পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে
Posted in পথে প্রবাসেআমার ভারতবর্ষ
রাজারানি মন্দির
দেবতার নেশা থাকেনা। মন্দিরের থাকে। এমন একটা দেশে জন্মেছি যেখানে এই নেশার জোগান পথেঘাটে। মন্দিরের আটদিকের শিখরে যেমন দিকপালেরা মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, দেখে যান, অপলক পাথরের চোখ দিয়ে। আমি মানুষ সেভাবেই তাঁদের দেখে যাই। বুঁদ হয়ে ভাবি, এমন বন্ধু আর কে আছে?
সে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় একহাজার বছর ধরে। একভাবে, ত্রিভঙ্গমুদ্রায়, একটা সাজানো কুলুঙ্গির ফ্রেমে। দু'হাত মাথার উপর, ধরে আছে বৃক্ষশাখা। ওষ্ঠাধরের হাসিটি লিওনার্দো কোনওদিন দেখতে পেলে মোনালিসা আঁকা ছেড়ে দিয়ে পায়রা পুষতেন। তাহার নামটি শালভঞ্জিকা। তার চারপাশে অজস্র নায়িকা, যক্ষী, সুরসুন্দরী নিরীহ দর্শকদের বেঁধে রাখে মোহমদির অপাঙ্গমায়ায়। দেবা না জানন্তি, আপ্তবাক্যের একটি পাথুরে প্রমাণ। মন্দিরটা তৈরি হয়েছিলো একাদশ-দ্বাদশ শতকে। কলিঙ্গ শিল্পস্থাপত্যের শেষ উজ্জ্বল নিদর্শন এবং একটি ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। এর জগমোহনটি নিখুঁত কলিঙ্গশৈলীর প্যাগোডাধর্মী হলেও এর বিমান বা শিখরটি পঞ্চরত্ন এবং অবিকল যে শৈলীটি মধ্যভারতের খাজুরাহো-কেন্দ্রিক চন্দেল স্থাপত্যের একটি মূর্ত রূপ। সম্ভবতঃ সারাদেশের একমাত্র পূর্ণ দেবালয়, যেখানে কোনও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হয়নি। এই মন্দিরটি সৌন্দর্যতত্ত্বের দিক দিয়ে এককথায় অনুপম। ঐতিহাসিক, শিল্প বা সমাজতত্ত্ব যে কোনও নিরিখেই হোক না কেন। সব কিছু নিয়ে এই নির্মাণটি একটি এনিগমা হয়ে রয়ে গেছে।
আমাদের দেশের মেয়েরা তো সততই সুন্দর। অর্ধেক আকাশ হয়ে বাকি আকাশটাকে ধরে রাখে। এটাও একটা নিজস্ব সৌন্দর্য। কিন্তু সামনে এসে দাঁড়ালে পুলকবাবুর গপ্পো। সেটা জানেন না বুঝি? একবার মান্না দে আর পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এক মফস্সলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন গাড়িতে। কারুর খোঁজও করছিলেন বোধ হয়। এমন সময় সামনের একটি বাড়িতে খোঁজ নেবার জন্য করাঘাত করতেই একটি মেয়ে দরজা খুলে এসে দাঁড়ালো। পুলকবাবুরা যাঁর খোঁজ করছিলেন তাঁর কথা আর মনে নেই। দরজার ফ্রেমে শুধু মেয়েটিই রয়েছে তখন। 'কী কথা তাহার সাথে' কিছুই মনে নেই তাঁর। গাড়িতে ফিরে এসে মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলো অধরা কিছু শব্দ, লাইন করে। এভাবেই তৈরি হয়েছিলো মান্নাদার সেই অমোঘ প্রশ্নময় গানটি। " ও কেন এতো সুন্দরী হলো? আমি তো মানুষ !" আমাদের কলেজকালের শোনার, শোনানোর গান। ইমপ্রেস করে ফেলা গ্যারান্টিড। এখন মেয়েদের ইমপ্রেস করার ধরণটা বোধ হয় বদলে গেছে। তা যাক। জানিনা, জানিনা কেন এমন হয়? তুমি আর নেই সে তুমি।
এখানেই মজাটা। সেই মেয়েগুলো কিন্তু মন্দিরের গায়ে হাজার হাজার বছর ধরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনও ক্লান্ত হয়না। পুরোনো হয়না। সামনে গিয়ে যেই দাঁড়াই, ধক করে বুকে বাজে। "ও কেন এতো সুন্দরী হলো? আমি তো মানুষ !!"
রাজারানি মন্দিরের সামনে এসে হঠাৎ এসে দাঁড়ালে এই গানটাই মনে পড়ে যায়। নামটাই দেখা যাক না কেন? রাজারানি মানে রূপকথার মানুষ নয়। ওটা এক ধরণের বালিপাথরের নাম। যার মধ্যে হলুদ আর লালচে আভা পরস্পর জড়াজড়ি করে থাকে। মাপের দিক দিয়ে দেখতে গেলে তেমন কিছু বিপুল নয়। বিশেষত সমকালীন পুরী জগন্নাথ মন্দির বা ভুবনেশ্বর লিঙ্গরাজ মন্দিরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলেনা। ১৭.৯ মিটার উঁচু পঞ্চরথ দেউলটির জগমোহন ত্রিস্তর। বিস্ময়করভাবে এই রেখদেউলটির নকশা খাজুরাহোর মন্দিরগুলির সঙ্গে মেলে। কলিঙ্গ শৈলির থেকে পৃথক। মন্দিরটির স্থাপত্য পঞ্চাঙ্গ রীতির। এর মধ্যে পাভগ, তালজঙ্ঘা, বন্ধন, উপরজঙ্ঘা এবং বারন্দা নামের পাঁচটি অংশ রয়েছে। ভিত্তিভূমির পাভগ অংশে আবার রয়েছে পাঁচটি অলংকৃত স্তর; খুর, কুম্ভ, পট্ট, কানি এবং বসন্ত। এর উপরের গণ্ডি ও শিখর অংশ ঘিরে রেখেছে ছোটো ছোটো অঙ্গশিখর। শীর্ষে যথারীতি আমলক ও কলস। জগমোহনটি বর্গাকার এবং নিরলংকার। সচরাচর অন্য সমস্ত কলিঙ্গ মন্দিরের জগমোহন বা পীড় অংশটি বিশেষভাবে অলংকৃত থাকে এবং আয়তাকার। এই মন্দিরটির জগমোহন ও গর্ভগৃহ ব্যতিক্রমী নিদর্শন। এই দুই অংশ দেখলে মনে হবে হঠাৎ কোনও কারণে এর নির্মাণ পরিত্যক্ত হয়েছিলো। এই রকম একটি সাড়ম্বর প্রস্তুতির মন্দিরে গর্ভগৃহ শূন্য। প্রবেশপথে নাগ এবং নাগিনী মূর্তি ও শৈব দ্বারপাল সূচিত করছে এটি শিবমন্দির হিসেবেই নির্মিত হয়েছিলো। এর সঙ্গে লকুলীশ মূর্তির ভাস্কর্যও শৈব আনুগত্যের প্রতি নির্দেশ করে। সেই সূত্রেই ধারণা করা হয় কোনও রকম বিগ্রহরহিত হওয়া সত্ত্বেও মন্দিরটি ইন্দ্রেশ্বর শিবের প্রতিই উৎসর্গীকৃত ছিলো। কৃষ্ণচন্দ্র পাণিগ্রাহী বলেছেন একাম্রপুরাণে এই রকম উল্লেখ পাওয়া যায়।
মন্দিরটির নির্মাণ সময়কাল বিষয়ে বিভিন্ন পণ্ডিতেরা মোটামুটিভাবে একই সময় নির্দেশ করেছেন। ব্রাউনসাহেবের মতে এই মন্দিরটি অনন্ত-বাসুদেব মন্দিরের সমসাময়িক, অর্থাৎ এগারো বারো শতক নাগাদ। সরসীকুমার সরস্বতী এই মত সমর্থন করেন। ফার্গুসন সাহেব বলেছেন মন্দিরটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১১০৫ সালে। মন্দিরটির স্থাপত্যকলা যেহেতু মধ্যভারতের শৈলির অনুরূপ তাই একটা মত রয়েছে যে বুন্দেলখণ্ডের সোমবংশীয় রাজারাই প্রকৃত নির্মাতা। তবে টাকাপয়সা যেই জুগিয়ে থাকুক না কেন, এই মন্দিরটি কলিঙ্গের ভাস্কর ও স্থাপত্য শিল্পীদের জয়গান অবিরাম গেয়ে যাচ্ছে প্রায় হাজার বছর ধরে।