Next
Previous
0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in





পর্ব (৫)

রামপ্রসাদের সঙ্গেই ভারত মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে ভিতরমহলের দিকে গেল। সেদিনের মতো দরবার তখন শেষ, অলস অপরাহ্ণটি অলিন্দে বসে থাকা পায়রাগুলির মতই গুজগুজ করছে। মহারাজ বিরামকুঠীতে তখন একাই ছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই দুটি মানুষের লম্বাছায়া তাঁর নজরে এল আর তার পরক্ষণেই নায়েব হুকুমচাঁদ এসে খবর দিল প্রসাদ এসেছে তার সঙ্গে আবার একটি নতুন লোক।

প্রসাদ ভিতরে এসে করজোড়ে প্রণাম সারলো। দেখাদেখি ভারতও। মহারাজ জানেন প্রসাদ তার আরাধ্যা ব্রহ্মময়ী ছাড়া কাউকেই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেনা, তাই বলে অন্য ছোকরাটিও কেন তাই করলো...?বেশ শ্লেষের সঙ্গেই প্রসাদকে বললেন -

" কি হে একেবারে ডুমুরের ফুল হয়ে উঠেছ দেকচি হে ! মাঝেমধ্যে কেষ্টনগর এলে কি তোমার জাত যাবে? তা এবারে এত দেরী করলে কেন? সকালটা পুরো মাটি হল ! তা সঙ্গের ভিরিঙ্গীটিকে আবার কোথায় জোটালে?"

প্রসাদ ছদ্মবিস্ময় প্রকাশ করে বলে,

" সে কি মহারাজ ! উৎসব তো সেই পরশু, আর আজকেই তো আমি রাজবাড়িতে এসে গেচি! তাতেও যে আসতে দেরী হল' বলে তা অবশ্য আমিও বুঝিনি ! আসলে ওই বেটীকে একা ফেলে রেখে আসতে মন চায়নে! তা যদিও এখানে তো সেও আছে জানি, তাইতো আসা ! নইলে কি আর আমি কোথাও নড়ি? আর আমার এই সঙ্গীটি হল ভারতচন্দর, সম্পক্কে আমার মিতে,ও আপনাকে কিছু আর্জি জানাতে চায়! "

মহারাজ বললেন - " তা বটে ! তবে কি জানো প্রসাদ, তোমার গানগুলো শুনলে বুকটা মনটা হাল্কা হয়ে যায়! চৌদিকে যা চলচে! মাঝে মাঝে সব ছেড়েছুড়ে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে হয়! ও বেলায় আরতির পর দালানে আসবখন। " তারপর ভারতকে আপাদমস্তক দেখে জিজ্ঞাসা করলেন - "তা, বামুন না কি জাত হে ? দুম্ করে হঠাৎ কেষ্টনগর? সাকিন কোথায়?"

ভারত তার পিতৃপরিচয়, ভাগ্যবিপর্যয় সবকিছু বলার পর অন্তিম আর্জিটি অবশেষে পেশ করে। কৃষ্ণচন্দ্র দেখেন এই যুবকটির চোখে এক স্বপ্নিল কল্পলোকের ভাবুক দৃষ্টি আছে তবে তা প্রসাদের মত ভোগহীন নির্মোহ নয় বরং শিল্পীর সদারঙ্গটি এত বিপর্যয়ের মধ্যেও তার জৌলুস হারায়নি। গড়গড়ার নলটি মুখ থেকে সরিয়ে তিনি চাপা গলায় বললেন -

" শোন বাছা যা বুজলাম, এতদিন তো শুধু খুচরো কবিতাই লিখলে ! ওসব পাঁচালি টাঁচালি লেখার লোকের অভাব নদে- শান্তিপুরে কোথাও নেই, আর তারও একন দরকার নেই ! একালে একটু অন্যরকম জিনিস চাই বুজচ? এই ধর বসন্তবর্ণনা বা নবরস বা কখনো বা ফার্সী হিন্দী বাংলা সংস্কৃত এসব মিশিয়ে টিশিয়ে আদিরসটাকেই যদি জমাতে পারো তো দেখ? ওই সব মুকুন্দরাম- টাম অনেক শুনিচি, ওসব হল গরীব মূখ্যু সুখ্যূ লোকেদের জন্য ! পুরনো চন্ডীকাব্য নয় একেবারে এক নতুন মেজাজের মঙ্গলকাব্য লেকো দিকি যদি পার!

অবশ্য এসব তোমার পারারই কতা! তুমি স্বভাবকবি তায় অলঙ্কারশাস্ত্রাদিও জান যখন ! তবে লেগে পড়ো পরশু থেকে! দশদিন সময় দিলাম ! আর হ্যাঁ, কাল দেশে গিয়ে তোমার পরিবারটিকেও এখেনে নিয়ে এস ! সৃষ্টির সময় পুরুষটিকে প্রয়োজনে সদা 'প্রকৃতি'স্থ হয়ে থাকতে হয়! হা ! হা! হা! যাও এখন এবেলা অতিথিশালায় গিয়ে খাও দাও বিশ্রাম নাও গে !একসঙ্গে সবাই প্রসাদের গান শুনবো সন্ধে আরতির সময়...হুউউউকুউউমচাঁআআআদ এ্যাই হারামজাদা কোথায় গেলি রে ব্যাটা..."।

ভারতের মাথার ভিতরে ভাবনার ঘোর লাগে। তবে কি সত্যিই তার ভাগ্যটা এবারে বদলাবে? পরক্ষণেই মনে সংশয় এসে উপস্থিত হয় যে সে কি আদৌ এই কাব্যটি রচনা করতে পারবে!এদিকে, কোত্থেকে যে শুরু করা যায় ! মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিজেও যথেষ্টই শাস্ত্রজ্ঞানী; তাঁকে খুশী করতে পারাটাও নেহাত মুখের কথা তো নয়। সে যাই হোক, সুযোগ এসেছে যখন তখন না হয় নিজেকে উজাড় করে দেবে এবার। প্রসাদ ওর ভাবনাক্লান্ত মুখটি দেখে মিটিমিটি হাসে। হাঁটুতে তাল ঠুকে সে চোখ বুজে আখর ধরে মিঠে গলায়,

" প্রভাতে দাও অর্থচিন্তা,
মধ্যাহ্নে দাও জঠর চিন্তা,
সায়াহ্নে দাও ফল চিন্তা,
বল্ মা তোমায় কখন ডাকি!"

গান গাওয়া শেষ হলে ভারত জিজ্ঞাসা করে - 'এ পদ কি তোমার রচনা মিতে? ' প্রসাদ বলে 'আমি কি ছাই লিখি! আমি গাই, লেখে তো আরেক জনায় ! সে কে জান?' বলেই সে আবার গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে -

" শ্যামা মা ওড়াচ্ছে ঘুড়ি ভব সংসার বাজারের মাঝেএএএ"

ভারত বুঝতে পারে প্রসাদের এই গান একদিন দেশের লোকের মুখেমুখে ফিরবে। ধনী-নির্ধন সবাইকে প্রসাদীসুরে ভাসতেই হবে। এ যে চিরকালের গান

যেন চিরজন্মজন্মান্তরের সাধনতত্ত্ব !



সাতটা দিন কিন্তু দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল। রাধাকে এখনো ভারত কৃষ্ণনগরে সঙ্গে করে আনেনি। বরং সে নিজে একদিন এরমধ্যে বাড়ি থেকে এক রাত্তির ঘুরে এসেছে। এখন সারাটা দিনের বেশীর ভাগটাই সে লেখায় নিয়োজিত। কৃষ্ণনগরে রাতে প্রদীপ জ্বালতে বাধা নেই। তাই বেশীর ভাগ দিনই সে রাত্রি জেগেই দ্রুত কাব্য রচনায় ব্রতী।

আর দু দিনের মধ্যেই তার লেখা সম্ভবতঃ শেষ হয়ে যাবে, তারপরে পরীক্ষা হবে তার প্রতিভার। অনেক ভেবে চিন্তে সে কাশীর অন্নপূর্ণাকে নিয়ে একটা মঙ্গলকাব্য রচনা করতে বসেছে। বাচস্পতি মশায়ের কাছে শোনা যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য, কতলু খাঁ আর ভবানন্দ মজুমদারের ইতিহাসটিকেও কায়দা করে এরই মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এই ভবানন্দ মজুমদারই আবার কৃষ্ণনগর রাজবংশের আদিপুরুষ। দেবী অন্নপূর্ণার মর্ত্যধামে দেবীমহিমাটি এই ভবানন্দের হাত ধরেই প্রচারিত হয়েছে এরকম ভাবেই ভারত লিখেছে। স্বয়ং অন্নদাই স্হিরা হতে আকাঙ্খা করেছেন ভবানন্দের ভদ্রাসনে। এটা অবশ্য মঙ্গলকাব্যেরই রীতি। রচনাকারের স্বনামে ভণিতা আর দেবীমহিমা প্রসারে রাজশক্তির অনুগ্রহ এই চেনা ছকটিই যুগ যুগ ধরে মঙ্গলকাব্যের আঙ্গিক। ভারত নিজেও অবশ্য এই ধারাটিকেই মেনে চলেছে।



ঈশ্বরচন্দ্র এখন ভারতচন্দ্রের রচনা পড়াতে বেশ আপ্লূত বোধ করেন। নিজেদের মুদ্রণযন্ত্রে অন্নদামঙ্গলটি বড় যত্ন করে প্রকাশ করেছেন। সাথে বাড়তি সংযোজন হয়েছে সাদা কালোয় উড্ কাট প্রিন্টের অলংকরণগুলি। বটতলা সংস্করণের মত সে বইটি কেবলমাত্র স্খলিতবসনা রমণীদের চিত্র বহুল নয়, বরং আর্টের বিষয়টাকে যোগ্য প্রাধান্য দিয়েই ছাপা হয়েছে।একদিন ক্লাসের মধ্যে তো তিনি স্বীকারই করলেন সংস্কৃতে কালিদাসের বাংলাভাষায় যোগ্য পরিপূরক হলেন ভারতচন্দ্রই।

এরমধ্যে একটি পত্র পেলেন বিদ্যাসাগর। সুদৃূর ফরাসীদেশের ভার্সেই থেকে পত্রটি লিখেছেন অার এক আশ্চর্য বঙ্গদেশীয় প্রতিভা। তার নাম মাইকেল মধুসূদন দত্ত। যথারীতি সর্বদাই উচ্ছৃঙ্খলতার চূড়ায় তার বসবাস। সঙ্গে প্রচন্ড মদ্যপানের মাত্রাটিও ক্রমবর্ধমান। এখন সবে ডিসেম্বর মাস পড়েছে তাই বিদ্যাসাগরের কাছে কিছু অর্থসাহায্য যাচনা করে চিঠি লিখেছেন এই যুবক কবি। পত্রের শেষাংশটি পাঠ করে বিদ্যাসাগর নিজেকে আর সংযত করতে পারেন না। বাংলাদেশের এই অনন্য প্রতিভাটি ওখানকার প্রবল শীতে গায়ে দেবার কোটটিকে বিক্রী করে কদিনের খাদ্যসংস্থান করতে বাধ্য হয়েছ। অথচ এই দূর্দিনের মধ্যেও মধুসূদন তার কবি মনের সরসতা ও সৌজন্যবোধটির কোনও হানি ঘটায়নি।

" It is about six times colder than the coldest day in our coldest month. Do you remember the line in Bharatchandra -বাঘের বিক্রম সম মাঘের হিমানী? What would he have said if he had been here?"

বঙ্গদেশীয় জননীর মতন কোমলপ্রাণ বিদ্যাসাগরের বিগলিত হৃদয়টি এই চিঠিটি পাঠের পর একটু যেন ভারী হয়ে আসে। যদি একটিবারের জন্যও মধুসূদন নিজের প্রতিভার মূল্যটি বুঝত! সেদিনের মত লেখাপড়ার কাজ সেরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বিদ্যাসাগর স্বগোতক্তি করেন -

" হা হতোস্মি!"



অবশেষে এল রাজসভায় 'অন্নদামঙ্গল' পাঠের দিনটি। সিংহাসনে মখমলের পাদপীঠে পা রেখে উন্মুখ স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্র। সভায় অনেক পরিজন, অমাত্যজন আর পন্ডিতবর্গ। এছাড়া বিশেষ ভাবে সদাদন্তবিকশিত রাজবিদূষক গোপালচন্দ্রও উপবিষ্ট ঠিক কৃষ্ণচন্দ্রের পাশটিতেই। ভারত আজকের সভায় তার 'মিতে' প্রসাদের অনুপস্থিতিতে কাতর বোধ করে। উৎসবের পরদিনই সে কুমারহট্ট ফিরে গেছে। অবশ্য মিত্রতার শর্তে ফিরে যাওয়ার আগে সে ভারতকে দিয়ে গেছে তার স্বরচিত একটি প্রসাদীসুধা -

" কালী কালী বল্ রসনা/ কর পদধ্যান নামামৃতপান /যদি হতে ত্রাণ থাকে বাসনা !"

ভারতচন্দ্র মনে মনে স্মরণ করে ইষ্টনাম

' ব্রহ্মস্বরূপা পরমা জ্যোতিরূপা সনাতনী'

বন্দনা শেষ হল, সভাবর্ণনাও। তারপর দক্ষযজ্ঞ -দশমহাবিদ্যা - সতীর আখ্যান ইত্যাদির পর হরগৌরীর মিলিত রূপবর্ণনা

'আধ বাঘছাল ভাল বিরাজে
আধ পটাম্বর সুন্দর সাজে,
আধ মণিময় কিঙ্কিণী বাজে
আধ ফণী ফণা ধরি রে !
আধই হৃদয়ে হাড়ের মালা,
আধমণিময় হার উজালা
আধ গলে শোভে গরল কালা,
আধই সুধা মাধুরী রে !'

সতীর দেহত্যাগ, মদনভস্ম, এইসবের পরেই শুরু মূলপর্বের বিস্তার। কাশীধাম থেকে বঙ্গদেশে অন্নপূর্ণার আগমন ও ভবানন্দের সৌভাগ্যউদয়পর্বের কাহিনীর সময় স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্রও যেন নড়ে চড়ে বসলেন একবার। অন্নপূর্ণার মর্ত্যে অবতরণের দৃশ্যে সে ইচ্ছে করে 'ঈশ্বরী' নামে এক পাটনী চরিত্রকে এঁকেছে। কাব্যের আবহে তার সেই খেয়াঘাটের পাটনীকেই অমরত্ব দেওয়ার এইতো যোগ্য স্থান। ভারতের জীবনে প্রতিষ্ঠালাভের এই পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পিছনে রাধার অবিচল স্থৈর্যের সাথে সাথে তার নিত্যদিনের শর্তহীন সমর্পণও যে সমানভাবেই মূল্যবান।

সভায় সকলে এই অপরূপ ভাষার চাতুর্যে, শব্দালঙ্কারের অনন্য প্রয়োগে স্তব্ধবাক হয়ে চেয়ে থাকে ভারতের দিকে। পুস্তিকা বন্ধ করে পাঠসমাপ্তি ঘোষণা করে ভারত, এবারে সংস্কৃতে!

" যদক্ষরং পরিভ্রষ্টং মাত্রাহীনঞ্চ যদ্ভবেৎ।
পূর্ণং ভবতু তৎ সর্বং ত্বৎ প্রসাদাৎ সুরেশ্বরী"

সমাপনের পরে সকলের আগে আসন ছেড়ে উঠে স্বস্তিবাচন করলেন 'গদাধর তর্কালঙ্কার'। রাজকবি 'বাণেশ্বর সংস্কৃতকেই কাব্য রচনার একমাত্র ভাষা হিসাবে স্বীকার করতেন এতদিন। তিনিও এসে আলিঙ্গন করলেন ভারতকে। 'কালিদাস সিদ্ধান্ত' উচ্চকিত হয়ে বলেন -' মহারাজের শতরত্ন সভায় ভারতচন্দ্রই শ্রেষ্ঠ রত্ন। '

গোপালও সহাস্য বদনে বলে - "বেড়ে লিকেছ দাদা! শিবকে আর এট্টু ক্ষেপিয়ে বোষ্টমগুলোকে নিকেশ কর্তেই পার্তে!"

'সাধু! সাধু!" রবে সভায় ভারতচন্দ্রের জয়জয়কার ধ্বনিত হতে লাগলো।

কিন্তু স্বয়ং মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ভ্রূকুঞ্চিত ও থমথমে মুখে নিশ্চুপপ্রায়। সকলে তাঁর আগেই ভাববিহ্বলতা প্রকাশ করে ফেলে যেন একটু অপরাধবোধে ভুগছে।

কিছুক্ষণ পরে গম্ভীর কন্ঠে তিনি বলে উঠলেন- "এ তো আমি চাইনি! আমার মনোমত হয়নি এই কাব্য। নাঃ হে, এ জমেনি! "

রাজসভায় যেন বজ্রপাত হয়।

ভারতের পা'এর নীচ থেকে মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম হয়। দিনরাত এক করে সাধনার এই পরিণতি! দুচোখে বাষ্প জমে ওঠে তার। কৃষ্ণচন্দ্র বলেন -

' তবে আজকের মতো সভাভঙ্গ হউক! ভারত, তুমি বরং সন্ধ্যায় বিরামকুঠীতে একবার এসে দেখা কর! '

মশালচি এসে বিকেলের পর বাতি জ্বালিয়ে দেওয়ার খানিক পরে বিরাম কুঠীতে ভারত একবুক নিরাশা নিয়েই প্রবেশ করে। মহারাজ গড়গড়া টানতে টানতে আড়চোখে চেয়ে বললেন -

" অভিমান হয়েছে বুঝি! কি হে?"

ভারত নতকন্ঠে উত্তর দেয় -

"এ আমার দূর্ভাগ্য আপনাকে খুশী করতে পারি নি ! এ আমার অক্ষমতা মহারাজ !"

বিপুল শব্দে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র বলে ওঠেন -

" বটে ! কবির বেশ অভিমান হয়েচে দেখচি! তবে শোন তোমার 'অন্নদামঙ্গল'টি শেষ অবধি একটি শুষ্ক পাঁচালীতেই এসে দাঁড়িয়েছে। জেনে রাখ ভবিষ্যতের বুকে আঁচড় কাটতে গেলে চাই বিশুদ্ধ আদিরসে জিরনো কাব্যই । এমনকি তা কুমারসম্ভবের মত ঠাকুর দেবতা নিয়ে হলেও। নবরসের ঐটিই আসল যা তুমিই পার একমাত্র শ্রীমন্ডিত করে বাংলায় লিখতে। দেখ, আমি তোমায় কেবল এক সফল পাঁচালীকার হিসেবে নয়; নতুন ধারার কবি হিসাবেই দেখতে চাই। আজ যারা সভায় বসে তোমায় ধন্য ধন্য করল, তাদের মনও আসলে ওই আদিরসের দিকেই। "

ভারত আভূমি নত হয়ে দন্ডবৎ করে মহারাজকে। সে প্রতিশ্রুতি দেয় তিনটি রাত্রির শেষে সে মহারাজকে তাঁর মনোমত সৃষ্টিটি নিবেদন করতে সক্ষম হবে।



তিনটি রাত্রি অতিক্রান্ত হল। রক্তিম চোখে ভারত সভায় এসে দাঁড়ায়।

" মহারাজ! আমার রচনা সমাপ্ত!"

কৃষ্ণচন্দ্র সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেন -
" আদিরস?"

"আজ্ঞে হাঁ মহারাজ! বিশুদ্ধ প্রেমআখ্যান!" ভারত নির্ভীক দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করে।

কৃষ্ণচন্দ্র উল্লসিত হয়ে বললেন -
'হে প্রিয়ে ! চন্দ্রাননে! বসন্তমলয়ে শোভে যত পুষ্পরাজি টাজি - এসব ঢাকাঢুকি নেই তো এবার?'

ভারত গাঢ় স্বরে বলে - "না মহারাজ! এ রসে কোনও আবরণ আমি রাখি নি!"

" সাধু ! সাধু! তবে সন্ধেবেলায় বিরামকুঠীতেই শোনা যাক! কি হে গোপাল থাকবে তো নাকি!" একটি চোখটিপে রসরাজ গোপালচন্দ্রকে মহারাজ মুচকি হেসে ইশারা করেন।



"অন্নদামঙ্গলে"র সংযোজন হিসাবেই এই "বিদ্যা সুন্দর" অংশটি ভারত লিখেছে। ভারত বিদ্যার দেহবর্ণনায় কাব্যের ঘনঘটা রেখেও অকারণ ইন্দ্রিয়ের উত্তেজনা প্রদর্শন করে তার রচনাটিকে অকারণে কেবল 'কামমোহিতম্' করতে চায়নি। সে যে আদতে শিল্পী। তার এতদিনের চর্চিত ভাষা প্রখরতা ও অনুশীলনে সে আজ সেই সাক্ষ্যই দেবে।

" কুচ হইতে কত উচ্চে মেরুচূড়া ধরে
শিহরে কদম্বফুল দাড়িম্ব বিদরে।
কে বলে অনঙ্গ অঙ্গ দেখা নাহি যায়
দেখুক সে আঁখি ধরে বিদ্যার মাজায়।
মেদিনী হইল মাটী নিতম্ব দেখিয়া
অদ্যাপি কাঁপিয়া ওঠে থাকিয়া থাকিয়া।।"

গোপাল শুনতে শুনতে উল্লসিত হয়ে বলে ওঠে - ' কাত করে বইটা ধরোনা খুড়ো! রস যে গড়িয়ে পড়বে এবার!'

পাঠ শেষ করে ভারতচন্দ্র যখন থামল, মহারাজ নিজে আসন ছেড়ে উঠে এসে ভারতকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

" অপূর্ব, অদ্ভূত! কৌতুকে,বাগাড়ম্বরে, কবিত্বে, কামকলাপ্রদর্শনে তুমি বিলহণ,অমরু,রাজশেখর সবাইকে হারিয়ে দিয়েছ হে! এতো মহাকাব্য ! আমি জানতাম তুমিই পারবে। তাই তোমার প্রতিভাটিকে কৌশলে উস্কে দিয়েছিলুম। অন্নদামঙ্গল ও বিদ্যা সুন্দর উভয় অংশই বাংলাদেশে চিরঅমর হয়ে থাকবে ! আর হ্যাঁ, তার সাথে কবিটিও! হাঃ হাঃ হাঃ আজ থেকে তুমি " রায়গুণাকর ! হাঁ রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র !"



মহারাজের সেদিনের প্রশস্তিবাচন যেন আজও কান পাতলে গঙ্গার গা জুড়নো ঠান্ডা বাতাসে শোনা যায়। দিনকাল কি দ্রুত বদলে গেল। মূর্শিদাবাদে কত নবাব এল আর গেল, এখন গোটা বাংলাদেশে শুধু ফিরিঙ্গীদেরই রাজত্ব। নদীয়ারাজ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রও সদ্যপ্রয়াত, ভারতের নিজেরও বয়স বেড়েছে। মূলাজোড়ে নিষ্কর ভূমিটি তার পারিতোষিক; স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে, আজকের ভদ্রাসনটি তো সেখানেই। তার নিকটেই তো সেই 'কুমারহট্ট' ,যার এখন নাম 'হালিশহর', সবাই তার মিতে 'রামপ্রসাদে'র নামে সে জায়গাকে এখন এক ডাকে চেনে। সেই মিতেও আর নেই, কিন্তু কালাকালের জলতরঙ্গে প্রসাদী গান রয়ে গেছে আজও আর আগামীদিনেও থাকবে ।

ভারত উঠে দাঁড়ায়। সামনে তার অতিপ্রিয় সেই 'কলক্কল তরঙ্গা ' গঙ্গা। একটি খেয়া কতদূর থেকে ভেসে আসছে। ভারত দেখতে পায় এক সুদর্শন তরুণ আর এক কৃষ্ণবর্ণ মেঘরঙা আকর্ষক দেহবল্লরীর সুন্দরী খেয়াপারাপারকারিণীকে। জীবনের উজানভাঁটায় তারা আজও খেয়া ভাসিয়ে ভেসে চলেছে....



পুনশ্চ :

জোড়াসাঁকোর দক্ষিণের বারান্দায় আজ জোর তর্কটি জমে উঠেছে। এ বাড়ির জামাতাটি 'সবুজপত্র' নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করে। সে পেশায় বিলেতফেরৎ ব্যারিস্টার হলেও সাহিত্যসেবী। তার নাম প্রমথ চৌধুরী। কতিপয় বন্ধু ও আত্মীয়বর্গের সাথে ধূমায়িত কফি ও কেক সহযোগে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য নিয়ে জোর ব্যবচ্ছেদ চলছে। এই নবীন সাহিত্যপ্রেমীদের মতে 'ভারতচন্দ্র' রাজকবি হলেও মূলতঃ অশ্লীলতাকেই প্রশ্রয় দিয়েছেন। কাব্যের গুণমানটি আদপে মামুলি। প্রমথ মাথা নেড়ে বলেন - " ইংরেজিতে যেহেতু অ্যাঙ্গলো স্যাক্সন ও নর্মান ফ্রেঞ্চ এদুটি ভাষা মিশ্রিত হয়েছে কিন্তু বাংলা তা নয়। বাংলায় অন্ততঃ ভারতচন্দ্রের সময় সংস্কৃত আরবী -ফার্সী কিছু শব্দই দেশী বাংলায় এসে মিশেছে। কিন্তু মূল ভাষাটি অক্ষূণ্ণ রয়েছে। " মন্মথ নামের একজন ছাত্র সঙ্গে সঙ্গে টিপ্পনী কেটে বলে " আমাদের মধুসূদন কিন্তু ভারতচন্দ্রকে বেশ সমালোচনা করেছেন.."

হীরেন্দ্র দত্ত বললেন, " ভায়া, এ হল অশ্লীলতার চারুশিল্প!"

এইসব গরম গরম আলোচনার মধ্যে এক দীর্ঘদেহী প্রবীণ ঋষিকল্প মানুষ সেখানে এসে যোগ দিলেন। আজকের কাব্যসাহিত্যের অঙ্গনে নববাল্মিকী ইনিই। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র ও বিশ্বকবিও বটে। বিশ্বসংসারে সবাই ওনাকে মিস্টার টেগোর,গুরুদেব এইসব ভারী ভারী সম্বোধনে ডাকলেও এ বাড়িতে তিনি 'বাবামশায়', 'রবিকা' বা 'রবিমামা' নামেই পরিচিত। ওনাকে দেখে সকলে একটু গলার স্বর নামিয়ে আনে। তাঁর সঙ্গে আর একজন সঙ্গী। ওনার প্রিয়তম ভ্রাতুষ্পুত্র অবন এখন দেশীয় শিল্পকলার নিদর্শন নিয়ে মেতে উঠেছে। প্রবীণ সস্নেহে অবনকে একটি বই তাঁর জোব্বার ভিতর থেকে বার করে বলেন - "দেখ অবন! দেশীয় শিল্পকে আবিষ্কার করতে হলে বটতলার উডকাট্ কে বাদ দিলে অন্যায় হবে!এটি অবশ্য বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সম্পাদিত!" অবন উল্লসিত হয়ে বইটি হাতে নিয়ে বলে উঠলেন - "রবিকা ! এতো দেখছি অন্নদামঙ্গল ! রায়গুণাকর প্রণীত না? এতো প্রথম যুগের বাংলায় ছাপা বইগুলির একটি? এতো আস্ত একটি স্বর্ণখনি !"

কাঁচা পাকা শ্মশ্রুগুম্ফের ভিতর থেকে স্মিত হেসে রবীন্দ্রনাথ বললেন -

" ঠিকই বলেছ ! আসলে রাজকবি হওয়ার অনেক জ্বালা, সবাই বড্ড ফরমায়েশ করে ! নিভৃতচারণ করার অবকাশ কই? তবে এই অগ্রজ কবিকে মধুকবিও অসম্মান করেননি জানো তো?

ভারতচন্দ্রের ঈশ্বরী পাটনীর জগদম্বাকে পার করার উপলক্ষে বলেছিলেন যদি তিনি ওই রকম করে কাব্য বর্ণনা করতে পারতেন তবে স্বচ্ছতোয়া ভাগীরথীর সংস্পর্শযুক্ত রাঙা অবিশ্বসুলভ চরণদুখানির কতই মহিমাকীর্তন করে ভক্তমনোহারী করে আঁকতাম। ভারতচন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে একখানি চতুর্দশপদীও তিনি রচনা করেছিলেন।

মধ্যযুগ আর আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণে ইতিহাস ভারতচন্দ্রকে অস্বীকার করতে পারবে না কখনো। রাজসভাকবি রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গলগান রাজকন্ঠের মণিমালার মতো, যেমন তার উজ্জ্বলতা তেমনি তার কারুকার্য।"


সমাপ্ত 



লেখকের কথা :

ভারতচন্দ্রকে নিয়ে লেখার ইচ্ছেটা আসলে অনেকদিনের। ভাবতে অবাক লাগে যে রতিরঙ্গ ধ্রুপদী ভারতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল প্রাক ইসলাম পর্বেও, মধ্যযুগে এসে তা যেন একটি বদ্ধ নীতিবাগীশ শাসনে শুধু মুখ লুকিয়েই থেকে গেল। বৈষ্ণবপদাবলীতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম মুক্তি পেলেও তা দেহাতীত নিকষিত হেম হয়ে সীমারেখা টেনে সামলে নিল। মানুষ মানুষীর মিলন মান্যতা পেল না। যৌনতার বিষয়ে মঙ্গলকাব্যেও সেই সাবধানী গা বাঁচানো রীতিটিই অকারণে বহাল রইলো।

অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ভারতচন্দ্র যেন 'প্রমিথিয়ূস' হয়ে এসে সেই নিষিদ্ধ রতিমঞ্জরীটিকে রসিকজনের সামনে নতুন অলঙ্কারে সাজিয়ে আনলেন। বাংলাভাষা সমৃদ্ধ হল ফার্সী আর হিন্দীর শব্দপ্রয়োগে।এভাবেই নিশ্চুপ হয়ে ভারত কৃষ্ণনগরে বসে বসে ধীরে ধীরে প্রাক উনিশশতকের আধুনিক ভাষা প্রবাহের প্রথম ইঁটটি গাঁথলেন। একদিন সেই পথ দিয়েই স্বচ্ছসলিলা ভাষার গঙ্গাটিকে বয়ে আনবেন ভগীরথসদৃশ স্বয়ং বিদ্যাসাগর। তারও আগে রুশ নাট্যকার লেবেদফ মজেছেন ভারতচন্দ্রে। রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছেন 'বিদ্যা সুন্দর'। পরবর্তী কালে ভারতে মজবেন মাইকেল সহ একঝাঁক তরুণ প্রতিভা। তারা সমালোচনাও করবেন পূর্বজ কবিটিকে দেহবর্ণনার বাহুল্যে। তবুও অস্বীকার করে এড়িয়ে যেতে পারবেন না ভাগ্যবিড়ম্বিত এই কবিপ্রতিভাটিকে যাঁর লেখাকে তার প্রায় দেড়শো বছর পরে আর এক মহাজন রবীন্দ্রনাথ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলবেন 'এ যেন রাজকন্ঠের কন্ঠের মণিমালা '।

'ভারতমঙ্গল' আদতে একটি উপন্যাস ই। ইতিহাস বর্ণনা নয়, বরং ইতিহাস যাপন। কল্পনা ও সত্যের মিশেলে সেই দিনগুলিতে একটু স্বপ্নিল পদচারণের প্রচেষ্টা মাত্র।

আপনাদের উৎসাহ ও প্রশ্রয়ে শুধু লিখতে বসে আমিও আবিষ্কার করেছি এক অন্য ভারতচন্দ্রকে । মাননীয়া বিনীতা চ্যাটার্জীর আনুকূল্য না পেলে এই লেখার উপাদান সংগ্রহই হত না। তাই তাঁর উদ্দেশ্যেই এই আখ্যান উৎসর্গীকৃত হল।



# তথ্যসূত্র-

1. কবি ভারতচন্দ্র - শঙ্করীপ্রসাদ বসু
2. ভারতচন্দ্র - মদনমোহন গোস্বামী
3. রায়বাঘিনী - বাণীকুমার
4. কলকাতা - শ্রীপান্থ
5. আদিগঙ্গার ইতিহাস - শৌভিক দে
6. Evolution of caste system in Bengal - Feature Stories, Sun Blogs