গল্প - লায়লী সরখেল
Posted in গল্পকালো কালো ছায়া প্রলম্বিত হয়। কৃষ্ণচূড়ার মাথা স্পর্শ করে আকাশে মিলায়।
দোয়া ছায়া মারিয়ে মারিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নিজের অবয়বকে নিজেই অতিক্রম করে চলে যাচ্ছে। ক্ষত যেন হাঁ মুখ করে আছে। দোয়া হোঁচট খায়। ছায়াটা গাছের গায়ে ধাক্কা খায়। দোয়া মাথার ওপরে হাত ছড়িয়ে দিলে ছায়া আকাশ ছুঁয়ে ফেলে।
দোয়া ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। ছায়ার প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে তখন । দোয়া এক বসন্তের রাত দেখতে পেল।"তুমি বসন্তের কোকিল। তুমি শীত গ্রীষ্মের কেহ নও।" প্রথম বসন্তের কোকিল ডাকা এক রাত এক প্রৌঢ়ের জীবনে একরাতের ঘুম কেড়ে নিল। সুসজ্জিত ছোট্ট বাগানেই কেটে গেল রাতটা। শাল ফুলের গন্ধ নেমে এসেছে। ছুঁয়ে দিতে চাইছে প্রশস্ত ললাট।
লোডশেডিং। নিবিড় আঁধারে নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। চেয়ারটা ঘুরিয়ে পশ্চিম দিকে মুখ করে বসলেন তিনি।নিঝুম পিচ রাস্তাটা চলে গেছে ডাইনে। নিয়নের আলো উপেক্ষা করে তিনি মাথার পেছনে হাত দিয়ে চোখ মুছলেন।
ব্লু তখন খুব ছোট। কতোই বা আর বয়স! সবাই যে নামে ডাকে, সে নামে ডাকতে আমার ভালো লাগে না। ও আমার কাছে বিশেষ একজন। ও নীল স্বপ্নের মতো বিধুর।
১৯৫৩ ! শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুতে দশ বছরের ব্লুকে নিয়ে গেছিলাম ক্যাওড়াতলায়। সেই প্রথম ওর মৃত্যু দেখা। দশ বছর। মাত্রই দশটি বছর। আমার সিদ্ধার্থের কথা মনে পড়ছিল। সেই প্রতিক্রিয়ায় ও সেদিন মূক হয়ে গেছিলো।
পাঁচ বছরের ভাইটিকে রেখে আমি '৪৮ সনে কাকার সঙ্গে এ দেশে চলে এসেছিলাম। আমি তখন পনেরো। নাকের নীচে দূর্বাদল !তখনই আমার দেশটার আর একটা নাম হয়ে গেল। বদলে গেল মানচিত্র। ভারতবর্ষটা কি করে পাকিস্তান হয়ে যায়, বুঝতে সময় লেগেছিল। কাকার বড়ো পরিবার। তবুও তার ভেতরেই আমার ঠাঁই হয়েছিল । ছোট ভাই বোনদের আমি ছিলাম মেজদা। সমস্ত শিক্ষাই ওখানে শেষ করি। স্কুল কলেজ । কাকা কখনো বলেননি ____আর পারছি না। তিনি পোস্ট অফিসের পিয়ন ছিলেন।
চাকদায় মাঝে মাঝে যেতাম। বাবা মা ১৯৫০ _এ সীমানা পার হলেন। "কী ভয়ানক যুদ্ধ হলো সে যে" ! পেয়ারা খেয়ে দিন যাচ্ছে! তারপর বাবাও চলে গেলেন।আশুও পড়া ছেড়ে রোজগারে নেমে পড়লো। ট্রেনে লজেন্সের হকারি শুরু করলো। আমি বাড়ি গেলে ব্লু আটখানা হয়ে যেত। সকালে দুজনে যখন বেড়াতে যেতাম, কলকল করে কথা বলে যেত ও। হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম আজগুবি তলায়। সে এক বিরাট মহীরূহ। তেঁতুল গাছ। জনশ্রুতি আছে যে ____কৃষ্ঞপ্রেমে বিভোর নিমাই নাকি ঐ পথ দিয়েই পুরী গিয়েছিলেন। নৃত্যরত অবস্থায় কোন এক বাড়ির চালে খোঁচা লেগে তিনি আহত হন। তেঁতুল তলায় বাস করতেন এক ফকির। তিনি নিমাইয়ের ক্ষতস্থানে তেঁতুল তলার ধূলো লাগিয়ে দেন।নিমাই সুস্থ হয়ে বলেছিলেন_____'কি আজগুবি কান্ড' ! সেই থেকে আজগুবি তলা। আমাদের কতো আজগুবি স্বপ্নের সাক্ষী হয়ে আছে এই প্রাচীন বৃক্ষ! আজও বাড়ি গেলেই ফাঁক বুঝে একবার আজগুবি তলা ছুঁয়ে আসি। ঐ ধুলো স্নানে আজ আরো একবার ক্ষত মুছতে চাই।
"আমরা খুব গরীব মানুষ। পড়ালেখা করেই আমাদের বড়ো হতে হবে।" ব্লু_কে বলেছিলাম একদিন। এই আজগুবি তলাতেই। কথা রেখেছিল। দু_দুটো বিষয়ে স্নাতক হয়েছিল। কিন্তু সংসারে আরো স্বচ্ছলতার কারণে তাকে স্কুলেই ঢুকে পরতে হলো। ততদিনে আশু বিয়ে করেছে। বাবাও হয়েছে। সামান্য বেতনে জুটমিলে কাজ করে। এদিকে আমার সংসার সামলে যৎসামান্য দিতে চেষ্টা করি। সবসময় পেরেও হয়তো উঠি না।
আমাদের মা কিছুটা আরাম পেয়েছিলেন বাবার তুলনায়। এদেশে আসার বছর তিনেকের মধ্যেই বাবা চলে যান। কাকার মতো বাবা নতুন জীবীকা খুঁজে নিতে আর পারেননি। বাবা মার তেরোটা সন্তানের মধ্যে আমরাই ছিলাম শেষ বেলার।
ব্লু! আমি তোর জন্মদিন পালন করতাম। মনে আছে? বড়ো হয়ে তুই আপত্তি জানাতিস। সেই তুই _ _ _ !!
নাহ্ ! আমি ঠিক ভাবতে পারছি না। মেলাতে পারছি না! এটাই কি সেই তুই ?? সেই??
বিভা চিরকালই মুখ আলগা কথা বলে। ওকে তো আমি কখনোই প্রশ্রয় দেইনি !তোদের সঙ্গে ব্যবহার ঠিক করেনি বলে কষ্ট পেয়েছি।অহরহ। কিন্তু আজ কি হলো? এটা কি করলি তুই? আমার অহং দুমড়ে মুচড়ে ধূলায় গড়াচ্ছে। মেয়েরাও টিটকারী দিচ্ছে ! আমি হেরে গেলাম । হারিয়ে দিলি আমাকে ? হাঁড়ি বাড়ির ঐক্যবদ্ধতায় আমি কখনো আপোষ করিনি কথাচ্ছলেও।
এখন আমি কি করবো? রিটায়ার্ডমেন্ট চলে এলো। দোয়া সবে এম -এ পাশ করলো। ছুটকি উচ্চ মাধ্যমিক পাঠরত। এখন আমি কিভাবে কি ব্যবস্থা করবো বলতে পারিস? আমি তো কিছুই ভাবিনি কখনো। তুই সবসময় আমাকে ভরসা দিয়েছিস। আচ্ছা ব্লু!তোর কি বিয়ে না হবার জন্য আমার ওপর রাগ আছে ? এখনো? বিভা সবসময় এরজন্য আমাকেই দোষারোপ করে। এটা ঠিক যে কাউকেই আমার ঠিক তোর জন্য উপযুক্ত বলে মনে হয় নি। সবাইকেই বড্ডো সাধারণ মনে হতো। তোর মাপমতো কাউকেই পেলাম না! নিজের বিয়েতে আমি তো পাত্রী দেখতেই তাই নি। মামা দেখে এসে বললেন___" এ মেয়ের পেছনে তোমাকে কোন খরচা করতে হবে না। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী।" মামা ডাক্তার ছিলেন। তাই শারীরিক স্বাস্থ্য দেখেছেন। কিন্তু আমি কি এই স্বাস্থ্যবতীকে নিয়ে সুখী হয়েছি? মিললো না! মিললো না! বিয়ে নিয়ে আমি হয়তো একটু বেশিই খুঁতখুঁতে।
তুই কি তাই রিভেঞ্জ নিলি ? প্রতিশোধ ?
এখন কি করি ?কিইই করি ? তুই সবসময় ভরসা দিতিস । বিভাকে তেমন কোন সুখি দিতে পারিনি। সবসময় বলেছি___" আমাদের সবকিছু এক হবে। হাঁড়ি এক। ফ্রিজ কিনতে হয় ,অবসরের পর কিনবো। একটাই ফ্রিজ হবে। আশু আমাদের পরিবারের জন্য অনেক ত্যাগ করেছে। লেখাপড়া ছেড়ে সেই বয়সেই রোজগার করতে না নামলে , আমাদের শিক্ষাও ঐখানেই ইতি হয়ে যেত। অকালে অসুস্থ হয়ে কাজ থেকে ছুটি নিতে হলো চিরতরে। এখন ওর আর ওর পরিবারের দায়িত্ব আমাদের দুই ভাইয়ের। আমি তো দায় এড়িয়ে যাই নি রে ! সাধ্যমতো পাশে থেকেছি। অথচ ছেলেদের পৈতে দিলি! জানালি না! যদিও তা মন্দিরে হয়েছে! বাবা মায়ের স্মৃতি বিজড়িত ঘর ভেঙে আধুনিক মডেলের ঘর গড়লি। গৃহপ্রবেশ করলি ! জানতেও পারলাম না! বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছি! বারবার ক্ষমা করেছি ! আমি যে বড়ো মুখ করে বলেছিলাম _____" ব্লু আমাকে বলেছে ___ তুমি মেয়েদের মানুষ করো। বাড়ির ভাবনা আমার!"
সিটি সেন্টারের জমিটা তো তুইই আমাকে বেচতে বলেছিলি! বিভার আপত্তি সত্ত্বেও নূন্যতম মূল্যে ছেড়ে দিলাম।
এখন আমি কোনদিক সামলাই। অবসরের আর মাত্র ছয়মাস আছে। এখন আমি বাড়ি করি ? নাকি মেয়ে বিয়ে দেই ?নাকি ছোটজনের শিক্ষা শেষ করি ?
****
চিঠিটা লিখে খুব ধীরে ধীরে খামের মুখটা আঠা দিয়ে আটকালেন। আর কোন তাড়া নেই। সব কাজ না ফুরাতেই যেন শেষ হয়ে আসছে। সুন্দর অক্ষরে ঠিকানা লেখা হলো। সকালের ডাকে ফেলে দেবেন।
তারপর কোনরকমে গোগ্রাসে খেয়ে নটার মধ্যে বাসস্ট্যান্ড। নেভিব্লু রঙের বুড়ো কোম্পানির বাস আসবে। ভারী গমগমে আওয়াজে আপিস পাড়ার সকালের ব্যস্ততা শিথিল হবে। কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বাসটা এগিয়ে যাচ্ছে। দোয়ার মনে হচ্ছে বাতাসের প্রতিটি স্তর ভেদ করে বাসটা যেন সৌরবলয়ে ঢুকে পড়তে চাইছে।
মরিয়া কোকিলটা তখনো ডেকে চলেছে। কোয়ার্টারের ছোট্ট বাগানটা ফুলে ফুলে আলো হয়ে আছে।
সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ খবরটা এলো। হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে ভদ্রলোক হাসপাতালে।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপট রচনার সময়কালটা ছিল সুদীর্ঘ ষাট বছর। কিন্তু যবনিকা খুব দ্রুত নেমে এলো। সকালের দায়িত্ববান ভদ্রলোক ঝটপট সাদা কাপড়ে মুড়ে চলে এলেন এবং খই ছিটোতে ছিটোতে চলেও গেলেন।
ট্রাকের উপর থেকে দোয়া দেখলো এক পাগল রাস্তা থেকে খই খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে।
কোকিলের কুহু তানে প্রকৃতিও পাগল হয়ে উঠেছে।