেকে রমেন্দ্র চ্যাটার্জি,তখন তার 'কাকু' বললেন, “ বুঝলে রুক্মিণী আমাদের আমেরিকা গিয়ে কিছুদিন থাকতে হবে। তোমার তো ছুটি। বলি কী, তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো।‘

“ তোমার কাকু তো তোমার টিকিট ও করে ফেলেছেন। তোমাকে শুধু একদিন ভিসার জন্য যেতে হবে” হাসতে হাসতে বলেছিলেন অতসী কাকিমা।

আর তার কিছুদিন বাদে রমেন্দ্র আর অতসীর সঙ্গে রুক্মিণী চলে এল ফ্লোরিডায়।

সেখানেই একদিন তার ঘরে এসে বসলেন দুজনে। কেমন যেন চোখ তাকাতাকি করলেন। তারপরে গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে রমেন্দ্র চ্যাটার্জি বললেন, “ একটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে। মন দিয়ে শোনো। তুমি মানবে তো, তোমার অনেক উপকার আমরা করেছি। করছি। এবার তোমাকে আমাদের একটা উপকার করতে হবে। “

“ তুমিতো জানো, আমাদের সব আছে। কিন্ত কোনো সন্তান নেই।“

“ কিন্তু আমি তার…” তার কথা শেষ করতে না দিয়ে একটু ধমকের সুরে বলে উঠেছিলেন রমেন্দ্র,” আমার পুরো কথাটা শোনো। ডাক্তার বলেছেন, অতসীর এগ কোয়ালিটি মানে ডিম্বানুর অবস্থা এতোটাই খারাপ যে, সাধারণ পদ্ধতি তে তো নয়ই, আই ভি এফ পদ্ধতিতেও সেগুলো সন্তান জন্মের অনুকূল নয়। আমাদের বাচ্চা হতে গেলে, মানে আই ভি এফ মেথডেও একজন এগ ডোনার লাগবে। আর তোমাকে সেই ডোনার হতে হবে।কাল তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। আপততঃ হি ইস দ্য বেস্ট। উনিই তোমাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবেন। আর হ্যাঁ, তুমি বলবে, তুমি নিজের ইচ্ছায় এগ ডোনেট করছো।“

“তবে কারুর কাছ থেকে কিছু আমি ফোকোটে নিইনা। দাম দেব। এর বদলে ভিয়েনায় তোমার পোস্টগ্রাজুয়েশনের সব খরচাখরচ ই শুধু নয়, তোমার পরিবারকেও একলপ্তে একলাখ টাকা দেবো আমি। শর্ত শুধু একটাই, একথা কোনোদিন কাউকে তুমি বলতে পারবেনা। যে সন্তান আসবে তাকেও না।“

এসব কোনো কথাই সেই মুহূর্তে অপার বিস্ময়ের অনুভূতি ছাড়া কুড়ি বছরের রুক্মিণী কে তেমন ভাবে স্পর্শ করতে পারছিলনা।

তার মন জুড়ে তখন পারমানেন্টলি বিদেশে থাকার, পড়াশোনা করার আনন্দ, আর পরিবারের আর্থিক স্বাচ্ছ্বল্যের নিশ্চিন্ততা।

তবুও খানিকটা সন্দেহের গলাতেই সে বলে উঠেছিল, “ বাট হোয়াই মি?”

উত্তরে স্বামী স্ত্রী দুজনেই বলেছিলেন, তাঁদের সন্তান এই বিশাল বানিজ্য সাম্রাজ্যের মালিক হবে। আর তাই তার এগ ডোনারকে হতে হবে বুদ্ধিমতী, শিক্ষিতা, গুনবতী ও স্বজাতির।

“যাকে তাকে দিয়ে তো বংশধর হয়না।“-অতসী নির্বিকার ভাবে বলেছিলেন। “আর প্রথমদিন তোমার সঙ্গে আলাপ হবার পরেই রমেন বলেছিল, ‘ বুঝলে অতসী পেয়ে গেছি’।“

“ সেইজন্য আপনারা আমার জন্য এতো কিছু করেছেন?” অবাক হবার সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন রাগ আর ঘেন্নাও হচ্ছিল রুক্মিণীর।

“ বলতে পারো। তবে তুমিও তো ঠকোনি। যত ই ভালো রেজাল্ট করো, তোমার বা তোমার পুরুত বাপের সাধ্য ছিল এই জীবন দেবার? আর বদলে কী চেয়েছি? একটু সাহায্য। তাও একটা সন্তান পাবার জন্যে; তাই তো?’

আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে বসে ছিল রুক্মিণী। হয়তো এই ভালো। তার ও কেরিয়ারের চিন্তা থাকবেনা। আর মা বাবার ও জীবন বেটার হবে।

পরের দিন থেকেই পরীক্ষা নিরীক্ষা, প্রসেসিং শুরু হয়ে গেছিল।

সব প্রসেসিং হয়ে যাবার পর, রুক্মিণী যখন ভিয়েনা রওনা দিল তখন অতসী চারমাস প্রেগন্যান্ট।

রমেন্দ্র চ্যাটার্জি ভিয়েনায় তাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, এপ্রিলের পাঁচ তারিখ অতসীর ছেলে হয়েছে।

“আমার ছেলে”,কথাটা রুক্মিণীর মাথাটাকে যেন ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেছিল। সেই রমেন্দ্র চ্যাটার্জির সঙ্গে তার শেষ কথা।

চুক্তি অনুযায়ী তাঁরাও আর যোগাযোগ করেননি। আর সেও না। শুধু প্রতিবছর এপ্রিলের পাঁচ তারিখ এলে তার বুকের ভেতর টা যেন কেমন করে উঠতো।

রমেন্দ্র আর অতসী মানুষের উপর থেকে তার বিশ্বাসটাই বোধহয় কেড়ে নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সে কেমন যেন বিট্রেড ফিল করতো।

হঠাৎ যেন একটা চাবুকের বারি রুক্মিণীর অস্ত্বিত্বের উপর সজোড়ে ছপাক্ করে আছড়ে পড়লো।

ভাবনার পৃথিবী থেকে বাস্তবের মাটিতে একেবারে আছাড় খেয়ে পড়লো রুক্মিণী।

শুভায়ু তো তাহলে তার ছেলে! সে শুভায়ুর মা।

তার প্রতি সে কী করে…বা শুভায়ু তার প্রতি…উঃ…উঃ…

“নাআআআ”, বলে আর্তনাদ করে ওঠে রুক্মিণী। পাগলের মতো মাথা ঠুকতে থাকে। নিজের শরীর টাকে গোল করে ছোট করে আনে।

একটু অন্ধকার গর্ভাবাস যদি কেউ দিতো! একটু অস্তিত্বহীনতা!

অবিরল চোখের জল বয়ে যায় আর সে শুধু বলতে থাকে, “মা,মা…”

একটু একটু করে সময় বয়ে যায়। চোখের জলের ধারাও কমে যায়। তবু দুহাঁটুর মাঝখানে মাথা ঢুকিয়ে ফিটাল পজিশনে পড়ে থাকে সে।

‘আচ্ছা, আমি শুভায়ুর মা, কিন্তু শুভায়ুর প্রতি কোনো বাৎসল্যভাব তো জাগছেনা! মাতৃত্বের অনুভূতি টা ঠিক কেমন হয়? তেমন আলাদা কোনো ফিলিংস ও তো হচ্ছে না। ও আমার গর্ভে জন্ম নেয়নি। সে অর্থে আমার শরীর থেকে ও খাবার নেয়নি, আমার শরীর থেকে বেড়িয়ে পৃথিবীর আলো দেখেনি। আমি ওকে বড় করিনি, বকিনি, ভালোবাসিনি সেই জন্যই কী?

তবু একটা অসহ্য কষ্ট, অকল্পনীয় যন্ত্রণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে কেন? “

অন্ধকার ঘরে এবার বিছানায় উঠে বসে, অল্প অল্প দুলতে থাকে রুক্মিণী।

শুভায়ুর মুখটা তার বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে ওঠে।… গরম একজোড়া ঠোঁট…

নাআআআ, বলে আবার চেঁচিয়ে উঠতে চায় রুক্মিণী। কিন্ত গলা দিয়ে একটা মৃত্যুন্মুখ আহত পশুর গোঙানির শব্দ শুধু উঠে আসে।

হাঁটু দুটো আঁকড়ে ধরে একটু একটু দুলতে থাকে রুক্মিণী। আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে” আমি কী তাহলে পাপ করলাম ? কিন্ত ছেলে কী মাকে বুকে জড়িয়ে ধরেনা?। আর শুভায়ু তো অসুস্থ….”

ভাবনা টা পুরো ও হয়না। কে যেন রুক্মিণীর গালের ওপর সজোড়ে একটা চড় মারে।

মনোভাব ..মনোভাবটাই সব। তারা পরস্পরকে কামনার চোখে দেখেছিল…এটাই সত্যি। এটাই। উঃ…উঃ..কী যন্ত্রণা…চাপচাপ অন্ধকার!

কেউ যেন তার মাথাটা জলের মধ্যে চেপে ধরে আছে। একটু বাতাস নেই কোথাও। ওঃ, মা গো! ভগবান…এ তুমি কোথায় এনে দাঁড় করালে আমাকে! কী করবো আমি এখন? কী করবো ?!

…আমাকে চলে যেতে হবে। শুভায়ুর কাছ থেকে অনেক দূরে। ও কোনো কিছু জানার, বোঝার আগেই।“

“যা সুখ হতে পারতো, তা আজ কলঙ্ক হয়ে গেলো কেনো? ..কেনো?.. কেনো? “

আর সহ্য করতে পারেনা রুক্মিণী। ফোন তুলে রিসেপশনে বলে,” আমার বিলটা পাঠিয়ে দিন। আর আধঘন্টার মধ্যে আমার একটা গাড়ি লাগবে। এমার্জেন্সি। “

তাকে চলে যেতে হবে। অনেক দূরে। যাতে শুভায়ুর সঙ্গে তার আর কোনোদিন দেখা না হয়। …

গাড়ি যখন দার্জিলিং ছেড়ে মোড়টা ঠিক ঘুরছে , তখন চারদিকের অন্ধকার হালকা হয়ে এসেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় এখনি প্রথম সূর্যের আলো আশীর্বাদের হাত রাখবে। কেবল রুক্মিণীর জীবনের আশীর্বাদ, অন্ধকার অভিশাপ হয়ে গেল।

“আজ থেকে নো চাক্কাজ্যাম ম্যাডাম”, হাসি মুখে ড্রাইভার জানায়।ড্রাইভার জানেনা, তার জীবনের চাকাই জ্যাম হয়ে গেলো। খুলবেনা কোনও দিন আর।

আস্তে আস্তে গাড়ির জানলার কাঁচে মাথা রাখে রুক্মিণী। ক্লান্তিতে চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসে। আর বন্ধ পাতার আড়াল থেকে ঝরে পড়ে চোখের জল। অবিরল ধারায়।

একেবারে অসার হয়ে যাওয়া মৃত মানুষের মতো রুক্মিণী তা টেরও পায়না।।