Next
Previous
1

গল্প - গান্ধর্বী ভট্টাচার্য

Posted in




















বুলবুল ভ্যারাইটি স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে একবার ইতস্তত করল সুমি ওরফে সুমনা গাঙ্গুলি। শুধু এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর মনে মনে কি একটা যেন সিদ্ধান্ত নিয়ে চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে গেল।
“পিঁপড়ে, আরশোলা মারার যে চক আছে না, কি যেন নাম, ওটা আছে?”
বয়স্ক লালা মোটা চশমার মধ্যে দিয়ে সুমিকে একবার দেখে নিল। তারপর টিকি দুলিয়ে বলল,
“লক্ষ্মণরেখা তো? হোবে।”
প্যাকেটটা ব্যাগে ঢুকিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে বাড়ির পথ ধরল সুমি। মাথায় অনেকক্ষণ ধরে একটা কবিতার লাইন ভাসছে।
“Me miserable! Which way shall I fly
Infinite wrath and infinite despair?
Which way I fly is hell; myself am hell;
And in the lowest deep a lower deep,
Still threat’ning to devour me, opens wide,
To which the hell I suffer seems a heaven.”
সেই গ্রীষ্মের দুপুর। শুনতে শুনতে সেদিন ক্লাসরুম, মিল্টন সব দূরে মিলিয়ে গিয়েছিল। শুধু ডায়াসের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে সুমি মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে ছিল। উত্থান আর চরম পতনের মাঝামাঝি দাঁড়ান স্যাটান যেন তাদের দুজনকেও এক সুতোয় জড়িয়ে নিয়েছিল। সারল্যকে একেবারে ছুঁড়ে ফেলার আগের অমোঘ সেই মূহুর্তে...
হ্যাঁ, সেদিনই তো যবনিকা উঠেছিল...


কোলকাতার এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি এম.এ'র ক্লাস চলছে। আবৃত্তি থামিয়ে সৌরাংশু ক্লাসের দিকে একবার তাকিয়ে নিল। সৌরাংশু তাকালেই সুমির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। চশমা পরা ভারিক্কি চেহারার 'স্যার' কে কোন দিক থেকেই সুপুরুষ বলা চলে না। কিন্তু প্রথম নজরেই ওই মেঘের মতো গলা আর দু'চোখের গভীরতা সুমির হৃদয় কেড়ে নিয়েছিল।
একটু থেমে সৌরাংশু আবার লেকচার শুরু করল।
“অ্যাডাম আর ইভের ভালোবাসা এখনও বিশুদ্ধ। তারা জানেনা কি গোপন প্রলোভন তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।”
যেন সুমির দিকে তাকিয়েই সে কথাগুলো বলছে।
“কিন্তু ভালোবাসা তো অন্ধকারের অতিথি। গভীরতা পেতে হলে তাকে অন্ধকার পাতালে প্রবেশ করতেই হবে, যেমন সাইকিকে করতে হয়েছিল। তাই ইভকেও স্বর্গের আলোময় বাগান ছেড়ে মর্ত্যের অন্ধকারে নেমে আসতে হয়, আর তার সঙ্গে নামতে হয় অ্যাডামকেও...”
সুমি কি কল্পনা করছে নাকি সত্যিই স্যারের হাসিতে কোন গভীর ব্যঞ্জনা আছে? বাস্তব আর কল্পনার মধ্যের সীমারেখা মাঝেমাঝে ধুয়েমুছে একাকার হয়ে যায়।
ক্লাস শেষ হওয়ার পরেও স্যারের কথাগুলো সুমির মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। এগুলো কি নিছক বইয়ের কথা নাকি স্যারের মনের কথা? উনি কি সুমিকে বিদ্রুপ করছেন? মনে করছেন সুমির ভালোবাসায় গভীরতার অভাব আছে? তাই যদি হবে তাহলে কেন উনি বারবার সুমির কাছাকাছি চলে আসেন?
হাঁটতে হাঁটতে সুমির মাথায় কথার ভিড় জমতে থাকে। লেকচার থামিয়ে স্যারের সুমির দিকে তাকানো, মাঝেমাঝে হেঁটে একেবারে সুমির পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো, চক্ আনার জন্যে সবাইকে ছেড়ে সুমিকেই পাঠানো - এগুলো কি নেহাৎ কাকতালীয়? না, তা তো নয়। সবকিছু তো সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল...
শীতের এক সকালে। রেফারেন্স বই ফেরত দিতে সুমি স্যারের চেম্বারে ঢুকেছিল। স্যার তখন সামনে একগুচ্ছ কাগজ ছড়িয়ে বসে আছেন। সুমিকে দেখে চশমার ওপর দিয়েই বললেন,
“বোস, সুস্মিতা।”
“আ-আমার নাম সুমনা, স্যার।”
“ওঃ, ইয়েস।”
মনে মনে একটু আঘাত পেয়েছিল সুমি। স্যারকে তো সে প্রথম দর্শনেই ভালোবেসে ফেলেছে। অথচ এতগুলো দিন ক্লাস করার পরেও স্যার তার নামটাও মনে রাখেননি...
মনে রাখার মতো কোন মহৎ কাজটা করেছিস শুনি?
মাথার ভেতর হঠাৎ মায়ের গলাটা ভেসে এল। সুমি আর বসার সাহস পায় নি। কিছুক্ষন পরে স্যার কাগজ থেকে চোখ তুলে বললেন,
“ওয়েল?”
“এই বইটা ফেরত দিতে এসেছিলাম, স্যার,” কাঁপা গলায় সুমি কোনমতে জানিয়েছিল, “আমার ফটোকপি করা হয়ে গেছে।”
বইটা টেবিলে রেখেই সুমি পালিয়ে যেত যদি না স্যার হাত বাড়িয়ে সেটা চাইতেন। আর সেটা স্যারের হাতে দিতে গিয়েই অঘটনটা ঘটেছিল।
আচমকা হাতে হাত ঠেকে গেল...আর সুমির শরীরে এক অজানা শিহরণ খেলে গেল...
হয়তো প্রয়োজনের থেকে এক মূহুর্ত বেশীই দীর্ঘায়িত হয়েছিল সেই স্পর্শ। সেটা শুধু সুমির দিক থেকেই কি না তা আজও সুমি ভালোভাবে জানে না। কিন্তু তার পর থেকেই স্যারের সুমির প্রতি আচরণে একটা তফাৎ এসেছিল...
“কোনদিকে যাবে?”
চেনা কন্ঠস্বরে চমকে তাকাল সুমি। আনমনে কখন যেন সে ইউনিভার্সিটির গেট অবধি চলে এসেছে। একটা উবার একদম তার সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে। আর তার মধ্যে থেকে উঁকি দিয়ে-
“স্যার!” সুমি ঢোঁক গিলে বলে উঠল, “আমি...ইয়ে, মানে গড়িয়া যাব।”
“আমিও ওইদিকেই যাচ্ছি।” সৌরাংশু একটা হাল্কা হাসি দিল। “উঠে পড়।”
সুমি যেন তার কানকে বিশ্বাসই করতে পারে না! স্যারের সঙ্গে এক ট্যাক্সিতে? শুধু সুমি আর স্যার, সম্পূর্ণ একান্তে...একটুও সময় নষ্ট না করে ট্যাক্সিতে ঢুকে দরজাটা টেনে বন্ধ করে নিল সে।
ট্যাক্সি নিজের পথে চলতে থাকে। কিন্তু পথ, ঘাট, দোকান কিছুই লক্ষ্য করার অবস্থা নেই সুমির। তার শরীরে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ, বুকের ধুকপুকানি থামতেই চাইছে না। বগলের ঘামের সঙ্গে মে মাসের গরমের কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না।
গাড়ির ঝাঁকানিতে স্যারের শার্টের হাতা তার হাত ছুঁয়ে যাচ্ছে। সুমি সরে বসার চেষ্টাও করছে না। লক্ষ্য করে দেখলে বোঝা যাচ্ছে, সরার চেষ্টা করছে না সৌরাংশুও।
হাল্কা করে আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে যাচ্ছে। আবার সেই শিহরণ, আর এক অদ্ভুত উত্তাপ। স্যারের তর্জনীতে এই পলার আংটিটা কি সবসময়েই ছিল? কি বলিষ্ঠ আঙুল...
কলেজে তোকে এই করতে পাঠিয়েছি?
মায়ের গলার আওয়াজকে পাত্তা দেয় না সুমি। এমনিতেও তার কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। সৌরাংশুর মুখে হাসির ছায়া।
“হাতটা যদি ধরতেই হয় ভালো করেই ধরো না।”
এই বলে সুমির কোলের ওপর হাতের পাতা ছড়িয়ে দিল। না বলা কথাটা এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
আমার হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। বাকিটা তোমার সিদ্ধান্ত।
“যা যা হয়েছে তোমার অনুমতিতেই হয়েছে,” পরে সুমিকে বলেছিল সৌরাংশু। দুই চোখে জলের রেখা নিয়ে সুমি তখন এই মূহুর্তটার কথাই ভেবেছিল। সত্যিই সৌরাংশু তাকে বিন্দুমাত্র জোর করেনি। স্বয়ং সুমির নির্দেশ মেনেই তার আঙুলগুলো ছুটে গিয়ে সৌরাংশুর আঙুলে জড়িয়ে গিয়েছিল।
এক মূহুর্ত পরে সৌরাংশুর হাত সুমির হাতের ওপর বুজে আসে। দুজন মানুষের একান্ত নিভৃত সেই মূহুর্ত – কেমন লেগেছিল সুমির? পরে অনেকবার সুমি সে কথা ভেবেছিল।
চিড়িয়াখানায় সবাই বাঘ দেখেছে। অনেকে হয়তো জঙ্গলেও দেখেছে। সেই বাঘের মতোই টীচারদের চিরকাল ভয় পেয়ে এসেছে সুমি। সেরকম একজন বাঘ যদি নিতান্ত পোষ্য জীবের মতো সুমির হাতের খাঁচায় এসে ধরা দেয় তো কেমন লাগবে তার? গর্ব...হ্যাঁ, গর্বমিশ্রিত আনন্দই তো, তেমনটাই তো লেগেছিল সেদিন।
সুমি গাড়িতে উঠেছিল এক বিকেলে কিন্তু ধাক্কাটা লেগেছিল তার পরের দিন সকালে। ক্লাসে ঢুকতে মিনিট পাঁচেক দেরী হয়েছিল বোধহয়। ক্যাঁচ করে দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে সৌরাংশু অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টার থেকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল। ব্যাস্, সেই শেষ। সুমিকে দেখে সেই যে চোখ ঘুরিয়ে নিল সে, আর সারা ক্লাস একটি বারের জন্যেও তাকিয়ে দেখল না।
পরের দু'তিন দিনও তাই। ফোন করলে উত্তর নেই, ক্লাসের পরে দেখা করতে চাইলে একটাই উত্তর – এখন ব্যস্ত, পরে এস। ক্লাসের মধ্যে সুমি কোন প্রশ্ন করলে কোনরকমে দায়সারা গোছের একটা জবাব দিয়েই অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়া...
গাড়ির মধ্যের সেই ঘনিষ্ঠতার পরে স্যারের এই ব্যবহার – প্রথমটায় তো সুমি বিশ্বাসই করতে পারছিল না। বুঝতে পারছিল না সে কোন দোষের শাস্তি পাচ্ছে। তারপর ভয় এবং ক্রমে এক গভীর দুঃখ তার মনে জমাট বাঁধতে শুরু করে দিল। স্যারের সঙ্গে যে সুন্দর সম্পর্কটা গড়ে উঠছিল তা বোধহয় তার নিজের দোষেই শেষ হয়ে গেল।
ক'দিন এইভাবেই কেটে গেল। মে মাসের গরম তখন তুঙ্গে উঠেছে। একদিন ক্লাসের শেষে রেশমীরা মলে যাওয়ার বায়না ধরল। ক্লাসে ওরাই সুমির বেস্ট ফ্রেণ্ড – মধুপর্ণা, নম্রতা আর রেশমী।
“চল্ না, নতুন মল খুলেছে,” রেশমী সুমির হাত ধরে টানাটানি লাগিয়ে দিল। “এসিতে বসব, খাব, একটা সিনেমা দেখব তারপর বাড়ি ফিরে যাব।”
“ট্যারান্টিনোর মুভিটা দেখব,” মধুপর্ণা হাসিমুখে বলল।
কিন্তু সুমির মলে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। সে শুধু ভাবছে কতক্ষণে বাড়ি গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে একটু কাঁদবে। তাই “আজ যেতে পারব না রে, অনেক পড়া জমে আছে,” বলে বিরসভাবে হাত ছাড়িয়ে নিল।
“চুপ কর্ তো! একদিন ঘুরতে গেলে তোর কেরিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে না!” নম্রতা তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল। মাঝেমাঝে মেয়েটা সাধারণ কথাও এতো চেঁচিয়ে বলে সবার কান ঝালাপালা হয়ে যায়।
“ফোনটা দে,” রেশমী চুড়ি ঝমঝমিয়ে হাত পাতল, “আমি কাকিমাকে বলে দিচ্ছি আজ তোর ফিরতে দেরী হবে।”
“আজ না, প্লিজ।”
সুমির বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। সে রেশমীদের কি করে বোঝাবে যে স্যারকে হারিয়ে ইহজগতের সব বিষয় থেকে তার উৎসাহ চলে গেছে? মধুপর্ণার দিকে কাতরভাবে তাকিয়ে বলল,
“মধু ওদের একটু বোঝা না।”
“থাক না, ও যখন চাইছে না ছেড়ে দে,” মধুপর্ণা তার লম্বা চুলে চিরুনীর আঁচড় দিতে দিতে বলল।
“বেশ, তুই বাড়িই যা তাহলে,” রেশমী কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল। “আমরা তোকে ছাড়াই যাচ্ছি।”
তিন বন্ধু ব্যাগ দুলিয়ে রওনা দিল। সুমি একটা তেতো হাসি নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল।
ঠিকই আছে, আমি তো একাই। স্যার ছাড়া আমার জীবনে আর ছিলই বা কি...
একা একা বাড়ির পথে হাঁটা লাগাল সুমি। এমন সময়ে - ওইতো, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে ধীর পায়ে সিগারেট টানতে টানতে বেরিয়ে যাচ্ছে – স্যার ছাড়া কেউ হতেই পারেনা। উফ্, ভগবান যে কি জাগ্রত...
ভাগ্যিস আজ রেশমীদের সঙ্গে যাইনি!
একছুটে সৌরাংশুর পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়ল সুমি।
“আপনি আমার ওপর রেগে গেছেন?”
“মানে? কি যাতা বলছ?” ধমক দিয়ে সৌরাংশু এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সুমি নাছোড়।
“আমার ফোন ধরছেন না, আমি কথা বললে জবাব দিচ্ছেন না...কেন স্যার আমি কি দোষ করেছি?”
আতঙ্কিত হয়ে চারিদিকে তাকাল সৌরাংশু। চাপা গলায় বলল,
“এখানে এভাবে সীন ক্রিয়েট কোর না! আমার উবার এসে গেছে তোমার সঙ্গে পরে কথা হবে।”
সত্যিই সুমিকে ছাড়িয়ে সে রওনা দিল। কিন্তু সুমির তখন ভয়ে দুঃখে লোকলজ্জা লোপ পেয়েছে।
“আমার কথার জবাব না দিয়ে যাবেন না প্লিজ!”
সৌরাংশু উবারের দরজা খুলে ফেলেছে। সুমির দিকে চোখের ইশারা করে সে গাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। সুমি সেই ইঙ্গিত খুব চেনে।
চুপচাপ গাড়িতে উঠে পড়।
সুমি আর কথা না বাড়িয়ে ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল। কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা। তারপর সৌরাংশু জানালার দিকে তাকিয়ে, খানিকটা যেন নিজের মনেই বলতে শুরু করল,
“এই ইউনিভার্সিটির অনেক স্টুডেন্ট সুবিধা পাওয়ার আশায় টীচারদের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়েছে। আর অনেক টীচার সেরকম সম্পর্কে গেছেও। কিন্তু সৌরাংশু মল্লিক সেরকম মানুষ নয়।”
সুমি ভুরু কুঁচকে তাকাল।
“কি বলছেন স্যার?”
সৌরাংশু সুমির দিকে ঘুরে বসল।
“আমার সঙ্গে যদি সম্পর্ক রাখতে হয় তো জেনে রাখ তুমি কোনরকম বাড়তি সুবিধা পাবে না। তোমার নম্বর বা অ্যাটেন্ডেন্স কোনটাই বাড়বে না, আর আমি ক্লাসে দেরী করে আসা অ্যালাউও করব না।”
ধোঁয়াশা কেটে এতক্ষণে জ্ঞানের আলো প্রবেশ করে।
“আমি মঙ্গলবার দেরী করে এসেছিলাম বলে...” বলতে বলতে সুমির চোখে জল এসে যায়। “সেদিন অটো স্ট্রাইক ছিল...বাসে তিলধারণের জায়গা ছিল না তাও আমি ঝুলে ঝুলে শুধু আপনার ক্লাস করতে এসেছিলাম...আর আপনি বলছেন আমি আপনার সুবিধা নিচ্ছি?”
“ও, স্ট্রাইক ছিল নাকি? তা সেকথা বলবে তো,” সৌরাংশুর সুর নরম হয়ে আসে।
সুমি দ্বিগুন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
“বলার সুযোগ দিলেন কোথায়? সেই থেকে তো কথাই বলেন না আমার সঙ্গে!”
গভীর বেদনায় দুলে দুলে কাঁদতে থাকে সুমি। সৌরাংশু ওর পিঠে আলতো করে হাত রাখল।
“আচ্ছা এতো কাঁদতে হবে না। একটা সামান্য ভুল বোঝাবুঝিই তো হয়েছে তাই নিয়ে এতো ওভাররিয়াক্ট করার কি হয়েছে?”
“আপনার আমার ব্যপারে এরকম ধারণা...” অভিমানে সুমির গলা বুজে আসে।
সৌরাংশু সুমির মুখ টেনে তুলে নিজের দুই হাতের পাতার মধ্যে রাখল।
“সেরকম ধারণা হলে কি আমার উবারে উঠতে বলতাম? এবার চোখ মুছে ফেল তো। এতো কাঁদলে তোমাকে ড্রপ করব কি করে? তখন তো তোমাকে আমার বাড়ি নিয়ে যেতে হবে।”
কথার অর্থ বুঝে সুমির কান গরম হয়ে ওঠে। তবু সে প্রতিবাদী গলায় বলে,
“বেশ তো, বাড়িতেই নিয়ে চলুন না।”
“ভেবে দেখ,” দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে সৌরাংশু, “এই সম্পর্কের কিন্তু কোন ভবিষ্যৎ নেই।”
সুমির চোখে দুঃসাহসী আলো জ্বলে ওঠে।
“ইউ আর দ্য ওনলি ফিউচার আই নিড।”
কথাটা ফিল্মি হলেও মনে হয় সৌরাংশুর পছন্দ হয়েছিল। কারণ তারপরেই তার ঠোঁট সুমির ঠোঁট খুঁজে নিয়েছিল...
সেদিন গাড়ি থেকে নেমে প্রায় উড়তে উড়তে বাড়ি ফিরেছিল সুমি। স্নান খাওয়া সেরেই ফোন নিয়ে বিছানায় উপুর হয়ে পড়েছিল। তারপরেই ওয়াটস্ অ্যাপে গেল নব অনুরাগিণীদের সেই চিরাচরিত প্রশ্ন:
“বাড়ি পৌঁছলে?”
কয়েক মিনিটের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। তারপর ফোনে আলো জ্বলে উঠল।
“এই কিছুক্ষণ আগে।”
সলজ্জ হাসি।
“আজকের দিনটা কখনো ভুলব না।”
“(হাসির ইমোজি) ফোন করছি...”
কথা চলেছিল প্রায় রাত একটা অবধি। 'সামান্য ভুল বোঝাবুঝির' পরিণাম যে এতো মধুর হবে কে জানত...


তারপরের দিনগুলো যেন ঝরের গতিতে কেটে গেল। ট্রেন খুব তারাতাড়ি গেলে বাইরের গাছপালা যেমন ঝাপসা হয়ে তালগোল পাকিয়ে যায়, সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে অনেকটা সেরকমই লাগে সুমির।
গোপন ভালোবাসার মধ্যে সত্যিই বেশ একটা মজার ব্যপার আছে। ক্লাসে হঠাৎ স্যারের চোখে চোখ পড়ে যাওয়া, করিডোরে মুখোমুখি হয়ে যাওয়া...গোপন হাসি, গোপন দৃষ্টি...গোপনে তাজপুর ডে ট্রিপও হয়ে গেছে (সুমি রাতেও থাকতে চেয়েছিল কিন্তু স্যারটা এমন ভীতু...) ভাবা যায়, ক'দিন আগেও যে সুমি ছিল বৈশিষ্ট্যহীন, ক্লাসের আর পাঁচজন স্টুডেন্টের মতোই একজন, সে আজ স্যারের একেবারে কাছের মানুষ!
আচ্ছা, স্যার তাকে এতো কেন ভালোবাসে? ভালো হয়তো তার বাবা মাও বাসে, কিন্তু সে তো একরকম বাধ্য হয়েই, ফ্যামিলি বলে। স্যারের ভালোবাসায় তো কোন বাধ্যতা নেই। স্যার তো স্বেচ্ছায় তার কাছে ছুটে এসেছে। তাহলে কি তার মধ্যে সত্যিই এমন কিছু আছে যা ভালোবাসার যোগ্য? স্পেশাল?
মাঝেমাঝে ঝিলের ধারে বন্ধুদের জোড়ায় জোড়ায় বসে থাকতে দেখে গলার কাছটা যে টনটন করে না তা নয়, তবে অন্ধকারের বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ওদের প্রেমের গভীরতা নিয়ে মনে সন্দেহও জাগে।
চিরকাল তো এরকম থাকবে না, নিজেকেই বোঝায় সুমি, একবার গ্র‍্যাজুয়েশন হয়ে গেলে আর স্যারকে বিয়ে করতে বাধা কি?
দেখতে দেখতে থার্ড সিমেস্টার শুরু হয়ে যায়। ক্লাস, পড়াশোনা আর সেমিনার নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারই মধ্যে অজান্তেই আড্ডা জমে ওঠে, কখনো ক্যান্টিনে কখনো গাছের নীচে।
আজ প্রসঙ্গ ছিল মধুপর্ণার বিয়ের। এক বছর ধরে ঝোলানোর পরে অবশেষে নাকি অভিজিতের বাবা মা মধুপর্ণার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। তাই শুনে বাকি তিন বন্ধুর আনন্দ আর ধরছে না।
“ট্রিট চাই, ট্রিট!”
মধুপর্ণাকে টেনে ক্যান্টিনে নিয়ে যায় ওরা। শরতের সকালে এমনিতেই ক্লাস করতে ইচ্ছে করে না। তার ওপর এখন তো হাওয়ায় পুজোর আমেজ।
নিমেষের মধ্যে টেবিলের ওপর চপ, প্যাটিস্ আর আইস্ টি এসে যায়। ভাগ্যিস চারটে চেয়ার পাওয়া গেছে, নাহলে দাঁড়িয়েই খেতে হত।
“আমি তো বাবাকে বলেছি ডিসেম্বারেই ডেট দেখতে,” মধুপর্ণা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “বেশী দেরী করলে ওরা আবার বেঁকে বসবে।”
“কিন্তু এতো শর্ট নোটিসে ভেনিউ পাবি?” রেশমী চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে, “দিদির বেলায় আমরা ছমাস আগে থেকে শুরু করেছিলাম তাও ভেনিউ পেতে চাপ হয়েছিল।”
“সে দাদা ম্যানেজ করে নেবে,” মধুপর্ণা নিশ্চিন্ত স্বরে জানাল।
“তোর কপাল ভালো রে মধু,” নম্রতা তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “আমার তো পুরো উল্টো কেস। দেবজ্যোতির মা বাবা তো আমাকে পছন্দ করে বসেই আছে। কিন্তু সে বজ্জাত ছেলে বিয়ে করলে তো!”
“অ্যাট লিস্ট বয়ফ্রেন্ড বলে কিছু আছে তোর,” রেশমীর দীর্ঘশ্বাস সারা ক্যান্টিনে ছড়িয়ে পড়ে।
“চিন্তা করিস না,” রেশমীর হাঁটুতে চাপড় মেরে আশ্বাস দেয় মধুপর্ণা। “অভিজিতের অনেক হাণ্ডু বন্ধু আছে। আমার বিয়েতে একবার আয় না তোরা, তারপর তোর, আর এই ইডিয়ট সুমিটারও, হিল্লে করে দেব।”
“সুমির হিল্লে আর তোকে করতে হবে না,” হাত নেড়ে বলল রেশমী। “তিনি নিজের ব্যবস্থা নিজেই দেখে নিয়েছেন।”
দুই জোড়া চোখ সুমির দিকে বিদ্যুৎবেগে ঘুরে যায়।
“তাই নাকি?”
“আমাদের কিছু বলিসনি তো!”
সুমি শুধু রহস্যময় হাসি হেসে বসে থাকে। উত্তেজনার চোটে একদিন সে রেশমীকে সৌরাংশুর ওয়াটস্ অ্যাপের একটা স্ক্রিনশট পাঠিয়েছিল – অবশ্যই নামটা মুছে।
“কে রে সুমি? আমাদের ক্লাসের কেউ?”
“না না,” সুমি কিছু বলার আগেই রেশমী বলে ওঠে, “তার নাকি শিশুশিল্পীতে উৎসাহ নেই। পুরুষসিংহ না হলে চলবে না।”
“তার মানে টীচার?” মধুপর্ণা উত্তেজনায় চেয়ারের প্রান্তে এগিয়ে এসেছে।
“বাজে বকিস না তো,” নম্রতা চেঁচিয়ে ওঠে, “আমাদের টীচার মানে তো সব বুড়ো দাদুদের লাইন।”
“সৌরাংশু স্যার অত বুড়ো না।”
সুমির বুকটা সবে ধড়াস করে উঠছে এমন সময়ে-
“ঈশশশশশ...”
নম্রতা আর রেশমী একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল।
“ওই ড্যাবড়া ড্যাবড়া চোখ আর সিঙ্গাড়ার মতো নাক নিয়ে ও সুমির প্রেমিক হবে?” রেশমী নাক কুঁচকে তাকায়।
“সেম শার্ট পরপর দু'দিন পরে আসে দেখেছিস?”
“সত্যি, ওর বউ যে ওকে কি করে টলারেট করে,” মধুপর্ণা হেসে প্রায় গড়িয়ে যায়।
হাতে আইস্ টি থাকা সত্ত্বেও সুমির গলাটা শুকিয়ে আসে।
“বউ?” সে জিজ্ঞেস করে, “স্যারের বউ আছে?”
“নিশ্চই আছে,” চপে কামড় দিয়ে নিশ্চিত গলায় বলে নম্রতা, “বয়স কম হলেও অতও কম নয়।”
“পড়ায় কিন্তু ভালো,” মধুপর্ণা হাসি চেপে বলে, “প্যারাডাইস লস্ট আবৃত্তি করেছিল মনে আছে? যেন সাক্ষাৎ শয়তান দাঁড়িয়ে বলছে কথাগুলো।”
গল্প চলতেই থাকে। কিন্তু সুমির কানে আর ঢোকে না কিছুই।
ক্লাসের শেষে উবারে উঠে সুমি আর এক মূহুর্তও নষ্ট করে না। এমনিও সরাসরি আক্রমণেই তার রুচি।
“তোমার বউ আছে?”
সৌরাংশু অবাক হয়ে তাকায়।
“হঠাৎ একথা?”
“মনে হল হঠাৎ।”
“আছে তো।”
“অ্যাঁ?”
গাড়ি জ্যামে দাঁড়িয়ে গেছে। বাঁশ দিয়ে প্রায় অর্ধেক রাস্তাই ঘেরা। ল্যাম্পপোস্টের কমলা আলোয় সুমি দেখে সৌরাংশুর চোখে কৌতুক ঝিলিক মারছে।
সে বুঝতে পারে না সৌরাংশু সত্যি কথা বলেছে না ইয়ার্কি মেরেছে।
“আমার বউ আছে, দুই ছেলে আছে,” হাসতে হাসতে বলে সৌরাংশু, “তোমাকে তো আগেই বলেছি আমাদের সম্পর্কের কোন ভবিষ্যৎ নেই।”
সুমি শিউরে উঠল। তার পিঠে যেন কেউ ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিয়েছে। এতো বড়ো কথাটা সৌরাংশু তার থেকে চেপে রেখেছে!
অবশ্য চেপেছে বলাটা ঠিক না – নিজের সঙ্গেই সুমি তর্ক করে। স্যারকে একথা আগে জিজ্ঞেসই করেনি সুমি। আজ জিজ্ঞেস করেছে তাই জানতে পেরেছে।
কিন্তু না জানতে চাইলেও সৌরাংশুর কি একবার বলা উচিৎ ছিল না?
হাতের ওপর সৌরাংশুর হাতের আলতো চাপে যেন সুমির সম্বিত ফিরে আসে।
“আমার বাড়ি যাবে নাকি আজ?”
“তোমার বাড়ি?” খানিকটা ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে সুমি, “বউ তোমাকে পেটাবে না?”
(ঠিকই আছে। পোষা বাঘকে আবার ভয় কিসের?)
“সেটা আমার প্রব্লেম। তুমি যেতে চাও কি না বল।”
সুমির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে।
“চল তাহলে।”
কোন বউটউ নেই, বউ থাকলে বাড়ি নিয়ে যেত নাকি? আমি কথাটা জিজ্ঞেস করেছি বলে আমাকে শাস্তি দিচ্ছিল। উফ্ কি বাজে লোক!
ট্যাক্সি গড়িয়া ছাড়িয়ে সোনারপুরের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর একটা বহুতল বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকে গেল। সৌরাংশু ভাড়া মিটিয়ে সুমিকে নিয়ে লিফটে উঠে গেল।
একতলা, দোতলা, তিনতলা...
ছ'তলায় এসে লিফট থামল। সৌরাংশু বাঁ দিকের একটা ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে গেল। কলাপ্সিবল গেট খুলে দরজা খুলে দিল। তারপর সুমির পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াল।
সুমি চৌকাঠ পেরিয়ে ঢুকল।
ঠিক যেন নববধূর গৃহপ্রবেশ হল, সুমি লজ্জিত মুখে ভাবল।
তারপর চারিদিকে তাকিয়ে দেখল।
প্রথমেই চোখে পড়ল একটা হলুদ ট্রাইসাইকেল। তার পাশেই কার্পেটের ওপর রাখা একটা খেলনা হেলিকপ্টার। আর সামনের সাদা কালো ডিজাইন করা দেওয়ালে একটা বড়ো বাঁধানো ছবি – স্বামী, স্ত্রী আর দুই সন্তান। ছোট পরিবার, সুখী পরিবার।
সুমির চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে গেল। কালো রঙের চামড়ার সোফাটার ওপর সে ধপ্ করে বসে পড়ল।
বলেছিলাম, বেশি ওড়ার ফল ভালো হয়না! শখ মিটল তো?
“কি হল? একেবারে চুপ মেরে গেলে যে?”
সুমি খেয়ালই করেনি সৌরাংশু কখন দরজা বন্ধ করে তার পাশে এসে বসেছে। এই অবস্থাতেও হাসিমুখে বসে আছে কি করে?
“নির্লজ্জ!” সুমি চীৎকার করে উঠল, “এতো বড়ো কথাটা আমাকে বলার প্রয়োজন মনে করলে না?”
সৌরাংশুর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।
“ভদ্র ভাবে কথা বল সুমিতা! নিজের সীমা ছাড়িয়ে যেয় না!”
“আমার নাম সুমনা!” দাঁতে দাঁত চেপে বলল সুমি।
“যাই নাম হোক সেটা ইম্পর্ট্যান্ট নয়,” মাছি তাড়ানোর মতো হাতের ভঙ্গি করল সৌরাংশু, “তোমার কাছে কোন ফালতু লেকচার শুনতে আমি বাধ্য নই।”
“অবশ্যই বাধ্য!” সুমি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রাগে দুঃখে তার চোখে জল এসে গেছে। “চার মাসের বেশি সময় একসঙ্গে কাটিয়েছি আমরা। ক্লাসের পরে এক উবারে ফিরেছি, তাজপুর বেড়াতে গেছি-”
“এর মধ্যে কোন্ কাজটা করতে তোমাকে বাধ্য করেছি?” চাপা গলায় বলল সৌরাংশু। “যা যা হয়েছে তোমার অনুমতিতেই হয়েছে।”
এক মূহুর্তের জন্যে থমকে যায় সুমি। তারপর বলে,
“আমি যদি জানতাম তোমার বিয়ে হয়ে গেছে তাহলে কক্ষণো তোমার গাড়িতে উঠতাম না! তুমিও সেটা জানতে তাই চেপে গেছিলে। তোমার মতো লোকেদের না-”
কথা শেষ হওয়ার আগেই সোফা থেকে সৌরাংশু লাফিয়ে উঠল।
“কি করবে?” তর্জনী নেড়ে থুতু ছিটিয়ে চীৎকার করতে লাগল, “ইউনিভার্সিটিতে কমপ্লেন করবে? বউকে জানিয়ে দেবে? তাহলে আমিও দেখে নেব তুমি ফাইনাল পরীক্ষায় কি করে বস!”
মূহুর্তের নিস্তব্ধতা। সুমির হৃৎপিণ্ডটা কে যেন বরফ ঠান্ডা হাত দিয়ে চেপে ধরেছে। সৌরাংশুর এই রূপ সে আগে কখনও দেখেনি। যেন সৌরাংশুর মুখোশের আড়াল থেকে একটা পিশাচ কথা বলছে।
সুমির মনের ভাব মুখেও ফুটেছিল কি না কে জানে, কিন্তু পরের মূহুর্তেই সৌরাংশু আবার আগের মূর্তি ধারণ করে। যেন মাঝের সবটা শুধুই সুমির কল্পনা ছিল। সুমির হাত ধরে সৌরাংশু তাকে আবার সোফায় বসিয়ে দেয়।
“তোমাকে কি আমি কখনো কোনো বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি?” মোলায়েম গলায় সে সুমিকে জিজ্ঞাসা করে।
সুমি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে।
“উল্টে শুরুর থেকেই বলেছি এই সম্পর্কটার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তুমি যদি তাও কোন ভবিষ্যৎ কল্পনা করে ফেল তার দায় আমাকে কেন দিচ্ছ?”
“তার মানে হিঁক,” সুমি হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে, “তার মানে তুমি আমাকে কখনো ভালোই বাসনি?”
সৌরাংশুর ঠোঁট আলতো করে সুমির গাল ছোঁয়। সুমি মুখ সরিয়ে নেয় না।
“ভালো না বাসলে তোমার সঙ্গে এতটা সময় কাটাতাম কি? বিশ্বাস কর, আমি যদি জানতাম তোমার সঙ্গে এরকম একটা সম্পর্ক তৈরী হবে তাহলে প্রথমেই সব কথা খুলে বলতাম। তখন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম আমি। যখন মাথা কাজ করতে শুরু করল তখন অলরেডি তোমার সঙ্গে জড়িয়ে গেছি। তখন শুধু তোমাকে হারানোর ভয়ে সত্যিটা বলতে পারিনি।”
সৌরাংশু নিজের মাথাটা সুমির কাঁধে নামিয়ে দিল।
“তোমার সঙ্গে কাটানো প্রত্যেকটা মূহুর্ত আমার কাছে স্পেশাল।”
সুমির রাগ পড়ে আসতে থাকে। সত্যিই তো, স্যার তো তাকে ইচ্ছে করে ঠকাতে চায়নি। প্রেমে পড়ে গেলে মানুষ কীই-বা করতে পারে? ভালোবাসা তো অন্ধকারের অতিথি। কখন চুপিসারে এসে পড়ে কে বলতে পারে? স্যার কি আর বিয়ের দিনে জানত যে সুমির মতো কেউ তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে? কাউকে দোষ দেওয়ার নেই...সবই ভাগ্যের পরিহাস।
“এখন আমরা কি করব স্যার?” কান্নাভেজা গলায় সুমি জিজ্ঞাসা করল।
সৌরাংশু একটু ভেবে বলল,
“আমার মনে হয় কিছুদিন তোমার আলাদা ফেরাই ভালো। আমাকে নিয়ে তোমার খুব বেশী সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সামনের বছরেই ফাইনাল আছে। পড়াশোনায় একটু মন দাও।”
সুমি তার টপের হাতায় চোখ মুছে বলল,
“তুমি রেগে আছ, তাই না? তাই এসব বলে আমাকে কাটিয়ে দিচ্ছ?”
সৌরাংশুর মুখ বিষন্ন হয়ে ওঠে। এক সন্ধের মধ্যে দ্বিতীয়বার যেন মুখোশের আড়ালের সত্যিকারের মানুষটাকে দেখতে পাওয়া যায়।
“কাটিয়ে কোথায় যাব বল? আমার জীবন তো শুধু বাড়ি আর ইউনিভার্সিটি – এই দুটো জেলের মধ্যে কাটে। তোমাকে আমার দুটো জেলই দেখিয়ে দিলাম। খুঁজলে এর একটাতেই আমাকে পেয়ে যাবে। বরং কাটানোর চান্স তোমার অনেক বেশি। গ্র‍্যাজুয়েশনের পর তুমি যে কোন দেশের যে কোন শহরে চলে যেতে পার। আমি তোমার নাগালও পাব না। আমার এখানে খুঁটি বাঁধা, তোমার তো নয়।”
সৌরাংশুর যন্ত্রণা যেন সুমিরও বুক ছুঁয়ে যায়। কিন্তু কিছু বলার আগেই সৌরাংশু ঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠল।
“সর্বনাশ! এক্ষুনি বউ বাড়ি ফিরে আসবে! তার আগে তোমাকে ড্রপ করে দিতে হবে তো। দেখেছ, তোমার সঙ্গে হেজিয়ে কতটা সময় নষ্ট হয়ে গেল। চল বেরোও, বেরোও!”
ফেরার পথে সৌরাংশুকে সুমি একটা কথাই জিজ্ঞাসা করেছিল।
“তুমি কি সত্যিই আমার পরীক্ষায় বসা আটকে দিতে?”
“দিতামই তো,” সৌরাংশু হাসতে হাসতে বলেছিল, “তুমি আমার ক্ষতি করলে আমি ছেড়ে দিতাম নাকি? সৌরাংশু মল্লিক সেরকম মানুষ নয়।”
সুমি বুঝতে পারেনি কথাটা সত্যি না ইয়ার্কি ছিল।


তিন অঙ্কের নাটক এটা। তুমি ভাবলে কি করে যে দ্বিতীয় অঙ্কেই যবনিকাপতন হবে?
সৌরাংশুর কথামতো আজকাল সুমি একাই বাড়ি ফেরে। এমনিতেও থার্ড সিমেস্টার শেষ হওয়ার মুখে। তাই অধিকাংশ দিন ক্লাসের পরে লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করতে হয়। ক্লাসে করতে আগে খুবই কষ্ট হত সুমির। ধীরে ধীরে সেটাও গা সওয়া হয়ে এসেছে।
সৌরাংশুর চেম্বারেও বার দুই ঢুকতে হয়েছে। কাজের কথা বলেই সুমি চলে এসেছে। শুধু বেরনোর আগে আহত প্রাণীর মতো দু'চোখ ভরা যন্ত্রণা নিয়ে প্রেমিকের দিকে একবার তাকিয়েছে। যন্ত্রণা পাচ্ছে সৌরাংশুও, সুমি ওর মুখ দেখলেই বুঝতে পারে।
ছাই পাচ্ছে।
মাথার ভেতরে মা বলে ওঠে।
ভালো খবর যে একেবারে নেই তা নয়। মধুপর্ণার বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে। রেশমী আর নম্রতা তুমুল আলোচনা জুড়ে দিয়েছে কোন দোকান থেকে লেহেঙ্গা কিনবে, কোন পার্লারে সাজবে, কোথায় চুল বাঁধবে। সুমিকেও কথার মধ্যে টানে কিন্তু তার এখন যোগিনী অবস্থা। সংসার থেকে মন উঠে গেছে কবেই। কিছু একটা অজুহাত দিয়ে ওদের কাটিয়ে দেয়।
এরকম ভাবেই সুমির দিন কাটছিল। কেটেও যেত এভাবেই যদি না সেদিন লাইব্রেরিতে পায়েলদির সঙ্গে দেখা হত। পায়েলদি সুমির দূর সম্পর্কের দিদি। এই ইউনিভার্সিটি থেকেই এম.এ, পিএইচ.ডি করে এখন একটা কলেজে পড়াতে ঢুকেছে। দেখা হতেই দু'বোনের গল্প জমে গেল।
“তারপর, ক্লাস কেমন চলছে?” এ কথা সে কথার পর পায়েলদি জিজ্ঞাসা করল। “কাদের ক্লাসে আছিস তুই? পি.কে.আর পড়াচ্ছেন? আর শর্মিষ্ঠা ম্যাম?”
“দুজনেই পড়াচ্ছেন।”
“উফ, শর্মিষ্ঠা ম্যামের ফেমিনিস্ট লিটারেচারের কোর্সটা যা ছিল না,” পায়েলদি ওপরের পাখাটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আজও ওনার বলা প্রত্যেকটা কথা মনে আছে!”
“ওটা পরের সিমেস্টারে আছে।”
সুমি এই কোর্সটার অনেক প্রশংসা শুনেছে।
“এম.এ শেষ করে কি করবি কিছু ভেবেছিস?”
“পিএইচ.ডি করার ইচ্ছে আছে। কয়েকটা ফরেন ইউনিভার্সিটিতে খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু এখানে করাই বেটার হবে কি না বুঝতে পারছি না।”
“জি.সি.র সঙ্গে একবার কথা বলিস,” পায়েলদি পরামর্শ দিল, “উনি আমাকে খুব হেল্প করেছিলেন।”
হঠাৎ সুমির মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।
“সৌরাংশু মল্লিক তোমাদের পড়িয়েছেন? ওনার কাছে পিএইচ.ডি করলে কেমন হয়?”
পায়েলদির মুখে কেমন একটা ছায়া নেমে এল।
“এস.এম. ভালো টীচার, অনেক জ্ঞান আছে,” একটু ভেবে বলল, “তুই বোধহয় সেটা দেখেই ওকে স্যুটেবল বলে মনে করেছিস। কিন্তু আমার মনে হয় তোর সিনিয়র কাউকে খোঁজাই ভালো।”
“এস.এমের কি কোন প্রব্লেম আছে?” ঠোঁট চেটে নিয়ে সুমি জিজ্ঞাসা করল।
পায়েলদি এদিক ওদিক তাকিয়ে গলাটা নামিয়ে নিল।
“এখানে বলা যাবে না, ঝিলের ধারে চল্!”
লাইব্রেরি থেকে বেড়িয়ে একটা বনবীথিকা টাইপের রাস্তা, আর তারপরেই ঝিল। একটা ফাঁকা বেঞ্চ দেখে পায়েলদি বসে পড়ল। সুমিও বসল। ঝিলে তখন বিদায়ী সূর্যের আলো চিক্ চিক্ করছে। আর একটু পরেই ঘাসের মধ্যে মশারা জেগে উঠবে। ব্যাগ থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল পায়েলদি।
“এস.এমের আশেপাশে বেশি না যাওয়াই ভালো, বুঝলি তো,” সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে পায়েলদি বলল। “লোকটার চরিত্র মোটেই সুবিধার না।”
“ম-মানে?” সুমি শুকনো গলায় প্রশ্ন করল। যদিও উত্তরটা সে ভালোমতো আঁচ করতে পেরেছে।
পায়েলদি সুমির দিকে সিগারেটটা এগিয়ে দিল। সুমি মাথা নেড়ে 'না' বলল।
“মানে যা হয় আর কি,” একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে পায়েলদি বলল। “প্রায় প্রত্যেক ব্যাচের কোনো না কোনো মেয়ের সঙ্গে অ্যাফেয়ার হয়েছে লোকটার। বেশি দূর এগোনোর সাহস নেই যদিও, বউকে যমের মতো ভয় পায়।”
সুমি হাসার চেষ্টা করল। শ্বাস টানা আর শেয়ালের ডাকের মাঝামাঝি একটা আওয়াজ বেরল। তবে পায়েলদি কিছু বুঝতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
“আমাদের ব্যাচের তুহিনাকে ফাঁসিয়েছিল। স্যারের দুঃখে হাতটাত কেটে কি অবস্থা...তুহিনাকে দেখেছিস তো?”
দেখেছে। আগের মাসেই একটা সেমিনারে দেখেছে। ফর্সা হাতে একগুচ্ছ চুড়ি, মাথায় সিঁদুর, হাসি আর ধরছে না...সেই তুহিনাদি? জিজ্ঞাসা করতে পায়েলদি গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।
“এখন বুঝবি না কিন্তু তখন যদি দেখতি...বেচারা কিছু করতেও পারেনি, জানিস? হারামজাদা কোনো প্রমাণ রাখেনি তো। এমন ভাবে ব্যাপারটা সাজিয়েছিল যেন ওর কোনোই ইন্টারেস্ট ছিল না আর তুহিনা পাগল!”
সুমি নিজের আর সৌরাংশুর ওয়াটস্ অ্যাপ্ মেসেজগুলোর কথা ভেবে দেখল। বেশীর ভাগ সুমি একাই প্রাণের উচ্ছ্বাসে লিখে গেছে। স্যারের দিক থেকে শুধুই 'হ্যাঁ', 'সেই', 'তা ভালো' গোছের উত্তর। বাকি কথা তো ফোনে। আর উবারে ফেরা বা তাজপুর যাওয়ারই বা প্রমাণ কি? গাড়ি তো সবসময় স্যারই অ্যারেঞ্জ করেছে।
(হ্যাঁ, সুমনাকে মাঝেমধ্যে ড্রপ করেছি। ও গড়িয়ায় থাকে আর আমার বাড়ি সোনারপুরে তাই রুটেই পড়ত...এতে অন্যায়টা কি?)
“যাই হোক, শেষটায় সামলে গেছিল,” সিগারেটটা ফেলে জুতো দিয়ে ঘষে দিল পায়েলদি। “তখন যা শুনেছিলাম, আরো অনেক মেয়ের সঙ্গেই এস.এম. এটা করেছে। তোদের ব্যাচের কাউকে ধরেনি?”
“কি জানি গো!” ব্যাগ থেকে ফোন বের করার ছুতোয় সুমি চোখ মুছে নিল।
“অবশ্য এম.এর মেয়েগুলোকেই ধরে। তুই পিএইচ.ডি করতে গেলে হয়তো অসুবিধা হবে না।” আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল পায়েলদি। “এমনিতেও ওর কথায় ফেঁসে যাওয়ার মতো বোকা তুই নস।”
ভাগ্যিস সূর্য অস্ত গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছিল। তাই পায়েলদি সুমির চোখমুখের অবস্থাটা আর দেখতে পায়নি। সুমি নিজেও জানে না ওই সময়ে তার চোখমুখের অবস্থাটা ঠিক কিরকম হয়েছিল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসার পর পায়েলদি উঠে দাঁড়াল।
“চল্ বেরোনো যাক। তোর লাইব্রেরির কাজ হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ...বাড়ি চল না পায়েলদি, মা বাবার খুব ভালো লাগবে।”
“না রে, আজ থাক। আরেকদিন যাব।”
মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ দেয় সুমি। আজ তার আর কারুর সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
গেটের কাছাকাছি পৌঁছেছে এমন সময়ে – সুমির চোখের সামনেই কি ঘটনাটা ঘটতে হল?
গেটের সামনে একটা উবার এসে থামল। সুমি দেখল সৌরাংশু হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠল। দরজা খোলাই রইল। এক মূহুর্ত পরেই একটা মেয়ে – বোধহয় ফার্স্ট ইয়ারের – লম্বা স্কার্ট দুলিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে গেল। তার মুখের হাসিটা সুমির খুব চেনা।
পায়েলদি সুমির কোমরে একটা হালকা খোঁচা দিল। সুমির মন ততক্ষণে বুলবুল ভ্যারাইটি স্টোরে পৌঁছে গেছে। বিষ চাই – আরশোলা মারার বিষ, ইঁদুর মারার বিষ, ছুঁচো মারার বিষ – যে কোন একটা হলেই চলবে।
রাগে গা রি রি করছে সুমির। দিনের পর দিন মিথ্যে কথা, প্রতারণা, অপমান - সবকিছু সে সহ্য করেছে শুধুমাত্র একটা কথা ভেবে।
সুমি বিশ্বাস করেছিল যে আর যাই হোক সৌরাংশুর তার প্রতি ভালোবাসায় কোন মিথ্যে নেই। তার মনে হয়েছিল সৌরাংশু পৃথিবীর একমাত্র মানুষ যে সুমির মধ্যে ভালোবাসার যোগ্য কিছু দেখেছে। তাই স্বার্থহীন স্বেচ্ছা-ভালোবাসা নিয়ে সুমির কাছে সে ছুটে এসেছে।
সে জানত যে সৌরাংশু ভুল করে ফেলেছে, কিন্তু ভুল তো সব মানুষই করে থাকে। সৌরাংশুর ভুলকে সুমি ক্ষমা করে দিতে রাজি হয়েছিল।
কিন্তু না, সুমি তার কাছে স্পেশাল ছিলই না। সুমি না হয়ে অন্য কেউ হলেও চলত। সে শুধুই শিকারী, শিকার ধরতে বেরিয়েছিল। সৌরাংশুর জীবনে সুমির কোন আলাদা অস্তিত্বই ছিল না।
একথা জানার পরে সৌরাংশুর অস্তিত্ব কি করে ক্ষমা করবে সুমি? সুমি যে পৃথিবীতে বেঁচে আছে, যে হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিচ্ছে সৌরাংশুও সেখানেই থাকবে, পড়াবে, সুমির চোখের সামনে অন্য মেয়েদের সঙ্গে ঘুরবে, তা কি করে হতে পারে?
Never can true reconcilement grow where wounds of deadly hate have pierced so deep.
বাড়ির কাছের বুলবুল ভ্যারাইটি স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে একবার ইতস্তত করল সুমি। শুধু এক মূহুর্তের জন্যে। তারপর মনে মনে কি একটা যেন সিদ্ধান্ত নিয়ে চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে গেল...
পরদিন সকাল।
সৌরাংশুর চেম্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে সুমি অস্থিরভাবে পা নাড়তে থাকে। কাল রাতেই সে লক্ষ্মণরেখাটা গুঁড়ো করে রেখেছে। আপদ মেয়েটা বেরোলেই সে ঢুকে পড়বে আর কিছু একটা আছিলায় গুঁড়োটা সৌরাংশুর জল বা সরবতে মিশিয়ে দেবে। খেয়ে যদি নাও মরে, অন্তত হাসপাতালে তো যাবেই। তাই বা কম কি?
কিন্তু মেয়েটা আর বেরোচ্ছেই না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সুমির পা টনটন করছে। সে করিডোরে পায়চারী করতে শুরু করল। থেকে থেকেই তুহিনাদির মুখটা তার মনে পড়তে লাগল।
বেচারা কিছু করতেও পারেনি, জানিস?
বেশ, যা করার সুমিই করবে। আর কোন মেয়েকে ওই সৌরাংশুর কবলে পড়তে হবে না।
একটা আওয়াজ পেয়ে সুমি করিডোরের উল্টোদিকটায় – যেদিকে খোলা বারান্দা সেদিকটায় – উঁকি মারল।
নীচের মাঠে ফুটবল খেলা হচ্ছে। কয়েকজন ছেলেমেয়ে বসে দেখছে, হাততালি দিচ্ছে, গল্প করছে।
ডিসেম্বরের রোদটা কি আরামের...
তুহিনাদির মুখটা আবার সুমির চোখের সামনে ভেসে উঠল। কি সুন্দর, কি হাসিখুশী...
সব কষ্টের স্মৃতি কতদূরে ফেলে রেখে চলে এসেছে তুহিনাদি। হয়তো এসেছে বাকি মেয়েরাও – যারা একদিন সৌরাংশুর 'শিকার' হয়েছিল। সুমি নিজেও কি এগিয়ে যাবে না? পিএইচ.ডি করবে, হয়তো এখানে হয়তো অন্য দেশে...নতুন দেশ, নতুন শহর, নতুন ভালোবাসা...
আজ সৌরাংশুর চেম্বারে যে মেয়েটা বসে আছে একদিন সেও তো জীবনে এগিয়ে যাবে।
এগোবে না শুধু একটা জীবন।
কি যেন বলেছিল স্যার?
আমার জীবন তো শুধু বাড়ি আর ইউনিভার্সিটি – এই দুটো জেলের মধ্যে কাটে।
হঠাৎ এক ঝলকে সুমির কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল। নিজের অসুস্থ মানসিকতার কবলে আটকে থাকা সৌরাংশুর কাছে কী-বা বাড়ি কী-বা বাইরে – সব সমান, সবই জেল। কোন এক ভেতরের অসুখ তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, সংসার-সন্তান-জীবিকা কোন কিছুই যার উপশম নয়। তাই নতুন নতুন জীবনের সান্নিধ্যে আসার চেষ্টা – যে জীবনগুলোতে এখনো আশা আছে, রং আছে, সম্ভাবনা আছে – তাদেরকে শুষে নিয়ে তাদের রং চুরি করে নিজের জীবনে ভরার ব্যর্থ বাসনা। প্রত্যেক বছরেরই এক গল্প। কলুর বলদের মতো একটাই অন্ধকার বৃত্তের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো।
পারবে না সৌরাংশু...নিজের অসুস্থ মানসিকতার সব থেকে বড়ো শিকার সে স্বয়ং। তাই সুমিরা যা পারে সে তা কোনদিনও পারবে না।
আনমনে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকল সুমি।
“অন্ধকারের ভালোবাসা...”
সবটা গোপন, সবটা অন্ধকার। দম যেন আটকে আসে। সৌরাংশুর জীবনের অন্ধকারকে আর একটু হলেই নিজের জীবনে সামিল করে ফেলছিল সুমি। ডিসেম্বরের সুন্দর সকালটায়, সারা ইউনিভার্সিটি যখন আনন্দে মেতে উঠেছে, তখন সে পকেটে বিষ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!
একটা ডাস্টবিন খুঁজে গুঁড়োটা ফেলে দিল সুমি। তারপর ফোনটা বের করল।
“রেশমী? তোরা ক'টার সময়ে লেহেঙ্গা কিনতে যাচ্ছিস রে?...হ্যাঁ, আমিও যাব।”